Pages

প্রকাশিত গ্রন্থ-সমূহ

সোমবার, ১৮ জানুয়ারী, ২০১৬

সাদ্দাম হুসেন ও বঙ্গবধু জরিনা

সাদ্দাম হুসেন বঙ্গবধু জরিনা

জরিনার জন্ম অজপাড়াগাঁয়ে। ওর বাবা অবস্থা সম্পন্ন গৃহস্থ। বড় ভাই লণ্ডনে, তাই লোকমুখে বাড়ীটির নাম হয়ে যায় লন্ডনী বাড়ি। অন্য দুভাই কুয়েত প্রবাসী। প্রৌঢ় বাবা আর মেজভাই ধরে আছেন বৃহৎ সংসারের হাল।
পাকারাস্তা ছেড়ে মেঠো পথ ধরে মাইল দেড়েক অগ্রসর হলেই দৃষ্টিগোচর হয় রঙ্গীন পাকা প্রাচীরঘেরা লম্বা প্রসাদময় লণ্ডনী বাড়ীটি। সামনে সান বাঁধানো বড় পুকুর পারে শতরঙ্গে রাঙ্গানো অপূর্ব একটা লেট্র্রিন। বাড়ীর চারপাশে সবুজ ধানের জমি। বাতাস বহে বহে সবুজ সবুজ ঢেউ তুলে ধানক্ষেতে। বাহারে, কি সুন্দর সবুজের মেলারে, মনরাঙ্গায়।
বাড়ীতে বড় হয় চার ভাইয়ের একমাত্র আদুরে বোন সুন্দরী জরিনা। মা-বাবার একমাত্র নয়নের মণি। সবার আদর আহলাদে বড়ই অভিমানী হয়ে পড়ে সে। বাড়ীতে সে যা চেয়েছে তাই পেয়েছে। যা- করেছে, তা-ই মেনে নিয়েছে সবাই। কেউ প্রতিবাদ করত না, বাঁধা দিত না। আদর আহলাদের রাজ্যে বসবাস করে সে এমনই দুর্নীবার স্বভাবে গিয়ে পৌছে যে, কোনকিছুতে ওর ইচ্ছের ব্যতিক্রম হলেই মুখভার করে, কান্না-কাটি জুড়ে সারাটা বাড়ীর বাতাস ভারি করে দিত। আর জরিনার মুখভার হোক, তা চাইত না বাড়ীর কেউ।
জরিনার বয়স তখন ষোল ছুঁই ছুঁই। বাড়ন্ত এক চঞ্চলা কিশোরী। সবেমাত্র শেষ হয়েছে কানামাছি গোল্লাছুট খেলার দিন। ভাইয়ের সাইকেল চালিয়ে সে অনেক সময় মেঠো পথ দিয়ে চলে যেত অনেক দূর। লোক আড়চোখে তাকাতো। মেজো ভাইয়ের কাছে দৃষ্টিকটু লাগত। মেঝভাই বললেন একদিন, 'তুই এখন অনেক বড় হয়েছিস জরিনা। এভাবে রাস্তায় সাইকেল চালালে লোকে বলবে কী? সবার বয়স বাড়ছে, আর তুই যেন দিনে দিনে কচি খুকী হয়ে যাচ্ছিস, বুদ্ধিসুদ্ধি কিছুই যেন নেই তোর।'
'ভাইয়া, তুমি এমন কথা বলতে পারলে আমাকে' বলে কিছুটা হৈ চৈ করলো জরিনা, তবে সেদিন হতে সাইকেল চালানো বন্ধ করে দিল। ওরও  বোঝার বয়স হয়েছে, তবে এখনো সে সখীদের নিয়ে পুকুর ঘাটে বসে আড্ডা দেয়, বৃষ্টির দিনে লুডু খেলে, গরমের রোদেলা দুপুরে বড় পুকুরে সাঁতার কাটে, জল ছুঁড়াছুঁড়ি খেলায় মেতে উঠে সবাই। গ্রামের স্কুলের ক্লাস টেনের ছাত্রী সে। বান্ধবীরা বাড়ী না এলে ছটফট করে। কাজের ছেলে আব্দুলকে পাঠিয়ে দেয় ওদের বাড়ীতে।
গ্রামে প্রেম-টেম নিষিদ্ধ বস্তু। এমন কি কোন ছেলের সাথে কথা বলাটাও যেন পাপ। কাজেই মন চাইলেও কারো সাথে মন দেয়া-নেয়া দূরে থাক, সামান্য খুশগল্পও করার কোন সুযোগ ছিলনা গ্রাম-বালিকা জরিনার। বাপ-ভাইয়ের ভয়, আত্মসম্মানবোধ এই পরমকাম্য মজার কাজ হতে দূরে সরিয়ে রাখে তাকে।
জরিনা স্বপ্নচারিনী। সে স্বপ্ন দেখে এক রাজপুত্তুরের। মনের পাতায় এক গোপন হিসাব কষে জরিনাসে হবে আমার চেয়ে এক বিঘত লম্বা। বয়সে পাঁচ বছরে বড়, অর্থাৎ একুশ। স্বাস্থ্যবান, কুঁকড়ানো চুল, দুধে আলতা রং, কন্ঠ হবে কোকিলের কন্ঠের মত মোলায়েম।'
আবার ভাবে, ছেলেদের দুধে-আলতা রঙ্গটা ভালনা। সে দিন এমন একটা ফর্সা ছেলে দেখেছে। কেমন যেন পানসে মনে হয় তার। ক্লিন সেভের পর ওদের গালে ফুটে উঠে নীলরেখা। এই রেখাটা সুন্দর, নাকি অসুন্দর, ঠিক করতে পারে না তার মন। আবার ভাবে উজ্জল শ্যামলা রঙ্গটা হয়ত ভাল হবে, মানাবে বেশ।
তবে ওর প্রিয় মানুষটিকে শিক্ষিত ভদ্র স্মার্ট হতে হবে অবশ্যই। বিদেশী হলে কেমন হয়, টাকা উড়াতে পারবে দুহাতে। কিন্তু কী হবে, মনের মানুষটাতো পড়ে রবে দূরে বহুদূরে। এতসব কতকিছু ভাবতে ভাবতে ঘরের এপাশ হতে পাশে অনবরত হাঁটতে থাকে জরিনা।
তার ভাবী মনের মানুষটিকে নিয়েই হাজার হাজার আজে বাজে প্রশ্ন করে যেত মনের কল্পনাদেবীকে; আর সব প্রশ্নের সুন্দর, রঙ্গমাখানো সাজানো গোছানো উত্তরও আসত সেখান থেকেভারী চমৎকার চমৎকার উত্তর।
মনের কল্পনাদেবীই তাকে একমনে অবিরত হাঁটতে বাধ্য করেন ঘরের পাশে পাশে। তারই প্রভাবে সে তন্ময় হয়ে কখনো হাসে, কখনও বিড়বিড় করে নাড়াতে থাকে ঠোঁট।
আশপাশের গ্রামগুলো থেকে ওর অনেকগুলো বিয়ের আলাপ আসে। জরিনা সবই শুনে। মনটা ওর এক অদৃশ্য আনন্দে শিরশির করে উঠে। ভাবে কতকিছু। কিন্তু প্রায় আলাপই ব্যর্থ হয়ে ফিরে যায়। লন্ডনি-বাড়ির কনে জরিনার সঙ্গে যৌতুক মিলবে প্রচুর, তাইতো এত বরের ভীড়। কিন্ত কোনটাই শেষপর্যন্ত পছন্দ হয় না ওর বাপ-ভাইয়ের। জরিনা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে রাজপুত্তুরের, অথচ রাজপুত্তুরেরা ধরা দিতে না দিতেই ফিরে যায়। কি যেন এক অশ্বস্তিতে ছেয়ে যায় জরিনার মন। 
শৈশবে ওকে আরবী পড়াতেন একজন হাফেজ সাহেব। ঘটকালী উনার পেশা নয় তবুও একদিন উনি এসে হাজির হন একটা টুকা হাতে। টুকাতে রয়েছে ছেলের নাম ঠিকানা সব। বিদ্বান, চাকুরীজীবি। বড়ঘরের ছেলে বর। এত ভাল বংশের শিক্ষিত ছেলে যে জরিনার জন্য আলাপ পাঠাবে তা ভাবতেও পারেনি ওর বাবা।
একদিন জরিনার বাবা মেজোভাই গিয়ে দেখে আসেন বর বরের বাড়ীঘর। প্রায় আঠারো মাইল দূরে রশিদপুর গ্রাম। সিলেট ঢাকা মহাসড়কের পাশ ঘেষে যেন নিরব হয়ে ঘুমিয়ে আছে গ্রামটি। গ্রামের সুন্দর সমতলে অবস্থিত মধ্যম ধরণের বাড়ী। বাড়ীর সম্মুখে পুরাতন বাংলোটা পার হলেই পাকাঘরের সামনে বাগানে ফোটা আজস্র ফুল। সুন্দর ড্রইংরুম, নজরুলরবীন্দ্রনাথ, বঙ্গবন্ধুর তৈলচিত্র। বাড়ীর সর্বত্র ভেসে আছে বাড়ীর মানুষগুলোর মর্জিত রুচি আর সাংস্কৃতিক মনের পরিচয়। ছেলেও দেখতে একেবারে রাজপুত্তুর, নাম নাদিম।
মেজোভাই নাদিমের একটি সুন্দর ফটো নিয়ে আসেন। বাড়ীতে এসে মা-সহ সবাই ফটো দেখে খুশীতে গদগদ। কী সুন্দর ছেলে, একেবারে চাঁদমুখ। জরিনার সঙ্গে মানাবে বেশ। জরিনারও ইচ্ছে হয় নাদিমের ফটো দেখার। মন ছটফট করে, দেখতে পারে না লজ্জায়।
দুএকদিন পর গোপনে মেজোভাইয়ের রুমে ঢুকে জরিনা, ড্রয়ার খুলে এলবাম বের করে। খুব একটা খুঁজতে হয়নি তাকে। প্রথম পৃষ্ঠায়ই এক নতুন যুবকের ফটো। টাই-কোট পরা, কোকড়ানো চুল, কালো তীক্ষ্মধার চাহনি, নিমিশেই গেঁথে যায় কলিজায়। জরিনা তার হৃদয়ের সবুজ রেখাগুলো মেলাতে থাকে ফটোতে। কী আশ্চর্য, একে একে সবগুলো রেখা মিশে যাচ্ছে যুবকটির চিত্রপটে। জরিনা আর বসতে পারে না। আনন্দে নেচে উঠে ওর মন। এলবাম রেখে আবার হাঁটতে শুরু করে ঘরের এপাশে ওপাশে। সেই বিষন্ন ঠোঁটে আবার দেখা দেয় হাসির রেখা।
নাদিমের মা ভাইবোন এসে দেখে যান জরিনাকে। দারুন পছন্দ হয় তাদের, মেয়েটি ডানাকাটা পরীর মত সুন্দরী। একেবারে সোনার প্রতিমা। জরিনার তর্জনীতে পরিয়ে দেন সোনার আঙ্গুরী। শুভলগ্নে লণ্ডন হতে আসেন সপরিবারে বড় ভাই। কুয়েতের ভাইরাও আসেন। বাড়ী আত্মীয়স্বজনে লোকারন্য। ধুমধাম ফুর্তির জোয়ার বইছে বাড়ীতে। একমাত্র বোনটির বিবাহ। তাই তুলকালাম কান্ড।
বসন্তের উজ্জ্বল এক রোদেলা দিনে পঙ্খিরাজের ঘোড়ায় চড়ে আসে জরিনার মনের রাজকুমার নাদিম। ছিনিয়ে নিয়ে যায় রাজকন্যে জরিনাকে। চঞ্চলা হরিণীর মত হেসে খেলে যে বালিকাটি এতদিন বেড়ে উঠেছিল এই বাড়িতে, আজ তাকে ছিন্ন করতে হচ্ছে বাড়ির সঙ্গে প্রাত্যহিক সম্পর্কটা, ফেলে যেতে হচ্ছে এতদিনের স্নেহমমতায় ভরা মা-বাবা ভাই বান্ধবীদের সোহাগী বন্ধন। ষোল বছরের মায়ায় ভরা কি আপন ছিল সব, যেন আজ হতে হয়ে যাচ্ছে পর, জরিনা বারণ করতে পারে না হৃদয়ের ঝড়। বুক ফেটে নেমে আসে কান্নার অশান্ত প্লাবন।
নববধুর আগমনে আনন্দে ভরে উঠে নাদিমের সংসার। কী সুন্দর জুটি, নাদিম-জরিনা। গ্রামবাসী কানাকানি জুড়ে দিল, লালগোলাপ আর সাদা গোলাপের প্রতিযোগিতা, নিজ নিজ সৌন্দর্য্যে চরম উদ্ভাসিত দুই লিঙ্গের দুজন।
বছর শেষে ঘর আলো করে আসে জোড়াসন্তান, সুমন আর শোভন। চাকুরীর আয়ে আর বড়বাড়ির আভিজাত্য বজায় রাখতে পারছেনা নাদিম। আশপাশের দিনহীন লোকগুলো ছুটে যাচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যে। পাঠাচ্ছে হাজার হাজার টাকা। টাকায় সয়লাব সারাটা দেশ, বাতাসে উড়ছে টাকা, কেবল টাকা নেই বড়বাড়ির ছেলে নাদিমের হাতে। টাকার জোয়ার বইছে মধ্যপ্রাচ্যের আনাচে কানাচে আর নাদিম কি হাত পা গুটিয়ে বসে থাকবে। তা-তো হয়না। এককালে যারা ছি্ল নিরস নিস্প্রা, আজ তারা টাকার বলে বলীয়ান হয়ে নাদিমদের ফেলে দিচ্ছে নীচে, পায়ের তলায়। গ্রামের বড় বংশের সন্তান নাদিম, তা আর সইতে পারছিলনা। তাই সেও টিকেট কাটে, চলে যায় ইরান।
সেখানে সরকারী গাড়ী চালাতো নাদিম। বেতন প্রচুর। থাকা-খাওয়া ফ্রি। পারস্য উপসাগরের কপালের টিপ, সুন্দর নগরী, বন্দর আব্বাস। সমুদ্রের দুরন্ত গর্জনে রাতের ঘুম ভাংগে শহরের মানুষের। আকাশ, বাতাস এবং মানুষের এক অপূর্ব মাখামাখি ভালবাসাবাসীর নগর এই বন্দর আব্বাস। এখানে রাস্তায় রাস্তায় সরকারী গাড়ী নিয়ে ঘুরে বেড়াত নাদিম। সামুদ্রিক বাতাসে ঝেড়ে ফেলতো সব ক্লান্তি। কী সুখে ভরা সোনালী দিনগুলো ছিল যে তার। মাস শেষে বেতন পেয়ে ড্রাফট করে টাকাগুলো পাঠিয়ে দিত দেশে। দিনার গুলো মনে দিত সুখের আমেজ, সেই সুখ শরীরে জমাতে থাকে মেদ। নাদিম হয়ে যায় নাদুস-নুদুস।
নাদিমের দখলে আজ আলাউদ্দিনের সেই আশ্চর্য প্রদীপ। ঐশ্ব্যর্যের দৈত্যটা হাতের মুঠোয়। দিনে দিনে নাদিমের সংসারটা মণিমানিক্যে ভরে উঠে। বিরাট বিল্ডিং হয় বাড়ীতে। গাড়ী, কালার টিভি, ডিসিআর ফ্রিজ সব হয় তার। বাড়ীর সামনে নির্মিত হয় বিরাট সুদৃশ্য তোরণ। গ্রামবাসী ভাবে, নাদিম বুঝি বিদেশের সব টাকা একাই লুটে নিয়ে আসছে।
জরিনার প্রতি শ্বশুড়-শ্বাশুড়ী কলেজ পুড়ুয়া একমাত্র দেবর আদিমের আহলাদের সীমা ছিল না। দেবরটা যখন তখন জ্বালাতো। ভাতিজা দুটোকে নিয়ে মেতে থাকে সব সময়। নিয়ে যাচ্ছে বাজারে, খেলার মাঠে, শহরে সিনেমায়। সে নাকি নিজের মত করে গড়ে তুলবে ওদের। দুই ভ্রাতুষ পুত্রের প্রতি আদিমের এত টান এত স্নেহ, যে স্নেহের জায়গা হবে না কোথাও। কলেজ হতে এসেই সুমন শোভন। এদের ছাড়া একদণ্ড শান্তি পায় না আদিম।
সুখের সীমাহীন সমুদ্রে সাঁতার কাটছিল জরিনা। বাপের বাড়ীতে দুঃখ কি জিনিস তা ঠাহর পায়নি সে, শ্বশুর বাড়ীতেও এসে তাই। ওর কপাল দেখে বান্ধবীরা ঈর্ষায় ফেটে পড়ে। কেমন একটা পরশ্রীকাতরতা অনুভব করে আশপাশের চেনাজানা লোকজন। জরিনার এই সুখের সূর্যটাকে হঠাৎ আড়াল করে দেয় এক দুর্যোগের কালোমেঘ। তার সুখের সাগরে আসে এক প্রচন্ড সামুদ্রিক টাইফুন। সেই টাইফুনটা কেউ নয়, ইরাকের উচ্চাকাংখী এক নায়ক সাদ্দাম। এই রক্তপিপাসু এক নায়কের ফৌজেরা হঠাৎ ঝাঁপিয়ে পড়ে তথাকথিত বিল্পব-উত্তর ইরান সীমান্তে।
প্রচণ্ড যুদ্ধ চলছে। বোমা বিস্ফোরণের বিকট শব্দ, বোমারু বিমানের তর্জন গর্জনে আতংকিত মানুষ। রাজায়-রাজায় যুদ্ধ, উলুখাগড়ার প্রাণান্ত অবস্থা। কখন যে কার প্রাণ যায় বলা মুশকিল। মাস দুয়েক পরের ঘটনা। যুদ্ধরত সৈন্যদের জন্য রসদ বয়ে নিয়ে যাচ্ছে অসংখ্য গাড়ী। ওগুলোর একটির চালক নাদিম। সামনে এক অজানা নদী, নদীর উপর বৃহৎ সেতু। সেতুটির উপর উঠে পড়ে রসদবাহী কনভয়ের সামনের অংশটা। হঠাৎ আকাশের কানফাটা শব্দে কাঁপতে থাকে গাড়ীগুলো; যেন মৃদু ভূমিকম্প হচ্ছে রাস্তায়। নিমিষেই শিকারী শুকনের মত উড়ে আসে একঝাঁক যুদ্ধ বিমান। বোমা মেয়ে উড়িয়ে দেয় গাড়ীসহ সেতুটি। গাড়ী ছেড়ে নেমে আসে নাদিম। ওর গাড়ীটা তখনও উঠেনি ব্রীজে। পালানোর চেষ্টা করে কিন্তু না, মুহুর্তেই উড়ে আসে কয়েকটি হেলিকপ্টার। নেমে আসে অসংখ্য ভারী অস্ত্রধারী ইরাকী সৈনিক। সবার সাথে হাততুলে আত্মসমর্পন করে নাদিম। বন্দী নাদিম, হেলিকপ্টার দ্রুত উড়ে যাচ্ছে পশ্চিমে। নেমে পড়ে বসরার এক দুর্গম বন্দী শিবিরে। সাদ্দামের বন্দী শিবির, পাষান হিটলারেরও বন্দী শিবিরকে হার মানাবে। সংকীর্ণ প্রাচীরঘেরা ঘরে অভুক্ত, অর্ধভুক্ত হাজার হাজার মানব সন্তান মৃত্যুর মুখোমুখী। এসব হতভাগ্য আদম সন্তানের মধ্যে বিলীন হয়ে যাওয়া এক বন্দী নাদিম।
এই দুঃসহ যন্ত্রণার মধ্যেও নাদিমের চোখে বারবার ভেসে উঠে জরিনার ছবি। বৃদ্ধ মা-বাবার জরাজীর্ণ আবয়ব। কচি কচি সোনামণি সুমন আর শোভনের মুখ। তখন মাত্র দেড় বৎসর বয়সের হাঁটি-হাঁটি, পা-পা সোনামনিরা, আজ হয়ত ওরা অনেক বড় হয়েছে। কথা বলা শিখেছে। স্কুলে যাচ্ছে নিয়মিত।আব্বু কোথায় আম্মি’ প্রশ্নে প্রশ্নে হয়ত বারবার বিরক্ত করছে জরিনাকে।
কিয়ামতের দিন, সে এক অত্যন্ত ভয়ঙ্কর দিন। এই দিন নাকি মানুষ ভুলে যাবে রক্তের বন্ধন, হৃদয়ের বন্ধন। সবাই চীৎকার করবে- ইয়া রাব্বী নাফসি, অর্থাৎ খোদা আমাকে বাঁচাও। তারা সবাই নিজেকে নিয়ে থাকবে শশব্যস্ত, মনে পড়বেনা মা-বাবা, স্ত্রী-সন্তান কারো কথা। সবাই নাকি থাকবে উদোম, অথচ সেখানে কেউ কারো দিকে তাকানোর ফুরসৎ পাবেনা। এসব আজ যেন একেবারে মিথ্যে মিথ্যে মনে হচ্ছে নাদিমের কাছে। সাদ্দামের কি ভয়ঙ্কর কিয়ামতের ময়দানে অবস্থান করেও যে সে ভুলতে পারছে না প্রিয়তমা জরিনাকে। ভুলতে পারছেনা কলিজার টুকরো সোনামনিদেরে, ভুলতে পারছেনা বৃদ্ধ জনক-জননীকে। গণ্ডবেয়ে নেমে তার আসে লোনাজল। ভেসে যায় খোচা খোচা দাড়ীভর্তি বিষন্ন মুখ। প্রচন্ড গরমে একপশলা বৃষ্টি হলে যেমন প্রকৃতিতে নেমে আসে শান্তি, বুকের প্রচণ্ড জ্বালা যন্ত্রনায় নাদিম তেমনি ঢেলে দেয় চোখের বৃষ্টি, বুকে নেমে আসে প্রকৃতির এক অনাবিল প্রশান্তি।
নিষ্ঠুর সাদ্দাম। তারচেয়েও হাজার গুন নিষ্ঠুর ওর ফ্যাসিষ্ট গার্ড বাহিনী। নাদিম অনেক অনুনয় বিনয় করে। ইশারায় ইঙ্গিতে বোঝানোর চেষ্টা করে সে একজন বাংলাদেশী। সে নির্দোষ এক প্রবাসী শ্রমিক মাত্র। তাকে যেন একটা ছোট্ট পত্র পাঠানোর সুযোগ দেওয়া হয় দেশে। ওর কথায় কান দেয়নি মেশিনগানধারী ইরাকী গার্ডদের কেউ। বন্দীদের সাথে কথাবলা নিষিদ্ধ তাদের। তাই প্রায় ক্ষেত্রে উল্টো খেয়েছে ধমক, পড়ে যায় গোয়েন্দাদের সন্দেহের নজরে। ইরানীরা আর্যজাতি। এই আর্য রক্ত এদেশের মানুষেরও রক্তে মিশ্রিত আছে। চেহারা সুরতে তাই অনেকটা ইরানীই মনে হতো ওকে। ও যতই বুঝানোর চেষ্টা করেছে সে ইরানী নয়, ততই সন্দেহটা বেড়েছে তাদের। 
যুদ্ধ চলল একটানা দশ বছর। নাদিম বন্দী হয়ে পড়ে রইল সাদ্দামের শক্ত লোহার গারদে। বাইরের জগত হতে চিরবিচ্ছিন্ন এক নির্জন দ্বীপে। তাইতো দেশে পাঠাতে পারলনা ছোট্ট একটি খবর ‘জরিনা, আমি বেঁচে আছি।
শেষ চিঠিটি এলো নাদিমের, কী সুন্দর ঝলঝলে ভাষায় লিখিত পত্রটি। কী খোলা-মেলা বিবরনে একে একে লিপিবদ্ধ হয়েছে বাড়ীর সকলের কথা। কী মনোরম ভাষায় প্রকাশিত হয়েছে সবার প্রতি দিলখোলা মমতা ও ভালবাসা। সবশেষে এসেছে যুদ্ধের ফিরিস্তি। কোন চিন্তা না করার জন্য অনুনয় বিনয়। বেশী বেশী করে দোয়া করার আকুল আবেদন, সুস্থ শরীরে দেশে ফিরে আসার আকুতি। তারপর ইতি।
এদিকে প্রতিদিন পত্রিকাগুলো প্রকাশ করছে, ইরান-ইরাক যুদ্ধের গরম গরম খবর। ইরাকী বাহিনীর অগ্রাভিযানের বিবরণ। বন্দর আব্বাস, ইরাক সীমান্তের নিকটবর্তী উপসাগরীয় বন্দর নগরী। যুদ্ধ প্রসারিত হয় এই নগরীর আশপাশে। দুশ্চিন্তায় ঘুমহারা হয়ে যান নাদিমের সংসারের লোকজন। শ্বাশুড়ী জরিনা উম্মাদ প্রায়। শ্বশুর প্রতিদিন দৌঁড়ে যান ডাকঘরে। অথচ একবুক যন্ত্রণা নিয়ে খালিহাতে ফিরে আসেন তিনি রান্না-বান্না, কাজকর্ম সবযেন এলোমেলো হয়ে পড়ে সংসারে। কী ছিল আর কী হল। চারপাশে    অশান্তির উত্তপ্ত বাতাস। সবার মনে যন্ত্রণার আগুন। আসলে এমন কঠিন সময় মাঝে মাঝে আসে মানুষের চলমান জীবনে। 
বুকচাপড়ে সারাটা দিন কাঁদেন শ্বাশুড়ী। আর জরিনা দুসন্তানকে বুকে জড়িয়ে দরজা বন্ধ করে চোখের জলে বুক ভাসায়। ডাকঘরে বছর দিন বিরামহীন ছুটাছুটি করে ক্লান্তশ্রান্ত ভগ্নমনরথ শ্বশুর আব্বা। এমন দুঃসময়ে হস্তগত হয় ইরানী সামরিক দপ্তরের প্রেরিত ইংরেজীতে লেখা এক অফিসিয়েল লেটার। তাতে সুস্পষ্ট অথচ সংক্ষেপে লিখিত রয়েছে, ইরাকী বিমান হামলার শিকার হয়েছে নাদিম। তার কোন সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে না। পত্রটির মর্মাথ ব্যাখ্যা করে সবাই, ‘নাদিম ইরাকীদের বোমার আঘাতে ছাঁই হয়ে গেছে।এই মর্মার্থের পিছনে খাড়া করে এক বাস্তব যুক্তিযুক্ত প্রমাণ, সে বেঁচে নেই, বেঁচে থাকলে সে অবশ্যই পত্র দিত। কান্নার রোল উঠে বাড়ীতে, ছুটে আসে আত্মীয়-স্বজন পাড়াপড়শী সব। যথাসাধ্য সান্ত্বনা দিয়ে সবাই ফিরে যায় যে যার ঠিকানায়।
দিন আসে, দিন যায়। সবাই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে নাদিমের, কিন্তু নাদিমের আসেনা খবর। সবাই নিরাশ হয়ে পড়েন। একে একে তিনটি বৎসর বয়ে গেল। এলোনা নাদিম, এলোনা পত্র। সবাই বলাবলি করে, নাদিম নেই, ওর জন্য অপেক্ষা করে লাভ কী। জোয়ান পুত্রকে হারানোর বেদনা সহ্য করতে পারেননি বৃদ্ধ জনক। এক সময় হার্টফেল করে চলে যান পরলোকে। আর বৃদ্ধা জননী, বারবার ছুটে যান, বাড়ীর সামনের তেঁতুল তলায়। একদৃষ্টে চেয়ে থাকেন সিলেট-ঢাকা মহাসড়কের দিকে, হয়ত আসছে নাড়ি ছেড়া ধন, নাদিম।
এদিকে এল.এল.বি পাস করে প্রেক্টিসে নেমে পড়ে আদিম। আদিমটা জরিনার দেবর হলেও হবে কি, সে জরিনার চেয়ে বছর দুয়েক বড় হবে। শিক্ষায়-দীক্ষায় এক পরিপূর্ণ যুবক আদিম। রোজগারেও কম নয় সে। ওর জন্য কনে খুঁজবেন জননী। আত্মীয় স্বজন সবাই পরামর্শ দিল ‘ঘরে লক্ষী মেয়ে জরিনা যখন রয়েছে বাইরে কনে খুঁজতে যাবেন কেন? ওর বয়স আর কত হবে, বড়জোর বিশ একুশ, সুন্দরী। তাছাড়া সুমন শোভনেরও গতি হবে। সংসারে নবজীবন ফিরে পাবে সবার প্রিয় অসহায় জরিনা। ওর ওতো সারাটা জীবন রয়ে গেছে, একা একা কাটাবে কেমন করে। 
শ্বাশুড়ি-মায়ের ভাবনা শুধু পুত্রকে ঘিরে নয়, সবাইকে ঘিরে। তাইতো নতুন করে আবার সাজিয়ে দিতে চান জরিনার ভাঙ্গা ঘর। লক্ষী বউটি যেন পরিপূর্ণ অধিকার বক্ষে ধারণ করে আবার প্রতিষ্ঠিত হয় বাড়ীর বউ হয়ে।
ছিঃ, মা এসব কী করছেন, ভাবতে পারেনা আদিম। ভাবী হিসাবে জরিনার সঙ্গে মাঝে মধ্যে হাসিঠাট্টা করলে হবে কি, বড়বোনের মত ভক্তি শ্রদ্ধা করতো তাকে। কোনদিনও সে এমন চিন্তা মনে আনতে পারেনি। ভাইয়ের মুখ ভেসে উঠে চোখে, বিবেকের তাড়নায় দুমড়ে মুচড়ে উঠে মন।
সবার অনুরোধ, উপদেশ, চাপ, কচি ভাবীটির জীবন, দুভাতিজার নিষ্পাপ করুণ চাহনি, সবশেষে জন্মদাত্রী জননীর নির্দেশ তাকে অনিচ্ছা সত্ত্বেও বলতে বাধ্য করে ‘আমি রাজী আছি আম্মাজান।'
অনেক তপস্যায় মা রাজী করান আদিমকে, কিন্তু বেঁকে বসে জরিনা। পোড়াকপাল জোড়া লাগানোর প্রচেষ্টায় আদৌ রাজী নয় সে। ওর সুখের বাগানে যখন অদৃষ্টের নির্দেশে আগুন লেগেছে, তখন কেন যাবে পানি ঢালতে, আগুন নেভাতে। শৈশবে সে মুরব্বীদের মুখে শুনেছে, খোদার হুকুম ছাড়া পৃথিবীতে হয়না কিছু। খোদা ওর সুখ চাননি বলেইতো তার দুরবস্থা। খোদা চাননা তার সুখ। আর সে কিনা যাবে সুখের সন্ধানে। তাইতো মা-বাবা, শ্বশুর-বাড়ীর লোকজন শত বুঝানো সত্ত্বেও দ্বিতীয় বিয়েতে আদৌ রাজী নয় অভিমানী জরিনা। একটি মাত্র মন তার, আর সে মন সে দিয়েছিল মাত্র একজনকে। এই মনটা আবার দিতে হবে আরেকজনকে। এই বেঈমানী কেমন করে সম্ভব, ভাবতে পারে না পল্লীবধু জরিনা, সে যে এতকাল ছিল একজন গর্বিতা সতীস্বব্দী  পতিপরায়না নারী।
চোখের পাতায় তার ভেসে উঠে সপ্রতিভ নাদিম আর নাদিমের উচ্ছ্বল ভালবাসায় ভরা সেই দিনগুলোর রঙ্গীন স্মৃতিমালা। এলবাম খুলে চেয়ে দেখে, সেই গাঁয়ে হলুদ, সেই শুভ মুহুর্ত, সেই বরবেশী রাজপুত্তুর নাদিম। চিন্তাশক্তি রহিত হয়ে যায় জরিনার, চোখ বেয়ে নেমে আসে দুফোটা অশ্রু বিন্দু।
অবস্থায় অতিবাহিত হল আরও দুটি বছর। সবাই নিশ্চিত নাদিম বেঁচে নেই। জরিনার হৃদয়েও ক্রমে ক্রমে ঝপসা হতে থাকে নাদিমের ছবি। এবার ওর নেগেটিভ মনটা পজেটিভ হতে শুরু করে। তেইশের উত্তপ্ত যৌবনা সে। একাকিত্বের যন্ত্রণায় বিষন্ন মন সংগোপনে ভালবাসতে শুরু করে পঁচিশের যৌবনদীপ্ত তরুন আদিমকে। মন হতে বিদায় নিতে শুরু করে ইউটোপিয়া, ধীরে ধীরে সে ধাবিত হয় বাস্তবতার রাজ্যে। সে দিব্যচোখে দেখতে পায় ঘরে নববধুর আগমন ঘটেছে, অমনি সে তার সন্তানদ্বয় পরিণত হয়েছে দুই নম্বর নাগরিকে। নিক্ষিপ্ত হয়েছে তারা অসহায় জগতে, নিজঘরে পরবাসী।
যে খুঁটির উপর ভর করে সংসারে টিকে আছে জরিনা দুসন্তান, সে খুঁটিটা সটকে যাবে। জরিনা ভাবে তখন কী হবে আমার? কী হবে সোনামনি সুমন শোভনের? তা শ্বাশুড়ী মায়ে অনুরোধ আর অগ্রাহ্য করতে পারে না জরিনা।
এই টানপোড়নের বিয়ে জরিনার জন্য দ্বিতীয় বার হলে আদিমের তো প্রথম। তাই বেশ ঘটাকরে সম্পন্ন হয় বিয়ের আয়োজন। অনেক আত্মীয় স্বজনও আসেন। মা চাচার বিয়ে সবার সাথে প্রত্যক্ষ করে দুটি নিষ্পাপ শিশু সুমন-শোভন। বর-কনের সাজে সজ্জিত মা-চাচার মুখ ফ্যালফ্যাল চোখে চেয়ে দেখে দুই ভাই বারবার, কী যে ঘটছে কিছুই তখন বুঝতে পারেনি ওরা। 
দেবর আদিমকে নিয়ে আরম্ভ হল জরিনার নতুন সংসার। বয়ে যায় একে একে সুখ দুঃখের পাঁচটি বছর। ঘরে এলো আরও দুটি পুত্র কন্যা। সুখেই কাটছিল আদিমের সাথে জরিনার দিনগুলো, নতুন করে সাজিয়ে নিয়েছিল সব। সবার স্মৃতির পাতায় গভীর কোয়াশা জমে হারিয়ে যায় নাদিম। ধীরে ধীরে আদিম দখল করে নেয় নাদিমের আসন।
আর নাদিম, সে তো মারা গেছে সেই কবে দশ বছর আগে। কাজেই ওর খালি স্থানটা তো আদিমেরই। সবাই সানন্দে বরণ করে নেয় আদিমকে। এটাই যে সংসারের শ্বাসত নিয়ম, চিরন্তন রীতি। 
একদিন দ্বিপ্রহরের পর কি এক নিদারুণ আহাজারি শুরু হয় আদিমের বাড়ীতে, সারাটা বাড়ী লোকে লোকারন্য। ইরান ইরাক যুদ্ধ বন্ধ হয়েছে বেশ কিছুদিন। আন্তর্জাতিক রেডক্রস শুরু করেছে দুপক্ষে বন্দী বিনিময়। ছাড়া পায় নাদিম। উদভ্রান্তের মত ছুটে আসে জন্মভূমি রশিদপুরে। বৃদ্ধা জননীকে বুকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে নাদিম। উসকো খুসকো চুল, খোঁচা-খোঁচা দাড়ি ভর্তি মুখ, কংকালসার দেহ, কিম্ভুতকিমাকার নাদিমের মুখপানে হা করে চেয়ে থাকে বার বছরের দুটি বালক সুমন-শোভন। হারিয়ে যায় আদিমের বাকশক্তি।
আর দুইটি সমান সমান্তরাল চুম্বকের প্রচন্ড আকর্ষনের ঠিক মধ্যবিন্দুতে অনড় স্থির হয়ে পড়ে থাকে শক্তলোহা জরিনা। 
এখন কি হবে জরিনার?  ধর্ম, রাষ্ট্র  সমাজ কি দেবে সমাধান।
রচনাকাল ঃ আগস্ট ১৯৮৮ সালে ইরান- ইরাক যুদ্ধের সমাপ্তিকালে রচিত।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন