আমার দেখা সৌদি আরব ও আরব সংস্কৃতি
মক্কার আয়শা মসজিদে আত্মজ জেফার কুরেশী ও কবি লেখক ব্লগার পূবালী ব্যাংকার ইসফাক কুরেশী ।
আমি যখন হাইস্কুলের ছাত্র, তখন অত্যন্ত মনোযোগ সহকারে কবি গোলাম মোস্তফার লিখা ‘বিশ্বনবি’ গ্রন্থটি পাঠ করি। বিভিন্ন ধরনের বই পুস্তকে মনোনিবেশ করা আমার এক চিরন্তন অভ্যাস। ইসলামের নবি হযরত মুহাম্মদের(সঃ) জীবনী পাঠ করে আমি খুবই আন্দোলিত হতাম। পরবর্তীকালে বড় হয়ে যখন সৈয়দ আমির আলীর রচিত ‘দি স্প্রিট অব ইসলাম’ অধ্যয়ন করি, তখন প্রাচীন আরবদের জীবন, সংস্কৃতি, বিশ্বাস ও আরবের ভূপ্রকৃতি গোত্রব্যবস্থা, আবহাওয়া ইত্যাদি নিয়ে মনরাজ্যে নানা জিজ্ঞাসার মুখোমুখী হই। নবির(সঃ) স্মৃতি বিজড়িত পবিত্র মক্কা ও মদিনা নগরী নিয়ে মনোরাজ্যে বিভিন্ন ধরণের কল্পনার সৃষ্টি হত। বাস্তবে এ অঞ্চলটি মানুষ ও তাদের ধর্মাচারণ এবং সংস্কৃতি কেমন তা দেখার জন্য প্রায়ই তীব্র মানসিক তাগিদ অনুভব করি। আরেকটি কারণে মক্কার প্রতি আমি তীব্র আকর্ষণ অনুভব করতাম- তা হচ্ছে আমার সতের জেনারেশন আগের পূর্বপুরুষ হযরত শাহদাউদ কুরেশী(রঃ) তের শতাব্দীতে হযরত শাহজালালের(রহঃ) প্রথম বারো জন সহচরের একজন হিসাবে এই পবিত্র মক্কানগরী হতে সিলেটের দক্ষিণ সুরমার দাউদপুর গ্রামে এসে বসতি স্থাপন করেন। কাজেই শৈশব হতেই আরবের এই হেজাজ অঞ্চল দেখার আগ্রহ আমাকে পেয়ে বসে। শিল্পী আব্দুল আলিমের গাওয়া আমার প্রিয়গান ‘কে যাও রে মদিনায়, এই অধমের সালামখানি পৌঁছাই দিও রসূলের রওজায়' আমাকে রসূলের রওজায় মুবারক দেখতে অনুপ্রাণিত করত।
ইসলামের পাঁচটি ফরজের মধ্যে হজ্জ অন্যতম। ২০০০ সন হতে আমার মনে হচ্ছে আমি ও আমার স্ত্রী ডাঃ নূরজাহান বেগম চৌধুরীর হজ্জ ফরজ হয়ে গেছে এবং পবিত্র হজ্জ পালনের একটা মানসিক তাগিদ অনুভব করছিলাম তখন থেকেই। মনে হত হঠাৎ যদি মারা যাই তাহলে পাঁচটি ফরজের একটি অপূর্ণ রয়ে যাবে। ২০০৯ সনে ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও অফিসের জটিলতায় হজ্জে যেতে পারিনি। কাজেই ২০১০ সনে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হই। শেষ পর্যন্ত রব্বানি ট্রাভেলসের মাধ্যমে যাবতীয় ব্যবস্থাদি সম্পন্ন হয়। সিলেট থেকে ট্রেভেলসের ভাড়া করা একটি বাসে আমরা ঢাকার বিমানবন্দরের কাছে হজ্জ ক্যাম্পে যাই। হজ্জ ক্যাম্প লোকে লোকারণ্য, সেখানে বসার জায়গা নেই। দুটি চেয়ার খালি আছে। বসতে গেলে একজন লোক বলল বসা যাবেনা, তাঁদের লোক এসে বসবে। অথচ তাঁদের কোন লোকই আসছেনা। লোকটা এতই বেতমিজ যে অন্য ক্লান্ত লোকজনকেও এই দুই চেয়ারে বসতে দিচ্ছেনা, যেন এই দুই চেয়ার তাঁর পৈত্রিক সম্পদ।
এখানে এসে আমার ছোট সমন্দি আজিজ ভাই ও ভাবী আনিকা এসে আমাদের সাথে দেখা করেন। একটু পর আমরা ঢাকা বিমানবন্দরে প্রবেশ করে অজু করে এহরামের কাপড় পরি। তারপর এহরাম বাঁধার দুই রাকাত সুন্নত নামাজ পড়ে নেই। এহরামের দুই টুকরা সেলাইবিহীন কাপড়পরার অভিজ্ঞতা এই প্রথম। এহরাম বাঁধার পর মনে এক অনাবিল প্রশান্তি আসে। দুনিয়া হতে মন সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। সব হাজিরা সমস্বরে লাব্বায়েক, আল্লাহুম্মা লাব্বায়েক পড়ে পড়ে বিমানে আরোহন করেন।
২০১০ সনের ১লা নভেম্বর মধ্য রাতে বাংলাদেশ বিমানের ভাড়া করা বিশাল বিমানে আমরা ৪৩৯জন যাত্রী ঢাকার হযরত শাহজালাল(রঃ) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর হতে জিদ্দা নগরীর উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করি। ঐদিন সিলেট হতে ট্রাভেলসের একটি ভাড়া গাড়িতে করে ঢাকার হজ্জ্ব ক্যাম্পে যাই। আমাদের ঢাকার আত্মীয়রা এসে দেখা করেন ও বিভিন্ন ধরনের পরামর্শ দিয়ে যান। সিলেটে অনেক আত্মীয়-স্বজন যাবার পূর্বে দাওয়াত খাওয়ান ও হজ্জ্বে গিয়ে ব্যবহার করা যায় এমন ধরনের জিনিসপত্র পুস্তকাদি দিয়ে সহায়তা করেন। এমনকি পূর্বে হজ্জ্বে যাওয়ার অভিজ্ঞতা সম্পন্ন গুরুজনরা রীতিমত প্রশিক্ষণ প্রদান করেন। তাদের মধ্যে বিশেষ করে আমার মেঝমামা ফজলুর রহমান চৌধুরী, মামী কুহিনূর চৌধুরী ও আমার স্ত্রীর সিলেট মেডিকেল কলেজ জীবনের সহপাঠিনী ডাঃ রাজিয়া সুলতানার নাম উল্লেখযোগ্য।
১লা নভেম্বর রাত ১০টায় ঢাকা হতে বিমানটি পশ্চিম দিকে অগ্রসর হয়ে স্থানীয় সময় শেষ রাতে জেদ্দা বিমানবন্দরে অবতরণ করে। সিলেট হতে একটানা প্রায় ১৮ ঘন্টার যাত্রা পরিসমাপ্তি ঘটে। বিমান হতে ৪৩৯ জন যাত্র বেরিয়ে বিমানবন্দরে কাঁচঘেরা শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত হলরুমে অবস্থান করে সবাই প্রাকৃতিক কাজ এবং অজু সেরে কসরের নামাজ আদায়ে রত হন। সৌদি আরব এক তৈল সমৃদ্ধ ধনী রাষ্ট্র কিন্তু বিমান বন্দরের পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা আমাকে হতাশ করে। ছোট ছোট বাথরুম, নিচে জমানো পানি এক দারুণ বিরক্তির সৃষ্টি করে। পরে শুনেছি এই বিমান বন্দরে হজ্জ টার্মিনাল আলাদা ও সাধারণ। এখানকার যাত্রী সেবাও সাধারণ। বিমানবন্দরে ভিআইপি রাষ্ট্রের লোকজনের জন্য উন্নত সেবা রয়েছে। ২/৩ ঘন্টা অতিবাহিত হবার পর নিয়ে যাওয়া হয় বহির্গমন কক্ষে। আরব দেশে জনসংখ্যা অল্প। শিক্ষার হার নিম্নমানের হওয়ায় অফিস চালানোর মত দক্ষ লোকজনের অভাব রয়েছে। হজ্জ মৌসুমে প্রায় ৬০/৭০ লক্ষ লোক এই বিমান বন্দর দিয়ে সৌদি আরবে প্রবেশ করে। এই বিশাল হজ্জ যাত্রীগণের ইমিগ্রেশনের অফিসিয়েল কর্ম সম্পাদনের জন্য সৌদি সরকার তাদের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অল্প বয়সের অপ্রশিক্ষিত ছাত্রদের নিয়োগ করে। চার-পাঁচটি লাইন ধরে দাঁড়িয়ে একজন একজন করে পার হতে হয়। এখানে অত্যন্ত ডিমেতালে কাজ পরিচালিত হয় ও দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে মানুষের মনে বিরক্তির সৃষ্টি হয়। বের হয়ে টার্মিনালে বিভিন্ন দেশের এয়ারলাইনের ভাড়া করা জায়গা রয়েছে, যেখানে ঐসব দেশের যাত্রীদেরকে বসানো হয়। আমাদের টার্মিনালে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকাসহ বরাদ্দকৃত স্থানে সবাই চলে যাই। আমাদের পিছনে গাড়িতে করে সবার মালামাল ঐ জায়গায় নিয়ে আসা হয়। তারপর মদীনার বাসে আরোহনের পালা। আমাদের মদীনায় নিয়ে যাবার জন্য রব্বানী ট্রেভেলসের লোক বড়লেখার হুজুর এসে আমাদের সহিত মিলিত হন। ২/১ ঘন্টা পর সৌদি আরবের দাল্লাহ কোম্পানির একটি শীতোতাপ নিয়ন্ত্রিত গাড়িতে আমাদের উঠানো হয় মদীনায় নিয়ে যাওয়ার জন্য। আমাদের ড্রাইভার সিরিয়ান লোক। এদেশের হজ্জ মৌসুমে পাশের গরিব রাষ্ট্র সিরিয়া, ইয়ামেন, মিশর, সুদান ইত্যাদি হতে অস্থায়ী ড্রাইভার নিয়োগ করা হয়। তাদের কাজের মধ্যে অনভিজ্ঞতার ছাপ দৃষ্টিগোচর হয়। আমাদের সকলের পাসপোর্ট ড্রাইভারের হাতে চলে যায়। পাসপোর্টের সহিত যাত্রি সংখ্যা মিলানোর পর বাস জেদ্দা হতে মদীনার দিকে রওয়ানা হয়। ইতিমধ্যে জেদ্দা টার্মিনালে একজন বাংলাদেশী লোকের কাছ হতে একটি আরবি সিম কিনে আমাদের মোবাইল সেটে ঢুকাই। আমাদের গাড়িতে একজন বৃদ্ধা মহিলা উঠেন কিন্তু তার স্বামী তারা মিয়া আমাদের পিছনে অন্য গাড়িতে উঠে পড়েন। উক্ত ভদ্রমহিলা স্বামী হারিয়ে সারাটা পথ অশান্তিতে কাটিয়ে মদিনায় গিয়ে স্বামীকে ফিরে পান।
জেদ্দা হতে মদিনা বিশাল মহাসড়ক। মোট বার লেন বিশিষ্ট সড়ক। জেদ্দা হতে মদীনার দূরত্ব ৪৫০ কিঃমিঃ। আসা ও যাবার ছয়টি করে লেন মধ্যভাগে প্রচুর খালি জায়গা থাকায় দু’দিকের গাড়িগুলোর লাইটের তীব্র বিপরীতমুখী আলো ড্রাইভারগণের চোখে পড়তে পারে না। রাস্তার দুই পাশে রুক্ষ পাথরের পাহাড়, মাঝেমধ্যে বালির উপত্যকা ও সেই উপত্যকায় হলুদ ও ফাকাসে মরুদ্যান। দেশটি বৃক্ষলতা তেমন নেই। আমাদের দেশের মত নেই পাখি ও প্রাণী বৈচিত্র। দুই দিকে তাকিয়ে মনে হয়েছে যেন চাঁদের উপর দিয়ে গাড়ি চলছে। এখানে বাতাস আছে কিন্তু চাঁদে নেই। এই যা পার্থক্য। মাইলের পর মাইল বাংলাদেশের মত কোন নদী-নালা, পানি, বৃক্ষলতার অস্তিত্ব নেই। বারবার মনে হয়েছে আরবের গোত্রগুলো প্রাচীনকালে এই মৃত অঞ্চলে কেমন করে টিকে ছিল। অসম্ভব কষ্ট সহিষ্ণু ছিল সেই আরবরা এই কঠিন রুক্ষ অঞ্চল দেখলেই অনুমান করা যায়। অসংখ্য গাড়ি রাস্তা দিয়ে ছুটে যাচ্ছে। বিশ চাকাবিশিষ্ট বৃহদাকার লরি এক সাথে ১৫টির মত কার, মাইক্রোবাসের মত গাড়ি পিঠে করে বয়ে নিয়ে যাচ্ছে গন্তব্যে- যা বাংলাদেশের সড়কগুলোয় চালানো সম্ভব নয়। মধ্য রাস্তায় গাড়ি থামলো-আমরা নেমে খাওয়া-দাওয়া ও নামাজ সেরে আবার গাড়িতে উঠলাম। গাড়ি দ্রুত মদিনার পানে ছুটে চললো। মদিনা শহরে ডুকার পূর্বে একটি বৃহৎ টার্মিনালে গাড়ি থামলো। আমাদের সাথের অন্য গাড়িটি না আসা পর্যন্ত আমাদেরকে পড়ে থাকতে হলো। সুদীর্ঘ যাত্রার ক্লান্তিতে সবার অবস্থা জর জর। সবাই হোটেলে গিয়ে ফ্রেস হয়ে ক্লান্তিমুক্ত হয়ে রসুলের(সঃ) রওজায় যাওয়ার জন্য উদগ্রীব। হজ্জে গমন ধৈর্যের এক অগ্নি পরীক্ষা। প্রতিটি ঘাটে দীর্ঘ লাইন, প্রচুর সময়ের অপচয়, বসে-দাঁড়িয়ে ধৈর্য্য ও কষ্টের শেষ সীমায় পৌঁছার পর গিয়ে উদ্দেশ্য হাসিল হয়। ক্লান্ত হাজিরা সুদীর্ঘ সময় পর ধৈর্য্যচুতির চুড়ান্ত সীমা অতিক্রমের পর বাস শহরে প্রবেশের অনুমতি পায়। মদীনা শহর-আল্লাহর রসূলের প্রিয় শহর। খোলাফায়ে রাশেদিন ও রসূলের সময় ইসলামি সাম্রাজ্যের রাজধানী ছিল। গোত্র বিভক্ত আরবের হেজাজ অঞ্চলের এই ইয়াসরিব নগরে সর্বপ্রথম আরবজাতির রাষ্ট্রব্যবস্থা চালু করেন হযরত মুহাম্মদ(সঃ)। ইসলামের বড় বড় বিজয় অভিযানও এই নগর হতে পরিচালিত হয়। শহরটি অত্যন্ত সুন্দর ও মনোরম। বিশাল বিশাল পরিচ্ছন্ন রাস্তাঘাট। টালীর ওয়ালঘেরা সুরম্য ভবনগুলো দৃষ্টি কেড়ে নেয়। ইতিমধ্যে রাত্রি নেমে এসেছে। আমাদেরকে কিং ফাহাদ রোডের ফখরানি হোটেলে উঠানো হয়। মদীনার নবুবী মসজিদের সামনের কিং ফাহাদ গেট হতে হোটেলটি ৫/৭ মিনিট হাঁটার রাস্তা দূরত্বে অবস্থিত। রসূলের রওজার গমনের জন্য আমাদের হৃদয় উদগ্রীব। আমার স্ত্রী ডাঃ নূরজাহান বেগম চৌধুরী দীর্ঘ ভ্রমণের ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়েন। আমি তখন চলে আসি মসজিদে নবুবিতে। দূর হতে ভারী সুন্দর মিনারগুলো ঝলমল করছে দেখে দেখে হেঁটে ৫/৭ মিনিটে রসূলের মসজিদে উপনীত হই। মসজিদের ভিতর ঢুকে চোখে ঝলসে যায়। এত সোনালি রং ও ঝাড়বাতি আমি কোনদিন দেখি নাই। মসজিদে নবুবির মত এত উন্নত ও আধুনিক স্থাপত্য কর্ম আমাদের দেশে বিরল। মসজিদের চতুর্দিকে বিশাল চত্বর-যা মসজিদটির সবদিক অবর্তন করে রেখেছে। বাহিরের চত্বরে অসংখ্য ছাতি- যা নামাজের সময় মেলে ছায়া দেয় ও পরবর্তীতে বন্ধ হয়ে যায়। মসজিদের ভিতরে সুপেয় ঠান্ডা পানির পীপাগুলো পানের জন্য সারিবদ্ধ রাখা- পাশে ওয়ানটাইম হাউজ গ্লাস রাখা। পানি পানের পর গ্লাসগুলো ফেলারও সুন্দর ব্যবস্থা রয়েছে। আমরা যখন পৌঁছি তখন মদিনাতে শীতকাল। বাতাস বেশ ঠান্ডা। কিন্তু বাতাস এতই শুস্ক যে নাসারন্ধ্র ও গলা শুকিয়ে যায়। পায়ের পাতা ও চামড়ার অনবরত ভেসেলিন মাখাতে হয়। মসজিদের বাথরুম ও অজুখানা মাটির নীচে চারতলা বিশিষ্ট। চলন্ত সিঁড়ি বেয়ে একের পর এক নীচে নামা যায়। এক সাথে হাজার হাজার মানুষ অজু ও বাথরুম সারতে পারেন। মসজিদটি অত্যন্ত উন্নতমানের মারবেল পাথরে নির্মিত। মসজিদটির ভিতরে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ও মাইকিং ব্যবস্থা দারুণ উন্নত। ইমাম সাহেবের কণ্ঠস্বর অত্যন্ত সুমধুর। মসজিদটিতে অবস্থান কালে খুব বেশী হযরত মুহাম্মদ (সঃ) এবং তার সাহাবিগণের কথা মনে পড়ে। মহানবি(স:) তাঁর জীবনের শেষ ১১ বৎসর এই নগরীতে অতিবাহিত করেন। মাঝে মাঝে মনে হয় তারা যেন এখনও এখানে বিচরণ করছেন। মসজিদটির একদম দক্ষিণ প্রান্তে মূল মসজিদে নবুবি, যেখানে হযরত মুহাম্মদ(সঃ) ছাহাবিগণকে নিয়ে নামাজ আদায় করতেন। এখানে মসজিদের ভিতর বামদিকে একটি সবুজ গম্বুজের নীচে শায়িত আছেন আমাদের প্রিয়নবি হজরত মুহাম্মদ(সঃ) ও তাঁর প্রিয় সহচর হযরত আবুবকর(রাঃ) ও হযরত ওমর(রাঃ)। রওজার উত্তরে একটি মঞ্চ রয়েছে, যেখানে হযরত(সঃ) তার সহচরদেরকে উপদেশ দিতেন। সবুজ হচ্ছে হযরত মুহাম্মদের(সঃ) প্রিয় রঙ্গ। তার রওজার গম্বুজটি তাই সবুজ এবং তার মাজার হতে নবুবির মিম্বর পর্যন্ত জায়গাকে লোকে অত্যন্ত সম্মানের চোখে দেখে যা বেহেস্তের একটি টুকরা মনে করা হয়। উহাও হালকা সবুজ গালিচায় আবৃত যদিও সারাটা মসজিদের গালিচা লাল বর্ণের। হযরত মুহাম্মদ(সঃ) রওজায় জায়গাটি তার জীবদ্দশায় হযরত আয়েশার (রাঃ) ঘর ছিল। রসূল(সঃ) এখানেই পরলোকগমন করেন এবং এখানেই তার সমাধি রচিত হয়। নবিজির (সঃ) রওজায় ঢুকতে গিয়ে প্রথমেই হোচট খেতে হয়। হাজার হাজার লোক ঢুকার জন্য অপেক্ষা করছে অথচ পুলিশ গেট বন্ধ করে দিয়েছে।
মদিনা মসজিদের অসংখ্য দরজা বা গেট রয়েছে। প্রতিটি দরজার স্বতন্ত্র নামও রয়েছে। রসুলের রওজা মুবারকে প্রবেশের গেটের নাম ‘বাবে সালাম’ বা সালাম গেট। তারপর রয়েছে হযরত আবুবকর গেট, ওমর বিন খাত্তাব গেট, বেলাল গেট ইত্যাদি। বর্তমান সৌদি রাজ বংশের রাজাগণের নামেও অসংখ্য দরজা রয়েছে যেমন- কিং ফাহাদ গেট, কিং ইবনে সৌদি গেট ইত্যাদি। এশার নামাজের পর বাবে সালাম খুলে দেওয়া হয়। দুরূদ শরিফ পাঠ করে করে হাজার হাজার মানুষ প্রবেশ করে রওজার পাশ অতিক্রম করে বাহিরের গেট দিয়ে বের হয়ে যায়। বিভিন্ন মাজহাব, বর্ণ, ভাষা ও পোষাক সংস্কৃতির মানুষের ভীড়ে নিজেকে বিলিয়ে দেই। রসুলের জীবনের তীব্র কষ্ট, যন্ত্রণা, সংগ্রাম- তারপর তার সাফল্য মনে পড়ে। চোখ পানিতে ভিজে যায়। মোট বার দিন মদিনায় অতিবাহিত হয়। শেষ রাতে তাহাজ্জুদের নামাজের আগে মসজিদে গিয়ে সূর্য উঠার পর হোটেলে ফিরতাম। মসজিদে মহিলা ও পুরুষের আলাদা নামাজের ব্যবস্থা রয়েছে। আবার মহিলাদের জন্য মসজিদে অজুখানা, টয়লেট ও আলাদা প্রবেশ পথ রয়েছে। মসজিদটিতে এক সাথে ৫/৭ লক্ষ মানুষ নামাজ আদায় করতে পারেন। যোহরের নামাজ জামাতে পড়ে এসে খাওয়া ও হালকা ঘুম সেরে আছরের সময় মসজিদে গিয়ে এক সাথে এশার নামাজ পড়ে ফিরে আসতাম। আমার রূমমেট ছিলেন সুনামগঞ্জ জেলার জামালগঞ্জ উপজেলার জনাব সাইদুল হাসান। বর্তমানে তিনি প্রাইমারি শিক্ষক হতে সদ্য অবসর নিয়েছেন। তার স্ত্রী সব সময় আমার সহধর্মিনীকে সঙ্গ দিতেন। সাইদুর সাহেবের গ্রামের ছেলে নূর হোসেন। তিনি দীর্ঘদিন হতে মদিনায় আছেন ও ছোটখাটো ব্যবসা করেন। একদিন তিনি প্রচুর বিভিন্ন ধরনের ফল নিয়ে আসেন। আঙ্গুর, পেঁপে, কলা, আপেল, চেরিফল ইত্যাদি। রূমমেট হিসাবে আমরা খাবারে শরিক হই। পরদিন নুর হোসেন গাড়ি ভাড়া করে আমাদেরকে পুরো মদিনা শহর ঘুরে দেখান। ওহুদের যুদ্ধক্ষেত্র ও ওহুদ পাহাড়, হযরত হামজার (রাঃ) মাজার ও হামজা মসজিদ ঘুরে দেখি। মসজিদুল কুব্বা-মদিনার এই প্রথম মসজিদে নামাজ পড়ি। তারপর চলে যাই মসজিদুল কিবলা তাইনে। ইসলামের প্রাথমিক যুগে নামাজের কিবলা ছিল জেরুজালেম মসজিদ। পরে উক্ত মসজিদে এসে রসুলউল্লা(সঃ) মুসলমানদের কিবলা আল্লাহর নির্দেশে কাবাগৃহের দিকে নির্ধারণ করেন। খন্দকের যুদ্ধক্ষেত্রের এরিয়া ঘুরে দেখি। রাস্তাগুলো বৃহদাকার হওয়ায় ১০০ কিঃমিঃ বেগে গাড়ি শহরটি প্রদক্ষিণ করে। একটি পাহাড়ে কৃত্রিম পানির ঝরণা রয়েছে, পাহাড় বেয়ে পানি নিচে নেমে আসছে। দু’টি রাস্তা যেখানে ক্রস হবে সেখানে একটি রাস্তা অন্যটির উপর ওভারব্রিজ করে দেওয়া হয়। ফলে কোন যানজন নেই। শহরের মধ্যে পাহাড় কেটে অসংখ্য সুড়ঙ্গ রাস্তাও করা হয়েছে। এখানে পানির তৃষ্ণা হয় প্রচুর ও প্রচুর পানি পান করলেও সে অনুপাতে প্রস্রাব হয় না- শুষ্ক বাতাস শরীর হতে পানি চুষে নেয়। প্রায়দিনই ফজরের নামাজের পর মুহাম্মদের(সঃ) রওজা ও জান্নাতুল বাকী জেয়ারত করতাম। জান্নাতুল বাকি হচ্ছে রসুলুল্লাহের রওজা হতে খানিক দূরে এমন এক সমাধি ক্ষেত্র যেখানে মা ফাতেমা(রাঃ), হযরত হাসান(রাঃ), হযরত উসমান(রাঃ) হযরত তালহা(রাঃ), হযরত জুবায়ের(রাঃ) হযরত আয়শা(রাঃ)সহ প্রায় দশ সহস্রাধিক সাহাবি ঘুমিয়ে আছেন। এখানে শেষনিদ্রায় শায়িত আছেন অসংখ্য সাহাবি, তাবেয়ি, তাবে তাবেয়িসহ অসংখ্য পূণ্যবান মানুষ।
মাজারকে কেন্দ্র করে ব্যবসা, বাতি জ্বালানো, ধূনা পোড়ানো, গোলাজল ছিটানো ও টাকা উঠানো এসবের প্রচলন আরব দেশে নেই। আরবরা মাজারের দিকে মুখ করে দুয়াদুরূদ পড়া বা প্রার্থনা করেন না। তারা কবরের পাশে গিয়ে কিবলামুখী হয়ে দোয়া দুরূদ পড়েন ও প্রার্থনা করেন। কোন ধরণের কবরের দিকে হাত উঠানো ও বাতি ধুনা জ্বালানো, আতর ছিটানো তারা বেদাত মনে করেন। বিখ্যাত বিখ্যাত সাহাবিদের কবরে কোন বাতি নেই, এমনকি স্মৃতিফলকও নেই। রসূলের(সঃ) রওজা শরিফেও এ ধরণের কোন ক্রিয়াকর্ম করতে দেওয়া হয় না। মানুষ হৃদয় দিয়ে ভক্তি শ্রদ্ধা করেন কিন্তু বাহ্যিক আচার আচরণ প্রদর্শনে আমাদের দেশের মত অতি বাড়াবাড়ি করতে দেওয়া হয় না। মদিনায় আমরা সকালের নাস্তা নিজেরা করতাম। দুপুর ও রাতে টুকেন দেওয়া হত। উক্ত টুকেন দিয়ে পাশের চট্টগ্রামী হোটেলে খাবার সারতাম। খাবার ছিল হরেক রকম মাছ, মোরগ, গরু ও খাসির মাংস। সাথে ডাল ও সবজি। রান্না বাংলাদেশী, খাবারও মনে হত বাংলাদেশ হতে সরবরাহকৃত। হোটেলে কাজ করেন কুমিল্লা ও চট্টগ্রাম অঞ্চলের লোকেরা। তাদের ব্যবহার অত্যন্ত ভদ্র। তাদের বিরতিহীন পরিশ্রমী জীবনেও মধুর আচরণ আমাদেরকে বিমুগ্ধ করে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন