বাংলাদেশে ভিক্ষাবৃত্তির অর্থনীতি আর কতকাল?
চৌধুরী
ইসফাকুর রহমান কুরেশী
স্বাধীনতার পর আমাদের জাতীয় জীবনে ছাব্বিশটি বছর পার হয়ে গেছে।
স্বাধীনতা যুদ্ধে গোটা জাতি ঝাঁপিয়ে পড়েছিল তিনটি কারণে। প্রথমতঃ বাঙ্গালী জাতির
স্বাধীনতা অর্জন, দ্বিতীয়তঃ গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থা
প্রতিষ্ঠা এবং তৃতীয়তঃ অর্থনৈতিক মুক্তি। এর মধ্যে আমরা প্রথমটি পেয়েছি। বহু ত্যাগ
তিতীক্ষা ও আত্মবিসর্জনের মাধ্যমে দ্বিতীয়টিও দেশে স্থায়ী রূপ নিতে যাচ্ছে। আর তৃতীয়টি বলতে হবে সামান্য উন্নতি হলেও
তা আমরা এখনও পুরোপুরি অর্জন করতে পারিনি।
বিগত দিনগুলোতে সরকারগুলো এমন অবস্থার সৃষ্টি করতো যে, বারমাস রাজনৈতিক উত্তেজনা, ধর্মঘট
ও বিশৃংখল অবস্থা বিরাজ করতো দেশে। বিরোধী দল গুলোও তেমন একটা গঠনমূলক মনোভাবের
পরিচয় দেয়নি। তাই দেশের অর্থনীতি যে তিমিরে ছিল, সেই
তিমিরেই রয়ে যায়। দরিদ্র ও ভূমিহীন মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। শহরের বস্তিগুলো
ভরে যায় অসহায় ছিন্নমূল মানুষের স্রোতে। চরম দারিদ্র সীমার নীচে মানুষ ধাবিত হয়।
জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে কোন কঠোর আইন কানুন প্রবর্তনে কোন সরকারই সাহসী হলো না।
বিত্তহীন, শিক্ষাহীন দরিদ্র মানুষগুলো উল্লেখ করার
মত কিছুই করতে সক্ষম না হলেও তারা একটি কাজ করলো- তা হলো জনসংখ্যা অপরিকল্পিত ভাবে
আরও বাড়িয়ে দিল। ৭১ এর সাড়ে সাতকোটি বাঙ্গালীর সংখ্যা এসে প্রায় চৌদ্দ কোটিতে
দাঁড়িয়েছে। কিন্তু সম্পদ বাড়লোনা,
উৎপাদন বাড়লো না, জমি বাড়লোনা,
শিক্ষা বাড়লো না কেবল বৃদ্ধি পেলো
নি:স্ব মানব সন্তান। সেই সাথে বেকারত্ব ও দারিদ্রতা। আর সরকার গুলো শুরু করলো
ভিক্ষার রাজনীতি। আমাদের অর্থনীতিকে করা হলো ভিক্ষাবৃত্তির অর্থনীতি। এদেশের
অতীতের সরকার প্রধানগণ দেশের বাইরে যেতেন হাত পাতার জন্য।
বাজেট ঘাটতি পূরণের জন্য
ভিক্ষা কিংবা বৈদেশিক ঋণের বিকল্প খুঁজে বের করতে সচেষ্ট হননি তারা। বরং ভিক্ষুকের
মত দান-খয়রাতের উপরই নির্ভরশীল হতে সচেষ্ট হন তারা, প্রসঙ্গত
বলা যায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ঝড়-বন্যা-খরা হয়। ফিলিপাইনে সবচেয়ে বেশী জলোচ্ছাস
হয়। জাপানে ঘন ঘন ভূমিকম্প হয়। কিন্তু আমাদের অতীত সরকার গুলো নিজেদের দৈন্যদশা, ঝড়-বন্যা-খরাকেই বর্হি:বিশ্বে বড় করে তুলে ধরছে যুগের পর যুগ।
বর্হি:বিশ্ব জানে বাংলাদেশ বন্যা-খরা ও বানের দেশ। ভিক্ষুকরা যেমন ভিক্ষা দাতাকে
আকৃষ্ট করার জন্য তাদের রোগাক্রান্ত অঙ্গ ভীষণ রকম উলঙ্গ করে প্রদর্শন করে, আমাদের অতীত সরকারগুলোও বৈদেশিক ভিক্ষা গ্রহণের জন্য একই নীতি
গ্রহণ করেন। আমাদের ভাল কিছু বিদেশে বা বিদেশী প্রচার মাধ্যমগুলোতে তুলে ধরা হয়নি।
বি.বি.সি, সি.এন.এন ইত্যাদি মিডিয়া গুলোতে বারবার
প্রদর্শিত হয়েছে আমাদের ঘিঞ্জি বস্তিগুলো। ঝড়ঝঞ্জা আর মানুষের সরকারী খয়রাত
গ্রহণের চিত্র। উদ্দেশ্য একটাই এসব দেখে বিদেশীরা ভিক্ষা দেবে দেশের সরকারকে।
আমাদের পূর্বের সরকারগুলোর দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই-তারা ফলাও করে ঝড়
জলোচ্ছাসের খবর বহি:বিশ্বে ছড়িয়েছে,
ভিক্ষা চেয়েছে। তারপর সেই ভিক্ষার বেশির
ভাগ অংশ নিজেদের পকেটে পুরেছে। দুর্গত এলাকায় তেমন কিছুই যায়নি, ভবিষ্যতে যাতে ঝড় বন্যার হাত থেকে বাঁচা যায় তার জন্য সুষ্ঠু
কোন ব্যবস্থাও তারা গ্রহণ করেনি। এভাবে তারা দেশের অর্থনীতিকে ভিক্ষাবৃত্তির পাঁকে
বন্দি করে দেন। মানুষের মনকে অসুস্থ সংকীর্ণ চিন্তার মধ্যে আবদ্ধ করে দেন। অর্থ উপার্জনের সবচেয়ে সহজ ও সুন্দর পথ
হচ্ছে ভিক্ষাবৃত্তি। ভিক্ষাবৃত্তির জন্য শারিরীক কিংবা মানসিক শ্রমের প্রয়োজন হয়
না। তাই নিঝঞ্জাট এই আয়ের পথে নেমে পড়ে আমাদের সরকার। আর ভিক্ষার জন্য প্রয়োজন হয়
রোগ-শোক-বালাই-মসিবৎ। আর এই ভিক্ষা
সংগ্রহের জন্যই হয়তো অতীতের সরকারগুলো ঝড়-ঝঞ্জা, রোগ-শোক, অশিক্ষা,
দারিদ্রতা স্থায়ীভাবে দুর করতে সচেষ্ট
হয়নি।
অবশ্য বর্তমান সরকার আসার পর থেকে আমরা ভিন্ন চেষ্টা দেখতে
পাচ্ছি। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ভিক্ষার বদলে বিদেশীদের বাংলাদেশে বিনিয়োগের কথা
বলছেন। বিদেশে তিনি আমাদের দেশের ভাল ও সুন্দর দিকগুলোই তুলে ধরার চেষ্টা করছেন।
তার প্রচেষ্টায় বিদেশে আমাদের ভাবমূর্তির পরিবর্তন হচ্ছে। এটা আসলে অত্যন্ত জরুরী।
প্রধানমন্ত্রির কাছে আমাদের আকুল আবেদন, আমরা আর ভিক্ষুকের জাতি হিসাবে পরিচিত হতে চাই না। আমরা
স্বনির্ভর, আত্মপ্রত্যয়ী ও মর্যাদাবান জাতি হিসেবে
পৃথিবীতে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে চাই। আমাদের অনেক পরে স্বাধীনতা লাভ করেও অনেক দেশ
আমাদের বহু উপরে উঠে গেছে। আর আমাদের সরকাররা ভিক্ষাবৃত্তির উপর নির্ভরশীল থাকার
চেষ্টা করেছেন। আমরা পিছিয়ে যাচ্ছি। আমাদের দেশটাকে ভিক্ষাবৃত্তির হাত হতে মুক্ত
করে নিজ পায়ে দাঁড় করতে হবে। বিশ্ববাসী দেখুক বাঙ্গালীরা নিজ পায়ে মাথা উঁচু করে
দাঁড়াতে শিখেছে। বাঙ্গালী এগুতে জানে,
পিছু হটতে জানেনা।
[প্রকাশ কাল: দৈনিক সিলেটের ডাক, বুধবার,
১৬ জুলাই, ১৯৯৭ইং]
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন