Pages

প্রকাশিত গ্রন্থ-সমূহ

শুক্রবার, ১৮ মার্চ, ২০১৬

মহান মে দিবসের ভাবনা

মহান মে দিবসের ভাবনা
চৌধুরী ইসফাকুর রহমান কুরেশী

১লা মে মহান ‘মে দিবস’। বিশ্বের শ্রমজীবী মানুষের আন্দোলনের ইতিহাসে এক চিরভাস্কর দিন। ১৮৮৬ সালের এই দিনটিতে আমেরিকার শিকাগো শহরে অগণিত নির্যাতিত ও শোষিত শ্রমজীবী জনতা তাদের সুনির্দিষ্ট কার্য্যপরিধি ও শ্রমঘন্টার ন্যায্য দাবি আদায়ের জন্য রাজপথে বুকের রক্ত ঢেলে বিশ্বেব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি করে। এই দিনটিতে শিকাগো শহরে শোষিত, বঞ্চিত, শ্রমজীবী মানুষের রক্তে এক বীরত্বের মহাকাব্য রচিত হয়। যে মহাকাব্য সর্বযুগের বঞ্চিত শ্রমিক-শ্রেণির জন্য প্রেরণার উৎস ও দিকনির্দেশনা হয়ে থাকবে। অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য প্রতিবাদ গর্জে উঠার অগ্নিমন্ত্র- এই দিনটি পৃথিবীর প্রতিটি অঞ্চলের মানুষকে উদ্ধুদ্ধ করবে, নিজ নিজ ন্যায়সঙ্গত অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে।
প্রাগৈতিহাসিক যুগে মানুষ বাস করত প্রকৃতির রাজ্যে। তখন ব্যক্তি-সম্পত্তির উদ্ভব হয়নি। মানুষ প্রকৃতির বুকে জোটবদ্ধ ভাবে পাহাড়-গোহায় বসবাস করত। শিকার লব্ধ পশুপাখি ও গাছগাছালীর ফলমুল খেয়ে জীবন ধারণ করত। জীবন ছিল অত্যন্ত সহজ সরল। বর্তমানের মত এতকিছুর প্রয়োজন ছিলনা। মানুষের জীবনে ব্যক্তি-সম্পত্তিহীন এই যুগে মানুষের মধ্যে ছিলনা স্বার্থের জন্য মারামারি হানাহানি। নরনারীর বিবাহ বহির্ভূত এই যুগকে সমাজ বিজ্ঞানী মর্গান ‘অযাচার যুগ’ ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানী জ্যাক রুশো ‘প্রকৃতির রাজ্য’ বলে অভিহিত করেছেন। যুগের পরিবর্তন হল, মানুষ কৃষিকাজ ও পশুপালন শিখল। আর তখনই আবির্ভাব হল ব্যক্তিসম্পত্তি। দুষ্ট ও লোভী মানুষেরা অধিক সম্পত্তি কুক্ষিগত করার জন্য তীব্র প্রতিযোগিতা ও সংঘর্ষে লিপ্ত হল। সাথে সাথে সৃষ্টি হলো কৃষিদাস ও কৃষি সামন্ততন্ত্র। কৃষি খামারে দুর্বলদের জোরপূর্বক খাটানোর জন্য শুরু হল ঘৃণ্য দাসপ্রথা ও মানুষ ক্রয়-বিক্রয়ের ঘৃণ্য দাসব্যবসা। পার্বত্য ও মরু অঞ্চলে পশুপালনকে কেন্দ্রকরে প্রথমে গোত্র ও পরে অনেক গোত্র সমন্বয়ে রাজতান্ত্রিক শোষক রাষ্ট্র সৃষ্টি হল।
অন্যদিকে সমতলভূমি ও উর্বর কৃষি অঞ্চলে ভূমিদাস ও ভূমিপ্রভু বিশিষ্ট সামন্ততন্ত্রের উদয় ঘটে। বিভিন্ন নদীবিধৌত উর্বর কৃষি অঞ্চল যেমন মিশর, সিন্ধু, ইরাক, চীন, বঙ্গ ইত্যাদি দেশে সামন্ততন্ত্র পরিপূর্নতা পেয়ে সৃষ্টি হল সামন্তবাদী রাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও সাম্রাজ্যসমূহ। ভূমিদাস, ভূমিপ্রভু ও কারিগর শ্রেণি সৃষ্টি হয়। ভূমিহীন দাসরা ও বিভিন্ন পেশার শ্রমজীবীরা অমানুষিক শ্রমদান করত। আর ফলভোগ করত কতিপয় সামন্ত প্রভূ, ভূস্বামী, রাজ্যের আমির-উমরা, ধর্মযাজক, ব্যবসায়ী ও সেনাপতিরা। এই শ্রেণিশাসন ও শ্রম-শোষণের জন্য ব্যবহার করা হত রাজ্যের সেনাবাহিনীপুলিশ, বিচার ও ধর্মব্যবস্থা সহ সমগ্র রাষ্ট্রযন্ত্রকে। রাজা ও সামন্ত্ প্রভূদের হাতে সমগ্র ক্ষমতা ও সম্পদ কুক্ষিগত থাকত। ধর্ম -যাজকগণকেও সুকৌশলে সব সময় কায়েমী স্বার্থে ব্যবহার করত শোষক রাজ্যপতিরা। রুমে পার্টাকাসের নেতৃত্বে অত্যাচারিত দাসদের বিদ্রোহ ও পরাজিত দাসদের প্রতি ইতিহাসের হিংসাত্মক হত্যাকান্ড, মিশরে ফেরাউনের বিরুদ্ধে ইহুদি দাসদের বিদ্রোহ ও অত্যাচারের কাহিনি, এমন কি এ শতকের মধ্যভাগে সিলেটের ভূমিহীন নানাকার (ভূমিদাস) শ্রেণির বিদ্রোহ, আমেরিকার কালো আফ্রিকান দাসদের নিগ্রহের কাহিনি ইতিহাস সচেতন মানুষমাত্রই অবগত রয়েছেন। অষ্টাদশ শতকে বিশ্বে শিল্পযুগ শুরু হয় ইউরোপ ও আমেরিকায়। এসব দেশে উৎপাদন ব্যবস্থায় দ্রুত পরিবর্তন সাধিত হয়। সেইসাথে পরিবর্তন সাধিত হয় শ্রমশোষণ পদ্ধতির। তখন কৃষিযুগ থেকে শিল্পযুগের সূচনা হয় পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে।
শিল্পযুগের প্রারম্ভে বিভিন্ন দেশে সমুদয় পুঁজি এসে জমা হতে থাকে কিছু সংখ্যক শিল্পপতির হাতে। সুষ্ঠু কোন শ্রমনীতি ও রাষ্ট্রীয় অনুকুল্যের অভাবে পুঁজিপতিরা নিষ্ঠুরভাবে শ্রমজীবী মানুষকে শোষণ করতে থাকে। এভাবে পুজিপতিরা সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলে, রাষ্ট্রযন্ত্র সরাসরি পুঁজিপতিদের নিয়ন্ত্রণে থাকায় শ্রমজীবীরা রাষ্ট্রের অনুকুল্য ও সহানুভূতি থেকে বঞ্চিত হয়। শ্রমজীবী শ্রেণি রিক্ততার চরম সীমায় উপনীত হয়। বর্তমানের কল্যাণ রাষ্ট্রের মত তৎকালে আমেরিকা কিংবা ইউরোপের শ্রমিকরা কোন ধরনের ছুটি বা অধিকার ভোগ করতে পারত না। বেতন ভাতার নীতিমালা না থাকায় তারা যা পেত তাদিয়ে সংসার নির্বাহ করা সম্ভব হতনা। ফলে তাদেরকে অর্ধাহারে অনাহারে বিনা চিকিৎসায় মরতে হত। তাদের সন্তানরা শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত হত। শ্রমিকেরা যখন শহরের বস্তিতে মানবেতর জীবনযাপন করত তখন পুজিপতিরা সুরম্য অট্টালিকায় দিনযাপন করত। ছুটি-অবসরহীন দুঃসহ অবস্থার অবসানে শ্রমিক শ্রেণি সচেতন হয়ে উঠে। আমেরিকায় শ্রমিক শ্রেণি সংগঠিত হয়। তারা সপ্তাহে ৪০ ঘন্টা কাজের দাবিতে ও অন্যান্য ন্যায়সঙ্গত ইস্যুকে কেন্দ্র করে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। আমেরিকার শিকাগো শহরে ১৮৮৬ সালে ৪টা মে পুলিশের গুলীতে নিহত হন অসংখ্য অসহায় শ্রমিক। পুজিবাদ প্রভাবিত রাষ্ট্র ও বিচার ব্যবস্থার মাধ্যমে ফাঁসির কাস্টে ঝুলানো হয় বেশ কিছু শ্রমিক নেতাকে। পরবর্তীতে শুভবুদ্ধির উদয় হল আমেরিকার সচেতন মানুষ, বুদ্ধিজীবী ও রাষ্ট্র কর্ণধারদের। চল্লিশ ঘন্টা শ্রম সপ্তাহের দাবি প্রতিষ্ঠিত হল। এই আন্দোলনের চেতনা ছড়িয়ে পড়ল সমগ্র পৃথিবীতে। কমিউনিজম গ্রাস করল পৃথিবীর এক বিশাল অঞ্চল। আর কমিউনিজমের হাত হতে বাঁচার জন্য পুঁজিবাদী রাষ্ট্রসমূহ শ্রমজীবী জনতার অধিকার মেনে নিল ও প্রতিষ্ঠিত হল আধুনিক কল্যাণ রাষ্ট্রের ধারণা।
জাতিসংঘ ১লা মে কে বিশ্ব শ্রমিক সংহতি দিবস হিসাবে ঘোষণা করে। ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু এই দিনটি জাতীয় ছুটির দিন হিসেবে ঘোষণা করেন। আমাদের দেশে দ্রুত শিল্পায়ন হচ্ছে। পোষাক শিল্প আজ আমাদের এক প্রতিষ্ঠিত উৎপাদন মাধ্যম। দেশ দ্রুত কৃষিযুগ পার হয়ে শিল্পযুগে প্রবেশ করছে। আজ যদিও বিশ্বব্যাপী ব্যক্তি মালিকানার জয় জয়কার, তবুও আমাদের লক্ষ্য রাখতে হবে, যেসব শ্রমজীবী মানুষের শ্রমে ও ঘামে পুঁজি ও মুনাফা সৃষ্টি হচ্ছে তারা যেন শোষণ বঞ্চনার শিকার না হয়। অন্যায়ভাবে তাদের শ্রমের ফসল অন্যরা চুরি কিংবা ডাকাতি করে ছিনিয়ে যেন না নেয়। শ্রমজীবী মানুষরা তাদের ন্যায্য পাওনা হতে যাতে বঞ্চিত না হয়, সেদিকে সরকার, রাষ্ট্রযন্ত্র, প্রশাসন, আইন ও বিচার বিভাগের সর্তক নজরদারী প্রয়োজন। আর এই সচেতনতার মাধ্যমেই মহান মে দিবসের শহিদদের প্রতি যথার্থ সম্মান প্রদর্শন সম্ভব। জয় হোক শ্রমজীবী মানুষের, অমর হোক মহান মে দিবস।
কবি লেখক ব্লগার ও পূবালী ব্যাংকার ইসফাক কুরেশী 
প্রকাশকালঃ দৈনিক সিলেটের ডাক, ১ মে, ১৯৯৮ইং

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন