ছবিঃ আবু আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ ইবনে বতুতা
ইবনে বতুতা ছিলেন একজন বিখ্যাত মুসলিম চিন্তাবিদ, বিচারক এবং সুন্নি মালেকি মাযহাবে বিশ্বাসী ইসলামি ধর্মতত্ত্ববিদ। তিনি ১৩০৪ সালের ২৫ ফেব্র“য়ারি উত্তর আফ্রিকার দেশ মরক্কোর তানজিয়ারে জন্ম গ্রহণ করেন। এই বিখ্যাত পর্যটকের নেশা ছিল ভ্রমণ। সারা জীবন তিনি এক দেশ হতে অন্যদেশে ঘুরে বেরিয়েছেন। যখন যে দেশেই এই বিশ্ববিখ্যাত পরিভ্রাজক গমন করেছেন সেখানেই তিনি লাভ করেছেন রাজানুকোল্য ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির মর্যাদা। তিনি ভারত সম্রাট মোহাম্মদ বিন তুঘলকের স্নেহভাজন হন ও দিল্লিতে বহু বছর কাজির দায়িত্ব পালন করেন। ভ্রমণের জন্য তিনি বিখ্যাত হয়ে আছেন। মধ্যযুগের তীব্র প্রতিকূলতা ও নিরাপত্তাহীন যোগাযোগ ব্যবস্থাকে উপেক্ষা করে এই অদম্য সাহসী মানুষটি তার ৩০ বৎসরের ভ্রমণ জীবনে প্রায় ৭৩ হাজার মাইল পথ পাড়ি দিয়ে ছিলেন। বর্তমান মুসলিম বিশ্বের প্রায় সমুদয় দেশ তার বিশাল ভ্রমণপথের আওতায় পড়ে।
তিনি ১৩২৫ সালের ১৪ জুন মক্কায় হজ্জ পালনের জন্য জন্মভুমি মরক্কোর তানজিয়ার হতে বের হন। এই তার ভ্রমণ শুরু হয়ে আর থেমে থাকে নাই, সমগ্র উত্তর আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য, মধ্যএসিয়া, তুরস্ক ও ইরান হয়ে ভারতবর্ষ অতিক্রম করে পূর্ব এশিয়া পার হয়ে সুদুর চীন পর্যন্ত প্রসারিত হয়। জীবনের শেষপ্রান্তে এসে তিনি পশ্চিম আফ্রিকা ও স্পেনদেশ সহ ইউরোপের বিশাল এলাকা ভ্রমণ করেন।
ইটালির ভেনিস নগরীর বাসিন্দা মার্কোপোলো তারও আগে পূর্ব ইউরোপ হয়ে মধ্যএসিয়ার ভিতর দিয়ে মঙ্গোলিয়ার শীতল গোবি মরুভুমি অতিক্রম করে চীনের গ্রেটওয়াল পার হয়ে চীনদেশে প্রবেশ করেন। তিনি বিখ্যাত মোঙ্গর বিজেতা চেঙ্গিস খানের পৌত্র চীনের সম্রাট কুবলাই খানের আনুকুল্য লাভ করে তার দরবারে গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তা হিসাবে দীর্ঘকাল দায়িত্ব পালন করেন। তার মাধ্যমে ইউরোপিয়রা সর্বপ্রথম চীনদেশ সম্পর্কে ধারনা লাভ করে।
কিন্তু ইবনে বতুতা মার্কোপোলোর চেয়েও অনেক বেশি পথ অতিক্রম করেন। কখনও পদভ্রজে, কখনও অশ্বপৃষ্টে আবার কখনও সমুদ্রপথে যন্ত্রহীন জলযানে এই বিশাল বিপদ সংকুল পাহাড়, নদী ও সমুদ্রপথ তিনি পার হন। অনেক সামুদ্রিক দ্বীপমালাও তার ভ্রমণের আওতায় রয়েছে। এই বিশাল ভ্রমণ কাহিনির চিত্তাকর্ষক বিবরণ হচ্ছে আরবি ভাষায় ইবনে বতুতা বর্নিত ও ইবনে জুজাইর কতৃক মরক্কোর সুলতানের নির্দেশনায় লিখিত বিখ্যাত গ্রন্থ “রিহলা”। এই গ্রন্থটির মাধ্যমে আমরা চৌদ্দ শতাব্দীর পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের রাজন্যবর্গ ও মানুষের জীবনাচরণ, ধর্ম, কৃষ্টি ও সংস্কৃতি সম্পর্কে সঠিক ধারনা লাভ করতে পারি। তৎকালীন বিভিন্ন দেশ ও শহরের প্রকৃতি, পরিবেশ, মানুষ ও রাজরাজড়ার বিবরণ অতি সুন্দরভাবে তিনি চিত্রিত করেছেন।
ইবনে বতুতা সিলেটের শাহজালালের সহিত সত্যিই সাক্ষাৎ করেছিলেন কিনা এব্যাপারে মুফতি আজহার উদ্দিনসহ বিভিন্ন ইতিহাসবেত্তাদের মধ্যে ভিন্নমত সৃষ্টি হওয়ায় আমি এই বিষয়ের উপর এখানে আলোকপাত করলাম।
হজরত শাহজালাল নামক একজন পশ্চিমদেশীয় দরবেশ সিলেটের শেষ স্বাধীন হিন্দু নরপতি গৌঢ় গোবিন্দকে আধ্যাত্মিক শক্তিবলে পরাজিত করে সিলেটকে সর্বপ্রথম মুসলিম শাসনাধীনে নিয়ে আসেন।
হজরত শাহজালালের সময়কাল বিষয়েও মতবৈষম্য রয়েছে। প্রসিদ্ধ মুর ভ্রমণকারী ইবনে বতুতা কামরূপের পার্বত্যদেশে ১৩৪৫/১৩৪৬ খ্রিস্টাব্দে তথা ৭৪৫ হিজরি সনে জালাল উদ্দিন তাবরিজির দর্শন লাভ করেন। কোন কোন ক্ষেত্রে ভুলবসতঃ তাবরিজির স্থলে তাঁকে সিরজিও লিখা হয়েছে। আদি ভারতীয় সুফিগণের জীবনচরিতে সিরাজি কিংবা তাবরিজি কোনও জালাল উদ্দিনের উল্লেখ নেই। সুতরাং ইবনে বতুতার সাক্ষাৎকৃত জালাল উদ্দিন তাবরিজি/সিরাজি সিলেটেরই হজরত শাহজালাল(রঃ)। সেকালে সিলেট কামরূপের অর্ন্তভুক্ত ছিল।
যারা সিলেটের হজরত শাহজালালকে ইবনে বতুতার জালালউদ্দিন তাবরিজি হতে পৃথক মনে করেন, তাদের যুক্তি এই যে তারা মনে করেন সিলেটের হজরত শাহজালাল ৭৪০ হিজরিতে ইন্তেকাল করেছেন। কিন্তু ইহা একটি ভুল মৃত্যু-তারিখ। ইহা নিশ্চিত যে ইবনে বতুতা হজরত শাহজালালের সহিত সাক্ষাৎ করেন এবং তার বর্ণিত জালালউদ্দিন তাবরিজি তথা হজরত শাহজালাল ৭৪৬ হিজরিতেই দেহত্যাগ করেন। অর্থাৎ এখানে মাত্র ছয় বৎসরের ব্যবধান তৈরি হয়।
অন্যদিকে পশ্চিমবঙ্গের মালদহ জেলার পান্ডুয়ার দেওতলায় যে জালাল উদ্দিনের সমাধি রয়েছে প্রস্তরলিপি অনুযায়ী তার ইন্তেকালের তারিখ ৬৪২ হিজরি (১২৪৪ খ্রিস্টাব্দ)। কাজেই পান্ডুয়ার জালাল উদ্দিন ইবনে বতুতা ভারতে আসার অনেক আগে ইন্তেকাল করেন। তাছাড়া ইবনে বতুতা পান্ডুয়া যাওয়ারও কোন প্রমাণ পাওয়া যায় না। ইবনে বতুতার বর্ণিত জালাল উদ্দিনের সমাধিও তার বর্ণনা মতে কামরুপেই তাঁর খানকায় অবস্থিত। কাজেই কামরুপ বা আসাম অঞ্চলের বাহিরে বাঙ্গালা বা অন্য কোন অঞ্চলের সমাধিতে শায়িত জালাল উদ্দিন নামের কোন দরবেশ ইবনে বতুতার দেখা কামরুপের জালাল উদ্দিন নন।
অন্যলোকের স্বপ্নদৃষ্ট বিবরণের উপর ভিত্তি করে মুফতি আজহার উদ্দিন ব্রহ্মপুত্র তথা যমুনা নদীর উজানে আসামের পাহাড়ি আদিবাসী অধ্যুষিত অগম্য এক অমুসলিম এলাকায় অনুমানের উপর ভিত্তি করে ইবনে বতুতার সহিত সাক্ষাৎকৃত যে শাহজালালের মাযারের বিবরণ লিপিবদ্ধ করেছেন তা সঠিক বলে ধরে নেওয়ার কোন বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই।
ইবনে বতুতা সিন্ধু অঞ্চলে তথা ভারতীয় উপমহাদেশে সর্বপ্রথম প্রবেশ করেন ৭৩৪ হিজরি তথা ১৩৩৩ খ্রিস্টাব্দে এবং এর বার বৎসর পর ৭৪৬ হিজরি (১৩৪৫ খ্রিস্টাব্দে) মুসলিম অধ্যুষিত কামরুপে হজরত শাহজালালের সাথে সাক্ষাৎ করেন। সিলেট তখন কামরূপের অংশ ছিল। অথচ তখন সিলেট ছাড়া কামরুপ বা আসামের কোন অংশ মুসলিম রাজ্যভুক্ত ছিলনা। অধিকন্তু কামরূপ বা আসাম অঞ্চলে আমাদের হজরত শাহজালাল ব্যতিত সমসাময়িক এমন কোন অনুরূপ “জালাল উদ্দিন তাবরিজি” নামের সুপ্রসিদ্ধ কোন দরবেশের অস্থিত্ব খোঁজে পাওয়া যায়না, যেখানে ইবনে বতুতার মত একজন সুবিখ্যাত পরিভ্রাজক গমন করতে পারেন। এমনকি শ্রীহট্ট ব্যতিত তখনকার যুগে কামরুপ বা আসাম অঞ্চলে তেমন কোন মুসলিম জনবসতিও ছিলনা যেখানে জালালউদ্দিন নামীয় কোন প্রখ্যাত মুসলিম দরবেশ অবস্থান করতে পারেন।
এমনও হতে পারে সিলেটের দরবেশ হজরত শাহজালালের নাম জালালউদ্দিনই ছিল। তৎকালীন যুগে প্রচলিত নিয়মানুসারে মানুষ তাঁকে সম্মান প্রদর্শন করে নামের আগে “শাহ” শব্দটি যুক্ত করে দেয় এবং “উদ্দিন” শব্দটি মুছে ফেলে। অথবা ইবনে বতুতা ভুলবসতঃ “উদ্দিন” যুক্ত করে ফেলেছেন।
একথা সত্য যে ইবনে বতুতার স্মৃতিভ্রমে অথবা পরবর্তী নকলকারকদের ভুলে একই দরবেশ তার “রিহলা” গ্রন্থে কখনও তাবরিজি আবার কখনও সিরাজিতে পরিণত হয়েছেন। ইবনে বতুতার স্মৃতিভ্রম হতেই পারে, কারণ তিনি সিলেট আগমনের অনেক অনেক বছর পর জীবনের শেষপ্রান্তে এসে তার ভ্রমণকাহিনি ধারাবাহিক বলে যান এবং মরক্কোর সুলতানের সাটলিপিকার ইবনে জুজাইর তা লিপিবদ্ধ করেন।
ইবনে বতুতা চট্টগ্রাম হতে স্থলপথে ত্রিপুরা, চুনারুঘাট, কমলগঞ্জ, শ্রীমঙ্গল ও কুলাউড়ার পার্বত্যপথে সিলেটে আসেন। ইবনে বতুতা দরবেশকে গোহার মধ্যে দেখেছেন, হয়তবা তার হুজরাখানা অথবা চিল্লাখানা গোহার মত ছিল। অথবা দরগাহের টিলাটি আরও উঁঁচু ছিল ও টিলার গায়ে গোহাকৃতির চিল্লাখানায় (নির্জন আরাধনা স্থল) তিনি আল্লাহর ধ্যানে নিমগ্ন থাকতেন। একটি চিল্লাখানার অস্থিত্ব এখনও তাঁর মাজারের উত্তর দিকে সুরক্ষিত রয়েছে।
সিলেটের লোকজনকে ইবনে বতুতা মঙ্গোলীয়দের অনুরূপ এবং অত্যন্ত কর্মক্ষম বলেছেন। তখন এই অঞ্চলে খাসিয়া মনিপুরী ইত্যাদি আদিবাসী মানুষের প্রাধান্য ছিল, যারা দেখতে অনেকটা মঙ্গোলীয়দের অনুরূপ। কাজেই স্থান, কাল ও যাত্রাপথ সবকিছুই প্রমাণ করে ইবনে বতুতা বর্ণিত কামরুপের পার্বত্য অঞ্চলের জালাল উদ্দিনই হচ্ছেন সিলেটের দরবেশ হজরত শাহজালাল ইয়ামনি(রঃ)। জ্ঞানতাপস ডঃ মোহাম্মদ শহীদুল্লাহও অনেক পরীক্ষা নিরীক্ষার পর এর স্বপক্ষেই তাঁর অভিমত ব্যক্ত করেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ইতিহাস বিভাগপ্রধান, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ভাইস চ্যান্সেলর, ঐতিহাসিক ও গবেষক ডঃ আব্দুল করিমও তাঁর "বাংলার ইতিহাস" গ্রন্থে একই অভিমত প্রদান করেছেন।
সুত্রগ্রন্থঃ ইবনে বতুতার ভ্রমণকাহিনি "রিহলা" এর বঙ্গানুবাদ।
কবি, লেখক, ব্লগার ও পূবালী ব্যাংকার ইসফাক কুরেশী
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন