সিলেট পৌরসভা থেকে মহানগর
সি.আই.আর.
কুরেশী সেফাক
আমাদের প্রিয় শহর সিলেট। আমাদের শিক্ষা ও কর্মজীবনের পুরোটা
অংশজড়িয়ে আছে এইশহরে। এই ছোট্ট সুনদর শহরটিকে আমরা যেমন প্রাণ ভরে ভালবাসি, তেমনি এই শহরটিাকে ঘিরে স্বপ্ন দেখি অনেক অনেক। সুরমা পারের এই
সাত/আট শতবৎসরের পুরানো জনপদটি বাংলার অন্যতম প্রাচীন নগরী। ঐতিহ্যে ও প্রাচীনত্বে
এই নগরটি সোনারগাঁও, ঢাকা, চট্টগ্রাম
তথা বাংলাদেশের যে কোন প্রাচীন নগরের সাথে তুলনীয়। মধ্যযুগের বিখ্যাত পব্রিাজক
ইবনে বতুতা দিল্লী, সোনারগাঁও পার হয়ে এই নগরীতে এসে মহান
সাধক হডরত শাহজালালের (রহঃ) সাথে স্বাক্ষৎ করেন এবং তার ‘রিসালা’ গ্রন্থে উল্লেখ
করেন যে, সিলেট ভ্রমণের মাধ্যমেই তার ভারতসবর্ষ
ভ্রমণ পূর্র্ণতা লাভ করে। আমাদের লেখার উদ্দেশ্য কিন্তু ইতিহাস নয়, বরং এই শহরের মর্যাদাও গুরুত্ব নিয়ে আলোকপাত করাই আসল
উদ্দেশ্য।
আজকের সিে লট শহর হচ্ছে বাংলাদেশের পঞ্চম বৃহৎ নগরী। আয়তন ও
লোকসংখ্যার ভিত্তিতে চার বিভাগীয় শহর-ঢাকা,
চট্টগ্রাম, খুলনা ও রাজশাহীর পরই এই শহরের অবস্থান।বাংলাদেশকে আমরা যদি
একটি ভবন হিসাবে কল্পনা করি তাহলে উক্ত ভবনের ছয়টি ভিত্তি খুঁটির একটি হবে এই
সিলেট। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এই অঞ্চলের অবদান ঢাকা ও চট্টগ্রামের ঠিক পরেই।
অর্থাৎ দেশের তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক জোন হচ্ছে এই সিলেট। কিন্তুু দেশের এই
তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলের কেন্দ্রস্থল এখনও মহানগরে রাপান্তরিত হয়নি। এখনও
আমাদের মর্যাদা ও অবস্থান পৌরসভার পর্যায়ে রয়েছে। অথচ এই সিলেটের ৪/৫ লক্ষ মানুষ
বাংলাদেশ সরকারের বৈদেশিক মুদ্রার প্রধান যোগান দাতা। পাট ও চামড়ার পরই প্রধান
রপ্তানী কৃষিপণ্য চায়ের উৎপাদকারী হচ্ছে এই অঞ্চল। বাংলাদেশেল প্রধান প্রধান খনিজ
সম্পদের সঞ্চিত ভান্ডারও এই অঞ্চল। রাজশাহী বিংবা খুলনার চেয়েও দ্রুত গতিতে এই
অঞ্চলের অর্থনীতি বিকশিত হচ্ছে। দেশের অর্থনীতিতে ভবিষ্য্যতে এই অঞ্চলের গুরুত্ব
আরও বর্র্ধিত হবার অপার সম্ভাবনা রয়েছে।
খুবসম্ভব শিঘ্রই সিলেট মহানগর হতে যাচ্ছে। বিগত আওয়ামীলীগ
সরকার দুই বিভাগীয় শহর বরিশাল ও সিলেটকে পৌরৈসভা থেকে মহানগরে রূপান্তরের
সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। কিন্তু তা বাস্তবায়নের সময় ও সুযোগ তারা পাননি। কাজেই এই দুই
নগরীকে মহানগরে রূপান্তরের সার্বিক দায়িত্ব এসে পড়েছে বর্তমান জোট সরকারের উপ। জোট
সরকাওে এ ব্যাপারে জোর তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। খুব সম্ভব আগামী ২/৩ মাসের মধ্যেই এই
দ্ইু নগরীতে মেয়র নির্বাচনও অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে।
একজন গরীব মানুষের পুত্রের নাম শাহজাদা রাখলেই সে শাহজাদা হয়ে
যায় না, তদ্রƒপ
সিলেট শহরের পদবী পৌরসভা থেকে মহানগর করলেই চলবে না। বরং কিভাবে এই শহরেটাকে
সত্যিকারের মহানগরে রূপান্তর করা যায়। এই ব্যাপারে আমাদের যতœশীল হতে হবে। আমাদের এই প্রিয় শহরটি এখন এক জায়্যগায় দাঁড়িয়ে
নেই। আকারে-আয়তনে দ্রƒত বর্ধিত হচ্ছে। বর্তমান যুগকে বলা নগর
সভ্যতার যুগ। শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও অর্থনীতি নগরকে কেন্দ্র করে
আবর্তিত হচ্ছে। শহরের আশপাশে হাউজিং প্রকল্প ও উপশহর গড়ে উঠছে। আমরা যদি সুনামগঞ্জ
রোড দিয়ে অগ্রসর হই তবে দেখতে পাব তপোবন আবাসিক প্রকল্প, সুরমা আবাসিক প্রকল্প ইত্যাদি এই দিকে শহরকে প্রসারিত করছে।
অনুরূপভাবে দিগন্ত, বলাকা, শহীদ
এম.আর চৌধুরী প্রকল্প ইত্যাদির মাধ্যমে বটেশ্বর সেনা নিবাসের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে
শহর। পর্যটন হোটেল সংলগ্ন নীাচল আবাসিক প্রকল্প, বাগবাড়ী
শামিমাবাদ আবাসিক প্রকল্প ইত্যাদি শহরটাকে মাইলের পর মাইল প্রসারিত করছে। একটি
শহরের গুরুত্ব নির্ভর করে শহরটির আয়তন,
জনসংখ্যা ও অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের উপর।
কাজেই আমদের এই মহানগরে গরুত্ব বাড়াতে হলে প্রয়োজন যত বেশী সম্ভাব এলাকাকে প্রথমেই
মহানগরে অন্তর্ভুক্ত করে নেওয়া। শহরের উপকষ্ঠে সমুদয় এলকাকে যথাশ্রীঘি সম্ভব
শহরভুক্তি করতে হবে। উত্তর সুরমায় উত্তরে সেনানিবাস, সুনামগঞ্জ
রোডে টুকের বাজার এবং বিমানবন্দর পর্যন্ত যতবেশী সম্ভব এলাকা মহানগরীভুক্ত করতে
হবে। সাথে সাথে এই মহানগরীতে দক্ষিণ সুরমা এলাকার ব্যাপক অঞ্চলকেও অন্তভুক্ত করতে
হবে। দক্ষিণ সুরমায় ভবিষ্যতে গুরুত্বপূর্ণ সরকারী স্থাপনা ও ব্যক্তি উদ্যোগে
আবাসিক প্রকল্প গড়ে তুলতে হবে। বর্তমানে দক্ষিণ সুরমায় বিনিয়োগকারীরা এগিয়ে
যাচ্ছেন। ইতিমধ্যে চন্ডিপুলে নর্থউস্ট মেডিকেল কলেজ ও শ্রীরামপুর ড্রিমল্যান্ড
পার্ক ব্যক্তি উদ্যোগে স্থাপিত হয়েছে। বিনিয়োগকারীদের সাহায্য ও সহযোগিতায় স্থানীয়
জনগণ এগিয়ে আসলে বিনিয়োগ আরও বাড়বে এবং দক্ষিণ সুরমার উন্নয়ন আরও ত্বরান্নিত হবে।
বর্তমান কুচাই ইউনিয়েনে বিভাগীয় অফিস স্থাপিত হয়েছে। দক্ষিণ সুরমার কুচাই, বরইকান্দি,
তেতলী ও সিলাম, এই চারটি ইউনিয়ন আজ কিংবা কাল হোক সিলেট মহানগরের আওতায় আনতে
হবে। কারণ এই অঞ্চলের শহর ভুক্তি এখন সময় তথা যুগের দাবী। সময়ের দাবীকে অস্বীকার
বুদ্ধিমানের কাজ নয়। যুগের দাবীকে এক সময় সবাইকে মেনে নিতে হয়। কজেইে বিষয়টাকে
আগেভাগে মেনে নেওয়াই দূরদর্শীতার পরিচায়ক।
আমরা মহানগরকে যতই বর্ধিত করতে পারবো ততোই জনসংখ্যাও বৃদ্ধি
পাবে। সরকার ও দেশবাসীর কাছে বেশী আয়তন ও জনসংখ্যারনগরী হিসাবে উক্ত মহানগরে
গুরুত্ব বৃদ্ধি পাবে। উপরোক্ত অঞ্চলসমূহ যথাযত ভাবে সিলেট মহানগরে অন্তভুক্ত হলে
‘সিলেট মহানগরী’ রাজশাহীর চেয়ে বৃহৎ নগরীতে পরিণত হবে। অর্থাৎ সিলেট মহানগরী
রাজধানী ঢাকা, বন্দরনগরী চট্টগ্রাম ও খুলনা পর তার
অবস্থান নির্ধারণ করতে সক্ষম হবে।
সিলেট শহর বর্তমানে সিলেট বিভাগের প্রধান শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও ব্যবসা কেন্দ্র। শাহজালাল বিম্ভবিদ্যালয় ছাড়াও
জনাব কুতুব উদ্দিনের আর্থিক আনুকুল্যে সিলেট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি ও জনাব
রাগীব আলীর উদ্যোাগে লিডিং ইউনির্ভাসিটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে
ওসমানী মেডিকেল কলেজ হসপিটাল ও সদর হসপিটাল ছাড়াও রাগীব-রাবেয়ে মেডিকেল কলেজ
হাসপাতাল ও নর্থ ইস্ট মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সুইট সাহেবের
প্রচেষ্ঠার ধুপাদিঘীতে ওসমানী উদ্যান ও পার্ক হয়েছে। বিনিয়্যোগকারীদের প্রচেষ্টায়
আল হামরা, মানরুর মত অত্যাধুনিক শপিং কমপ্লেক্স
স্থাপিত হয়েছে। এই পৌরসভাকে মহানগরে রূপান্তরে বিনিয়োগকারীদের উদ্যোগ সমূহ অবশ্যই
অবদান রাখবে। সিলেটে উন্নয়নমূলক যে কোন অবদানকে আমরা স্বাগত জানাই। এই বিভাগে এখনও
কোন কৃষি কলেজ কিংবা বি.এস.সি. ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ নেই। সরকারে উচিত দেশ ও এই
অঞ্চলের মানুষের স্বার্থে সিলেটে অতিসত্বর বি.এস.সি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ ও একটি কৃষি
কলেজ স্থাপন করা। যোগাযোগ ব্যবসঋার উন্নয়ন ও শহরের যানজট নিরসরে জন্য এই শহরের
পূর্ব ও পশ্চিম দিকে সুরমা নদীর উপর আরও দু’টি সেতু নির্মাণ ছাড়াও বৃটিশ আমলে
নির্মিত ঝুঁকিপূর্ণ ক্বীনব্রীজ অপসারণ করে উক্ত স্থানে চার লেন বিশিষ্ট বৃহৎ আকার
সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হউক। সিলেটে একটি চিড়িয়াখানা ও বোটাণিকেল গার্ডেন
প্রতিষ্ঠা করাও মানুষের প্রাণের দাবী। এ ব্যাপারে সরকারের দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন।
প্রবাসীরা হচ্ছেন সিলেট শহরের অর্থনীতির প্রাণ। সিলেটের
অর্থনীতিকে টিকিয়ে রাখার জন্য কেবল প্রবাসীদের দিকে তাকিয়ে রইলে চলবে না। ভারতে
দক্ষিণাঞ্চল অর্থাৎ কেরালা ও কর্নাটক প্রবাসী বহুল অঞ্চল। আর এই প্রবাসী বহুল
অঞ্জলের কেন্দ্রীয় নগরী হিসাবে ব্যাঙ্গলুর আই.টি.সিটি হিসাবে গড়ে উঠেছে। তদ্রƒপ সিলেট ও প্রবাসী বহুল অঞ্চল। এই অঞ্চলের মানুষ উন্নতবিশ্বের
বিভিন্ন অঞ্চল, যেমন যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র কানাডা ইত্যাদি দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছেন। তাছাড়া
শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার প্রযুক্তি বিভাগ ও উক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের
স্বনামধন্য প্রফেসর ডঃ জাফর ইকবালেরও স্বপ্ন হচ্ছে এই সিলেটকে বাংলাদেশের
আই.টি.সিটি হিসেবে রূপায়ন। প্রয়াত সম্মানিত স্পীকার হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী সিলেটে
সাইবার সিটি প্রতিষ্ঠায় স্বপ্রচেষ্ট ছিলেন।
তিনি জাপানী বিনিয়োগকারী প্রতিনিধি দলকে সিলেটে নিয়েও এসেছিলেন সিলেটে একটি
তথ্য প্রযুক্তি অঞ্চল প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে। কিন্তু পরবর্তীতে তা চাপা পড়ে যায়।
সিলেটকে বাংলাদেশের তথ্য প্রযুক্তি নগরীতে রূপান্তরে বর্তমান অর্থমন্ত্রী এম.
সাইফুর রহমান এগিয়ে আসবেন-এ আশায় সিলেটবাসী তার দিকে তাকিয়ে রয়েছেন।
সিলেট মহানগরী হবে। কোন এক ভাগ্যবান ব্যক্তিত্ব প্রথম মেয়ের
হয়ে আসবেন। আমরা আশা করবো এই নগরী একদিন বাংলাদেশের একটি শ্রেষ্ঠ নগরে পরিণত হবে।
সেই সাথে এই মহানগরী বাংলাদেশের রাজনীতি,
অর্থনীতি, শিক্ষা, বাণিজ্যে আরও অবদান রাখতে সক্ষম হবে। পর্যটন ক্ষেত্রেও উক্ত
নগরীর বিকাশের অপার সম্ভাবনা রয়েছে। বাংলাদেশের একমাত্র জলপ্রপাত মাধবকুন্ড, জাফলং ও ভারতের সাথে ট্রেনজিট স্থাপিত হলে সেভেন সিষ্টারের
সংযোগ পয়েন্ট হবে। এই মহানগরীর অবস্থান। হযরত শাহজালালের (রহঃ) ও শাহপরানের (রহঃ)
মাজার ধর্মপ্রাণ লোকদেরকে এই শহরে সব সময় হাতছানি দেবে। ভবিষ্যতে এই মহানগরীর
ভাগ্য ও সম্ভাবনা উজ্জ্বল।
[প্রকাশ কাল: দৈনিক সিলেটের ডাক, ২ জুন,
২০০২ইং]
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন