Pages

প্রকাশিত গ্রন্থ-সমূহ

শুক্রবার, ১৮ মার্চ, ২০১৬

বাংলাদেশের ছাত্র সমাজ ও ছাত্র রাজনীতি

বাংলাদেশের ছাত্র সমাজ ও ছাত্র রাজনীতি
চৌধুরী ইসফাকুর রহমান কুরেশী

আজকাল প্রায়ই প্রশ্ন উঠছে ছাত্রদের মধ্যে শিক্ষা ও রাজনীতি একসাথে চলা ঠিক কিনা? কারণ ছাত্রজীবন একটি মানুষের শ্রেষ্ঠ সময়। এ সময়ে ছাত্রদের প্রধান কর্তব্য হচ্ছে অধ্যয়ন। প্রতিটি ছাত্রের উচিত নিজেকে ভবিষ্যত দায়িত্ব গ্রহণের উপযোগী করে গড়ে তোলা এবং সেইজন্য প্রয়োজনীয় জ্ঞান সঞ্চয় করা। জ্ঞানার্জনের জন্য প্রয়োজন একাগ্রতা ও সুকঠিন সাধনা। জ্ঞান অর্জনের সাথে সাথে তাদের কর্তব্য দেশের জন্য নিজেদেরকে যথার্থরূপে গড়ে তোলা। তাদের যোগ্যতা ও কৃতিত্বের উপর দেশের ভবিষ্যত অনেকাংশে নির্ভরশীল। রাজনৈতিক অঙ্গনেই সৃষ্টি হয় দেশের ভবিষ্যত সামাজিক ও অর্থনৈতিক কাঠামো। তাই জীবন ও দেশকে গড়ে তুলতে একদিকে যেমন প্রয়োজন গভীর ধ্যানময় অধ্যয়ন, অন্যদিকে প্রয়োজন তীক্ষè রাজনৈতিক দৃষ্টি ও রাজনীতি সচেতন মন।
সমাজ সচেতন অংশ হিসাবে পূর্বে ছাত্রদের বিভিন্ন ন্যায় সঙ্গত অধিকার আদায়ের আন্দোলনে অংশ গ্রহণ দেশের জন্য অত্যন্ত জরুরী ছিল। অতীতের বিভিন্ন জাতীয় সংকট মোকাবেলায় ছাত্র সমাজ ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে এসেছে। বৃটিশ আমলে পরাধীনতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছিল ছাত্র সমাজ। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে মাতৃভাষাকে জীবন ও রাষ্ট্রে প্রতিষ্ঠা করার জন্য যারা প্রাণ দিয়েছিল তারা সবাই ছাত্র। উনসত্তুরে এহিয়ার স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে প্রাণ বিসর্জন করেন ছাত্রনেতা শহীদ আসাদ। একাত্তুরের স্বাধীনতা যুদ্ধেও অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিল এদেশের ছাত্র সমাজ। স্বাধীনতা লাভের পরও এদেশে যখন গণতন্ত্র, বাক স্বাধীনতা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হরণ, সামরিক শাসন ও ক্ষমতার অবৈধ জবর দখল হয়েছে তখনই ছাত্ররা প্রতিবাদ করেছে। স্বৈরাচার অপসারণের মাধ্যমে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ৯০ এর অভ্যুত্থান ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মাধ্যমে নিরপেক্ষ নির্বাচন পদ্ধতি প্রবর্তনের ৯৫ এর আন্দোলন মূলতঃ ছাত্রদের অগ্রণী ভূমিকার কারণেই সাফল্যমন্ডিত হয়।

দেশে যদি গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করে, ক্ষমতার পরিবর্তন যদি সাংবিধানিক ভাবে জনগণের রায়ে সুসম্পন্ন হয়, যদি বাক স্বাধীনতা, লিখার স্বাধীনতা ও মানবাধিকার লংঘিত না হয় তবে ছাত্রদের আর রাজনীতিতে হস্তক্ষেপের প্রয়োজন ধীরে ধীরে ফুরিয়ে আসবে। উন্নত বিশ্বের দেশগুলোতে ছাত্ররা রাজনীতিতে তেমন সক্রিয় নয়, কারণ তাদের রাজনীতিতে উল্লেখিত সমস্যাগুলো নেইএসব দেশের শাসকগণ কর্তৃক এমন কোন গুরুতর আইনের লংঘন হচ্ছে না যে ছাত্রদেরকে ক্যাম্পাস ছেড়ে রাস্তায় নেমে আসতে হবে।
ছাত্ররা দেশের সবচেয়ে বড় যুবশক্তি। রাজনীতির সাথে তারা যুক্ত হয়ে পড়লেও অল্প বয়স ও অভিজ্ঞতার অভাবে তাদের দৃষ্টি মন ও মনোযোগ পরিপূর্ণতা লাভ করতে পারেনা। সেজন্য রাজনীতির নামে তাদের বিভ্রান্ত হবার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। বিশেষ করে রাজনীতিবিদদের দলীয় স্বার্থ ও ক্ষমতা লিপ্সা ছাত্রদের পতন ডেকে আনে। তারা স্বার্থবাদী রাজনীতিবিদগণের ক্রীড়ানক হয়, বিনিময়ে কিছুই পায়না বরং নিজেদের উজ্জ্বল ভবিষ্যতকে নষ্ট করে।
বর্তমানে বাংলাদেশের ছাত্র রাজনীতি একটি বিতর্কিত ব্যাপার হয়ে ওঠেছে। শিক্ষাঙ্গনে ছাত্ররা আজকাল সন্ত্রাসমূলক কর্মকান্ড শুরু করায় ব্যাপারটি বিতর্কিত হয়ে পড়েছে। ছাত্র সমাজের একাংশ কিছুসংখ্যক স্বার্থন্বেষী রাজনীতিবিদদের হাতের পুতুলে পরিণত হয়ে নিজেরা নিজেরা সংঘর্ষে লিপ্ত। এর ফলে শিক্ষাঙ্গণ বন্ধ হচ্ছে, পরীক্ষা হচ্ছে না, লেখাপড়া হচ্ছে না, মূল্যবান সময় নষ্ট হচ্ছে, এভাবে সবচেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে ছাত্র সমাজই। বাংলাদেশের এমন কোন বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা কলেজ নেই যেখানে ছাত্র রাজনীতিকে কেন্দ্র করে রক্তপাত কিংবা হত্যাকান্ড সংঘটিত হয়নি। শিক্ষাঙ্গণগুলোতে এমন মারাত্মক সহিংস পরিস্থিতি যারা সৃষ্টি করেন, তারাই যখন আবার ছাত্রদের সদুপদেশ বিতরণ করেন ও রাজনীতি থেকে দূরে থাকার উপদেশ দেন তখন তা হাস্যকর মনে হয়। ছাত্র রাজনীতি ও সন্ত্রাস এক কথা নয়। অথচ বর্তমান ছাত্র রাজনীতিকে সন্ত্রাস এমনভাবে ছেয়ে ফেলেছে যে, ছাত্র রাজনীতি ও সন্ত্রাসকে আলাদা ভাবা অসম্ভব হয়ে পড়েছে। আর ছাত্র রাজনীতিকে সন্ত্রাসের আবর্তে নিক্ষিপ্ত করার জন্য দায়ী আমাদের সমাজের শঠ, স্বার্থান্বেষী সমাজপতি ও রাজনীতিবিদগণ ও তাদের সংকীর্ণ অসহিষ্ণু দলীয় মন মানসিকতা।
ছাত্ররা রাজনীতি করবে, তবে এ রাজনীতিকে সম্পূর্ণরূপে সন্ত্রাসমুক্ত হতে হবে। এই রাজনীতিকে দলীয় লেজুড়বৃত্তি মুক্ত হতে হবে। এই রাজনীতি হতে হবে দেশ এবং দেশের বারকোটি মানুষের জন্য। ছাত্র রাজনীতিকে কখনও কোন দল বা ব্যক্তির উচ্চাকাংখা পূরণের হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহৃত হতে দেয়া উচিত হবে না। ছাত্র রাজনীতি এমন হওয়া প্রয়োজন যে রাজনীতি হতে ছাত্ররা লাভবান হবে, ক্ষতিগ্রস্থ হবে না। যে রাজনীতি ছাত্রদের মধ্যে কোন্দল নয়, ভালবাসা সৃষ্টি করবে। হত্যকান্ডের কলঙ্ক নয়, প্রেমের বন্ধন সৃষ্টি করবে। আর যদি এমন সত্য, সুন্দর ও ভালবাসা সৃষ্টিতে ছাত্র রাজনীতি ব্যর্থ হয় তবে সেই রাজনীতির প্রয়োজন দেশবাসী কামনা করে না। এমনকি ছাত্রদেরও এমন রাজনীতি কামনা করা উচিত হবে না। কাজেই এই মহান ধারণার বশবর্তী হয়ে আমাদের মহামান্য সর্বজন শ্রদ্ধেয় রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাহাব উদ্দিন আহমদ কিছুদিন পূর্বে এক বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে ভাষণ দানকালে সবগুলো রাজনৈতিক দলকে ছাত্রদেরকে তাদের লেজুড় হিসাবে ব্যবহার না করার জন্য আহবান জানিয়েছেন। আসুন আমাদের মহান রাষ্ট্রপতির আহবানে সাড়া দিয়ে সন্ত্রাসমুক্ত সত্য সুন্দরের ছাত্র রাজনীতি গড়ে তুলি। দলীয় লেজুড় ভিত্তি পরিহার করে দেশ ও বারকোটি মানুষের জন্য আমরা ছাত্ররা ভালবাসার রাজনীতি গড়ে তুলি।


[প্রকাশ কাল: দৈনিক সিলেটের ডাক, শুক্রবার, ৪ জুলাই, ১৯৯৭ইং]

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন