Pages

প্রকাশিত গ্রন্থ-সমূহ

শুক্রবার, ১৫ জানুয়ারী, ২০১৬

হজরত শাহজালাল (রঃ) আগমনের প্রক্ষালে শ্রীহট্টের প্রাচীন রাজ্য সমূহ



প্রাচীন শ্রীহট্ট গৌড়, লাউড়, তরফ, বানিয়াচং, ইটা, জগন্নাথপুর, জয়ন্তিয়া, প্রতাপগড় ইত্যাদি ছোট ছোট রাজ্যে বিভক্ত ছিল। প্রত্যেক রাজ্যে ভিন্ন ভিন্ন নৃপতি রাজত্ব করতেন। বর্তমান উত্তর সিলেট প্রাচীন গৌড় রাজ্য নামে প্রসিদ্ধ ছিল। তৎকালীন গৌড় রাজ্যের বিক্রম ও প্রতাপ পাশ্ববর্তী অন্যান্য রাজ্য অপেক্ষা অধিক ছিল। তৎপর ইটা, প্রতাপগড়, জয়ন্তিয়া ও লাাঊড়ের কিয়দংশ গৌড়ের সঙ্গে সম্মিলিত হয়ে উক্ত রাজ্যের শক্তি ও প্রতাপ প্রভুত পরিমানে বৃদ্ধি পায়। ৭৫০ সালে লাউড় রাজ্য কামরূপ হতে পৃথক হয়। দশম শতকে সিলেট বিভাগ মোঠামোঠি লাউড়, জৈন্তা ও গৌড় এই তিন রাজ্যে পরিণত হয়।
পূর্বকালে সিলেটে গৌড়গোবিন্দ নামে এক পরাক্রান্ত রাজা রাজত্ব করতেন। তার রাজধানী শ্রীহট্টে স্থাপিত হয়। গৌড়গোবিন্দ প্রতিমা পূজক ছিলেন। গৌড় রাজ্যের অধীশ্বর বলে তিনি গৌড়গোবিন্দ নামে অভিহিত হন। গৌড়গোবিন্দের পৈত্রিক পরিচয় সম্মন্ধে ইতিহাস সম্পূর্ণ নীরব। সিলেটের ইতিবৃত্তকাররা পৌরানিক কাহিনি অবতারণা করে গৌড়গোবিন্দের পৈত্রিক পরিচয় উদ্ধারে যে গবেষণা করেছেন, বর্তমান বৈজ্ঞানিক জগতে তা নিতান্তই অচল। তবে এতটুকু জানা যায় যে গৌড়গোবিন্দ কোন নির্বাসিতা ত্রিপুর রাজমহিষীর সন্তান ছিলেন। কোন কোন ইতিহাসবেত্তা গোবিন্দকে বাংলার গৌড়ের সেন রাজবংশের একজন বংশধর মনে করেন, যিনি মুসলিম অগ্রাভিযানের মুখে পূর্ববঙ্গ অতিক্রম করে শ্রীহট্টের সিংহ-বংশীয় রাজাকে যুদ্ধে পরাজিত করে সিলেটে স্বাধীন গৌড় রাজ্য গড়ে তুলেন ও প্রাচীন গৌরবের প্রতীক হিসাবে “গৌড়” শব্দটি নামের পূর্বে যুক্ত করে গৌড়গোবিন্দ নামে পরিচিত হন। আবার কেউ কেউ মনে করেন সিলেটের আদি রাজা গোড়কের নামে রাজ্যটির নাম 'গৌড়' হয়েছে। রাজা গৌড়গোবন্দ ছিলেন এই বংশের শেষ সার্বভৌম শাসক। 
শ্রীহট্টে  মুসলিম বিজয়ের পূর্বে চব্বিশ বৎসর গৌড়গোবিন্দ প্রবল প্রতাপে সিলেটে শাসনদন্ড পরিচালনা করেন। সিলেটের এই শেষ হিন্দু শাসক অতীব ধূর্ত ও তীক্ষ্ণ ধীশক্তিসম্পন্ন ছিলেন। তিনি গেরিলা যুদ্ধকৌশল জানতেন এবং অন্তরালে থেকে লক্ষ্য ভেদ করতে পারতেন। তিনি অনেক কুটকৌশল জানতেন ও তার অসাধারণ ক্ষমতা ছিল বলে মুসলমানগণ তাকে যাদুবিদ্যা বিশারদ বলে বর্ণনা করেছেন। বর্তমান আম্বরখানা বাজারের উত্তর পাশে মজুমদারী মহল্লায় গৌড়গোবিন্দের দুর্ভেদ্য দুর্গ ছিল। পূর্বে এই স্থান গৌড়দোয়ার নামে অভিহিত হত। শহরের বর্তমান চৌহাট্টার উত্তরাংশে মিনারায়ের টিলায় উচ্চ স্থম্ব বিশিষ্ট সুদৃঢ় রাজপ্রসাদ ও দেবমন্দির উচ্চতায় ও বৈভবে সিলেট রাজ্যের গৌরব ও মহিমা বিঘোষিত করত। 
উপাখ্যানে বর্ণিত রাজা গৌড়গোবিন্দের অস্থিত্ব কোন শিলালিপি বা তৎকালীন ঐতিহাসিক কোন লিখিত বিবরণে পাওয়া যায় না। গৌড়গোবিন্দ প্রসঙ্গে সুখময় মুখোপাধ্যায়ের অভিমত 'সিলেট বিজয় কাহিনির গৌড়গোবিন্দের ঐতিহাসিকতা সম্মন্ধে এ পর্যন্ত কোন প্রমাণ পাওয়া যায়নি।' তবে মুসলমানদের সিলেট বিজয়কাল থেকে তৎকালীন হিন্দু রাজা গৌড়গোবিন্দের নাম ও কাহিনি প্রজন্ম হতে প্রজন্মে মানুষের হৃদয়ে বিরাজিত হয়ে আসছে এবং তাই আজ ইতিহাসের এক অলিখিত ও অপ্রমাণিত উপাদানে পরিণত হয়েছে। 
তাছাড়া তখন  হবিগঞ্জের ছোট রাজ্য তরফে আচক নারায়ন নামে এক ক্ষুদ্র হিন্দু রাজাও রাজত্ব করতেন, তার সম্পর্কেও এধরণের গোহত্যার অপরাধে নরহত্যার কাহিনি প্রচলিত রয়েছে।
দিল্লির তৎকালীন শাসকবর্গের দুর্বলতার সুযোগে অনেক প্রদেশ দিল্লির অধীনতা ছিন্ন করে ছিল, তখন বঙ্গদেশে ইতিহাস প্রসিদ্ধ সোলতান শামসউদ্দিন ফিরোজ শাহ সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে রাজত্ব করতেন। শামসউদ্দিন প্রকৃতপক্ষে বাংলার স্বাধীন নরপতি ছিলেন। শামসউদ্দিন ফিরোজ শাহ দিল্লির বাদশাহ গিয়াসউদ্দিন বলবনের অধস্তন পুরুষ অথবা তার প্রেরিত একজন পদস্ত কর্মকর্তা ছিলেন বলে ঐতিহাসিকেরা মনে করেন। তাই সিলেটে প্রাপ্ত শিলালিপিতে তাকে দেহলভি (দিল্লিবাসী) উল্লেখ করা হয়েছে। 
শামসউদ্দিন রাজ্য লাভের পর জাজিনগর ও ত্রিপুরা আক্রমন করেন। তখন প্রতাপ মানিক্ষ্য ত্রিপুর রাজসিংহাসনে অধিষ্ঠিত ছিলেন। এই সময় সমগ্র বাংলাদেশে ইসলামের বিজয় পতাকা উড্ডীন হয় ও সোনারগাঁয়ে পূর্বাঞ্চলীয় রাজধানী স্থাপিত হয়। এই স্থান হতে পূর্ববাংলার ঈশান কোনে অবস্থিত শ্রীহট্টে আক্রমন পরিচালনা করা সহজ হয়েছিল। শামসউদ্দিন ত্রিপূরা আক্রমন করেন ও যুদ্ধে প্রতাপ মানিক্যকে পরাজিত করে অনেক হস্থি ও অর্থ লাভ করেন। শামসউদ্দিনের এই আক্রমন ও বিজয় অত্র অঞ্চলের ছোট ছোট নরপতিদের আশংকার কারণ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। রাজা গৌড়গোবিন্দ এই  শামসউদ্দিনের সমসাময়িক ছিলেন। শামসউদ্দিন সিলেটে এসেছিলেন কিনা জানা যায় না। তবে তাঁর শাসনামলে ১৩০৩ সালে সিলেটে প্রথম মুসলিম বিজয় সুচিত হয় এবং সিলেটের শেষ স্বাধীন হিন্দু রাজত্বের অবসান ঘটে।
সূত্র গ্রন্থ: বৃহত্তর সিলেটের ইতিহাস প্রকাশকালঃ নভেম্বর ১৯৯৭ইং; আল ইসলাহ শাহজালাল সংখ্যা, প্রকাশকাল-১৯৫৮ইং
                         
দাউদপুর চৌধুরীবংশীয় সাহিত্যিক ইসফাক কুরেশী, তাঁর অগ্রজ তাহমিদ কুরেশী ও অনুজ নিশাত কুরেশী

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন