স্মৃতিতে পুবালী ব্যাংক আঞ্চলিক অফিস ও মহিলা
কলেজ শাখাঃ
অবস্থানকালঃ
২৭ আগষ্ট ১৯৯০ সাল হতে ১৮ মার্চ ১৯৯৩ সাল।
মোঠ সময়ঃ ২ বৎসর ৬ মাস ২১ দিন।
২৭ আগস্ট
১৯৯০ সালে আমি চাকুরীতে যোগদান করতে ছূটলাম সিলেটের বন্দর বাজারে পুবালী ব্যাংক
আঞ্চলিক অফিসে। পুবালী ব্যাংকের নিজস্ব পাচতলা ভবনের চারতলায় সিঁড়ি বেয়ে উঠে
আঞ্চলিক অফিসে প্রবেশ করলাম। তখন পুবালী ব্যাংকের আঞ্চলিক প্রধান ছিলেন উপমহাব্যবস্থাপক
আব্দুল মজিদ, যাকে আমি অনেকবার ইতিপূর্বে জনাব ই এ চৌধুরীর সাথে দাউদপুরের বাড়িতে
যেতে দেখেছি। তিনি বললেন, আপনাকে মহিলা কলেজ শাখায় দিলে কেমন হয়। এই মহিলা কলেজ
শাখা কোথায় আমার কোন ধারনা ছিলনা। মনে হল এটি হয়ত কলেজের ভিতরে হবে, তাই ভাবলাম
মেয়েদের আড্ডাখানায় এক শিক্ষিত পরিবেশে কাজ করা যাবে।
আমি উত্তর দিলাম স্যার আপনার
ইচ্ছে হলে দিতে পারেন। মজিদ স্যার তখন বললেন আজ ও কাল
দুইদিন এই অফিসে অবস্থান করবেন এবং ২৮ আগস্ট বিকেলে
আপনি ছাড়পত্র নিয়ে পরদিন মহিলা কলেজ শাখায় যোগদান করবেন। দাউদপুর হতে ২৯ আগষ্ট আমি
সিলেট মহিলা কলেজ শাখায় গিয়ে সকাল ৯ ঘটিকায় ব্যবস্থাপক রুস্তম আলী স্যারের কাছে
জয়েনিং রিপোর্ট পেশকরি।
হাসিখুশি
রুস্তম আলী স্যার ছোটখাট হালকা পাতলা লোক। তার বাড়ি কুমিল্লার লাকসামে, তিনি
ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় হতে অনার্স ও মাস্টার্স। আমি পরিচয় প্রদান করলে তিনি
আমাকে চাকুরিসংক্রান্ত কিছু উপদেশ দিয়ে বললেন
আপনি তো নিচের লেবেলে ঢুকে গেছেন, এখান হতে উপরে উঠা বেশ
কঠিন। জুনিয়র অফিসারে ঢুকে ব্যাংকের আকাশছুঁয়া খুব কম
মানুষের ভাগ্যে জুটে।
এইদিনই আমি
বুঝলাম ব্যাংকে সিনিয়র অফিসার, অফিসার ও জুনিয়র অফিসার এই তিন পদে অফিসার নিয়োগ
করা হয়। ১৯৯০ সালে পুবালী ব্যাংকে যোগদানকারী ব্যাচটি ছিল একটি ভাগ্যহীন ব্যাচ।
সেই বছর পত্রিকায় সিনিয়র অফিসার ও অফিসার পদে নিয়োগের বিজ্ঞাপন দেওয়া হলেও তৎকালীন
ব্যবস্থাপনা পরিচালক আব্দুল মতিন খান সিনিয়র অফিসার বাদ দেন ও সবাইকে একপদ নিচে কেবল
অফিসার ও জুনিয়র অফিসার এই দুইপদে নিয়োগ দেন। ফলে প্রথমেই এক কিংবা দূই পদ
নিশ্চিতভাবে নিচে নিয়োগপত্র পাই। অথচ ১৯৮৭, ১৯৮৮ কিংবা ১৯৮৯ সালে
ব্যাংকে ঢুকলে এই ঠকা খেতে হত না।
তাছাড়া এই ভাগ্যহীন ব্যাচের শিক্ষানবিশ কালও
একের স্থলে দুই বৎসর করে দেওয়া হয়।
যোগদানের
প্রথমদিনই বুঝলাম পুবালী ব্যাংকে আমি এক শুভঙ্করের ফাঁকিতে পড়ে গেছি। মনে
মনে ভাবি এখানে আমি কিছুদিন সময় কাটাতে এসেছি, সময়ে সুযোগ পেলেই পাততাড়ি গুটাবো। অথচ
সেই শুভঙ্করের ফাঁকির চোরাবালিতে হাবুডুবু খেয়েই
সারাটা চাকুরি জীবন পার করতে হল।
তখন মনে হল গ্রিনডেল্টা ইন্সুরেন্স কোম্পানিতে
সিনিয়র অফিসারে যোগদান না করে আমি কি ভূলটা করলাম। আমার ভাতিজা মুন্তাকিম কুরেশী
রিপন আমার অনেক পরে গ্রিনডেল্টায় জয়েন করে বেশকটি দেশভ্রমণের
সুযোগ পায়, দামী গাড়ি পায় ও ধানমন্ডিতে সুরম্য বাসায় থাকার মত বেতন পায়। আমার
আত্মীয়স্বজন ও প্রতিবেশীদের মালিকানাধীন পূবালীতে সারাজীবন পার করে আজ বায়ান্ন বছর
বয়সেও হিসেব করলে দেখি অন্যদের তুলনায় যেই লাউ সেই কদু ছাড়া আলাদা কোন সুযোগ
সুবিধা আমার ভাগ্যে জুটেনি। এমন কি বাহিরের জগতের
লোকজনের প্রচুর সম্মান এবং সহানুভূতি পেলেও
এখানে আমাকে শেষদিকে সব ধরণের
হেনস্থা ও অপমানের মুখামুখি হয়ে কাজ করতে হয় আমার নিজের
আত্মীয়সম্পর্কীয় লোকজনের অন্যায় আচরণের কারণে।
দাউদপুর হতে
আগের মত সকালে বের হয়ে ভূদৌড় দিয়ে ৯টায় এসে অফিসে ঢুকতাম। বিকেল ৫টার পর দাউদপুর
ফিরতাম। ভাউচার চিনতে আমাকে প্রথমে টোকেন ইস্যুতে
বসান হল। পাশে বসতেন কর্মচারী সাথী পাঠক দিদি।
খুব ধৈর্যশীলা শান্তসুবোধ সাথীদি তার পদের
চেয়ে বড়পদের কাজ অনায়াসে করে যেতেন, এমন কি প্রয়োজনে ক্লিনক্যাশও মিলাতেন। আমি
ব্যাংকের প্রাথমিক কাজগুলো তার কাছে শিখে নেই। সাথীদিদির স্বামী ছিলেন সিলাম উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষক।
সাথী
দিদি আজ নেই। তার জীবনের শেষবেলায় পাঁচছয় বৎসর মরনব্যাধী স্থন ক্যান্সারের সাথে
অতি মনোবল নিয়ে যুদ্ধ করেন ও সেইসাথে
ব্যাংকের চাকুরিও চালিয়ে যান। অক্টোবর ২০১৮ তে তিনি
চাকুরি জীবন পুর্ণ
করে সিলেট স্টেডিয়াম শাখা হতে যথারীতি অবসর গ্রহণ
করেন। একদিন স্টেডিয়াম শাখায় তার বিদায় সম্বর্ধনা হল। অল্প বয়সে চাকুরিতে ঢুকে
সারাজীবন সংগ্রাম করে প্রশান্ত চিত্তে সাথীদি ফিরলেন
ঘরে। কিন্তু তিনি আর বিশ্রাম নিতে পারলেন না। কিছুদিনের
মধ্যেই ঈশ্বর তাকে আদর করে তার কাছে নিয়ে যান।
সহকর্মী
শ্যামলী নন্দী ছিলেন মেঘবরণ কন্যা,
লম্বা কাজল চূল, মায়াবী চেহারা ও স্পষ্টসাধু বাচনভঙ্গি
তার বুদ্ধিমত্তা ও স্মার্টনেস প্রকাশ করত। হিন্দুদের মধ্যে সেকেন্ড লাইন ভাইবোনের
মধ্যে বিয়ে হয় না। শ্যামলী নন্দী বলতেন মুসলমানদের
সেকেন্ড লাইন ভাই বোনের মধ্যে বিয়ে হচ্ছে শুনলে আমার মনে কি যেন একটা কিত কিত করে।
শ্যামলী দিদিও খুব ভাগ্যবতী, এস এস সি
পাস করে টাইপিষ্ট পদে ব্যাংকে ঢুকে আজ লাখ
টাকা বেতনের এস পি ও।
নোয়াখালীর
যুবক কবির আহমদ ছিলেন ক্যাশিয়ার কাম ক্লার্ক। গৌরবর্ণ
কবির আহমদের অঙ্ক মেলানোর ব্রেন খুব একটা ভাল ছিল না,
তাই কাজে প্রচুর ভুলভ্রান্তি হত। তিনি নোয়াখালীর
আঞ্চলিক ভাষায় গান গাইতেন, ‘বরের চাইতে কইন্যা বড়, ই বিয়ার কি ডেফ আছে। আর হুনলাম
কইন্যার মা হ্যালদি উঠে তাল গাছে’। শুনেছি কবির
সাহেব এক সময় ব্যাংকের চাকুরি
ছেড়ে দেন ও অল্প বয়সে মারা যান।
কর্মপাগল
হারাধন নাথের বাড়ি ছিল ছাগলনাইয়া, ফেনী। তিনি ১৫/২০
বছর ধরে সিলেট অঞ্চলে হাবুডুবু খাচ্ছেন, হেড অফিসে বদলির আবেদন করেছেন কিন্তু কাজ
হচ্ছে না। মেয়েরা বিয়ের
উপযুক্ত অথচ বাবা বছরের পর বছর সিলেটে। আমাকে ধরলেন আমার চাচাত ভাই
ই এ চৌধুরীকে দিয়ে তাকে চট্টগ্রাম কিংবা ফেনী যাবার যেন একটা উপায় করে দেই। এই
কাজের অগ্রিম এনাম স্বরূপ আমাকে হাত করতে তিনি
প্রতিমাসে আমার দুই একটা লেজার ব্যালেন্সিং করে দিতেন।
একবার ব্যাংকের প্রশিক্ষণে ঢাকা যাই। এক ফাঁকে
চেয়ারম্যান অফিসে গিয়ে চাচাতো ভাই ই এ চৌধুরীর সাথে দেখা
করি ও আসার সময় হারাধনের আবেদনপত্র তার হাতে দিলে তিনি একটু বিরক্ত হয়ে হাতে নেন।
আমার কিছুটা সন্দেহ ছিল কাজটা হবে তো? কিন্তু
মাস দেড়েক যেতে না যেতেই হারাধন নাথের বদলির আদেশ আসে সিডিয়ে শাখা চট্টগ্রামে।
বদলির আদেশ পেয়ে হারাধন আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললেন,
কারণ তখন আঞ্চলিক বদলি আজকের মত
এত সহজ ছিল না।
তিনি আবেগ
আপ্লুতকন্ঠে বললেন কোরেশী সাহেব, ভগবান আপনার মঙ্গল করুন। আমি
বললাম, বলুন কোরেশীকে নয়, আল্লাহ ই এ চৌধুরীর মঙ্গল করুন। এখানে ক্যাশ কাউন্টারে
কাজ করতেন নোয়াখালীর বেখাপ্পা চেহারার ক্যাশ অফিসার ফরিদ আহমদ।
ক্যাশ
ইনচার্জ ছিলেন বয়স্ক হবিগঞ্জি লোক এম এ মন্নান, যিনি অঙ্কে এতই কাচা ছিলেন যে তার
পক্ষে তিন লাইনের একটা যোগ মিলানো ছিল অসম্ভব। যোগ-বিয়োগের
কাজ তুষামুদি করে অন্যকে দিয়ে করিয়ে নিতেন। মনে মনে ভাবতাম এত দূর্বল গাণিতিক
মস্তিস্ক নিয়ে তিনি সারাজীবন ব্যাংকে চাকুরি করলেন কেমন
করে? শেষে বুঝলাম এই ধূর্ত মানুষটি টিকে আছেন
কেবল চাপার জুরে। বাকপটু এই চাপাবাজ মানুষটি কোন
পরিশ্রম না করেই সারাজীবন ব্যাংকে কেবল
উন্নতি করেন। কোন টেবিলকাজ না করেও এসএসসি পাস
এম এ মন্নান বরইকান্দি শাখার ব্যবস্থাপক হন এবং সিনিয়র
প্রিন্সিপাল অফিসার হিসাবে অবসর গ্রহণ
করেন।
এই এম এ মান্নান
সাহেব যতরপুরে এক হিন্দুবাড়ি ভাড়া নিয়ে পরে দখল করে বসেন। তার
একটা গুণ ছিল, তিনি নিজের অতীত অপকটে স্বীকার
করে আমাকে বলতেন, ‘চৌধুরী সাব, আমি কোনমতে মেট্রিক পাশ করে লাঙল জোয়াল ফেলে
শুন্যহাতে হবিগঞ্জ হতে পূবালী ব্যাংকের ক্যাশিয়ার হয়ে সিলেটে আসি, আজ এই শহরে আমার
গাড়ি বাড়ি সবই এই রত্নপ্রসবা পুবালী ব্যাংকে বসে হয়ে গেছে। মন্নান সাহেব বদলি হলে
আসেন কুমিল্লার কাজি সফিক। সদাহাস্য কাজি সফিক ছিলেন কথাবার্তায়
স্মার্ট ও কাজে দক্ষ।
এই শাখার ক্যাশে কাজ করতেন হবিগঞ্জের
মোঃ মোজাম্মেল চৌধুরী। তিনি কুচাই পশ্চিমভাগের জননেতা দারা মিয়ার ভাতিজি বিয়ে
করেন। মোজাম্মেল চৌধুরী প্রচুর পত্রিকা পড়তেন। ক্যাশে ভূল করে প্রায়ই জরিমানা
দিতেন। একবার একজন কাস্টমারকে তিনি দশ হাজার টাকা অতিরিক্ত প্রদান করেন। কাস্টমার
ব্যবস্থাপক রুস্তুম আলী স্যারের হাতে এই টাকা জমা দিয়ে চলে যান। বিকেলে দশ হাজার
টাকার খুঁজে গলদঘর্ম মোজাম্মেল সাহেব।
ব্যবস্থাপক স্যার তাকে ডেকে এনে দশ হাজার টাকা ফিরিয়ে দিয়ে ধমক দেন, আগামিকাল হতে
ক্যাশের ভিতর পত্রিকা ঢুকানো যাবেনা। শোকরিয়া আদায় করুন ভদ্রলোক টাকা নিয়ে যাননি,
নইলে জরিমানা গুণতেন। পরে কদমতলি শাখায় গিয়ে আবার তার সাথে চাকুরী করি। ২০২২ সালের
ফেব্রুয়ারিতে সিলেট প্রিন্সিপাল অফিসে যোগদানের কিছুদিন পর ২রা মার্চ অবসরপ্রাপ্ত
প্রিন্সিপাল অফিসার মোজাম্মেল চৌধুরী সিলেটে পরলোকগমন করেন।
ফরিদা নামক
একজন মহিলা সারাদিন পরিস্কার কর্ম ও ফুট ফরমায়েশ কাজ
করতেন।
প্রিন্সিপাল
অফিসার রুস্তুম আলী স্যারের বাসা ছিল শিবগঞ্জ, তার দুই ছেলে। একদিন আমরা তার
ছেলেদের খতনা অনুষ্ঠানে গেলাম। ধুমধাম করে খানাপিনা হল।
আমরা কিছু প্রাইজবন্ড উপহার দেই। মজার ব্যাপার হল এই প্রাইজবন্ড হতে স্যার পঞ্চাশ
হাজার টাকা লটারি জিতে যান।
রুস্তুম আলী স্যার ছিলেন ধার্মিক ও আত্মমর্যাদাবোধ সম্পন্ন মানুষ। তিনি সিলেট
জালালাবাদ হোমিও কলেজ হতে ডি এইচ এম এস ডিগ্রি
নেন। ৭ মার্চ ১৯৯২ সালে রুস্তুম আলী স্যার মহিলা কলেজ শাখা হতে বদলি
হয়ে ঢাকা চলে যান। পরবর্তীকালে উপমহাব্যবস্থাপক পদে থাকাকালে বারবার পদোন্নতি হতে
বাদপড়ায় তিনি হতাশাগ্রস্থ হয়ে পদত্যাগ করেন ও হোমিওপ্যাথি পেশায় চলে যান।
পরদিন ৮ মার্চ ১৯৯২, শাখা ব্যবস্থাপকের দায়িত্বভার
গ্রহণ করেন আমার অন্যতম প্রিয় ব্যাক্তিত্ব জকিগঞ্জের ফরিদ
উদ্দিন। ফরিদ স্যার ন্যায়নিষ্ঠ ও সৎ লোক।
তার আদর্শ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি গরম মানুষ ও কোন ধরনের হাঙ্কিপাঙ্কি
পছন্দ করতেন না। তিনি গর্বের সাথে বলতেন আমি সোনালী ব্যাংকের শিক্ষানবিশ অফিসার ও
সোনালী ব্যাংকের স্বনামধন্য প্রাক্তন মহাব্যবস্থাপক মুফতি বদরু উদ্দিন স্যারের
কাছে ব্যাংকিং শিখে এসেছি। এই মুফতি
বদরু উদ্দিন ছিলেন দরগামহল্লার আমার আপন ফুফুত ভাই, যাকে আমরা ডাকনামে বলতাম
‘এখলাস ভাই’। আমি ১৯ মার্চ ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত এক
বৎসর দুই মাস ফরিদ উদ্দিন স্যারের সহিত মহিলা কলেজ শাখায় কাজ করি।
ফরিদ স্যার
কারণে অকারণে হঠাৎ রেগে
যেতেন, যা পরে তার জন্য ক্ষতির কারণ
হয়ে দাড়াত। শ্যামলী নন্দীর স্বামী একবার পত্নীর কাছে ফোন করলে স্যার ফোন ধরেন।
শ্যামলীদিকে ডেকে না দিয়ে তার স্বামীকে বললেন, বউ চাকুরিতে দিছেন, এত
ফোনালাপ কিসের? সে কাজ করছে, তাঁকে ডেকে দেওয়া যাবেনা। ফরিদ স্যার শ্যামলীর কর্তার
সাথে ফোনে বাকবিতণ্ডায় লিপ্ত হন।
সেইদিন আমি শ্যামলীদিকে কাঁদতে দেখি। স্যারের নিষ্টুর
বকুনী খেয়ে পরিস্কার কর্মী ফরিদাও
মাঝে মাঝে হাউমাউ করে কাঁদত। তবে স্যার
ব্যাংকের স্বার্থে কঠোর হলেও কোনদিন কলম দিয়ে লোকের
উপকার ছাড়া কোন ক্ষতি করেননি। ফরিদ স্যারের বেগমের একজন আত্মীয় নারী
সিলেট শাখার কাজ করতেন। এই নারী অফিসে আসতে প্রায়ই দেরি করতেন। একদিন এই অপরাধে
স্যারের হাতে এই শ্যালিকা চরম অপদস্ত হন। তিনি নালিশ জানাতে ছুটে যান স্যারের
পিরমহল্লার বাসায়। বেগম সাহেবা সব অভিযোগ শুনে আত্মীয়াকে সান্তনা দিয়ে বললেন, বোন
তুমি অফিসে নির্যাতিত আর আমি বাসায় নির্যাতনের শিকার। আমি সারাজীবন ধর্য্য ধরেছি।
কি আর করবা বোন তুমিও ধর্য্য ধর।
উপমহাব্যবস্থাপক
ফরিদ উদ্দিন স্যার ছিলেন আত্মসম্মানি ও আত্মভিমানী ব্যাক্তিত্ব। ২০১০ সালে তার
চাকুরি এক বছরের জন্য বর্ধিত হলে এই সময়
কোন এক কারণে তিনি ব্যাংক পরিচালকদের কোপানলে
পড়েন। ক্ষমা চাইলেই তিনি অনেক সুযোগ সুবিধাসহ রক্ষা পেতেন
কিন্তু মাফ চাননি এবং সিলেটের অঞ্চলপ্রধানের আসন হতে বিদায় গ্রহণ
করেন। শিখগুরু অর্জুনের মত ফরিদ স্যার শির দিলেন তো
শের দিলেন না।
আমি চাকুরিতে
যোগদানের পর ধীরে ধীরে এরশাদ বিরোধী আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করে। নবেম্বর
মাসে বিরোধীদলের সম্মিলিত হরতালে অফিস আদালত বন্ধ হয়ে আসে।
সিলেট কেন্দ্রীয় শহিদমিনারের কাছে ছিল শাখাটির অবস্থান।
লাগাতার হরতালে জিন্দাবাজারে দুতলা অফিসের নিচে সারাদিন পুলিশ ছাত্র সংঘর্ষ চলত। জনতার
ঢিলে বিমান অফিসসহ চারপাশের ভবনের গ্লাস ভেঙ্গে চুরমার হয়ে
যায়। তাই অফিসে লোকজন ঢুকানো ছিল খুবই বিপদজনক। আবার
হরতালে অনুপস্থিত থাকলে চাকুরি থাকবেনা। দাউদপুর হতে খানিকপথ যানবাহনে
খানিক হেঁটে আনেক কষ্টকরে এসে অফিসে নিস্কর্মা
সারাদিন বসে থাকতাম। ২৭ নভেম্বর
ডাঃ মিলন ঢাকার শহিদ হলে আন্দোলনের আগুনে পেট্রোল পড়ে। শাখার
নিচে দাঙ্গাপুলিশ উপরে আমরা, কপাটবদ্ধ অফিসে শ্বাসরুদ্ধকর এক অবস্থার সৃষ্টি হত।
৬ ডিসেম্বর
১৯৯০ সালে দেশের সামরিক ও বেসামরিক আমলাতন্ত্র এরশাদ
সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাহিরে চলে যায় এবং একনায়ক হোসেন
মোঃ এরশাদের পতন ঘটে। দেশবাসী
বহুদিনের এক দুর্বিসহ অবস্থা হতে মুক্তিলাভ করে স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেলেন।
এরশাদের পতনের পর নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য
বিচারপতি সাহাব উদ্দিনের অধীনে তত্ত্ববধায়ক সরকার গঠিত হলে আমাদের বংশের চাচাত
ভাই, সাবেক সচিব, ইমাম উদ্দিন চৌধুরী এই সরকারের বানিজ্য উপদেষ্টা হিসাবে দায়িত্ব
পালন করেন। ১৯৯১ সালে নির্বাচনে জিতে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বি এন পি সরকার গঠন
করে পরবর্তী পাঁচ বছর দেশের শাসনকার্য্য পরিচালনা করে।
মহিলা কলেজ
শাখায় অবস্থানকালে আমি ব্যাংকের বিভিন্ন প্রশিক্ষণে
ছয়বার ঢাকা গমন করি। কাষ্টমার সার্ভিস, ফরেইন এক্সচেঞ্জ, রিফ্রেসার কোর্স, মানি লন্ডারিং
ইত্যাদি নামের প্রতিটি প্রশিক্ষণ দুই থেকে
পাঁচ ছয় দিন পর্যন্ত সংঘটিত হত। চাকুরিতে যোগদানের
পর ঢাকা সদরঘাটে ২৫ মে ১৯৯১ সাল হতে আমাদের ১৩ দিনের ভিত্তি প্রশিক্ষণ
অনুষ্ঠিত হয়।
পুরান ঢাকার
সদরঘাটে ব্যাংকের নিজস্ব ভবনের পাঁচতলায় ছিল ব্যাংকের প্রশিক্ষণ
ইন্সটিটিউট। এখানে থাকারও বন্দোবস্ত করা ছিল। এখানে অবস্থান করে লালবাগের কেল্লা,
পরীবিবির মাজার ও মোগল যাদুঘর, আহসান মঞ্জিল, বাহদুরশাহ পার্ক, হোসনি দালান,
সদরঘাটসহ পুরান ঢাকার সব ঐতিহাসিক নিদর্শন ঘুরে দেখি। ঝাকড়া চুলের ভাস্কর রাসার
সাথেও একদিন দেখা হয়। ব্যাংকের প্রশিক্ষণ
ইন্সটিটিউট পরে হেডঅফিসে চলে গেলে সেখানেও প্রশিক্ষণে
অংশগ্রহ করি। এসব প্রশিক্ষনণে বিভিন্ন
সময় আহমদ এনায়েত মঞ্জুর, অমল কান্তি দাস,
জাহাঙ্গীর আহমদ, ওমর ফারুক, এফ এম আলমগীর হোসেন প্রমুখ আমার শরিক ছিলেন। আমার
দাউদপুর গ্রামের সচিব ডঃ ক্ষণদা মোহন দাসের ভাই অমল কান্তি দাস রসায়নে মাস্টার্স
করে পূবালী ব্যাংকে যোগদান করেন এবং পরে অস্ট্রেলিয়া চলে যান। তিনি ছিলেন ছোটখাট আবয়ব,
আমি তাঁকে সহজে কোলে তুলে নিতাম।
পুবালী
ব্যাংক ট্রেইনিং ইন্সটিটিউটের প্রিন্সিপাল এম এ জলিল ছিলেন খুব রসিক লোক। তিনি
নানা খুশগল্পে ক্লাস জমিয়ে রাখতেন। আমাদের প্রাক্তন এম ডি হেলাল আহমদ চৌধুরী যখন
ক্লাস নিতেন, তখন তার আকর্ষণীয় জ্ঞানগর্ব
বক্তব্যে ক্লাসে নীরবতা নেমে আসত। তিনি একটা কথা সব সময়
বলতেন যা আমি কোনদিন ভুলে যাইনি। তিনি বলতেন Hardwork
has no substitute. তিনি বড় বড় মানুষের উদাহরণ দিয়ে
বলতেন তারা যে খুব মেধাবী ছিলেন তা নয়, বরং সততা,
নিষ্টা ও কঠোর পরিশ্রম তাদেরকে স্মরণীয় ও বরণীয়
করে উচ্চতার শিখরে নিয়ে গেছে। কিন্তু পরবর্তীকালে আমি এর ব্যাতিক্রম দেখেছি, কেবল
তার বর্ণিত এই গুণগুলোর
মাধ্যমে অনেকের পক্ষে উন্নতি করা সম্ভব হয় না,
সাথে দাওয়ারও প্রয়োজন হয়। মামুর জুর কিংবা তৈলমর্দণের
মত বলকারক ঔষধ যারা যথাযত মালিশ করতে জানেন তারাই সফলকাম হন। হেলাল স্যার প্রায়ই মাইন্ডসেটের
কথা বলতেন। তিনি বলতেন কোন লক্ষ্যমাত্রায় উপনীত হতে
হলে আগেই বিষয়টি অর্জনে মনস্থির করে নিতে হবে।
হেলাল আহমদ
চৌধুরী স্যার জকিগঞ্জ উপজেলার দুহাল নামক গ্রামে এক সম্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ
করেন। তিনি ছিলেন একজন বিসিএস ক্যাডার। সদ্য স্বাধীন
দেশের সরকার তাকে সরকারি পুবালী ব্যাংকে নিয়োগ দেন। তিনি
দক্ষতার সাথে বহু বছর এমডির দায়িত্ব পালন করেন। মোঃ
মোস্তাফিজুর রহমান ছিলেন ঋণবিশেষঞ্জ জ্ঞানী বক্তা, তিনি মোল্লা নাসিরুদ্দিন হোজ্জার হাসির গল্প দিয়ে ক্লাস
শুরু করতেন। পরে তিনি ব্যাংকের ডিএমডি হয়ে
অবসর গ্রহণ করেন।
কোন এক
প্রশিক্ষণে গিয়ে আমি ছোটবোন মান্নার
শাহজাহানপুরের বাসায় উঠি। মুন্না ও লিজা তখন ছোট শিশু। ঢাকা মেডিকেল কলেজে গিয়ে
আমাদের পাশের গ্রাম শ্রীরামপুরের ডাঃ আলাউদ্দিনের কাছে বামকান দেখাই। তিনি আমাকে
ভর্তি করে বামকানের পর্দা অপারেশন করেন। পরে একদিন
ঢাকা মেডিকেলে দেখাতে গেলে তাকে ছাত্র পরিবেষ্টিত পাই। তিনি ‘এই লোকটি, এই লোকটি’
বলে তাচ্ছুল্যে করে তার ছাত্রদের সাথে আমার রোগ নিয়ে
আলাপ করলে আমি বেশ মনঃকষ্ট অনুভব করি। আমি কোন
পরিবারের লোক তিনি ভাল করেই জানতেন, তাছাড়া আমার পত্নী ডাঃ নুরজাহান বেগম চৌধুরী
তার মেডিকেল ছাত্রী ছিলেন। তাঁর বৃদ্ধা মায়ের চিকিৎসায় সিলেটের
বাসায়ও যান। এরপর আমি আর কখনও তার কাছে
যাইনি।
১৯৯১ সালের
৭ম সেপ্টেম্বর আমি সিলেটের ঐতিহ্যবাহী কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদের জীবন সদস্য
হই। আমার জীবন সদস্য নং আ-১৪৫০। ১৯৩৬ সালের
১৬ সেপ্টেম্বর দরগাহ মহল্লায় শাহজালালের(রহঃ)
দরগা মোতাওয়াল্লি এ জেড আব্দুল্লার নেতৃত্বে
কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদ স্থাপিত হয়। আমি ১৯৮০ সালে সিলেট মোবাইল পাঠাগারের
প্রতিষ্ঠাতা আমার এক দোলাভাই মনিরউদ্দিন চৌধুরীর
হাত ধরে মুফতিবাড়ি, দরগামহল্লার
ফুফুর বাসা হতে কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদে
যাই।
মনির
দোলাভাই একজন আমোদে হাসিখুশি লোক ছিলেন।
সব সময় তিনি তার পাশে লোকের আড্ডা জমিয়ে রাখতেন। এই জ্ঞানী মানুষটি প্রচুর লিখতেন
ও মাইকে দাড়িয়ে সুন্দর ভাষণ দিতে
পারতেন। তার ইতিহাস বিদ্যা ছিল প্রখর। আমি দরগায় আসলে
ইতিহাস জানতে আমার ফুফার ভাতিজি বর পাশের বাসার আলোর ফেরিওয়ালা মনির দোলাভাইয়ের
কাছে প্রায়ই ধর্ণা দিতাম।
বাল্যকাল
হতেই আমি একজন বইপাগল লোক। একদিন কিশোর আমাকে মনির দোলাভাই তার কর্মক্ষেত্র মুসলিম
সাহিত্য সংসদে নিয়ে যান। মনির দোলাভাইয়ের সাথে হেঁটে হেঁটে দরগার পুর্বগেটে সংসদে ঢুকে
এত বইয়ের সমুদ্র দেখে আমি অবাক হয়ে যাই। বইয়ের এত বড়
রাজ্য আমি জীবনে আর কোনদিন দেখিনি। মনের আবেগে এক তাকিয়া হতে অন্য
তাকিয়ায় কিশোর আমি হেঁটে হেঁটে একটার পর
একটা বই হাতে নিয়ে নাম ও সুচীপত্র পড়তে থাকি।
মন চাইছিল সব মজার বই একসাথে পড়ে সাবাড় করে ফেলি।
সেই সময়ে
বিটিভি ছাড়া আর কোন টিভি চ্যানেল ছিলনা। সারামাসে মাত্র একটি সিনেমা, একদিন রাতে
ছায়াছবির গানের অনুষ্ঠান ‘ঝিলিমিলি’ ও ফজলে লোহানীর ‘যদি কিছু মনে না করেন’ এরমত
হাতেগুনা গুটিকয় অনুষ্ঠান দেখার জন্য মানুষ দিনের পর দিন
উদগ্রীব হয়ে বসে থাকতেন। হাতেগুনা কয়েকজন
নায়ক নায়িকা, গায়ক গায়িকার মুখশ্রী দেখে দেখে মানুষ বিটিভি দেখার স্বাধ মেঠাত।
শাসকশ্রেণির লোকদের নানা গুণগান, স্থুতি বাক্য,
তুষামুদির বন্যায় জনগণের কান জ্বালাপালা করত। এরশাদ,
বেগম রওশন এরশাদ এবং চাটুকার মন্ত্রীদের একমাত্র চ্যানেল বিটিভিতে বারংবার দেখে
বিরক্ত হয়ে লোকে টিভিকে বলত ‘মিয়া বিবি গোলামের বাস্ক’। বেতারের
অবস্থাও ততৈবচ।
আজকের
অনলাইন নেটওয়ার্কের এই মোহনীয় স্বর্গরাজ্যের অস্থিত্বও সেদিনের মানুষের কাছে ছিল
কল্পনাতীত। অতএব মানুষ যাবে কোথায়? তাই সেদিনের
মানুষের কাছে বই ই ছিল ধ্যান, জ্ঞান, আনন্দ, বিনোদন সব। এই আমার শুরু হল এক প্রজ্জলিত
প্রদীপ মনির চৌধুরীর হাত ধরে কেন্দ্রীয় মুসলিম
সাহিত্য সংসদ নামক আলোর ঘরে যাত্রা। আজও এই যাত্রা থামেনি। এই আলোর ঘরের আলোক
বন্যায় আমি এত আলোকিত হই যে এই আলোতে আজও আমি পথ চিনে নেই।
এই ঘরের
রংমঞ্চের হাজার স্মৃতি মনে পড়ে, এখানে
জননেতা দেওয়ান ফরিদ গাজী, লেখক রাঘিব হোসেন চৌধুরী, লেখক মনির উদ্দিন,
সাংবাদিক আব্দুল হামিদ মানিক, আজিজুল হক মানিক, সেলিম আউয়াল, আব্দুল মুকিত অপিসহ
অনেক সুধীজনকে জ্ঞানের আড্ডায় বসতে দেখেছি। একদিন কলেজ সহপাঠি সিদ্দিকুর রহমান
নির্ঝর এই মুসলিম সাহিত্য সংসদের নির্জন এক টেবিলে বসে বইপাঠে নিবিষ্ট
আবুল মাল আব্দুল মুহিতকে দেখিয়ে বলল, হেই সেফাক, এই দেখ
সাবেক অর্থমন্ত্রী বসে বই পড়ছেন। নির্ঝর আর বলল,
প্রেসিডেন্ট এরশাদ তাকে বিদেশ হতে ধরে বেঁধে এনে অর্থমন্ত্রী
করেন। কিন্তু এরশাদের সাথে তার মতের মিল না
হওয়ায় পদত্যাগ করে আবার বিদেশে চলে যান। আমি এই প্রথম আবুল মাল আব্দুল মুহিতের মুখ
দেখি। এখানে সিলেটের আর অনেক বরেণ্য ব্যাক্তিত্বকে
বিভিন্ন সময়ে একমনে বই পড়তে দেখেছি।
আমি সংসদের
আড্ডাখানায় খুব একটা বসতামনা। আমার হাতে সময় থাকত সীমিত, তাই বসে বসে বই পড়ে কিংবা
দরকারি বইটি হাতে
নিয়ে বেরিয়ে আসতাম। কলেজ জীবনে একদিন দুপুরে সংসদে বসে মোঘলসম্রাট বাবুরের আত্মজীবনী
‘তুজুখে বাবুর’ হাতে নেই। বইটি আমাকে এতই আত্মনিমগ্ন করল যে কিভাবে দিন পার হয়ে
রাত্রি নেমে আসে বুঝতেই পারিনি।
সাপ্তাহিক
বৃহস্পতিবারের সাহিত্য সভায় আমার অংশগ্রহণ করার
সৌভাগ্য সময়ের দন্যতায় খুব একটা সম্ভব হয়নি। একদিন কবি কালাম আজাদের সভাপতিত্বে
অনুষ্ঠিত একটি সভায় আমার স্বরচিত কবিতা পাঠ করি। অন্য একদিন
গল্পকার সেলিম আউয়ালের সভাপতিত্বে পরিচালিত সভায় আমার লিখা একটি ছোটগল্প পড়ে
শুনাই। ২০১৩ সালে সংসদের বাৎসরিক সাধারণ সমাবেশে
বক্তব্য রাখার সৌভাগ্যও আমার হয়েছিল। আমি সে বৎসর আমার লিখা ‘ইসফাক কুরায়শী
রচনাসমগ্র’ এর পাচটি কপি উপহার প্রদান করি, যা এই সভায় সম্মানের সাথে স্মরণ
করা হয়।
বেশ কয়েকবার
ভোটের লাইনে দাড়িয়ে সংসদ কমিটি নির্বাচনে ভোট প্রদানের স্মৃতিও আমার বেশ মনে পড়ে।
তখন প্রার্থিরা জনে জনে গিয়ে ভোট চাইতেন এবং সংসদ আঙ্গিনা ব্যানার পোস্টারে ছেয়ে
যেত। সংসদের বইমেলা ও ভোট অনুষ্ঠানে এক
উৎসবমুখর আবস্থা বিরাজ করত। সিলেট আঞ্চলের যতসব কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও লেখক
লেখিকাদের হৈ চৈ, মঞ্চ বক্তব্য, কানাঘুষা, আনন্দব্যদনা, স্মৃতিচারণ
কেমুসাসের বইমেলা ও নির্বাচন অনুষ্ঠানকে এক প্রাণবন্ত
কিংবদন্তি অনুষ্ঠানে পরিণত
হত। আমার স্মৃতিময় এই প্রতিষ্ঠানের
জীবন সদস্য হওয়া যতই তুচ্ছ ঘটনা হউক না কেন তা আমার কাছে একটা বড় ও মহৎ কিছু হবার
মত আমার সাধারণ জীবনে ঘটা এক অসাধারণ ঐতিহাসিক
ঘটনা বলেই মনে হয়।
চাকুরী
স্থায়ীকরণের জন্য ২৬ জুন ১৯৯২ সালে আমাদের
লিখিত পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। আমরা এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ
হলে ১লা সেপ্টেম্বর ১৯৯২ সালে আমার চাকুরী স্থায়ীকরণ
কার্যকর হয়। এই পরীক্ষায় অনেকে আটকাও পড়েন। শিক্ষানবিশ সিনিয়র অফিসার মইনুল ভাই ও
দিলদার ভাইয়ের মত লোকও পরীক্ষায় আটকা পড়ে যান। এই শাখায় অবস্থানকালে হতাশাগ্রস্থ আমি লন্ডনে যেতে আবার সেখানকার একটি কলেজে ব্যাংকিং
বিষয়ে ভর্তি হই। কিন্তু এবারও স্পন্সর দুর্বলতায় ভিসা পেতে ব্যর্থ হই।
চাকুরীতে
যোগদান করেই আমি দাউদপুরের ঘরের কিছু পাকার কাজ করি। বড়ঘরের মেঝে সহ উত্তরের একটি
কোঠা ও পাকঘর নির্মাণ হয়। আমাদের গ্রামের কোনারপাড়ার
কুটই আলী মিস্ত্রি কাজ করেন।
জুনিয়র অফিসারের কনসলিডেটেড বেতন ছিল ২৩৬৩/=টাকা। মনে পড়ে আমার এক মাসের বেতন এই
২৩৬৩/= টাকায় আমি তখন তিন হাজার ইট কিনি। এত বৎসর পর আজ আমি যখন হিসেব মিলাই তখন
দেখি বারবার এত বেতন বৃদ্ধির পরও জুনিয়র অফিসারের বেতন এই তিন হাজার ইটের দামের
সমানই রয়ে গেছে।
তখন রুস্তম
আলী স্যারের আমল, ছাতকের একজন লন্ডনি একদিন এসে
তার হিসাবের স্থিতি বাইশ লক্ষ টাকা উঠাতে চান। স্যার
বললেন এত নগদ টাকা আমাদের হাতে নেই। কালকে
আসেন আমরা সিলেট শাখা হতে এনে দেব। পরদিন লোকটি আসলে তাকে ২২লক্ষ টাকা পরিশোধ করা
হয়। টাকা পেয়ে এই গ্রাম্যলন্ডনি অনেকক্ষণ
ধরে টাকাগুলো গুনেগুনে দেখে বললেন আজ আমার টাকা লাগবেনা আবার জমা করে দেন। লোকটি
চলে যাবার পর ক্যাশের মন্নান স্যার বললেন, এই এতটাকা একসাথে উঠায়ে আবার জমাকরনের
মুজেজা কি কেউ বলতে পারেন? ভদ্রলোক পরীক্ষা করলেন লন্ডন হতে পাঠানো তার টাকাগুলো
একাউন্টে ঠিকঠিক আছে কিনা। টাকাগুলো গুণেগুণে
যখন দেখলেন বাইশ লক্ষ ঠিক আছে তখন নিশ্চিত হলেন
নিশ্চয়ই কোন ধরনের খেয়ানত হয়নি। ব্যবস্থাপক রুস্তম আলী খুশি হয়ে বললেন,
শোকরিয়া, আল্লাহর রহমতে আমাদের ২২ লাখ টাকা
ডিপোজিট চলে যায়নি।
ব্যাংকের পাশে
মো ভিলা। এই ভিলার মালিক মো মিয়া একজন দাম্ভিক নিচমনা লোক। লাল মাতাল চোখের এই কাল
লোকটা প্রতিদিন ব্যাংকে এসে দেশে বিদেশে তার টেলিফোন করার কাজ মাগনা সেরে নিত। লোকটা বেতমিজ
হওয়ায় ম্যানেজার শত বিরক্ত হলেও কিছু বলার সাহস করতেন না। রোজ
রোজ এসে টেলিফোনটি সে তার বাপের সম্পদের মত ব্যাবহার করত। কালো
এই লোকটার একটা অদ্ভুদ গর্ব ছিল যে, তার ভাই সামরিক শাসক এরশাদের একজন এমপি, এই শয়তান
এম পি ছিল একজন খুনী, সে কদমতলীর আজাদ
বখতকে গোলশান হোটেলে জূয়ার আসরে পিস্তল দিয়ে খুন করেছে।
মোতালেব মিয়া বেশ অহঙ্কার করে তার কীর্তিমান ভাইয়ের
এই খুনের কাহিনি বলত যেন তার বাহাদুর ভাই একটা খুব
ভাল সুনামের কাজ করেছে। মোতালেব মিয়া এই
আত্মঅহংকারে নিমগ্ন থাকাকালেই একদিন তার ক্যানাডা পলাতক এমপি ভাইয়ের বিরুদ্ধে মৃত্যুদন্ডের রায় ঘোষিত হয়। অদ্ভুদ দেশ ক্যানাডা,
তাদের দেশে মৃত্যুদন্ডের বিধান না থাকায় তারা মৃত্যুদন্ড প্রাপ্ত পৃথিবীব সব
ভয়ঙ্কর অপরাধীদেরকে রাজনৈতিক আশ্রয় ও নাগরিত্ব দেয়। এমনকি বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত
খুনী নুর চৌধুরীর মত ঘৃণ্য অপরাধীকেও
তারা জামাই আদরে আশ্রয় প্রদান করে। এরশাদের এই খুনী এমপি ক্যানাডা হতে এখন দেশে
আসলেই তাকে গলায় ফাঁসির দড়ি পরতে হবে। আমার ভাবতে অবাক লাগত এসব বাজে লোকেরা তাদের
অপকর্ম লোক সমক্ষে প্রকাশ করাকে লজ্জার কাজতো মনে করতই না বরং মনে করত দশজনের কাছে
বলিয়া বেড়ানোর মত দারুণ অহংকারের কাজ।
এই শাখায় অনেক
নামী দামী লোকজনও আসতেন। এখানে প্রায়ই
বিচারপতি রনধীর শর্মা ও তার পত্নী রেবা সেন আসতেন। সিলেট
মহিলা কলেজ প্রতিষ্ঠাকালে রেবা সেন এই কলেজে অবৈতনিক
প্রভাষকের দায়িত্ব পালন করেন। সেই সময়ে তিনি হিসাবটি খোলেন। তাদের জ্ঞানগরিমা ও
শিষ্টাচার আমাদেরকে বিমুগ্ধ করত। আমাদের একজন অতিপ্রিয় ঋনগ্রাহক মোহাম্মদ জামান
ভাই, যিনি ছাতক হতে সিলেটে হিজরত করে আসেন। সদাহাস্য জামান ভাইয়ের প্রকৃত নাম
হুশিয়ার আলী। সিলেটে এসে ব্যবসা বানিজ্যে তিনি খুবই উন্নতি করেন, গাড়িবাড়ির মালিক
হন। হুশিয়ার আলী ভাই খুব উদারমনের মানুষ, তিনি এফিডেভিট করে নিজেকে একটি মানানসই নাম উপহার দেন, সুন্দর এই নামটি-
মোহাম্মদ মাসুদ জামান।
আমার অনুজ
নিশাত চৌধুরী ১৯৯০ সালে এসএসসি (বিজ্ঞান)
পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হয়। আমি
তাকে এম সি কলেজে ভর্তি করে দেই। একই পরিবার
হতে আমার পিতা সফিক চৌধুরী ১৯৩৫ সালে, আমি ১৯৮১ সালে ও নিশাত
১৯৯০ সালে এম সি কলেজের একাদশ শ্রেনীতে ভর্তি হয়। এম সি কলেজের হোস্টেলে সিট না
পেয়ে তাকে টিলাগড়ের একটি মেছে পাঠিয়ে দেই। ১৯৯২ সালে সে দ্বিতীয় বিভাগে এইচ এস সি
পাশ করে।
এই মহিলা
কলেজ শাখায় থাকাকালে ১৯৯১ সালের কোন একদিন মোগলাবাজার রেবতী রমন উচ্চবিদ্যালয়ে
আমার পিতা সফিকুর রহমান চৌধুরীর বিদায় সম্বর্ধণা
অনুষ্টিত হয়। এখানে তিনি তার সুদীর্ঘ্যকালের শিক্ষকতা জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটান।
১৯৯০ সালের ২৭ আগষ্ট ব্যাংকের চাকুরিতে ঢুকেই আমি তাকে
অবসর গ্রহণে পাঠাই। বহুদিন কোন খবর নেই হঠাৎ
স্কুল হতে একদিন জানান হল তার বিদায় সম্বর্ধণা
হবে। তখন প্রধানশিক্ষক ছিলেন সবার প্রিয় শ্রীগুনেন্দ্র চক্রবর্তী স্যার। স্কুলের
রাস্থাপাশের উত্তরের ঢালাই ভবনে সম্বর্ধণা অনুষ্ঠান
হয়।
রি-ইউনিয়নের
মত এই অনুষ্ঠানটি আব্বার নতুন ও পুরাতন ছাত্রদের
এক বিশাল মিলন মেলায় পরিণত হয়। বড় হলঘর পুর্ণ হয়ে
অনেকে বাহিরে বারান্দায় দাড়িয়ে থাকেন। অনেক বক্তা আব্বার অনেক গুণাগুণ
বর্ননা করে অনেক স্মৃতিচারণ করলেন।
তারা বক্তব্যে নিজেরা কাদলেন, অন্যদেরকেও কাদালেন। এই অনুষ্টানের প্রধান অতিথি হয়ে
আসেন আমার আদর্শ শিক্ষক, এম সি কলেজের বাংলা বিভাগীয় প্রধান ডঃ শফি উদ্দিন।
বক্তব্যে ডঃ শফি উদ্দিন স্যার বললেন,
আমি বিষ্মিত মফস্বলের একজন হাইস্কুল শিক্ষক ছাত্রদের কাছে যে এত জনপ্রিয় হতে
পারেন, এত শ্রদ্ধাভাজন হতে পারেন, এখানে না এলে তা আমার বিশ্বাসই হতনা।
অজস্র অজস্র
মানপত্র, পুষ্প্যমাল্য ও উপহারে ঘরের একটি কোণ
ভরে যায়। এসব শ্রদ্ধাঞ্জলি বিতরণ
করে করে হেডস্যার ও শফি উদ্দিন স্যার হাফিয়ে উঠেন। কেউকেউ বক্তব্যে বললেন মানুষের
ভালবাসাই তো জীবনের সার্থকতা। স্যারের জীবন সার্থক, তিনি জীবনভর মানুষের শ্রদ্ধা ও
ভালবাসা পেয়েছেন। অনুষ্ঠান শেষে আব্বা সফিক চৌধুরীকে নিয়ে
রাতে যখন ঘরে ফিরলাম, তখন বারবার মনে পড়ছিল কবি জীবনানন্দ দাসের ‘বনলতা সেন’
কাব্যের কয়েকটি লাইন “সমস্ত দিনের শেষে শিশিরের শব্দের মতন,/ সন্ধ্যা আসে, ডানায়
রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলে চিল।/ পৃথিবীর সব রঙ নিভে গেলে পান্ডুলিপি করে আয়োজন,/ তখন
গল্পের তরে জোনাকির রঙ্গে ঝিলমিল,/ সবপাখি ঘরে আসে- সব নদী- ফুরায় এজীবনের সব
লেনদেন”।
১৯৯২ সালে
এই শাখায় থাকাকালে ভারতে ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদ ভাঙ্গার মত ঘৃণ্য
ঘটনা সংঘটিত হয়। সারা ভারতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় শতশত নিরিহ
মানুষ নিহত হন। এর কিছুটা উত্তাপ বাংলাদেশে এসে পড়ে। বাবরি মসজিদ ভাঙ্গার
প্রতিবাদে একদিন ব্যাংকের মহিলা কলেজ
শাখার সামনের রাস্থা দিয়ে হাজার হাজার
মানুষের এক বিশাল জঙ্গি মিছিল বয়ে যায়। মিছিলটি এত বড় ও
জঙ্গি ছিল যে এধরনের মিছিল আমি সিলেটে আর কখনও দেখিনি।
সিলেটের হিন্দু মন্দিরগুলোয় কিছু মিছিলকারী লোক ডিল নিক্ষেপ ও ভাংচুর করে। জানালা
দিয়ে এই বিশাল জঙ্গি মিছিল দেখে
আমাদের হিন্দু সহকর্মী শ্যামলী দি ও সাথী দি ভয়ে কাঁপতে
শুরু করেন। আমরা দরজা জানালা বন্ধ করে দেই ও তাদেরকে সাহস দিয়ে বলি কোন ভয় করবেন
না আমরা জীবিতাবস্থায় আপনাদেরকে কেউ কিছু করতে
পারবেনা।
বিকেলে ফরিদ
স্যার বিশ্বস্থ লোক মারফত তাদেরকে বাসায় পৌছে দেন। বাবরি মসজিদ ভাঙ্গার প্রতিবাদে
আমাদের চৌধুরীবাজারে কোন এক শুক্রবার বিকেলে জনসভা অনুষ্ঠিত
হয়। এই জনসভায় আমি বক্তব্যে বলি ভারতে ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদ ভাঙ্গা নিঃসন্দেহে
একটি চরম নিন্দনীয় কাজ, কিন্তু এই ঘটনায় আমাদের বাংলাদেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের কোন
লোকজন জড়িত নন। এটা ভারতের আভ্যন্তরীণ ব্যাপার, ভারতে সংঘটিত কিছু দুবৃত্তের এই
অপকর্মের দ্বায়ভার আমাদের দেশের সাধারণ নিরীহ
হিন্দু লোকজনের উপর কোনমতেই চাপানো যায়না।
ইন্ডিয়ার এই ঘৃণ্য ঘটনায় আমাদের দেশের শান্তি শৃংখলা
যেন বিনষ্ট না হয়। আমরা এই ঘটনার নিন্দা ও প্রতিবাদ করি, কিন্তু তা যেন শান্তিপুর্ণ
হয় এবং কোন মতে হিংসাবিদ্বেষ বা সাম্প্রদায়িকতায়
পরিণত না হয়। আমাদের দেশে ধর্মবর্ণ
নির্বিশেষে প্রতিটি মানুষের জানমাল ও ইজ্জতের নিরাপত্তা রক্ষা আমাদের সমাজের সকলের
ঈমানি দায়িত্ব। এদায়িত্ব পালনে আমরা যেন সদা সচেষ্ট থাকি।
অবশ্য কিছুদিন পর উগ্রবাদীদের বাবরি মসজিদ
ভাঙ্গার উত্তাপ ধীরে ধীরে কমে গিয়ে শীতল হয়।
ব্যবস্থাপক
ফরিদউদ্দিন স্যারের একবার জন্ডিস হলে কয়েকদিন অফিসে আসতে পারেন নি।
আমি একদিন ফাজিলচিস্ত মহল্লার সর্বশেষ বাসাটিতে গিয়ে তাকে দেখে আসি। তার পাশের
বাসায় থাকতেন আমাদের আরেক জন ব্যবস্থাপক
বড়লেখার বর্নি গ্রামের এম এ মান্নান ডিজিএম স্যার।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন