Pages

প্রকাশিত গ্রন্থ-সমূহ

শনিবার, ১৩ জানুয়ারী, ২০১৮

রাতারগোলের ভূত

কবি লেখক ব্লগার ও পূবালী ব্যাংকার চৌধুরী ইসফাকুর রহমান কুরেশী
আমি একজন সামান্য লেখক ও কবি। অফিসের বড়কর্তা আমি রাতারগোল জলাবন দেখতে এলাম সাথে এক বড় লাটবহর নিয়ে। আমার অফিসের লোকজনতো আছেনই সেইসাথে কয়েকজন সম্মানিত মেহমান। বাদক বাদিকা ও গায়ক গায়িকার একদল বাউল নিয়ে শরিক হন সুমিষ্ট কোকিলকন্ঠি  গায়ক শাহ্রুর রেজা। বাজনার তালে তালে বড় বাসটা সাহেববাজার পার হল। আমাদের লোকজনে পনেরটি নৌকা ভরে গেল। সবকটি নৌকা রাতারগোল জলাবনের মাঝে পাশাপাশি হিজল করস ছায়ায় নোঙ্গর করল। ঢোল করতালের তীব্র নিনাদে বাউল করিম হতে শুরু করে আমি বড়স্যারের লেখা গানও গাইতে লাগলেন শাহরুর রেজা ও তার দল। জলাবনের মাঝিমাল্লা ও মাছ শিকারীরা এসে চারপাশে জড় হল। রেজার দল গাইতে গাইতে ক্লান্ত, এবার গান শেষ, গল্পের পালা। আমরা এত এত খাস বাঙ্গাল এখানে জমায়েত হয়েছি যে কেচ্ছা ছাড়া কি কারো পেটে ভাত হজম হয়।
লোকে আমাকে বলল সাহেববাড়ির আমুদাদার কাহিনি। আমুদাদা কয়েকপুরুষ ধরে রাতারগোল জলাবনের পাশের গ্রামের সাহেব বাড়ির পিছনের গভীর বনে বসবাস করতেন। আদিকালের বড় বটগাছটা ছিল তার আসল ঠিকানা। সুখ দুঃখ আনন্দ ব্যদনায় এবাড়ীর লোকজনের সাথে তিনি মিশে আছেন কয়েক যুগ ধরে। তিনি এবাড়ির ছোট ছোট বাচ্চাদের সাথে খেলা করেন, হাসিঠাট্টা করেন। এবাড়িতে রাতে কোন চোর ঢুকতে পারেনা, আমুদাদা পাহারা দেন। চোর ডাকাত এলে ঘরের ছাদের টিনে ঢিল ছুড়ে গৃহস্থকে জাগিয়ে দেন। আমুদাদা কালো সাপের সুরত ধরেও রাতে এবাড়ি পাহারা দেন। আসংখ্য লোক আমুদাদাকে রাতে সর্পবেশে ঘুরতে দেখেছে। 
বাড়িতে কোন নুতন শিশুর জন্ম হলে সন্ধ্যার পর বারান্দায় রাখা হয়। রাতে আমুদাদা এসে দেখে যান, প্রমাণ স্বরূপ আমড়া কলা কিছু একটা উপহার রেখে যান। বাড়ির লোকজন আমুদাদাকে ভালবাসে। এবাড়িতে নতুন বউ এলে আমুদাদাকে সালাম দিতে হয়, এটা এবাড়ির কয়েক পুরুষের রেওয়াজ। হালিমা বানু যখন এবাড়িতে প্রথম এলেন তাকে বলা হল নববধুর পোষাক পরে গভীর রাতে বটগাছের তলায় যেতে হবে। হালিমা  ভীষণ ভয় পান, আমুদাদার ভয়ে  তার অন্তরাত্মা  জমাট বেঁধে বরফ হয়ে যায়। অন্ধকার বন কাপিয়ে আমুদাদা এলেন। গায়বি আওয়াজ শুনা গেল, 'কোকিল সুন্দর হয় সুমধুর গানে, সংসার সুন্দর হয় রমণীর গুণে'। আমুদাদা তার উপস্থিতির প্রমাণ দিলেন, ধড়মড় করে বটগাছের একটি ডাল হালিমার সামনে ভেঙ্গে পড়ল। হালিমা ভয়ে জ্ঞান হারাল। পরদিন হালিমার জ্বর হল, সে প্রলাপ বকতে লাগল।
তিনি আমেনা বিবি, তার বড়পুত মতি মিয়া। তাই মতির মা  নামেই আশপাশের লোকালয়ে  তার পরিচয়। এই অজপাড়া গায়ে ডাক্তার নেই, হাসপাতাল নেই। এলাকার কোন মহিলার বাচ্চা প্রসবের ব্যদনা শুরু হলেই মতির মার ডাক পড়ে। বাচ্চা প্রসবের আপদক্ষণে তাই মতির মা ই  এলাকার শেষ ভরসা। মানুষের বিপদকালে মতির মা বসে থাকতে পারেন না। রাতবেরাতে যখনই ডাক আসে তিনি বেরিয়ে পড়েন। খালাস বাচ্চার কান্না শুনামাত্র মতির মার বুকটা এক বেহেশতি আনন্দে ভরে উঠে।
একদিন মধ্যরাতে মতির মার ঘরের দরজার কড়া নড়ে উঠে। দরজা খুলতেই একটা অজানা লোক অনুনয় বিনয় করে বলে,  বড় বিপদে পড়ে এসেছি মা আপনার সাহায্য দরকার। আমার বউয়ের বাচ্চা হবে, অসহ্য যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। মানুষের বিপদে দৌড়ে বের হওয়া মতির মার নেশা। ভাই কোন চিন্তা করবেন না আমি এখনি বেরুচ্ছি, বলে আগপিছ কিছু না ভেবেই মতির মা বেরিয়ে পড়েন। লোকটি মতির মাকে নদীঘাটে নিয়ে যায়। অচেনা লোকটার ছোট্ট ডিঙ্গিতে উঠেন বিগত যৌবনা পৌড় বয়সী  মতির মা। ডিঙ্গির নিশানা রাতারগোল, লোকটা বৌঠা বেয়েই যাচ্ছে কিন্তু দীর্ঘপথ শেষ হচ্ছেনা দেখে মতির মার মনে অজানা ভয় জেগে উঠে। মতির মা জানতেন ভূতেরা আগুনের তৈরী তাই ভূতের ছায়া নেই। পূর্নিমার পরিস্কার আলোয় মতির মা চেয়ে দেখেন মাঝির কোন ছায়া নেই। এবার মতির মা নিশ্চিত হন তিনি ভূতের নৌকায় আছেন। নির্জন রাতে অজানা আতংকে তার অন্তরাত্মা শিউরে উঠে। মতির মা ভয়ে 'সোবহান আল্লাহ' জপে জপে সময় পার করতে থাকেন। এক অজানা বনে নৌকা থামে। মতির মা সাহসী মহিলা। মনে মনে ভাবেন এখানে সাহস হারালে চলবেনা, সামান্য ভূল হলে পৈত্রিক প্রাণটা খোয়াতে হবে। মতির মা ডিঙ্গি হতে নেমে লোকটাকে নীরবে অনুসরন করতে থাকেন। বনের মধ্যে ভূতের গ্রাম। অসংখ্য ছোট ছোট খেলনা ঘর। প্রতিঘরে কার্টুন আকৃতির বিচিত্র ছায়া-মানুষ। এই ছায়া-মানুষরা  মতির মাকে খুব সম্মানের সহিত আতুরঘরে নিয়ে যায়। 
মতির মা ভয়ে ভয়ে কাজ শুরু করেন। প্ৰসূতি মায়েব পেট হতে একে একে অগুনতি বাচ্চা বেরিয়ে আসে। নীরব ভূতের গায়ে আনন্দের বন্যা বয়ে যায়। এবার মতির মা লোকটাকে ফেরার তাগদা দেন। আবার সেই ডিঙি নায়ে ফিরে আসেন বাড়ির ঘাটে। ভূত দেখার চেষ্টা করলে ক্ষতি হয়। তাই মতির মা ডানবামে না তাকিয়ে সোজা দৌড়ে ঘরে ঢুকে চিৎপটাং হন। চিরকৃতজ্ঞ লোকটা এক পুটলীতে সামান্য মাছ ও একটি শাড়ি ঘরের বারিন্দায় রেখে ছায়ায় হারিয়ে যায়। পরদিন মতির মার গৃহে গতরাতের গলপ শুনতে লোকের ভীড় জমে যায়। ভূতেরা মতির মাকে কিছুই করে নি বরং যথেষ্ট খাতিরযত্ন করেছে, কিছু উপহারও দিয়েছে। সবাই ভাবে এতো ভাল জাতের জীন, হয়তবা জীন্নে মুমিন। 
মুরব্বিরা বললেন, এই জীন্নে মুমিনরা পাশের গায়ের পীর সাহেবের মুরিদ হয়। রাতে হুজুরের হাত-পা টিপে দেয়, হজুরের পাশে কেউ ঘুমালে স্পষ্ট টের পান, জীনের হিমশীতল হাতের পরশ পেয়ে ভয়ে চীৎকার করে উঠেন। লোকে অজানা ভয়ে পীর সাহেবের কুটিরে ঘুমায়না। হুজুরের বিবিগনের শোবার কোঠা জীন্নে মুমিনের ভয়ে তাবিজ দিয়ে পীর সাহেব বন্ধ করে দেন। 
একবার পাশের মাদ্রাসায় এক তালবা পড়তে আসে, তার নাম রহমত আলী। সবাই মনে করত সে বেওয়ারিশ টুকাই বালক। তাই কেউ তার বাড়িঘরের খবর নেয়নি। সে এতিমখানার ছাত্ৰদের সাথে মিলেমিশে বহু বছর লেখাপড়া করে। ছেলেটা ভদ্র ও মেধাবী, তাই বড় হজুরেরও অতি প্রিয় ছাত্ৰ সে। একদিন রাতে বড় হুজুরের নারকেল খাবার স্বাধ জাগে, এমনি সে ছাত্ৰটা জানালা দিয়ে হাতটা বের করে। বড় হুজুর দেখলেন হাতটা লম্বা হতে হতে উচু নারকেল গাছটার আগায় পৌছে গেছে। নারকেলের কাদিটা হুজুরের সামনে পড়তে না পড়তেই তিনি ভয়ে চীৎকার করে জ্ঞান হারান। সবার সামনে একটি কালোবিড়াল একলাফে বের হয়ে অন্ধকারে মিলিয়ে যায়। এতকাল একসাথে বসবাস করেও সহপাঠিরা ঘুনাক্ষরেও বুঝতে পারে নি তাদের সহপাঠি একজন জীন্নে মুমিন। যেদিন চিনল সেদিন সে উধাও। অনেক খোজাখোজি করেও তাকে আর পাওয়া যায় নি।
জলাবনের পাশের তালুকদার বাড়ির কিশোরী সকিনা। নাদুসনুদুস ফর্সা মেয়ে। বাড়ির বাথরুম বাইরে, রাতে ঘর থেকে বেরিয়ে একটু দূরে সে বাথ্রুমে যায়। এসেই জ্বর হয়, আবোল তাবোেল বকতে থাকে, পরে সে ঘুমিয়ে যায়। কিছুদিন আগে একটি জবাফুল গাছ লাগানো হয়েছে। পরদিন গাছটিতে একটি সুন্দর লালজবা ফুটে। প্ৰথম ফোটা ফুল দেখে সবাই আনন্দ ফূর্তি করছেন। সকিনা এসে ফুলটির পানে তাকিয়ে চিৎকার করে  বলল, ফুলটির উপর এক ব্যাটা দাড়িয়ে হাসছে। কে একজন ফুলটি ছিড়ে ফেলে দেন। এবার তার চিৎকাৰ থামে কিন্তু কিছুক্ষণ পর আরেক বিপদ শুরু হয়। সকিনা আবুল  তাবুল বকতে থাকে। তার কথা-বলা আর থামে না। লোকে বলল তাকে বড়টায় ধরেছে। বড় হুজুর  ছাড়া কাজ হবে না। হুজুর এলেন, কাগজে কিছু হিজিবিজি রেখা টানলেন। চারপাশে তাৰিজ  পোতা হল। বড়হুজুর পুরানো ঝাড়ু দিয়ে সকিনার গায়ে আঘাত করলেন। কয়েকটি ঘা মেরে বাজখাই গলায় বললেন, মহ শালার শালা, তুই কেন ওকে ধরেছিছ। সকিনা বলল  হুজুর ওর রূপ দেখে আমার মন মজে যায়, তাই ওকে ধরেছি। হুজুর বললেন তোর ঠিকানা কি। সকিনা বলল রাতাৱগোল। তোর পরিচয়? সকিনা বলল আমি তালেবপুরের আমির আলীর নামহীন জারদ পুত্ৰ। আমার জন্মদাতা আমির আলীর ভাই সিফত আলী মুক্তিযুদ্ধে মারা যান। আমির আলী আমার মায়ের ঘনিষ্ট হন, সংগোপনে আমি ভূমিষ্ট হই। জন্মের পরমুহুর্তে চাচা আমির আলী আমাকে বস্তায় পুরে নৌকায় করে ভোর রাতে বাদাবনের পেনার নিচে গোপনে পুতে আসে। জন্মের পরদিন হতে আমার আত্মাটা বের হয়ে এই জলাবনে ঘুরে বেড়াতে থাকে। আজ অবধি রাতাৱগোলের এই জলাবনেই আছি। তবে এবনের অন্য জীনেরা আমাকে ঘেন্নায়। তাৱা বলে আমি নাকি নষ্ট জন্মের ফসল। আমার সামাজিক মৰ্যাদা তারা একধাপ নিচে নামিয়ে আমার নাম দিয়েছে প্রেত। বনে কেউ আমার সাথে মিশতে চায় না, তাই রাতে মাঝে মাঝে একাকি চলে আসি তালুকদার বাড়ি। রাতে সকিনাকে দেখে আমার মাথাটা বিগড়ে যায়। আমি তার রক্তের মাঝে ঢুকে পড়ি। বড়হুজুর একটি শিশি বের করেন। হজুৱ এবার সুরে জীন পড়ে বললেন, মহ শালার শালা প্রেত, তুই যদি সকিনাকে ছেড়ে না যাস তবে এই শিশিতে পুরে রাতাগোলের প্যাকে পুতে দেব। হুজুরের লাল লাল আগুন চোখ দেখে ভূতটার প্রাণে কাপুনি এসে যায়। হুজুর যেন ভূতটাকে পেলে চিল্লা কাইট্টা তার গায়ে মরিচগুড়ো ছিটাবেন। প্রেতটা ভয়ে সকিনার কন্ঠে হাতজোড় করে চিৎকার করে উঠে, আমাকে মাফ করেন, আমাকে আপনার শিশিতে পুরবেন না হুজুর। আমি চলে যাব। আর কোনদিন এখানে আসব না। আমি চলে যাচ্ছি, আমি চলে  যাচ্ছি, বলে সকিনা মুর্চ্ছা যায়। যখন সকিনায় সংজ্ঞা ফিরে সবাই দেখে সকিনা সম্পূৰ্ণ সুস্থ্য কিশোরী। 
সবশেষ গল্পটি বললেন একজন মাঝি, গল্পটি তার পাশের বাড়ির বড়মিয়ার। বড়মিয়া বড়লোক, তার বড়বাড়ি বড়দিঘি। বড়মিয়ার ধন আছে তো জন নেই। একটি মাত্ৰ ডাউস মাইয়্যা রেখে বড়মিয়া মারা যান। মাইয়্যাটা বিয়ে হলে চলে যায় শহরে। কয়েকজন বুয়া নিয়ে মিয়ারবৌ বিরাট বাড়িতে একা একা দিন গুজরান করেন। বেশ সুখশান্তিতে তার দিন যাচ্ছে। তখনকার দিনে গায়ে বিজলী বাতি ছিল না, রাতে কেরোসিন লন্ঠনে মৃদু আলোই ছিল ভরসা। কয়েকদিন ধরে একটা কাক ও একটা কোকিল রাতে বাড়িতে ভীষণ ডাকাডাকি শুরু করে। রাত বাড়লে কাক-কোকিলের গান তীব্র থেকে তীব্র হতে থাকে। দিনে সাড়া শব্দ নেই অথচ রাতে তাদের প্রচণ্ড নিনাদে বাড়ির সবাই অতীষ্ট হয়ে উঠেন। মিয়ারবৌ বারান্দায় বের হয়ে অন্ধকারে এসার নামাজের জন্য অজু করছেন। সবার কান জ্বালাপালা করছে, আর কাহাতক সহ্য হয়। মিয়ারবৌ সামনের বড় গাছটির দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে বললেন, ও শালার কাউয়া-কুলীরে, তোমরা রে দিনের বেলা পাইলে ভাল করে ঢিল দিতাম, লম্বাবাশের গল্লা দিতাম। 
অজু শেষ হতে না হতেই মিয়ারবৌর সামনে এসে বেশ কয়েকটি ঢিল পড়ে। মিয়ারবৌ অজুর বদনা ফেলে রেখে  দৌড়ে ঘরে ঢুকে কপাট বন্ধ করে দেন। এবার টিনের ছাদেও ঢিল পড়তে থাকে,  ঢিলের পর ঢিল, শত শত ঢিল। এবার মিয়ায়বৌ  কাতর হন। দুহাত জোড় করে মাফ চান, অনুনয় বিনয় করে বলেন, আমি আপনাদেরে চিনতে পারি নাই, চিনলে কখনও এমন অসভ্য কথা বলতাম না। মিয়ার বৌয়ের মিনতিতে কিছুক্ষণের জন্য ঢিল বন্ধ হল, সবাই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। এমন সময় পাশের গোলাঘরের ভিতর ভীষণ হাল্লাগোল্লা শুরু হল। কেরাশিনের টিনগুলো একে অন্যকে আঘাত করতে থাকে। পাশের কোঠায় নরক নেমে আসে। এবার মিয়ারবৌর শোবার ঘরেও ঢিল আসা শুরু হয়। মিয়ারবৌ ভয়ে তিনজন বুয়াসহ তোষকের তলায় আপাদমস্তক ঢুকে পড়েন ও সুরা একলাস পড়ে পড়ে বিনিদ্র রাত কাটান। 
খুব ভোৱে ঢিল পড়া বন্ধ হলে মিয়ারবৌর ভীতসম্ভস্ত্র বুয়া গিয়ে আব্বাহুজুরের দরবারে হাজির হন। মিয়ারবৌর চাচাজান আব্বাহুজুর গতরাতে ভাতিজির দুঃখের কথা শুনে রাগে অগ্নিশৰ্মা হয়ে ছুটে আসেন। আব্বাহুজুরের  তর্জন গৰ্জনে মনে হচ্ছিল জীনদেৱে পেলে তিনি কেটে টুকরা টুকরা করে ছাড়বেন। এসেই বললেন, তবে রে হারামজাদা, আমার মেয়েটারে রাতে তোরা ঘুমাতে দিছ নাই। এবার মজা দেখাব। আব্বাহুজুর বাড়ির সীমারেখা বরাবর অসংখ্য তাবিজ পুতে দেন। সারাটা বাড়ি তিনি জীনের জন্য বন্ধ করে দেন। পরদিন হতে বাড়িতে আর কাক-কোকিলের উৎপাত নেই। 
ভারতের খাসিয়া জৈন্তিয়া পাহাড় হতে নেমে এসেছে এক ছোট নদী। এসে ঢুকে পড়েছে বাংলাদেশের এক জলাবনে। কয়েকশত একর বনের মধ্যে করচ হিজলের ফাকে ফাকে অজস্র খাল জালের মত ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। স্বচ্ছ জলে হিজলবনের আলোছায়া খেলা করে যায়। অনেক দূরে লোকালয় ও গ্রাম। নৌপথে ডিঙ্গি বেয়ে লোকেরা এই বনে আসে। ঘাস তুলে, কাঠ কাটে, মাছ ধরে সন্ধ্যা নামার আগেই ফিরে যায় ঘরে। শহর হতে লোক এসে সুন্দর জলাবনটি নৌকায় ঘুরেফিরে দেখে দিনে দিনেই চলে যায়। 

একজন  গ্রামবাসীর নিকট শুনলাম ঐ জলাবনটি নাকি ভূতের বিচরণভূমি। এদিকে রাতে ভয়ে কেউই পা মাড়ায় না। রাতে ভূতের আলোয় সারাটা বন ঝিকিমিকি করে, ভীতিকর কিছু বিভৎস্য রহস্যময় শব্দ পাখি তাড়ায়। গভীর রাতে ভূতেরা নাকি ডিঙ্গি নিয়ে ঘাটে আসে, মানুষকে তাদের নৌকায় উঠার জন্য অনুনয় বিনয় করে। ভুতেরা দলে দলে নৌকায় আলোর মশাল জালিয়ে সারারাত বনের আনাচে কানাচে চরে বেড়ায়। যারা তাদের নৌকায় ভুল করে উঠেছে তাদের কেউ ফিরে আসে নি আজও। পরদিন জলাবনে পাওয়া যেত তাদের ভাসমান লাশ। 
প্ৰতিবছর গুটিকয় বেদিশা লোক গভীর রাতে এ জলাবনে ঢুকে কদাচিৎ তাদের দু'একজন ভাগ্যক্রমে ফিরেছে, বাকিরা মরেছে। ভূলবসতঃ রাতে নৌকা নিয়ে গ্রামবাসী কেউ এই জলাবনে ঢুকলে সারাৱাত একই জায়গায় ঘুরপ্যাক খায়। এখানকার দুষ্ট জীনেরা পথ ভূলায়ে নাকি সারারাত তাদের একস্থানে আটকে রাখে, কানের কিনারে করে ফিসফিস আওয়াজ ও গাঢ়ের কাছে ছাড়ে সুউষ্ণ নিঃশ্বাস।
আমি একজন এডভেঞ্চারপ্রিয় লোক। রাতারগোলের জলাবনের নৌকা সমাবেশে এসব ঘটনা শুনে ভূত দেখার এক অদম্য বাসনা আমাকে পেয়ে বসে। জীবনে কতকিছু দেখলাম কিন্ত ভূত দেখা আজও হল না। ভূত দেখার আগ্রহ প্রকাশ করামাত্ৰ লোকেরা বাধা দিল। তারা বলল, স্যার, ভূত দেখার দুরাশা ছাড়েন, শখ করে কি মরতে যাবেন। বয়স অল্প, জীবনের বহুদিন এখনও রয়ে গেছে। আপনি না হয় সুখের মরা মরলেন কিন্তু আপনার বৌ- বাচ্চাদের কি হবে।
রাতারগোলের কথিত ভূতেরা যে সবাই দুষ্ট তা আমার মনে হল না। এরা খারাপ হলে মতির মাকে ছাড় দিত না। মাদ্রাসায় পড়তে আসত না। আমার মনে হল রাতাৱগোলের জলাবনে রাতে যারা মরেছে, তার পিছনে একটা কিন্তু রয়েছে ।
আমি শখ করে অজগরের সাথে ঘুমাতে যাওয়া লোক। আমি যাহা বলি তাহা না করে শান্তি পাই না। আমি শপৎ নেই একদিন অমাবশ্যা রাতে রাতারগোলের জলাবনের নদীঘাটে আসব। ভূতের ডিঙ্গি হতে কেউ অনুনয় বিনয় করলেই উঠে বসে পড়ব। আমার লাটবহরের সবাইকে আমার সাথি হতে আমন্ত্ৰণ জানাই। কিন্তু কোন সাড়া পেলাম না ।
হঠাৎ মনে হল রবি ঠাকুর আমার কানের কাছে বলছেন, 'যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চল রে'। হ্যা, এক অমাবশ্যার রাতে একলাই চললাম। শহর হতে বের হয়ে রাতে সাহেববাজার এলাম। বাজার মসজিদে এশার নামাজ পড়ে আধার বেদ করে ছুটলাম রাতারগোল জলাবনের নদীঘাটে।
জনহীন প্রান্তর, ঘিসঘিসে কালো অন্ধকার। দু-একটা জুনাকি বনের আশপাশে জ্বলানিভা করছে। পথের নিশানা বরাবর কদম ফেলে ফেলে নদীঘাটে এলাম। বাদুরের ডানা ঝাপটানোর কিছু এলোমেলো শব্দ কানে এলো।
দেখলাম একটা ছোট্ট ডিঙ্গি ধেয়ে আসছে। মাঝির সামনে একটা লেণ্ঠন জ্বলছে। বৈঠার নাড়াচাড়া জলে মৃদুমন্দ ঢেউ তুলছে। জলের ছলাৎ ছলাৎ শব্দও কনে আসছে। জনকয়েক ভূতুমপ্যাচা যেন একে অন্যকে উদ্দেশ্য করে ডাকাডাকি করছে। এবার মাঝির ডাক শুনতে পেলাম, সালাম সাহেব, সালাম। এতরাতে আপনি যাবেন কোথায়? নিশ্চয় এই জলাবনের আশপাশের কোন গ্রামে যেতে চান। সাহেব এই নিৰ্জন জায়গায় এতরাতে কেউ আসে না। যখন তখন বিপদ হতে পারে। ছুটে এলাম, বিদেশী মেহমান আপনি, তাই বসে থাকতে পারি নি। বলুনতো আমি আপনার কি উপকার করতে পারি।
আরব্য উপন্যাসের যে যাদুর ঘোড়ায় সওয়ার হবার আশায় আমি এখানে এসেছি, মনে হল এই সেই সওয়ারি। মনে পড়ল, একবার অসহায় এক যাইফ বৃদ্ধা একজন লোককে হাটুজলের খালটি রাতে পার করে দিতে অনুনয় বিনয় করে। ভদ্রলোক গলে যান। তিনি দয়াবশতঃ বৃদ্ধাকে খালপার করাতে কাঁধে উঠান। বৃদ্ধা ছিল একজন দুষ্ট ডাইনি। খালপার হয়ে সে আর কাঁধ হতে নামে নি। সারাটা রাতভর লোকটাকে আরামছে ঘোড়াচড়ে ভোরের আলোয় তবে ছাড়ে। হ্যা লোকটা ডাইনিকে সারারাত তার কাঁধে চড়িয়েছে। আর আমি শহরের অফিসের বড়কর্তা ডাইনির কাঁধে চড়তে এসেছি। ভাগ্য ভাল হলে সারাটি রাত ওকে চড়বো। ডিঙ্গিটার খালি গোলইটায় উঠলাম। চুপেচুপে খোলের ভিতর জেকে বসলাম। আমার চোখদুটি মাঝিটার চারপাশে ঘুরপ্যাক খেতে থাকে।
এবার মাঝি মুখ খুলে, বেয়াদবি মাফ করবেন স্যার, আমার ডিঙ্গিতে উঠলেন অথচ যাবেন কোথায় জানা হল না। বলুনতো আপনাকে কোথায় নিয়ে যাব স্যার।
উদাস গলায় বললাম, মাঝিভাই আমাকে আপনি যেখানে খুশী সেখানে নিয়ে যান। ইতিপূৰ্বে আমি বন্ধুবান্ধব নিয়ে পূর্ণিমার সুমিষ্ট আলোয় টাঙ্গুয়ার হাওরে বড়নৌকায় রাত কাটিয়েছি। সত্যি বলতে কি আমি এবার এই অমাবশ্যা রাতে একাকি আপনার ছোট ডিঙ্গিটায় রাতারগোলের নির্জন জলাবনের নিরব রূপসৌন্দর্য্য উপভোগ করতে এসেছি। মাঝি বলল, আপনার এই সাহসকে ধন্যবাদ জানাই স্যার। মানুষতো ভীষণ ভয় পায়, এদিকে রাতে ভুলেও পা বাড়ায় না। আপনি শহর হতে এখানে এলেন সুদীর্ঘ রাত কাটাতে, বলেই হাহ হাহ করে বন কাপিয়ে অট্টহাস্যে ফেটে পরল মাঝি। ডিঙ্গি চলল, মিচিমিটি হারিকেন জ্বলছে, গভীর বনে ঢুকে পড়লাম। ধপ করে হঠাৎ বাতি নিতে গেল। চারপাশে নিকষ অন্ধকার। এবার অন্ধকার বেদ করে মনে হল মাঝির শরীর হতে মদু আলো বের হচ্ছে। আলো উজ্জল থেকে উজ্জলতর হতে হতে মাঝি যেন এক গোলাপী আলোক শিখায় পরিণত হল। বুকে সাহস নিয়ে বললাম, মাঝি ভাই আপনি কি জীন্নে মুমিন? সে বলল আপনি জানলেন কেমন করে? বললাম , আপনার নুরের ঝলকানি দেখে। আবার অট্টহাস্যে ফেটে পড়ল মাঝি, আপনিতো দারুণ সাহসী ইনসান। ইনসান জাতি আল্লাহর সেরা সৃষ্টি। এই জাতিকে আমাদের অনেক কিছু বলার ছিল। কিন্তু বলা হল না, কেমন করে বলব, তারা যে আমাদের গন্ধ পেলেই ভয়ে হুশ হারায়, দৌড়ে পালায়। আমি বছরের পর বছর ধরে এমনই একজন সাহসী ইনসান খোজছিলাম, যিনি আমাদের কাহিনি শুনবেন ও মানব জাতিকে তা জানিয়ে দিবেন। 
এবার মাঝি বলল, আমি দীনি ইলিম তালিম করতে বহু বছর পাশের গ্রামের মাদ্রাসার বডিং এ ছিলাম। বড়হুজুরকে রাতে নারকেল খাওয়াতে গিয়ে ধরা পড়ে যাই। তারপর চলে আসি এই রাতারগোল জলাবনে আগের ঠিকানায়। আপনার আগে যাদের সাথে আমার মোলাকাত হয়েছে তারা তুলকালাম কান্ড ঘটিয়েছে। কেউ জ্ঞান হারিয়েছে, কেউবা হার্ডএটাক করে মারা পড়েছে, পরদিন স্বজনরা এসে জলাবন থেকে তাদের লাশ নিয়ে গেছে। আমাদের মধ্যকার দুষ্ট জীন পিসাস লাল সাহেবের পাল্লায় পড়েও কেউ কেউ প্ৰাণ হারিয়েছে। আমি অবাক হয়ে বললাম, লাল সাহেব আবার কে? মাঝি বলল সে একজন দুষ্ট ইংরেজ, ওর গাত্ৰবর্ণ ছুলানো তরমুজের মত লাল। তাই দেশীরা তাকে বলত লাল সাহেব। বৃটিশ আমলে চুনের ব্যবসা করতে আসে খাসিয়া পাহাড়ে। চুক্তি ভঙ্গ করে সহজ সরল খাসিয়াদের ঠকাতে গিয়ে ওদের হাতে মারা পড়ে। সে তার ধনদৌলদ নিয়ে চলে আসে এই জলাবনে। বিলের পঞ্চাশ হাত নিচে সব গুপ্তধন পুতে রাখে। বিগত তিনশ বছর ধরে সে এই গুপ্ত ধন পাহারা দিয়ে আসছে। রাতে এদিকে কাউকে দেখলেই সে ঘাড় মটকায়, জলে ডুবিয়ে মারে। সে দারুণ সন্দেহ প্রবণ, তার ধারণা এতরাতে এসব লোক নিশ্চয়ই তার গুপ্তধন চুরি করতে এসেছে। হঠাৎ দেখলাম ডিঙ্গির অন্য গোলুইতে আরেকটা আলোর রেখা। ইয়া দাড়িওয়ালা বুড়ো মানুষের ছায়া। কিছুটা ভয় পেলাম, লাল সাহেবের পাল্লায় পড়ে গেলাম নাকি। 
ভয়ে ভয়ে বললাম, আপনি কি লাল সাহেব? বুড়ো মানুষের ছায়াটা জবাব দিল, না লালসাব নই, আমি আমু দাদা, মানুষেরা শত শত বছর আমাকে এই নামে ডাকতো। আমি বললাম, আপনি আমুদাদা, আপনার নাম পাশের গ্রামে অনেক শুনেছি। আপনাকে ওবাড়ির লোকেরা তো খুব ভালবাসতো। হ্যা, ভালবাসতো বলেই চোখে জলের ফোটা ফেলে বললেন এক দুঃখের কাহিনি। ওবাড়ির সাত পুরুষ ধরে আমি ছিলাম তাদের স্বজন। সেদিন আমাকে দেখে ভয়ে নববধূর জ্বর হল। সে প্রলাপ বকতে লাগল। তার বাপের বাড়ির লোকেরা আসল। তাদের সাফ কথা, আমু দাদা এ বাড়িতে থাকলে এখানে তাদের মেয়েকে রাখা যাবে না। 
এই ঘটনার দিন দুয়েকের মধ্যে গরমের দুপুরে ক'জন কৃষক বটগাছের ছায়ায় ঘুমিয়ে পড়ে। আমি তাদেকে কিছুই করি নি অথচ এই লোকগুলো হঠাৎ 'ভূত' 'ভূত' বলে বিকট চিৎকার দিয়ে দৌড়াতে থাকে। ঘুমের মাঝে আমি আমুদাদা নাকি তাদের গলা টিপে ধরেছি, শ্বাসরুদ্ধ করে মারতে চেয়েছি, এসব বলে তারা লোকজনকে ক্ষেপিয়ে দেয়। ভাবলাম এঁরা ডাহা মিথ্যাবাদী, মিছামিছি আমাকে দোষারোপ করছে। আদমেরা কেন এমন আদুম চুদুম করছে,  তা জানতে গেলাম সবজান্তা সিজ্জিনের দরবারে। পন্ডিত সিজ্জিন বলল, ব্যাপারটা কিছু না, মহাদানব বটবৃক্ষ কার্বন ডাই অক্সাইডের সাথে প্রচুর অক্সিজেন টেনে নেয়। লোকেরা ঘুমানোর সময় বটতলা অক্সিজেন হারায়, যাহা এই ঘুমন্ত কৃষকদের নিঃশ্বাস বন্ধ করে দেয়, এই যা।    
পরদিন আমার চোখের সামনে অসংখ্য ক্ষেপা-পাগলা লোক  আমার পাচশত বছরের বসত আদিম ছায়াবৃক্ষ বটগাছটায় কুঠার চালায়। দিনের আলোয় আমাদের শক্তি নিঃশেষ হয়ে যায়। দিনভর কাদলাম, কিছুই করতে পারলাম না। নিজেকে দারূণ অপরাধী মনে হল। ভিটেমাটি হারিয়ে চলে এলাম আবার আমার আদি ঠিকানায়, রাতারগোল জলাবনে। 
হঠাৎ দুই গোলুইয়ে আলো নিভে গেল। অন্ধকারে ডিঙ্গিটা দোলতে লাগল। হিজল গাছের শাখায় শাখায় বেশ কিছু আলোর ফুল ফোটে উঠল। মনে হল এই ফুল, ফুল নয় যেন অসংখ্য জীনদের জমায়েত। আলোক ফুলেরা গল্প শুরু করল। কাক কোকিলা সমবেতকণ্ঠে বললেন, স্যার, আমাদের দু'টি কথা শোনবেন? বললাম, কেন শোনব না, আমিতো আপনাদের কথা শোনতে শহর হতে এসেছি। কোকিলা বলল, আমি বড় ঘরের মেয়ে। জাতে জীন্নে সোলায়মান। আমাদের পূর্বপুরুষরা সোলায়মান নবির সহচর ছিলেন। আমার বংশের কোন তুলনা হয় না। আমি প্ৰথম যৌবনে এক সুদৰ্শন খাবিশের প্ৰেমে পড়ি। ছোটলোকের সাথে প্ৰেম। আমার জাতিরা ক্ষেপে যায়। আমাদের মেলামেশায় আপত্তি উঠায়। বাধ্য হয়ে সব ফেলে আমরা পাড়ি জমাই বড়মিয়ার বড়বাড়ি। যৌবনের উন্মাদনায় আমরা মাতাল হয়ে পড়ি। পরস্পর ওধর-ওঠর জড়ায়ে দু'জনে রাতভর উচ্চসুরে কোরাস তুলে গান গাই। মিয়ার বৌ রাতে আমাদেরে গালী দিলে আমরা ক্ষেপে যাই, অজুর ধারায় ইস্টক বৰ্ষণ করি। যার নাম শুনলে আমাদের অন্তরাত্মা কেপে উঠে, জীনেরা ভয়ে পালায়, সেই আব্বা হুজুরের অগ্নিমূর্তি দেখে আমরা প্ৰাণ নিয়ে পালিয়ে আসি। 
বৃক্ষডালে বসা কয়েকজন বলল মতির মার হাতে তাদের জন্ম হয়েছে। দয়াবতী মতির মা না এলে তাদের জন্মদাত্রি মাতা সেই কালো রাতে মারা যেতেন। 
একজন বলল আমি আমির আলীর জারদ। এখনও সখিনার প্রেমে আছি। হুজুরের শক্ত বাধে সখিনার বাড়িতে ঢুকতে পারি না। তাই বাড়িটার বাহিরের আসমান ছুয়া তালগাছে বসে গভীর রাতে মনের যন্ত্ৰণার সুর করে কেদে আসি। আমার কান্না শুনে রাতে এবাড়ির গাছপালাও কাদে, কুকুর ঘেউঘেউ করে কান্না জুড়ে দেয়। লোকেরা তালগাছটাকেও ভয় পায়, বলে ভুত-কাদুনে বৃক্ষ। 
এবার জমায়েত জীনেরা অভিযোগের সুরে তাদের কিছু দুঃখের কথা আমাকে শোনালো। বলল, দেশটাতে আদম সংখ্যা বন্যার মত বাড়ছে। আর তারা আমাদের বসতখানা, বৃক্ষলতা,  বন-বাদাড় কেটেকুটে নিঃশেষ করে ফেলছে। বসত হারিয়ে আমাদের সঙ্গি সাথীরা একে একে এদেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছে। হয়তো এমন একদিন আসবে যেদিন বাংলাদেশে জীন জাতির কাউকে আর খোজেই পাওয়া যাবে না ।
আচমকা বন কাপিয়ে এক উল্কা ছুটে আসে। সে আমাকে আক্ৰমন করতে উদ্যত হয়। সব আলো ফুলেরা তার উপর ঝাপিয়ে পড়ে। বেশ কিছুক্ষণ তীব্র মারামারি চলে। সবাই চিৎকার করে উঠে, খবরদার লালসাব। উনি একজন লেখক, আমাদের সম্মানিত মেহমান। তিনি আমাদের সুখ-দুঃখের কথা জানতে এসেছেন। লালসাব তাদের সাথে পেরে উঠতে পারল না। উল্কার বেগে পালিয়ে গেল। 
জীনেরা বলল, স্যার ভোর হয়ে আসছে, পিসাস লালসাব আপনার ক্ষতি করতে পারে। আসেন, আপনাকে আমরা ঘাটে পৌছে দেই। ডিঙ্গির দুই গুলইয়ে বসা আলোর বাতিরা সমস্বরে বলল, স্যার আমাদের কথা কি লিখবেন। হ্যা, অবশ্যই পত্রিকায় আপনাদের কথা লিখব, বলেই ঘাটে নেমে গেলাম। চেয়ে দেখি চোখের সামনে ডিঙ্গিটি অদৃশ্য হয়ে গেছে। 
আর তখন আমার রাতজাগা দু'চোখ জুড়ে অজস্ৰ তারা ফুল জ্বলানেভা করছে।

রচনাকালঃ আগষ্ট ২০১৩ সাল।       

২টি মন্তব্য:

  1. অসম্ভব কল্পনা শক্তি আপনার! রাতারগুল ঘুরে এসেছি, কিছুদিন আগে৷ এসবের কিছুই মনে হয়নি৷ ইচ্ছে আছে, আরেকবার যাব৷ যাওয়াটা রাতে হলেই এডভেঞ্চার জমবে বেশি৷ তখন মাথায় কাজ করবে আপনার গল্পটা৷ মনে হবে, এই বুঝি ছুটে এল কোন আলোর রেখা, মটকে দিল ঘাড়!

    উত্তরমুছুন