Pages

প্রকাশিত গ্রন্থ-সমূহ

সোমবার, ১৮ জানুয়ারী, ২০১৬

ঝরাকলি

গল্পকার, কবি, লেখক ও পূবালী ব্যাংকার চৌধুরী ইসফাকুর রহমান কুরেশি
ঝরাকলি

মেয়েটির হাতের কাচা মেহেদীর কমলারং না মুছতেই মুছে যায় তার জীবনের সব রস মধু গন্ধ শোভা আশা ভরসা মাত্র তিন মাস আগে সুখের স্বর্গ গড়ার স্বপ্ন নিয়ে কৈশোর উত্তীর্ণ যে মেয়েটি বাঁধা পড়ে তার মনের মানুষটির বাহুডোরে, তা আজ ছিন্ন হয়ে গেল, একা হয়ে গেল সে। সকরুণ বিদায়বেলায় নববধুকে বলে যায় ইমরান, আমি চলে যাচ্ছি, তুমি আবার বিয়ে কর, সংসার গড়। তোমার জীবনের অফুরন্ত সময় সামনে। এত সুদীর্ঘপথ একা একা কেউ চলতে পারে না। এভাবেই নয়নের জলে ভিজে ভিজে মাত্র তেইশ বছর বয়সে জীবন প্রদীপ নিভে যায়  এক উচ্ছ্বল তরুণের।
১৯৮১ সাল। এসএসসি পাস করে ভর্তি হই সিলেট এমসি কলেজে। গল্পের নায়ক ছেলেটির নাম আসফাক চৌধুরী ইমরান এই কলেজে সে ছিল আমার একজন প্রিয় সহপাঠী। ধীরে ধীরে ছেলেটির সঙ্গে আমার ভাব জমে যায় হঠাৎ একদিন এই অপরিচিত ছেলেটির পরিচয় বেরিয়ে পড়ে আমার কাছে। সে আমার ফুফুতো বোনের দেবরের সন্তান। থেকে সে আমাকে মামু বলে ডাকতে শুরু করে। আর ওর বদৌলতে মামু শব্দটি এমসি কলেজে আমার আর একটি সাধারণ নামে পরিণত হয়।
যৌবনের সূচনালগ্নে আমরা পরস্পর ঘনিষ্ঠ হই। উজ্জ্বল গৌড়বর্ণ সুদর্শন ইমরানকে দেখে আকৃষ্ট হত সবাই। প্রখর বুদ্ধিমত্তা ছিল তার, সাজিয়ে সাজিয়ে কথা বলত ধীর স্থিরভাবে। স্বাস্থ্য সচেতন ইমরান শরীরচর্চা করে করে সুন্দর এক বলিষ্ঠ শরীর গড়ে তুলে। শারীরিক শক্তির জন্য অন্য ছেলেরা ভয় করত তাকে।
দুষ্টুমিতে ইমরানের কোন জুড়ি ছিল না। সদ্য কৈশোর পার হওয়া এই ছেলেটির দুরন্ত স্বভাব একটুও পরিবর্তন হয় নি। সারাদিন ছেলেদের সাথে হৈ চৈ করা, পিছন হতে ধাক্কা দেয়া, অন্যের গায়ে আঁচড় কাটা ছিল তার চিরাচরিত অভ্যাস। প্রায়ই তাকে দেখা যেত টেবিল টেনিসের বেট হাতে দাঁড়িয়ে রয়েছে কমন রুমে কিংবা চারপাঁচজন বন্ধুকে নিয়ে বসে আছে পাহাড়ের সবুজ ঢালে। দেখা যেত আড্ডার আসর জমিয়ে রেখেছে সদাহাস্য ইমরান।
ইমরানের একটা মন্দ অভ্যাস ছিল, প্রতিদিন কলেজ ছুটি হলে সে দুষ্টু ছেলেদেরে নিয়ে উঠে যে কলেজের বাসের ছাদে। হালকা নীল কলেজ বাস, গায়ে বড় বড় কালো অক্ষরে লিখা সিলেট বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ। একদিন  কলেজে এসেই সহপাঠি দেলোয়ার ও খালেদের কাছে জানতে পাই,  ইমরান  এক্সিডেন্ট  করেছে। দূর্ঘটনাটা ঘটেছিল বালুচরের টিবিগেট এলাকায়। সেখানে কলেজ বাস আসতেই  টেলিফোনের তারে আঘাত খেয়ে গাড়ির ছাদ থেকে ইমরান পড়ে যায় পাশের রাস্থায়। বন্ধুরা গাড়ির ভিতর থেকেই দেখতে পায় ইমরান বালির মধ্যে পড়ে নিস্থব্ধ হয়ে গেছে। তখন সঙ্গাহীন অবস্থায় তাঁর মুখ দিয়ে ফেনা বেরুচ্ছিল। অভিজ্ঞ চালক তরু ভাই লুকিং গ্লাসে সব দেখতে পেয়ে শক্ত ব্রেক কষেণ এবং ছাত্রদেরে এখানে নামিয়ে দিয়ে চারপাচ জনসহ ইমরানকে দ্রুত নিয়ে যান ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। 
প্রায় মাসাধিক কাল হাসপাতালে অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকে ইমরান। সবাই বলাবলি করে  আর বাঁচবে না। তবে ভাগ্য ভাল ও যাত্রায় সে বেঁচে গেলেও অপ্রকৃতিস্থ ছিল বেশ কিছুদিন। ইতিমধ্যে সহপাঠিরা প্রথমবর্ষের সমাপনী পরীক্ষা দিয়ে দ্বিতীয় বর্ষে ক্লাস শুরু করছে। কিন্তু ইমরানের কোন খবর নেই। ব্রেইন আউট। স্টাডি সম্ভব আর হচ্ছে না তাঁর।
১৯৮৩ সালে এইচএসসি দিয়ে চলে আসি সিলেট পলিটেকনিকে। আবারও দেখা ওর সাথে। এইচএসসি অসমাপ্ত রেখেই চলে এসেছে এখানে, শরীর-মন মোটামোটি ভাল হয়ে গেছে আমি সিবিলে আর সে পড়ছে পাওয়ার টেকনলজিতে।
শরীরে তার অফুরন্ত শক্তি, মনে অফুরন্ত সাহস। পলিটেকনিকে এসে সে কিছুটা মাস্তানীতে জড়িয়ে পড়ে। একদিনের ঘটনা, আমি কামাল নামের ঢাকার একজন কুট্টি ছেলে হেঁটে যাচ্ছি ইন্সটিটিউটের করিডোর দিয়ে। কামাল পলিটেকনিকের ছাত্র ইউনিয়ন সভাপতি। ইমরান পূর্বশত্রূতাবশত হঠাৎ একটি পাঁচসূতি রড দিয়ে ভীষণভাবে কামালকে পিঠাতে শুরু করে। আমি সাধ্যমত আটকানোর চেষ্টা করি। কামালকে পালিয়ে যেতে দেই অতঃপর বিচার হয়। স্যারদের মধ্যস্থতায় মামলার নিষ্পত্তি ঘটে।
আমার প্রতি ইমরানের আকর্ষণ ছিল অমলিন। সামনাসামনি হলেই মামু কেমন আছেন- বলেই জড়িয়ে ধরতো আমাকে। একদিন ক্লাস হচ্ছে না। সে আমাকে নিয়ে যায় চৌহাট্টায়, ওর এক দোলাভাইয়ের ফার্মেসিতে। তারপর টেলিফোনে রসের প্রেমালাপ শুরু করে দেয় কোন এক মেয়ের সাথে। তারপর শুনালো তার প্রেমের মধুর গল্পমালা অনেক অনেক শুনলাম কাহিনি। একবার এক বিয়েতে যাই ওদের বাড়ি। পরিচয় করিয়ে দেয় ওর প্রেমিকার সাথে। ভাগনার প্রেমিকা, আমার লজ্জায় মাথা হেট।
বেশ কিছুদিন পর জানতে পারি ওর ভালবাসার স্বীকৃতি দিতে রাজী নন বাবা-মা কেউ। ওর প্রেমিকা না কি ছোট্ট বংশের মেয়ে, তদুপরী ঘরের কাছে কুটুম। তা সইতে রাজী নন ইষ্টিগোষ্টি কেউ। ইমরান প্রেমিকার সাথে বেঈমানী করতে পারবে না। পরিস্কার জানিয়ে দেয় সবাইকে। প্রেমের জন্য সব উৎসর্গ করে দিতে তৈরি হয়ে গেল পাগলাটা হাতের আঙ্গুল কেটে সে রক্ত দিয়ে দেয়ালে দেয়ালে লিখা শুরু করে তার ভালবাসার কথা। সবাই বিষয়টি লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করে কিন্তু তা আর সম্ভব হলনা, দ্রুত চারপাশের গ্রামগুলোতে তা রাষ্ট্র হয়ে পড়ে। মুখে মুখে উচ্চারিত হতে  থাকে  ইমরানের ভালবাসার কেচ্ছা কাহিনি।
আহার নিদ্রা বন্ধ করে দেয় ইমরান। সিদ্ধান্ত নেয় যতদিন সে সফল না হবে চুল দাড়ী কাটবে না, গোসল করবে না। ধারালো ব্লেড সুচ দিয়ে সে শরীরের চামড়ার সর্বত্র লিখা শুরু করে দেয় সেই মেয়েটির নাম। কিছুদিনের মধ্যে স্বাস্থ্যবান ইমরান হয়ে যায় কংকালসার ইমরানে। ক্লিন সেইভে অভ্যস্ত পরিপাটি ইমরানকে অবস্থায় দেখে কেউই হঠাৎ চিনতে পারত না। লম্বা চুল দাড়ী নখ, হাড্ডিসার শরীর তাকে যেন কিম্ভুতকিমাকার শিলামূর্তি করে দেয়।
ছেলের এই এত ত্যাগ কষ্ট সহ্য করতে পারেন নি তার পিতা-মাতা। শেষ পর্যন্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও মেয়েটিকে পুত্রবধু করে নিয়ে আসেন ঘরে। তৃতীয় বর্ষে অধ্যয়নকালে লেখাপড়া ছেড়ে ক্যানাডা যাত্রা করে ইমরান কিন্তু লন্ডনে ধরা পড়ে ফেরত আসে। আর সে কোনদিন আসেনি পলিটেকনিক।
তাদের আর্থিক অবস্থা তেমন ভাল ছিল না। মধ্যভিত্ত সংসার। সুদীর্ঘ  মনকষাকষির চিকন বাশের  সাঁকো  অতিক্রম  করেও  বেশ  সুন্দরই  জমে যায় নব বর-বধুর সুখী দাম্পত্য জীবন।
১৯৮৭ সাল। সেদিন শনিবার। জিন্দাবাজারের রাজা ম্যানশনে ছিলাম সিলেট বাণী পত্রিকা অফিসে। উদ্দেশ্য ওখানে কর্মরত প্রিয়বন্ধু আমিরুল চৌধুরীর সাথে দেখাসাক্ষাৎ করা। আমিরুলের টেবিলের সামনে বসে গল্প করছি। এমন সময় একজন ভদ্রলোক এলেন মৃত্যুসংবাদ ছাপাতে। কাগজটি হাতে নিয়েই দেখি, ইমরান চৌধুরী, ফুলবাড়ী। বিশ্বাস হলনা। মনে হল এই নামের গ্রামের অন্যকেউ হতে পারে। এমন সুন্দর স্বাস্থ্যবান তরুণ অকালে ঝরে যেতে পারেনা, তাই সে খবর তখন বিশ্বাস হয় নি। কিন্তু না  ভদ্রলোক  কাছে সেই সংবাদের ময়নাতদন্ত করে যে  সত্যটা পেলাম, তাতে নিশ্চিত হই  আমাদেরই সেই উচ্ছ্বল সহপাঠী ইমরান।
মাথায় আকাশটা যেন ভেঙ্গে পড়ে। দুদিন পর ছুটে যাই ওর বাড়ি। বিয়েতে যাই নি যদিও ওর বউ দেখার আমন্ত্রণ ছিল অনেক আন্তরিকতায় ভরা। কিন্তু তার বউ দেখা কোনদিন হল না আর। কারণ তখন তিনমাসের শোক পালন করছিল পর্দার অন্তরালে।
লোকমুখে শুনলাম শত্রূরা নাকি ওকে যাদুবান মেরে হত্যা করেছে। আরও শুনলাম শখ করে একটি কুকুর পুষে। আদর করে কুকুরটির মুখে ঢুকিয়ে দিত তার পা। তাই নাকি জলাতঙ্ক হয়েছিল। মৃত্যুরহস্য উদ্ধার পুলিশের কাজ, তাই তা নিয়ে নিয়ে তেমন ঘাটাঘাটি না করেই রুমালে চক্ষু মুছে দ্রুত বের হয়ে আসি ওর ঘর হতে। রাস্তার পাশে টিলার গায়ে ঘাসহীন নতুন কবরটি জেয়ারত করে দৌঁড়ে উঠে যাই কাছেই যাত্রিঠাসা বাসে পিছনে চোখের আড়ালে হারিয়ে যায় বড়মোকাম টিলা। সেইসাথে টিলার কোঠরে হারিয়ে যায় আমার ভাগনা বন্ধু ইমরান চৌধুরী।
আজও রাস্তা দিয়ে যেতে এই কবরগাহের পাশে গাড়ি এলেই মনে হয় ইমরান আমাকে ডাকছেমামু, একবার এসো না আমার বাড়ি। কানে বাজে আজও সেই সুর, সেই কন্ঠ; চোখে ভাসে আজও সেই সতেজ সতরুণ ইমরান।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন