Pages

প্রকাশিত গ্রন্থ-সমূহ

শুক্রবার, ১৫ জানুয়ারী, ২০১৬

সংক্ষেপে শাহজালালের দরগাহ

হজরত শাহজালালের দরগার প্রধান প্রবেশ পথসমুহে হজরতের নামান্কিত অনেকগুলো সুদৃশ্য তোরন রয়েছে। এই পবিত্র দরগাহ সিলেট শহরের মধ্যে নিভৃত স্থানে এক মনোরম টিলার উপর অবস্থিত। দরগার পূর্বদিকে কয়েকধাপ সিড়ি বেয়ে দরগায় প্রবেশ করতে হয়। এই দরগার উপস্থিতির জন্য সিলেট শহর মুসলমানদের এক প্রধান তীর্থকেন্দ্রে পরিনত হয়েছে। পূর্ব বা পশ্চিমে যে কোন প্রবেশ পথ দিয়ে ডুকে চিল্লাখানার উত্তর দিকে হযরত শাহজালাল (র:) মাজার দৃষ্টি গোচর হয়। মাজারটি ইট দিয়ে পাকা করে বাধাঁনো। হযরতের মাজার ও পাকা প্রাচীর ১৯৫৯ খ্রীষ্টাব্দে নির্মিত হয়। চারপাশে চারটি বিরাট স্তম্ব রয়েছে। স্তম্বগুলো আধুনিক কালের তৈরী। এই স্তম্বগুলো হতে একটির উপর একটি করে অনেক চাদোয়া টাঙ্গানো হয়। যুগে যুগে সংস্কারের মাধ্যমে দরগাহ বর্তমান অবস্থানে এসেছে। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের দরগার মত হজরতের মাযারের উপর কোন ছাদ নেই, সর্বদা গিলাফ দিয়ে ঢাকা থাকে ও উপরে ঝুলানো থাকে একাধিক সালু কাপড়। মাজারের পশ্চিমে মোগল সম্রাট আলমগীরের আমলের একটি প্রাচীন তিনগম্বুজ বিশিষ্ট আয়তাকার ছোট্ট ইবাদাতখানা রয়েছে। দরগার পাশেই পাঁচতলা সুদৃশ্য মসজিদ ও ১৯৬১ সালে স্থাপিত তিন তলা মাদ্রাসা রয়েছে। দরগার সুউচ্চ ঘড়িযুক্ত মিনার অনেক দূর হতে দৃষ্টিগোচর হয়। উক্ত মিনারটি তৎকালীন মোতাওয়াল্লী এ.জেড আব্দুল্লাহর উদ্যোগে ১৯৭১ সালে নির্মাণ কাজ শুরু হয় এবং দেশ স্বাধীনতা হবার কিছুদিন পর সমাপ্ত হয়।
দরগাহের বাহিরের কবরগাহ অসংখ্য বৃক্ষশোভিত। অজস্র জালালী কবুতর আনাচে কানাচে বিচরন করে ও মানুষের ছিটিয়ে দেয়া খাদ্যকনা খুটে খায়। কাছেই রয়েছে গজার মাছে ভরা মধ্যমাকৃতির পুষ্করিনী। এখানে মানুষ ওজু করে থাকেন। দরগাহর পূর্বদিকে টিলার নীচে মহিলাদের জন্য রয়েছে একটি উপাসনালয়। হজরত ছিলেন চিরকুমার, তাই মহিলারা মাজারে প্রবেশ করেন না। উক্ত উপাসনা গৃহে বসে ইবাদত করেন। হজরতের সম্মানার্থে কেউ জুতা নিয়েও মাজারের মধ্যে প্রবেশ করেন না। হজরত শাহজালাল (র:) জীবন্ত অবস্থায় অযু ও গোসলের জন্য একটি কূপ খনন করান তাঁর পর উক্ত কূপে তাঁহার হাতের পবিত্র লাঠি স্থাপন করলে ঝর্ণাটি হতে অনবরত পানি আসতে থাকে। বর্তমান কাল পর্যন্ত হজরতের ঝর্না হতে সব সময় জল নির্গত হয় ও পাশ্ববর্তী আয়তাকার পাকা আধারে জমা হতে থাকে। এই কুপের পানিকে অনেকে অত্যন্ত পবিত্র মনে করে ও উদ্দেশ্য পুরনের জন্য পান করে থাকে। এই অলৌকিক কূপটি হযরত শাহজালাল (র:) জীবন্ত মোযেজা। দরগাহ ও মসজিদের মধ্যবর্তী স্থানে চিল্লাখানা (নির্জন ধ্যানের স্থান) ও পাঁচফুট প্রশস্থ প্রাচীর বিশিষ্ট চতুস্কোন বর্গাকার এক গম্বুজ চুন-সুরকী নির্মিত মোঘল আমলের জলসা ঘর রয়েছে, যাহা খাদেমগন ব্যবহার করে থাকেন। এখানে জিকির আজগার ও মিলাদ মাহফিল অনুষ্টিত হয়। উক্ত ঘরের পশ্চিমে দরগার প্রবেশ পথে আবু নাসির ও আবু নসর নামীয় দুইজন সরকুম ও মোতাওয়াল্লীর কবর রয়েছে। উক্ত কবর দুটির সন্নিকটে বিভিন্ন যুগের দরগাহ ও মসজিদ সম্পর্কিত অনেকগুলো প্রাচীন রাষ্ট্রীয় ভাষায় লিখিত ঐতিহাসিক শিলালিপি রয়েছে। দরগা শরীফে আরোহনের সিঁড়ির বামপাশে পাঁচতলা বিশিষ্ট দরগাহে হজরত শাহজালাল(র:) মসজিদ অবস্থিত। হজরত শাহজালালের(র:) সময় হতে এখানে মসজিদটি বিদ্যমান ছিল। পরে বাংলার সুলতান আবু মুজাফফর ইউসুফ শাহের মন্ত্রী মজলিসে আতার আমলে ১৪০০ খ্রী: মসজিদটি শক্তভাবে নির্মিত হয়। এটি সিলেটের অন্যতম প্রাচীন ও প্রধান মসজিদ। ১৭৪৪ খ্রী: সিলেটের ফৌজদার বাহরাম খাঁর (১৭৪০- ’৪৮ খ্রী:) সময়ে এটি পূণ:নির্মিত হয়। এই রূপ পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন যুগে সংস্কার ও নির্মাণ কাজের মাধ্যমে মসজিদটি বর্তমান অবস্থায় উপনীত হয়েছে। দরগাহ মসজিদের সম্মুখে গেটের বামদিকে লঙ্গরখানা ও দরগা অফিস রয়েছে। লঙ্গরখানায় সিরনী রান্নার জন্য কয়েকটি বিশাল আকৃতির ডেগচি রয়েছে যে গুলোতে একসাথে অনেকগুলো গরুর আখনি  রান্না করা যায়। শাহজালালের ব্যবহৃত বেশ কতকগুলো মূল্যবান দ্রব্য খাদেমগন কতৃক বংশপরাম্পর মাজারের সন্নিকটে অতীব যতেœর সহিত সংরক্ষিত হচ্ছে। সেগুলোর বিবরন দিচ্ছি-১) এক জোড়া কাটের খড়ম ২) হরিনের চামড়ার তৈরী একখানা জায়নামাজ ৩) একটা উট পাখির ডিম ৪) হজরতের তায়াম্মুম করার পাতর ৫) একটি সুদীর্ঘ্য তরবারী ৬) একটি থালা ও বাটি ৭) জালালী কবুতর।
শাহজালালের উফাত দিবস উপলক্ষ্যে প্রতি বৎসর হিজরি সনের ১৯,২০ ও ২১ শে জেলকদ উরস হয়ে থাকে। শাওয়াল মাসের ২৭ তারিখে শাহজালালের মামা সৈয়দ আহমদ কবিরের ফাতেহা দিবসেও  উরস হয়। প্রতি বছর শবে বরাত ও শবে কদর উপলক্ষ্যে অনুরূপ উরস হয়ে থাকে। এসব উরসে হাজার হাজার মানুষ ও ভক্তের সমাবেশ ঘটে থাকে। দরগাহের ভিতর মানুষ কোরান পাঠ, জিয়ারত, দোয়া দুরূদ পাঠ ও জিকির আজকার করেন। দরগার বাহিরে প্রচুর আউল বাউল মজ্জুফ প্রকৃতির মানুষ ভক্তির অতিশয্যে ঢাক ডোল বাজিয়ে খোদা প্রেম, ভাব ও বাউল সঙ্গীতে নিমগ্ন হন। দরগার বাহিরে বহুদূর পর্যন্ত গ্রাম্য মেলার মত বিশাল পন্য মেলা বসে। উপমহাদেশের বিভিন্ন এলাকা হতে আগত শত সহস্র মানুষের ভীড়ে সিলেট শহর তখন লোকে লোকারন্য হয়ে পড়ে। শাহজালালের সঙ্গী কতিপয় আউলিয়া যেমন হাজী ইউসুফ, বুরহান উদ্দিন  কাত্তাল যারা তাঁর জীবদ্দশায় সব সময় তাঁর সাথে ছিলেন, তাদের বংশধরগন যথাক্রমে সরেকওম পরিবার ও মুফতি পরিবার পরবর্তীকালে বংশপরাম্পর দরগার খাদেমের দায়িত্ব পালন করে আসছেন। তাদের মধ্য হতে হাজী ইউসুফের বংশধরগন  বংশপরাম্পর দরগার মোতাওয়াল্লীর নিয়োজিত হয়ে আসছেন।
দরগাহের ভিতর শাহজালাল (র:) ও আর আট জনের সমাধি রয়েছে। হজরতের  অন্তিম শয্যার পূর্বদিকে ইয়ামেনের যুবরাজ শেখ আলী ও পশ্চিম দিকে তৎকালীন মুসলিম বাঙ্গলা রাজ্যের গৌড়ের উজির মকবুল খান (১৪৪০ খ্রীষ্টাব্দে সিলেটের ফৌজদার ছিলেন) চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন। শাহজালালের সমাধির দক্ষিন দিকে তার সহাধ্যায়ী পূর্বদিক হতে ক্রমান্নয়ে হাজী ইউসুফ, হাজী খলিল ও হাজী দরিয়ার তিনটি কবর বিদ্যমান। পাশের চতুর্থ কবরটি এক সময়ের দরগার মোতাওয়াল্লি সরকুম আবু তুরাব আব্দুল ওয়াহাবের। কাজেই  পশ্চিমের প্রবেশপথের দুইটি কবর সহ দরগাহ চত্বরে মোঠ নয়টি সমাধির মধ্যে পাঁচটিতে হজরত ও তাঁর মাত্র চারজন সঙ্গী আউলিয়া রয়েছেন। পরবর্তী কালে তিনজন মোতাওয়াল্লী সরকুম ও বাঙ্গালা রাজ্যের গৌড়ের একজন উজির  ভিতরে চিরশায়িত হন।
শাহজালালের দরগার মহিমা বর্ণনাতীত। যুগ যুগ ধরে এই দরগার মাহাত্ম্য অক্ষুন্ন রয়েছে, যাহা কেবলমাত্রই জিয়ারতকারীরা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করতে পারেন। এখানে এসে স্রষ্টার কাছে প্রার্থনা করে কেউ শূন্যহাতে ফিরে যায়না- অন্তরে এক অনাবিল প্রশান্তি নিয়ে ফিরে যায়।
সূত্রগ্রন্থঃ "সিলেটে ইসলামের জ্যোতি" লেখক- মুফতি আজহার উদ্দিন সিদ্দিকি।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন