Pages

প্রকাশিত গ্রন্থ-সমূহ

শুক্রবার, ১৫ জানুয়ারী, ২০১৬

কোন মুসলিম নরপতি প্রথম সিলেট বিজেতা

            কবি লেখক ব্লগার ও পূবালী ব্যাংকার ইসফাক কুরেশী
মুসলমানদের সিলেট বিজয়ের উপখ্যানে দিল্লির বাদশাহ আলাউদ্দিন খলজির নাম শোনা যায়। সিলেটে প্রাপ্ত প্রাচীন শিলালিপি হতে প্রমাণিত হয় সিলেটে প্রথম মুসলিম বিজয়ের সন ৭০৩ হিজরি তথা ১৩০৩ খ্রিস্টাব্দ। ১৩০৩ খ্রিস্টাব্দে  সিলেটে প্রথম মুসলিম বিজয়কালে আলাউদ্দিন খলজি দিল্লির সিংহাসনে আসীন ছিলেন এবং উক্তসনে তিনি দক্ষিণ ভারতের রানি পদ্মাবর্তীর রাজ্য চিতোর বিজয়ে ব্যাতিব্যস্থ ছিলেন।
১২৯০ খ্রিস্টাব্দে দিল্লিতে খলজি রাজবংশ প্রতিষ্ঠিত হলে বাংলার লখনৌতির সঙ্গে দিল্লির রাজনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায়। সুলতান গিয়াসউদ্দিন বলবনের মৃত্যুর পর তার কনিষ্ট পুত্র বাংলার শাসনকর্তা বঘরা খান, সুলতান নাসির উদ্দিন মাহমুদ উপাধি ধারন করে লখনৌতিতে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। তিনি বাংলার মুসলিম রাজ্য সম্প্রসারণের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। পরবর্তীকালে তার দুইপুত্র রুকনউদ্দিন কায়কাউস ও শাসসুদ্দিন ফিরুজের আমলে বাঙ্গালা সালতানাত আর সম্প্রসারিত হয়। কাজেই তৎকালীন দিল্লির শত্র“রাজ্য স্বাধীন বাঙ্গালার উপর দিয়ে অসংখ্য নদনদী অতিক্রম করে প্রায় দেড় হাজার মাইল দুরে সুদূর দিল্লি হতে পদাতিক সেনাবাহিনী পাঠিয়ে বাংলার পূর্বপ্রান্তের ক্ষুদ্ররাজ্য শ্রীহট্টে অভিযান চালানো দিল্লির বাদশাহ আলাউদ্দিন খলজির পক্ষে সম্ভব নয়। তাছাড়া বাংলা যদি তার করদরাজ্য হয়েও থাকে তবে তিনি নিজে সিলেটে সৈন্য প্রেরণ না করে বড়জুর বাংলায় তাঁর করদ শাসক শামসুদ্দিনকেই বাঙ্গালার পূর্বপ্রান্তের ক্ষুদ্ররাজ্য শ্রীহট্টে অভিযান চালানোর নির্দেশ দিতে পারেন। 
সিলেট বিজেতা হিসাবে অন্য যে দিল্লির সম্রাটের নাম লোকমুখে প্রচলিত তিনি হচ্ছেন ফিরোজ শাহ তুঘলক। তাহার প্রকৃত নাম মালিক ফিরোজ ইবনে সালার রজব। শিলালিপিতে বর্ণিত ফিরোজ শাহ দেহলবি নামের সহিত মালিক ফিরোজের নামের মিল থাকায় অনেকে ভুলবসত তাকে সিলেট বিজয়ী দিল্লির সম্রাট মনে করে থাকেন। তিনি কখনও দেহলবি বা অন্য কোন উপাধি গ্রহণ করেন নাই। ঐতিহাসিকদের কেউ কেউ তুঘলক বংশীয় সম্রাট হিসাবে তাহাকে ফিরোজ শাহ তুঘলক বলেও অভিহিত করেন। তিনি সিলেটে মুসলিম বিজয়ের অনেক পর ১৩৫১ খ্রিস্টাব্দে দিল্লির সিংহাসনে আরোহন করেন। তিনি একজন দুর্বল শাসক ছিলেন ফলে তার শাসনামলে অনেক প্রদেশ হস্থচ্যুত হয়ে দিল্লির  ক্ষমতা সন্কুচিত হয়ে পড়ে। ফলে তার পক্ষে শ্রীহট্টে সেনা পাঠানো একটি নিছক কাহিনি মাত্র। 
কোন কোন ঐতিহাসিক বঙ্গের ইলিয়াসশাহি রাজবংশের শ্রেষ্ট সুলতান  শামসউদ্দিন ইলিয়াস শাহকে প্রথম সিলেট বিজয়ী মুসলিম শাসক মনে করেন। কিন্তু তিনিও সিলেট বিজয়ের সময়কাল ১৩০৩ খ্রিস্টাব্দের অনেক পর ১৩৪৫ খ্রিস্টাব্দে গৌড়কে রাজধানী করে বাঙ্গালায় স্বাধীন ও সার্বভৌম  ইলিয়াস শাহি রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করেন যাহা ১৪১৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। “ফিরোজ” তার নামের অংশ নয় এবং  তাঁর উপাধি   “ইলিয়াস শাহ”। তিনি “ফিরোজ শাহ দেহলবি” নন। 
সুতরাং নিশ্চিতভাবে বলা যায় শ্রীহট্টের প্রথম মুসলিম বিজেতা হচ্ছেন সার্বভৌম মুসলিম বাঙ্গালা সালতানাতের বলবন বংশীয় গৌড়ের সুলতান শামস উদ্দিন ফিরোজ শাহ দেহলবি, যিনি ১৩০১ খ্রিস্টাব্দ হইতে ১৩২২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত প্রায় বাইশ বছর বাঙ্গালা দেশে শাসনকার্য পরিচালনা করেন। 
তিনি “আল সুলতান আল আজম- শামস আল দুনিয়া ওয়াল দীন- আবুল মুজাফ্ফর ফিরোজ শাহ আল-সুলতান” উপাধি গ্রহণ করেন। “দেহলবি” বলতে দিল্লির জাতক, দিল্লিবাসী বা দিল্লি হতে আগত এমনটি নির্দেশ করে। 
কোন কোন ঐতিহাসিকের মতে তিনি দিল্লির সম্রাট গিয়াসউদ্দিন বলবনের পৌত্র ছিলেন বলিয়া পরবর্তীকালে 'দেহলবি' নামে অভিহিত হন। আবার কোন কোন ঐতিহাসিক মনে করেন  শামসউদ্দিন ফিরোজ দিল্লির সম্রাট গিয়াসউদ্দিন বলবনের বংশধর ছিলেন না, ছিলেন তাঁর একজন দক্ষ ও সুশিক্ষিত কর্মকর্তা। ১২৮৯ খ্রিস্টাব্দে বাংলার বিদ্রোহী শাসনকর্তা তুঘ্রিল খানের বিদ্রোহ নিষ্টুরভাবে দমনের পর দিল্লি আধিপতি গিয়াসউদ্দিন বলবন তার পুত্র বুঘরা খানকে বাংলার শাসনকর্তা নিয়োগ করে দিল্লি ফিরে যান। শাহজাদা বুঘরা খানকে রাজকাজে সহায়তা করার জন্য দিল্লি হতে  সাথে আসা দক্ষ রাজকর্মকর্তা শামসউদ্দিন ফিরোজ শাহ দেহলবিকে বাংলায় রেখে যান গিয়াসউদ্দিন বলবন, যিনি পরবর্তীকালে ঘটনাচক্রে বাংলার সুলতান হবার সৌভাগ্য লাভ করেন।   
তাই ঐতিহাসিক সত্য হচ্ছে, দিল্লির শাহি বাহিনী নয় বরং বাংলার সুলতান শামসউদ্দিন ফিরোজ শাহ দেহলবির প্রেরিত মুসলিম বাহিনী কতৃকই সিলেটে প্রথম মুসলিম বিজয় সংঘটিত হয় এবং বাঙ্গালার তৎকালীন রাজধানী লখনৌতি হতে সিলেটে এই মুসলিম অভিযান পরিচালিত হয়। 

চিত্রঃ প্রথম সিলেট বিজয়ী বাঙ্গালা মুসলিম রাজ্যের স্বাধীন সার্বভৌম সুলতান শামসউদ্দিন ফিরোজ শাহ দেহলবি(রঃ)

সূত্রগ্রন্থঃ 
১। ‘বৃহত্তর সিলেটের ইতিহাস’ প্রকাশক- বৃহত্তর সিলেট ইতিহাস প্রনয়ন পরিষদ, প্রকাশকাল- নভেম্বর ১৯৯৭   
২। "বাংলার মুসলিম ইতিহাস" লেখকঃ ঐতিহাসিক ও অধ্যাপক ডঃ আব্দুল করিম, প্রাক্তন বিভাগীয় প্রধান, ইতিহাস বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, প্রাক্তন ভিসি, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
৩। "বাংলার ইতিহাস" লেখকঃ রাখাল দাস বন্ধ্যোপাধ্যায় ।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন