Pages

প্রকাশিত গ্রন্থ-সমূহ

সোমবার, ১৮ জানুয়ারী, ২০১৬

কাজের মেয়ে কুটিনা


কাজের মেয়ে কুটিনা
 

কুটিনা আমার চিন্তাজগতে এঁকে দেয় অসংখ্য বক্ররেখা- কেন ইবা তার জন্ম, আর কেনই বা তার মৃত্য? কুটিনারা থাকতো সিলেট শহরের খরাদিপাড়া, শিবগঞ্জে। এখানে একটি সুন্দর আবাসিক ভবন। বাসাটির নাম বনলতা। প্রায় ত্রিশ কাটা জায়গা জুড়ে অজস্র কুসুমরাজিতে সুসজ্জিত ‘বনলতা হাউস’ যে কোন মানুষের দৃষ্টি কেড়ে নিত। রাস্তা থেকে মানুষ চেয়ে চেয়ে দেখত নয়নমুগ্ধকর বাড়িটির রূপ। ও বাড়িতে যদি আমি কিছুদিন না থাকতাম তা হলে হয়ত এ গল্পটি হত না।
এই বাড়িতে বছর দেড়েক অবস্থান করে আমি এমসি কলেজে অধ্যয়ন করি। বাড়ির মালিক লন্ডনপ্রবাসী ফুফুতো বোন। তখন তাদের দু’টি মেয়ে ও একটি ছেলে ছিল। ছেলেটির নাম পাপ্পু। ওদের বাংলাদেশে পড়ানোর জন্য নিয়ে আসেন দেশে। যাকে নিয়ে আমার এ গল্প সে হচ্ছে ও বাসার কাজের মেয়ে কুটিনা। কুটিনার বয়স তখন বার কিংবা তের হবে। শ্যামলা বরণ গোল গাল মেয়েটি দেখতে ছিল মোটামোটি সুন্দরী। ওর পূর্ব ইতিহাস আমার তেমন জানা ছিল না। ওকে নাকি সেই ছোট্ট বয়সে ঢাকা হতে কুড়িয়ে আনা হয়। হয়তবা কোন গরিবের সন্তান। অভাব আর ক্ষুধার জ্বালায় ওদের পরিবারটি ভেঙ্গে তছনছ হয়ে পড়ে। আর এর এক ভগ্নাংশ হয়ে কুটিনা তার পরিবার হতে চিরবিচ্ছিন্ন হয়ে চলে আসে সিলেটের ঐ লন্ডনি বাড়িতে। সেই থেকে আমার বোনের শ্বশুর আদর যত্ন করে কুটিনাকে প্রতিপালন করেন। ভাদেশ্বর গ্রামের অনুচ্ছ টিলাকাটা সুরম্য বাড়িতে সে কাজের মেয়ে হিসাবে অতিবাহিত করে তার শৈশবের দিনগুলো। ও বাড়ির আর্থিক অবস্থা ছিল অত্যন্ত সচ্ছল। টাকাকড়ির কোন হিসাব ছিলনা ওদের। মানুষগুলোও ছিলেন অত্যন্ত উদার ও উঁচু মনের অধিকারী। কাজের মেয়ে বলে তার কোন ধরণের মৌলিক অধিকারে কেউ হস্তক্ষেপ করে নি কোনদিন। বরং এবাড়ির একজন কাজের মানুষেরও জীবনযাত্রার মান অন্য একটি মধ্যভিত্ত পরিবারের একজন মানুষের জীবনমানের চেয়ে কোন অংশেই কম ছিলনা। নামাজ, রোজা ও ক্বোরআন শিক্ষা দেয়া হয় মেয়েটিকে। আমার বোন তার সন্তানদেরে পড়ানোর জন্য সিলেট নিয়ে এলে কুটিনাকে গ্রামের বাড়ি থেকে নিয়ে আসা হয় বনলতায়।
আমার বোন ছিলেন অত্যন্ত বুদ্ধিমতি। দরদি এক মন ছিল তার। দোলাভাইও তাই। কাজের মেয়ে হওয়া সত্ত্বেও বোন তাকে আদর করতেন সন্তানের মত। কোন কিছুর অভাবে ভূগছে কুটিনা, তা আমি বুঝতে পারি নি কোনদিন। বাসার বাবুর্চি, ড্রাইভার, দারোয়ান ছাড়াও আরও অনেক কাজের মানুষ ছিল। ছেলে-মেয়েদের সেবাযত্ন ছাড়া কুটিনার আর কোন বিশেষ কাজ ছিল না।
অন্য দশজন কাজের মেয়ে হতে কুটিনা ছিল অনেকটা ভিন্ন। ওর নিজস্ব বুদ্ধি ও চিন্তাশক্তি ছিল। ও তার জীবন নিয়ে ভাবত খুব বেশি। অনেক দিন দেখেছি কুটিনা একাকী বসে কাঁদছে। গুনগুন করে কি সব যেন বকে যাচ্ছে সুর তুলে। জিজ্ঞেস করলে ও বলত- “দাসী হয়ে জন্ম নেয়ায় ভাবছি। খোদাতো ইচ্ছে হলে আমাকে একটি ভালঘরে জন্ম দিতে পারতেন। কেন এমনটি করলেন। এ জীবনের চেয়ে নাজন্মাটাইতো ছিল উত্তম।” চৌদ্দ বৎসরের কুটিনা যদিও লন্ডনি বাড়িতে সুখেই ছিল, তবুও এটা পরিস্কার বুঝতে পারতো তার কোন ভবিষ্যত নেই। যতই রূপসী হোক না কেন কোন ভাল ও স্বাধীন ঘরের লোক আসবে না তাকে বিয়ে করতে। একেতো আজন্ম কাজের মেয়ে তদুপরি পিতৃমাতৃ-পরিচয়হীনা সে। হয়ত কোন এক গরিব নিম্নমানের লোকের সাথে বিয়ে দিতে বাধ্য হবেন ওর বর্তমান অভিভাবকরা। তাই লন্ডনি বাসার নরম খাটে শুয়েও শুধু কাঁদতো। কেঁদে কেঁদে বুক ভাসাতো।
চৌদ্দ বৎসর বয়সে নাকি যৌবনের দেবতা এসে হাত বুলিয়ে দেন মেয়েদের শরীরে। হঠাৎ নাকি রূপে জ্বলে উঠে মেয়েদের শরীর। মাথার চুল থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত ঘুম হতে জেগে উঠে চতুর্দশী কিশোরীর। নতুন এক উত্তপ্ত বাতাস এসে গ্রাস করে শৈশবের শীতল প্রবাহকে। চৌদ্দের সবক’টি লক্ষণ হঠাৎ সুসজ্জিত করে তোলে কাজের এই মেয়েটিকে।
সদ্য যৌবনা এ মেয়েটি কাজের ফাঁকে ফাঁকে গুন গুন করে গান গাইতো। মাঝে মধ্যে আপার সঙ্গে সেজেগুজে গাড়ি করে আত্মীয়স্বজনদের বাড়ি যেত। ও পরিপাটি হলে প্রায় সময়ই লোকে বুঝতে পারতনা ও কাজের মেয়ে না ভদ্র ঘরের মেয়ে। ওর রূপসৌন্দর্য্যে অনেক সময় লোকের ঈর্ষা হত। মাঝে মধ্যে ও কাঁদতো। ওর কান্নাকে আপা সন্দেহের চোখে দেখলেও আমি এর প্রকৃত অর্থ বুঝতে পারতাম। ওর কান্না ছিল ওর জীবটাকে নিয়ে, ভবিষ্যৎকে নিয়ে। একদিন দুপুরে ভাগ্না পাপু এসে আপাকে বললো “আম্মা, কুটিনা ড্রাইভারের ঘরে”। ওমনি তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন আপা। ড্রাইভার গোপালের সামনে ভীষণভাবে গালাগালী করলেন মেয়েটাকে। বললেন, চাবাগানের লেবারশ্রেণির লোক ড্রাইভার গণেশ, সে ভিমকালো, একে তো হিন্দু তদুপরি কয়েক সন্থানের বাপ। ড্রাইভারের ঘরে অনেক প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ছিল। হয়তবা জরুরি কিছু একটা আনতে গিয়েছিল নির্দোষ এ মেয়েটি। অথচ এ অপরাধে মিথ্যাই বকুনী খেতে হল তাকে।
দিনে দিনে আপার সন্দেহটা বাড়তে লাগলো। আপা সিদ্ধান্ত নিলেন মেয়েটাকে আর ওখানে রাখা যাবে না। ওর আচার আচরণ সবকিছুতে তিনি সন্দেহজনক একটা কিছু আবিস্কার করতে থাকেন। এক সময় আপার ধৈর্য্যরে বাঁধ একেবারে ভেঙ্গে পড়লো এ মেয়েটির প্রতি।
ধলাই নামের একজন বোকাটে বেঁটে লোক। তবে রে সে যতটুকু বোকা সবাই ভাবে আসলে ততটা বোকা নয়, সে আমার চোখে ছিল গোপন চালাক। ওকেও নাকি শৈশব হতে লন্ডনি বাড়িতে লালন পালন করা হয়েছে। ও বাড়ির সাহেবরা ওকে বিয়েও দিয়েছিলেন। কিন্তু ওর দুর্ব্যবহারে বউ পালিয়ে যায়। পাপ্পুর পিতামহ বার্ধক্য-রোগে শয্যাশায়ী, তার সেবাযত্ন করত এই ধলাই। অর্ধবয়সী লোকটা বৃদ্ধার মৃত্যুর পূর্বক্ষণে ওসিয়ত আদায় করে নেয় কুটিনাকে বিয়ে করার। বৃদ্ধাও সহানুভূতিশীল হয়ে পুত্রদেরে নির্দেশ দিয়ে যান কুটিনাকে ধলাইয়ের কাছে বিয়ে দিতে।
সিলেটে কুটিনার কানে এসে পৌছে যায় খবরটি। অসহায় মেয়েটি অত্যন্ত মনমরা হয়ে পড়ে। ওর অভিভাবক দোলাভাই ও তার ভাইয়েরা। জান্নাতবাসী পিতার নির্দেশ, কী আর করা যায়? সবাই তৈরি হয়ে গেলেন।
একদিন আমি কথাচ্ছলে জিজ্ঞেস করলাম- কিরে কুটিনা, ধলাইকে কি তর পছন্দ হয়? কুটিনার সপ্রতিভ উত্তর, ওর সাথে বিয়ে হলে আমি গলায় দড়ি দেবো।
প্রায়ই দেখতাম ও একা একা কাঁদছে। আর বলছে, আল্লাহ এজীবনের পরিবর্তে আমাকে তুলে নাও। কেন খোদা দাসী জীবনে আমাকে বন্দি করলে তুমি!
সেইবার স্রষ্টার এক অপার মহিমায় রক্ষা পায় কুটিনা। ধলাই নামের বখাটে লোকটা হঠাৎ এক অমার্জনীয় কাণ্ড করে বসে বাড়িতে। কুটিনার সঙ্গে বিয়ে তো দূরের কথা, সবাই ওকে পিটিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দেন।
বনলতা থেকে কুটিনাকে নিয়ে যাওয়া হলো ভাদেশ্বরের গ্রামের বাড়ি নালিউরিতে। বেশি দেরি করা ঠিক নয় মনে করে রূপসী এ মেয়েটিকে বিয়ে দেয়া হয় ছখাই নামের অল্পবয়স্ক এক কালো লিকলিকে ছেলের সঙ্গে।
বনলতা ছেড়ে এসেছি দুই বছর। কোন কারণ বসতঃ সেদিন যাইনি কলেজে। আমার দিনে ঘুমানোর তেমন অভ্যাস নেই। অথচ সেদিন সকালের খাওয়া শেষে ঘুমিয়ে পড়ি। ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখি, বনলতা হাউসের আপা সিলেট মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। তার সন্তান হবে আমরা অপেক্ষা করছি এমন সময় টং টং ঘণ্টা বাজতে শুনি। আমরা লেবার রুমের সামনে যেতেই চিকিৎসক বললেন রুগীকে বাঁচানো গেলনা, মারা গেছেন তিনি।  এ স্বপ্ন দেখে ঘেমে জেগে উঠি এবং অনবরতঃ ওয়াসতাগফার পড়তে থাকি। ভাবলাম কত ধরনের স্বপ্নইতো মানুষ দেখে, এই স্বপ্ন নিয়ে এত ভেবেচিন্তে কি লাভ। অথচ এই স্বপ্নের তাড়া খেয়ে একদিন পরই আমি যাই ওদের বাসায় বনলতায়। সেখানে গিয়ে দেখলাম সব স্বাভাবিক। যে সিরিয়া আপার দুশ্চিন্তায় গেলাম তিনি শান্ত ও সৌম। নাস্তার টেবিলে বসে চায়ে চুমুক দিতেই বড় আফসুস করে তিনি বললেন, ও হে সেফাক, আমার কুটিনা যে নাই, গতপরশু সকাল ১১টার সময় এক মৃত কন্যাসন্তান প্রসব করে সিলেট মেডিকেলে মারা গেছে। সময়, বার মিলিয়ে অবাক হয়ে যাই। স্বপ্নে দেখা সেই দিনে, সেই ক্ষণে, কুটিনা মারা গেছে। কিছুক্ষণের জন্য হিপনোটাইজড হয়ে পড়ি। আসলে কোন কোন স্বপ্ন কেমন করে যেন জলজ্যান্ত সত্য হয়ে যায়। একেই বলে মহান স্রষ্টার রহস্যের অদৃশ্য লীলাখেলা।
রচনাকালঃ ১৯৮৫ সাল, রেঙ্গা দাউদপুর, দক্ষিণসুরমা, সিলেট।

কবি, লেখক, ব্লগার, গল্পকার ও পূবালী ব্যাংকার ইসফাক কুরেশি

২টি মন্তব্য:

  1. স্বপ্নের সাথে অনেক সময় বাস্তবতাও কাকতালীয়ভাবে মিলে যায়। লেখাটি অনেক সুন্দর হয়েছে, বাস্তব জীবনে মুখোমুখি হওয়া অনেক সত্য ফুটে উঠেছে গল্পে।

    উত্তরমুছুন