হিরোশিমা দিবস-আধুনিক সভ্যতার কলংক
চৌধুরী
ইসফাকুর রহমান কুরেশী
বিশ্বের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, সেই সুপ্রাচীন কাল হতে বিভিন্ন দেশে দাম্ভিক ও ক্ষমতাশালী শাসক
কিংবা জাতি কর্তৃক অন্য দুর্বল জাতি বা মানবগোষ্ঠীর প্রতি নানা অত্যাচার ও
নিপীড়নের ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। মোঙ্গর নেতা চেঙ্গিস খান মধ্যযুগে মুসলিম বিশ্বে এক
ত্রাসের সৃষ্টি করেন। তার অপরাজেয় বাহিনীর হাতে তৎকালীন সভ্যতার কেন্দ্র বিন্দু
বুখারা, সমরখন্দ, তাসখন্দ
প্রভৃতি নগর সমূহ ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। তিনি নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করেন লক্ষ লক্ষ নিরপরাধ
মানবসন্তান। তিনি তার সৈন্যদেরকে জঘন্য হত্যাকান্ড ও ধ্বংসলীলা চালানোর নির্দেশ
দেন, যাতে বিভিন্ন দেশের মানুষ ও শত্র“রা
তাকে প্রতিরোধের সাহস হারিয়ে ফেলে। তিনি মধ্যএশিয়া, পূর্ব
ইউরোপ, চীন, ইরান
প্রভৃতি দেশে মৃত্যু ও ধ্বংসের ভয়ঙ্কর এক বিভীষিকা ছড়িয়ে দিয়ে মঙ্গোলিয়ার গোবী
মরুভূমির অজ্ঞাত বনে সমাধিস্থ হন। তার পৌত্র হালাকু খান মুসলিম সভ্যতার
কেন্দ্রবিন্দু বাগদাদ নগরী ১২৫৮ খ্রীষ্টাব্দে একেবারে মাটির সাথে মিশিয়ে দেন। সেই
প্রাচীন কালে আর্যগণের ভারত আগমণের সময় জনৈক বিজেতা রাজা সিন্ধু সভ্যতার শতাধিক
নগরী (পুর) ধ্বংস করে ‘পুরন্দর বা নগর ধ্বংসকারী উপাধী গ্রহণ করেন। মোঘল রাজত্বের
শেষ দিকে ইরান সম্রাট নাদিরশাহ দিল্লীতে মারাত্মক গণহত্যা চালান। আর বর্তমান আধুনিক
সভ্যতার যুগে কুখ্যাত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রুমেন (সত্যমানব) জাপানের বন্দর নগরী
হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে যে জঘন্য হত্যাকান্ড ও ধ্বংসলীলা সংঘটিত করেন, তা বিশ্বের সচেতন মানুষকে হতবাক করে দেয়।
এই শতাব্দির প্রারম্ভে ইউরোপীয় জাতিসমূহের উপনিবেশ সৃষ্টির
সাম্রাজ্যবাদী আচরণ, নতুন নতুন উপনিবেশ দখলের তীব্র
প্রতিযোগিতা, এই প্রতিযোগিতা থেকে সমর প্রস্তুতি, পরিণতিতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মত মারাত্মক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের
সূচনা হয়। প্রায় সারা পৃথিবীতে ইউরোপীয় জাতিসমূহের উপনিবেশ বিস্তৃত থাকায় এই যুদ্ধ
সমগ্র পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে। এশিয়ায় একমাত্র জাপানই ইউরোপীয় জাতিসমূহের মত শিক্ষায়-দীক্ষায়, সম্পদে-শক্তিতে
সমকক্ষতা অর্জন করে ও এশিয়ায় উপনিবেশ বিস্তারে মনোযোগী হয়। এশিয়ায় ইংরেজ ও
ফরাসীদের উপনিবেশ থাকায় তারা জাপানের প্রতিপক্ষে পরিণত হয়। স্বার্থগত কারণেই জাপান, জার্মানী ও ইটালীর সাথে অংশ নিয়ে এশিয়ায় নিজ আধিপত্য সৃষ্টির
জন্য এই মহাসমরে অংশ গ্রহণ করে। ইতিপূর্বে ১৯০৫ সালে জাপান ইউরোপীয় শক্তি রাশিয়াকে
পরাজিত করে মঙ্গোলিয়া দখল করে নেয়। এই যুদ্ধে ইউরোপীয়দের চেয়ে এশিয়ার এই উদীয়মান
শক্তির শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইঙ্গ-ফরাসী জুটে অংশ নিয়ে
যুদ্ধে যোগদান করলে তা প্রশান্ত মহাসাগরে জাপান-মার্কিন যুদ্ধে পরিণত হয়। জাপানীরা
পার্ল হারবার আক্রমণ করে মার্কিন নৌঘাটি ধ্বংস করে দেয় এবং ইউরোপীয় জাতিসমূহের দখল
থেকে ফিলিপাইন, কুরিয়া, ইন্দোনেশিয়া
ও মালয়শিয়া হতে বার্মা পর্যন্ত অঞ্চল মুক্ত করে নেয়। ১৯৪১ সালে শুরু হওয়া এ যুদ্ধে
১৯৪৩ সন পর্যন্ত অক্ষশক্তি এগিয়ে গেলেও ১৯৪৪ সাল হতে তাদের বিপর্যয় শুরু হয়।
জার্মানী ও ইটালীর পরাজয় যখন সময়ের ব্যাপার অর্থাৎ দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ যখন সমাপ্তির
দ্বার প্রান্তে ঠিক এমনই এক মুহুর্তে ১৯৪৫ সালের ৬ই আগষ্ট তৎকালীন মার্কিন
প্রেসিডেন্ট কর্তৃক ইতিহাসের সবচেয়ে বর্বরতম ও মানুষের গা শিউরে উঠা পারমানবিক
হত্যাকান্ড এবং ধ্বংসযজ্ঞ সংঘটিত হয়।
১৯৪৫ সালের ৬ আগষ্ট। জাপানের কর্মব্যস্ত বন্দরনগরী হিরোশিমার
মানুষ তখন নিজ নিজ কাজে ব্যস্ত। এমনই এক মুহুর্তে বিমান আক্রমণ সংকেত বেজে উঠে
সারা শহরে। কিছুক্ষনের মধ্যে মার্কিন যুদ্ধ বিমান অত্যন্ত সতর্কতার সাথে নগরীর
আকাশে নিক্ষেপ করে বিশ্বের প্রথম পারমানবিক বোমা “লটল বয়”। মুহুর্তে হাজারটা সূর্য
যেন জ্বলে উঠে নগরের আকাশে। প্রায় চার লক্ষ নারী-শিশুসহ নিরপরাধ মানুষের শরীর ঝলসে
যায়। হাজার হাজার ভীত স্বস্ত্রস্ত মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়ে পার্শ্ববর্তী নদীতে। লন্ডবন্ড
হয়ে যায় নগরীর সবগুলো বাড়ীঘর। তাৎক্ষণিক মৃত্যুর কুলে ঢলে পড়ে দুই লক্ষাধিক
মানবসন্তান। কিছুক্ষণ পর শুরু হয় পারমানবিক বিকিরণ ঝড়। পারমানবিক রেডিয়েশন ছড়িয়ে
পড়ে আশপাশের বিস্তীর্ণ এলাকায়। এই জঘন্য
হত্যাযজ্ঞের পরও হত্যাকারীরা বিবেকের কোন দংশন অনুভব করেনি। মাত্র তিনদিন পর ৯
আগষ্ট একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটায়,
জাপানের আর এক শিল্পনগরী নাগাসাকিতে।
আজও এই নগরীগুলোর বেঁচে যাওয়া মানুষের পারমানবিক রেডিয়েশনের কারণে বিকলাঙ্গ ও
মানসিক প্রতিবন্ধক সন্তান জন্ম নিচ্ছে। বংশ পরস্পরায় এই অভিশাপ বহন করতে হবে মানব
জাতিকে। খ্রীষ্টের জন্মের দুই হাজার বছর পূর্বে ইটালীর পুম্পাই নগরী ভিসুভিয়াসের
লাভার স্রোতে হারিয়ে গিয়েছিল। প্রাচীন ও মধ্যযুগে বর্বর জাতি এবং শাসক কর্তৃক
অসংখ্য নগরীতে হত্যালীলা সংঘটিত হয়েছে। কিন্তু আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সভ্যতার
যুগে, বিশ্বের এক উন্নত ও শিক্ষিত দেশের
গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রধান কর্তৃক সংঘটিত এই জগন্য হত্যাকান্ডকে কি মেনে নেয়া যায়? মার্কিনরা যুক্তি দেখান,
যুদ্ধকে সংক্ষিপ্ত ও রক্তপাতকে কমানোর
জন্য এই দু’টি নগরীতে পারমানবিক বোমা নিক্ষেপ করা হয়েছে। কিন্তু এই যুক্তি গ্রহণ
করা যায় না। কারণ জাপানের পরাজয় তখন এমনিতেই অত্যাসন্ন ছিল। তাছাড়া যুদ্ধকে
সংক্ষিপ্ত করার জন্য নিরপরাধ নারী শিশু,
বৃদ্ধসহ বিশাল জনগোষ্ঠীকে পারমানবিক
বোমা মেরে হত্যা করে ফেলা বিশ্বের কোন বিবেকবান ও সভ্য মানুষ মেনে নিতে পারে না।
ইউরোপে ইহুদী হত্যার জন্য হিটলার ও নাৎসী বাহিনীকে যদি যুদ্ধ অপরাধী সাব্যস্ত করা
হয়, তাদেরকে বিচারের মাধ্যমে জেল জরিমানা
মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়- তাহলে আন্তর্জাতিক আদালতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রুমেন কেন
যুদ্ধাপরাধী হবেন না? একটা গণতান্ত্রিক সভ্যদেশের
রাষ্ট্রপ্রধান হয়ে যে মানুষটি লক্ষ লক্ষ নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করলো, সে কেন বিচারের আওতায় আসবে না। এক বিশ্বে তো দু’আইন চলতে পারে
না। সব দোষ, সব পাপ পরাজিত হিটলারের কাঁধে চাপিয়ে
দিয়ে ট্রুমেনরা শতপাপ করেও সদম্ভে টিকে থাকে সভ্যতার ত্রানকর্তা হয়ে। কিন্তু
বিশ্বের মানুষ যুগে যুগে এইসব জঘন্য হত্যাকারীদের ধিক্কার দিয়েছে। ঘৃণা করেছে।
আসলে ঘৃণাই এদের একমাত্র প্রাপ্য।
আজও বিশ্বে এই সভ্যতা বিনাশী পারমানবিক বোমা তৈরীর প্রতিযোগিতা
চলছে। কমিউনিজমের পতনের পর বিশ্বে পারমানবিক যুদ্ধের সম্ভাবনা কমে এলেও বর্তমানে
বিভিন্ন রাষ্ট্রে যে পরিমাণ এই ভয়ঙ্কর অস্ত্র মজুদ রয়েছে তা দিয়ে এই বিশ্বকে
কয়েকবার ধংস করে দেওয়া সম্ভব। আমাদের ঘরের কাছে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যেও এই
আত্মঘাতি ধ্বংসের প্রতিযোগিতা চলছে- যা এই উপমহাদেশের আবহাওয়া ও পরিবেশকে ভবিষ্যতে
ধ্বংস করে দিতে পারে। আজ সারা বিশ্বের শান্তিপ্রিয় মানুষের দাবী-বিশ্বে সমগ্র
পারমানবিক অস্ত্রের মজুদ ধ্বংস করে বিশ্বকে নিরাপদ এক শান্তির আবাসে পরিণত করা
হোক। আমরা শান্তিতে বেঁচে থাকতে চাই।
[প্রকাশ কাল: দৈনিক সিলেটের ডাক, বুধবার,
৬ আগস্ট, ১৯৯৭ইং]
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন