‘শাহ” শব্দের অর্থ সম্রাট বা অধিপতি এবং “জালাল” একটি আরবি শব্দ, যার অর্থ যশ ও প্রতিপত্তির অধিকারী। কাজেই “শাহজালাল” শব্দটির অর্থ দাড়ায় যশ ও প্রতিপত্তির অধীশ্বর। হোসেন শাহী আমলের ১৫০৬ খ্রিস্টাব্দের একটি শিলালিপি পাঠে মনে হয় শাহজালাল(রঃ) 'শেখ বা শায়েখ' জালাল নামে পরিচিত ছিলেন, পরে তার সম্মানার্থে জনমুখে 'শেখ বা শায়েখ' শব্দ 'শাহ' রূপ নেয়। যুগে যুগে মানুষের মনে হজরতের প্রতি যে ভক্তি-শ্রদ্ধার স্রোত প্রবাহমান দেখা যায় তাতে সহজেই অনুমিত হয় তার নামের অর্থ তার উপর মহান আল্লাহ্ কতটুকু কার্যকর করে রেখেছেন।
হজরত শাহজালাল আরব উপদ্বীপের ইয়ামেন দেশের অধিবাসী ছিলেন। দরগায় রক্ষিত একটি শিলালিপি হতে জানা যায় যে, তিনি ছোট্ট শহর কুনিয়ার অধিবাসী। এই কুনিয়ার অবস্থান কোথায় তা নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে ভিন্নমত রয়েছে। ঐতিহাসিক ব্লকম্যান কুনিয়াকে ইয়ামেনের একটি গ্রাম বলে নির্দেশ করেছেন। আবার মুফতি আজহার উদ্দিন সহ কেউ কেউ কুনিয়াকে বোখারার নিকটবর্তী জনপদ মনে করেন। হজরত শাহজালালের পূর্বপুরুষগন মক্কার অধিবাসী হলেও পরবর্তীকালে ইয়ামেনে বসতি স্থাপন করেন। হজরত শাহজালালের পিতা কোন কারনে ইয়ামেন হতে মধ্যএসিয়ার বোখারায় এসে হয়ত বসতি স্থাপন ও বিয়ে করেছিলেন। হজরত শাহজালাল তুর্কিস্থানের বিভিন্ন অঞ্চল ভ্রমন করায় অনেকে ভুলবসতঃ তাকে তুরস্কের কুনিয়াবাসীও বলে মনে করেন, যার কোন সত্যতা পাওয়া যায়নি। তুর্কিস্থানের সুফিদের তালিকায় বা তুর্কি ইতিহাসে জালাল বিন মোহাম্মদ নামে প্রখ্যাত কোন সুফির উল্লেখ নাই। ঐতিহাসিক আরনল্ড ইবনে বতুতার ভ্রমন কাহিনী “রিহলা” এর বিবরনের উপর ভিত্তি করে হজরত শাহজালালকে ইরানের তাবরিজ শহরের বাসিন্দা বলে অভিমত ব্যক্ত করেন। আবার এই একই হজরত শাহজালালকে ইবনে বতুতা শাহজালাল সিরাজি বলেও অভিহিত করেছেন। ইবনে বতুতা বৃদ্ধ বয়সে জন্মভুমি মরক্কোয় ফিরে গিয়ে তার ভ্রমন কাহিনী রচনা করেন। তার স্মৃতিবিভ্রাট হতেও হজরত শাহজালাল নামের সাথে কোথায়ও তাবরিজি আবার কোথায়ও সিরাজি শব্দদ্বয় যোগ করতে পারেন। হজরত শাহজালাল ও তাঁর পূর্বপুরুষগনের বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে বসবাস ও অবস্থানের কারনে এবং ঐতিহাসিকগনের মতভিন্নতার জন্য তিনি শাহজালাল ইয়ামেনি, শাহজালাল বোখারি, শাহজালাল তাবরিজি, শাহজালাল সিরাজি নামেও অভিহিত হন। হজরত শাহজালাল যে ইয়ামেনি তার বড় প্রমান হল তিনি শিক্ষা জীবন মক্কায় সমাপ্ত করে কর্মক্ষেত্র সিলেটে আসার পূর্বে মক্কার দক্ষিনে জন্মভুমি ইয়ামেন জিয়ারত করেন এবং ইয়ামেনের শাহজাদা শেখ আলী তথায় তাঁর সঙ্গী হন। ইয়ামেনের ‘করন’ নামক স্থান হতে সুলেমান করনি(রঃ) হজরত শাহজালালের সফর সঙ্গী হন। যাঁর মাজার ওসমানী নগরের করনশিতে বিদ্যমান আছে। শাহজালালের অসংখ্য সহচর ইয়ামেন দেশের বাসিন্দা ছিলেন। তিনি ইয়ামেনি না হলে ইয়ামেনের এত দরবেশ তার অনুগামী হতেন না। তাছাড়া ইয়ামেন শাহজালালের জন্মভূমি নাহলে তিনি দক্ষিন দিকে ইয়ামেনে না গিয়ে মক্কার উত্তরে মদীনা জিয়ারত করে পূর্বদিকে বাগদাদ হয়ে সরাসরি ভারতের দিকে অগ্রসর হতেন। অধিকাংশ ঐতিহাসিকদের অসংখ্য যুক্তি-প্রমান ও গবেষকদের গবেষনা এবং শিলালিপি ঐতিহাসিকভাবে প্রমান করে হজরত শাহজালালের জন্মস্থান ইয়ামেনের অন্তর্গত ছোট্ট শহর কুনিয়ায়।
কবি ও লেখকঃ ইসফাক কুরেশী
হজরত শাহজালালের(রঃ) জন্ম সময়
হজরত শাহজালালের জন্মসন বা সময় নিয়ে ইতিহাসবেত্তাদের মধ্যে মতপ্রার্থক্য রয়েছে। কারো কারো মতে ১৩২২ খ্রিস্টাব্দ। কিন্তু হোসেন শাহী আমলের শিলালিপি অনুসারে তিনি ১৩০৩ খ্রিস্টাব্দে সিলেট জয় করেন। কাজেই এই মত গ্রহনযোগ্য নয়। ইবনে বতুতার রিহলায় শাহজালালের এক মুর্শিদের উদ্ধৃতি হতে বর্নিত হয় হজরত শাহজালাল দেড়শত বৎসর বয়সে মৃত্যুবরন করেন। ইবনে বতুতা বর্নিত হজরত শাহজালালের মৃত্যুসন ১৩৪৬ খ্রিঃ বিয়োগ ১৫০বৎসর = ১১৯৬ খ্রিস্টাব্দ হচ্ছে তাঁর জন্মসন। হজরত শাহজালালের জন্মসন ১১৯৬ খ্রিস্টাব্দ সঠিক হলে সিলেট বিজয়কালে তাহার বয়স দাঁড়ায় (১৩০৩খ্রিঃ বিয়োগ ১১৯৬খ্রিঃ) ১০৭ বৎসর, এত জইফ বৃদ্ধ বয়সে সিলেট আসার বিষয়টা সঠিক বলে মনে হয় না। ইবনে বতুতা চীন হতে ভারত প্রত্যাবর্তনের পর হজরত শাহজালাল(রঃ) এক মুর্শিদের সাথে দেখা হয়, তিনি বলেন হযরত শাহজালাল(রঃ) ১৫০ বৎসর বয়সে দেহত্যাগ করেছেন। মানুষ খুববেশী দীর্ঘ্যায়ু হলেও বড়জুর একশত বৎসর বা তৎদপেক্ষা ১০/১২ বৎসর বেশী বেঁচে থাকতে পারেন। একজন মানুষের ১৫০ বৎসর বেঁচে থাকাটা অনুমান নির্ভরই মনে হয়। তাছাড়া হজরত শাহজালাল(রঃ) নিজে ইবনে বতুতার কাছে সাক্ষাৎকালে তাঁর বয়স বা জন্মসন সম্পর্কে কিছুই বলেন নাই। হজরতের একজন মুর্শিদ বর্ণিত ইবনে বতুতার তথ্যকে গ্রহণ করে দেওয়ান নুরুল আনোয়ার হোসেন চৌধুরীসহ অনেক জীবনীকার তাদের রচনায় হজরত শাহজালালকে(রঃ) ১৫০ বৎসরের অবিশ্বাস্য দীর্ঘ্য জীবন দান করেছেন। ইবনে বতুতার কাছে হজরত শাহজালাল ১২৫৮ খ্রিস্টাব্দে হালাকু খানের বাগদাদ ধ্বংসের সময় বাগদাদে তার অবস্থানের কথা উল্লেখ করেছেন। অন্য সমসাময়িক গ্রন্থ ইসরারুল আউলিয়া দ্বারাও তা সমর্থিত। এই হিসাবে ১২৫৮ খ্রিস্টাব্দে হজরত শাহজালালের(রঃ) বয়স কুড়ি হলে তিনি ২০/২২ বৎসর পূর্বের ১২৩৮/১২৪০ খ্রিস্টাব্দের লোকও হতে পারেন। মুফতি আজহার উদ্দিন আহমদ সিদ্দিকীর “শ্রীহট্টে ইসলামের জ্যোতি” অনুসারে শাহজালালাল ৩২ বৎসর বয়স কালে শ্রীহট্টে আগমন করেন। কাজেই তাঁর মতানুসারে হজরত শাহজালালের জন্মসন (১৩০৩ সাল বিয়োগ ৩২ বৎসর) = ১২৭১ খ্রিস্টাব্দ। এই হিসাবে শাহজালালের জন্মসন হিসেবে ১২৭১ খ্রিস্টাব্দ হত কিন্তু হালাকু খানের বাগদাদ ধ্বংসের সময় তার বয়স দাঁড়ায় (১২৭১ বিয়োগ ১২৫৮)=১৩ বৎসর মাত্র। এই অল্প বয়সে তাঁর বাগদাদ থাকার কথা নয়। কাজেই ১২৭১ সালেও তার জন্ম গ্রহনের সম্ভাবনা তেমন নেই। প্রকৃতপক্ষে ১২৩৩ খ্রিস্টাব্দ হতে ১২৫৮ খ্রিস্টাব্দ এর মধ্যবর্তী কোন সময়ে হজরত শাহজালাল জন্মগ্রহন করার সম্ভাবনা সর্বাধিক। ইতিহাস লিখার খাতিরে আমরা তাঁর সম্ভাব্য একটি জন্মসন ১২৪০ খ্রিস্টাব্দ ধরে নিলাম, যদিও আসলে শাহজালালের(রঃ) জন্মসনের ব্যাপারে শাহজালাল গবেষকগন একমত হতে পারেন নি।
হজরত মোহাম্মদ(সঃ) যে বংশে জন্মগ্রহন করেছিলেন সেই বিখ্যাত কুরাইশ বংশীয় শায়েখ পরিবারের ইব্রাহীমের পুত্র মোহাম্মদ ছিলেন হজরত শাহজালালের জনক। তার পিতার নাম যে 'মোহাম্মদ' তা বাংলার প্রাচীন হোসেনশাহি আমলের শিলালিপি হতে নিশ্চিত হওয়া যায়। হজরত শাহজালালের পিতা মোহাম্মদ প্রখ্যাত দরবেশ আবুসাইদ তাবরিজির মুরিদ ছিলেন। মুর্শিদের তাবরিজি উপাধি নামের সাথে ধারন করে তিনি মোহাম্মদ তাবরিজি নামে খ্যাত হন। তাকে শাইখুল মাশায়েক বা পীরানে পীর বলেও চিহ্নিত করা হয়েছে। শাহজালালের বংশধারা হচ্ছে শাহজালাল বিন মোহম্মদ বিন ইব্রাহীম কোরেশী বিন ইমাম আহমদ তাইজি বিন ইমাম জায়েদ বিন ইমাম জয়নুল আবেদীন বিন ইমাম হোসেন বিন হজরত আলী(রাঃ)। হজরত শাহজালালের জননী সৈয়দা ফাতিমা বোখারার সৈয়দ বংশীয় মহিলা ছিলেন। তার মাতামহের নাম সৈয়দ সুররখ বোখারি বিন আব্দুল মুয়িদ মক্কি বিন ইমাম সৈয়দ জাফর বিন ইমাম আলী আসগর বিন ইমাম জয়নুল আবেদীন বিন ইমাম হোসেন বিন হজরত আলী(রাঃ)। সৈয়দ সুররখ বোখারির একমাত্র পুত্র সৈয়দ আহমদ কবির ও একমাত্র কন্যা ছিলেন হজরত শাহজালালের মাতা সৈয়দা ফাতেমা।
সূত্রগ্রন্থ: দেওয়ান নুরুল আনোয়ার হোসেন চৌধূরীর ‘জালালাবাদের কথা’ প্রকাশকাল ১৯৯৭ খ্রিস্টাব্দ
হজরত শাহজালাল যখন তিন মাসের শিশু, তখন তার মাতার মৃত্যু হয়। মাতার মৃত্যুর পর পিতাই তাকে লালন পালন করতে থাকেন। কিন্তু তিনিও বেশী দিন আয়ু পান নি। ইসলাম ধর্মের প্রচার করা ছিল তাঁর কাজ। যখন হজরত শাহজালালের বয়স মাত্র পাঁচ বৎসর তখন তার পিতা মোহাম্মদ কোন এক ধর্মযুদ্ধে শহিদ হন। এবার পিতাকে হারিয়ে সম্পূর্ন নিরাশ্রয় হয়ে পড়েন বালক শাহজালাল।
আমাদের নবি হজরত মোহাম্মদের(সঃ) শৈশব জীবনের সহিত হজরত শাহজালালের শৈশবের যথেষ্ট মিল রয়েছে। তারা উভয়েই অল্প বয়সে পিতৃমাতৃহারা হন। হজরত মোহাম্মদের(সঃ) দায়িত্ব নেন তার চাচা আবু তালেব, আর হজরত শাহজালালের দায়িত্ব গ্রহন করেন তার মামা উচ্চ শ্রেণীর আলেম ও কামেল ওলি হজরত সৈয়দ আহমদ কবির সোহরাওয়ার্দি। পিতামাতার মৃত্যুর পর হজরত শাহজালালকে দেখবার মত আর কেহ তার সংসারে ছিলেন না, কাজেই তার মাতুল হজরত সৈয়দ আহমদ কবির তাহার লালন পালন ও শিক্ষার ভার গ্রহন করলেন। তৎকালীন যুগে হজরত সৈয়দ আহমদ কবির মক্কার একজন শ্রেষ্ট আলেম ও ধম্র্প্রচারক ছিলেন। এই হজরত সৈয়দ আহমদ কবির তার এতিম ভাগিনা শাহজালালকে ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক জ্ঞানে দীক্ষিত করে তুলেন ও তার ধর্মগুরুর পদে সমাসীন হন। কথিত আছে যে, বাল্যকালে হজরত শাহজালাল একজন মহাপুরুষের দর্শন লাভ করেন। তিনি হজরত শাহজালালের নিকটবর্তী হয়ে তাকে হাঁ করিয়ে স্বীয় মুখের একটু লালা তার জিহ্বায় ঘষে দিয়ে প্রস্থান করেন। সেদিন হতে হজরত শাহজালালের স্মৃতিশক্তি অসম্ভবরূপে বৃদ্ধি পায়। তিনি কোরান হাফিজ হন। সৈয়দ আহমদ কবিরের তত্থাবধানে হজরত শাহজালাল অল্পদিনের মধ্যে কোরান, হাদিস, ফেকাহ, ইসলামের ইতিহাস ও এলমে মারেফতে অগাধ জ্ঞান অর্জন করেন ও মাত্র ষোল বৎসর বয়সে একজন বড় আলেম ও কামেল দরবেশে পরিনত হন।
হজরত শাহজালালের হৃদয় ছোটকাল হতেই ছিল পুত ও পবিত্র। কোন ধরনের মিথ্যা বা কলুষতা তাকে স্পর্শ করতে পারে নি। ইসলামের শরিয়তের নিয়ম কানুন তিনি দৃঢ়ভাবে অনুসরন করতেন। তাছাড়া কামেল ওলি এবং গুনী মামার সহচার্য্যে তার অন্তর মারেফতের উজ্জল নুরে আলোকিত হয়ে উঠে। খুব অল্প সময়ে তিনি বাকা ও ফানার স্থর অতিক্রম করে মারেফতের গভীর সমুদ্রের তলদেশে প্রবেশ করতে সক্ষম হন।
পবিত্র মক্কা সৈয়দ আহমদ কবিরের বাসস্থান ও সাধনাস্থল ছিল। শিষ্য ও ভাগিনেয় শাহজালাল তৎসঙ্গে অবস্থান করে বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে সাধনামার্গের উচ্চস্থরে অগ্রসর হন। একদিন সৈয়দ আহমদ কবির নিজ হুজরায় বসে আল্লাহর আরাধনা করছিলেন, এমন সময় একটা হরিণী বাঘ্র কতৃক বিতাড়িত হয়ে সৈয়দ আহমদ কবিরের নিকট এই হিংস্র জন্তুটির অত্যাচারের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনে তাহার নিকট সুবিচার প্রার্থনা করল। সৈয়দ আহমদ কবির তার ভাগিনা শাহজালালের উপর সুবিচারের ভার অর্পন করলেন। হজরত শাহজালাল ঘটনাস্থলে চলে গেলে হজরত সৈয়দ আহমদ কবির হুজরায় বসে মনে মনে ভাবলেন যদি এই বাঘ্রটিকে ডানহাতের তিন ও বামহাতের দুই আঙ্গুলীর সাহায্যে থাপ্পড় মেরে জঙ্গল হতে তাড়িয়ে দেয়া হলে তাই হবে তার যোগ্য শাস্তি। বাঘ মাংসাশী প্রাণী তাই হরিণ শাবক হত্যা বাঘের জন্য প্রাকৃতিক নিয়মে তেমন কোন অপরাধ নয়। প্রতিটি প্রানীই পৃথিবীতে অন্য কোন প্রাণী বা উদ্ভিদ খেয়ে বেঁচে থাকে, প্রকৃতিতে প্রাণী ও উদ্ভিদ জগতে বৈচিত্র ও সাম্যাবস্থা নিয়ন্ত্রনের জন্যই আল্লাহ পাকের এই ব্যবস্থা। তা না হলে পৃথিবী একই ধরনের প্রাণী ও উদ্ভিদে ভরে যেত। হজরত শাহজালাল আধ্যাত্মিক শক্তি বলে তার মাতুলের ইচ্ছা হৃদয়াঙ্গম করে তদানুসারে কাজ করলেন এবং ফিরে এসে মাতুলের নিকট বর্ননা করলে মামা সন্তুষ্ট হয়ে বললেন- 'তোমার আধ্যাত্মিকতা চরম সীমায় পৌঁছে গেছে। তোমার ও আমার হৃদয় এক হয়ে গেছে। তোমাকে আর এখানে আবদ্ধ করে রাখা চলে না। অতএব যাও, এবার ইসলাম প্রচারে নিজেকে নিয়োজিত কর।'
হজরত সৈয়দ আহমদ কবির তার ভাগনা হজরত শাহজালালকে নিয়ে যখন ভাবছেন এমন সময় একদিন রাতে শাহজালাল স্বপ্নে দেখলেন সৌমকান্তি চেহারার এক মহাপুরুষ তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন। তার চারদিক স্নিগ্ধ
আলোকিত। মহাপুরুষ তার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বললেন- এই অল্প বয়সে তোমার কঠোর সাধনা, বৈরাগ্য, ত্যাগ ও সংযমের পরিচয় পেয়ে আমি অত্যন্ত খুশী হয়েছি। পরম করুনাময় আল্লাহতায়ালা তোমার উপর প্রীত হয়ে তোমাকে তার প্রিয় বান্দাদের একজন করে নিয়েছেন। আমি তোমাকে হিন্দুস্থানের খিলাফত দান করলাম। অবিলম্বে তুমি হিন্দুস্থানে চলে যাও। সেখানকার মুসলমানগন বিধর্মীদের অত্যাচারে অতীষ্ট হয়ে আছে। বহু মুসলমান তাদের ধর্মপথ থেকে দুরে সরে যাচ্ছে। তুমি পথভ্রাষ্ট ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানুষকে আল্লাহর ন্যায়ধর্ম ও সত্যের পথে পরিচালিত করবে। এটা আল্লার ইচ্ছা ও আমার আদেশ। আমি তোমাদের শেষ নবি ও রসুল। আল্লাহ তোমার সহায় হউন বলে মহাপুরুষ অন্তর্ধান করলেন। আব্দুর রহিমের “শ্রীহট্ট নূর” প্রকাশকাল ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দ হতে স্বপ্নটি উল্লেখ করা হল- 'পরম কারুণিক রহমানুর রহিম আল্লাহতায়ালার ইচ্ছা, তুমি ভারতখন্ডের পূর্বসীমায় ইসলামি ঝান্ডা উড্ডীন করে স্বীয় কীর্তি চিরস্মরণীয় করবে। সত্বর পূর্বদিকে রওয়ানা হও। স্বীয় মাতৃভুমি তুল্য ভুমি যে স্থানে পাবে সেখানে বসতি করবে।'
হজরত শাহজালাল পরদিন মামা সৈয়দ আহমদ কবিরের কাছে স্বপ্নবৃত্যান্ত সব খুলে বললেন। তিনি যে সিন্ধান্তের অপেক্ষায় ছিলেন তারই সমাধান স্বপ্নের মাধ্যমে স্বয়ং রসুলে করিম(সঃ) জানিয়েছেন। তিনি তাকে বললেন বাবা শাহজালাল, তুমি সত্যই সৌভাগ্যবান লোক। নিশ্চয় খোদা তোমাকে দিয়ে কোন মহৎ কাজ সমাধা করাতে চান। এজন্য নিজ রসুলকে তোমার নিকট পাঠিয়েছেন। আমি তোমার জন্য দোয়া করছি- চারদিকে তোমার সুনাম ও খ্যাতি ছড়িয়ে পড়বে। বিপথগামী লোক তোমার স্নেহধন্য হয়ে উপকৃত হবে। সৈয়দ আহমদ কবির শাহজালালকে ধর্মপ্রচারের জন্য অবিলম্বে ভারতের দিকে রওয়ানা হতে আদেশ করলেন। তিনি একটি পাত্রের মধ্যে কিছু মাটি এনে শাহজালালের হাতে দিয়ে বললেন, এই মৃত্তিকা অত্যন্ত সযতনে রাখবে এবং হিন্দুস্থান গিয়ে যেস্থানে অবিকল অনুরূপ বর্ন ও গন্ধ বিশিষ্ট মাটি পাবে ঠিক সেই স্থানে তোমার স্থায়ী আস্থানা স্থাপন করবে। হিন্দুস্থানের সেই স্থানের মাহাত্ম্য হবে অতুলনীয়।”
হজরত শাহজালাল পবিত্র মক্কায় মাতুলের নিকট হতে বিদায় নিয়ে ভারতে রওয়ানা হবার আগে ১২৯৬ খ্রিস্টাব্দে নিজ জন্মস্থান ইয়ামেন শেষবারের মত দেখে নিতে ইয়ামেনের রাজধানী সানা শহরে উপনীত হন। ইতিমধ্যে তার যশ চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। পাশ্চাত্য লেখক গিবসের 'হিস্ট্রি অব ইয়ামেন ডাইনেষ্টি' গ্রন্থসূত্রে কেউ মনে করেন তৎকালে ইয়ামেনের শাসক ছিলেন সুলতান ওমর আশরাফ, যিনি একজন সংশয়বাদী লোক ছিলেন। আউলিয়া দরবেশগনের অলৌকিক শক্তিতে তার তেমন বিশ্বাস ছিল না। হজরত শাহজালালকে তিনি তার দরবারে ডেকে নিয়ে বললেন, আধ্যাত্মিক দীক্ষাগ্রহন করার জন্য আমার একজন উপযুক্ত দরবেশ প্রয়োজন। অতঃপর রাজপ্রাসাদে শাহজালালকে পরীক্ষা করার জন্য তাঁকে তীব্র বিষ মিশ্রিত এক গ্লাস শরবত দিলেন। তাঁর এই অসৎ উদ্দেশ্য আধ্যাত্মিক শক্তিবলে জানতে পেরে হজরত শাহজালাল বললেন, যে ব্যক্তি অন্যের ক্ষতি করতে চায় সে নিজেই ক্ষতিগ্রস্থ হয়। এই বলে সমস্ত শরবতটুকু নিঃশেষে পান করে ফেলেন।
এ ঘটনায় শাহজালালের কিছু না হলেও সুলতান বিষক্রিয়ায় সিংহাসনে মুর্ছিত হয়ে পড়েন এবং মহুর্তের মধ্যে তিনি মৃত্যুর করাল গ্রাসে নিপতিত হন। শাহজাদা শেখ আলী উক্ত সুলতানের পুত্র। তিনি পিতার এই শোচনীয় পরিনতি দেখে শাহজালালের পদতলে লুটিয়ে পড়েন। তাঁর মনের মধ্যে বৈরাগ্যের উদয় হয় এবং তিনি শাহজালালের শিষ্য দলভূক্ত হয়ে ভারত অভিযানে হজরতের সঙ্গে যাবার বাসনা জানালেন। কিন্তু শাহজালাল তাকে স্বদেশে অবস্থান করে ন্যায়পরায়নতার সহিত রাজ্য শাসন করবার উপদেশ দিয়ে গন্তব্য স্থানের দিকে রওয়ানা হয়ে যান। হজরত শাহজালালের সংস্পর্শে এসে শাহজাদার মনে যে বৈরাগ্য ও খোদাপ্রেমের আগুন জ্বলে উঠে, তা আর নির্বাপিত হল না। তাই নুতন সুলতান শেখ আলী অল্প কিছুদিনের মধ্যে রাজ্যের মায়া ত্যাগ করে কোন এক আত্মীয়ের হাতে রাজ্যভার অর্পন করে একেবারে শুন্যহস্থে ফকিরের বেশে দ্রুত শাহজালালের সাথে মিলিত হন। যুবরাজের এই সংকল্প ও আত্মত্যাগ দেখে হজরত শাহজালাল তাকে সানন্দে বরন করেন এবং এই যুবকও নিজ সাধনায় তাঁর একজন প্রিয় শিষ্যের মর্যাদা লাভে সমর্থ হন। তিনি সারাজীবন একসাথে অতিবাহিত করে হজরত শাহজালালের পূর্বপ্রান্তে পাশাপাশি চিরনিদ্রায় শায়িত হন।
হজরত শাহজালাল আরব উপদ্বীপ তথা মক্কাশরিফ হইতে মাত্র বারোজন সঙ্গী নিয়ে রওয়ানা হন। তন্মধ্যে হজরত শাহদাউদ কুরায়শী, হজরত তাজউদ্দিন কুরায়শী, হজরত হাজি খলিল, হজরত হাজি ইউসুফ, হজরত শেখ জাকারিয়া আরবি, হজরত মোহাম্মদ শেখ আলী ইয়ামেনি, হজরত আরিফ ইয়ামেনি, হজরত বোরহান উদ্দিন কাত্তাল, হজরত কামাল ইয়ামেনি ও হজরত চাষনী পীর অন্যতম। এই চাষনী পীর ছিলেন সৈয়দ আহমদ কবিরের প্রদত্ত মাটির তহবিলদার। তাঁহারা ক্রমে ক্রমে মদিনা, ইরাকের বাগদাদ, ইরানের সিরাজ, মধ্যএসিয়ার বোখারা ও আফগানিস্থানের গজনি অতিক্রম করে সম্ভবতঃ খাইবার গিরিপাস দিয়ে ভারতে প্রবেশ করেন। গুলজার-ই-আবরার গ্রন্থের বর্ননা মতে হজরত শাহজালাল সাত শত সঙ্গী সাথী নিয়ে ভারতীয় উপমহাদেশে প্রবেশ করেন। এই সঙ্গী সাথীদের সবাই আরব উপদ্বীপের ছিলেন না বরং চলতি পথে তারা হজরতের ব্যক্তিত্ব ও আধ্যাত্মিক শক্তির প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে তাঁর কাফেলার অন্তর্ভুক্ত হন। পথে পাকিস্থানের মুলতান শহরে কিছুদিন অবস্থান করে তারা দিল্লিতে আসেন। শাহজালাল মাত্র বার জন সঙ্গী নিয়ে আরব দেশ হতে যাত্রা শুরু করে ছিলেন কিন্তু পথিমধ্যে বিভিন্ন স্থান হতে তাহার গুনে মুগ্ধ হইয়া অনেকে তাহার অনুগামী হন। গুলজার-ই-আবরার গ্রন্থের বর্ননা মতে তাহাদের মধ্যে সমরখন্দের সৈয়দ উমর, গজনি নগরের মাখদুম জাফর ও সৈয়দ মোহাম্মদ, আফগানিস্থানের শায়েখ গাবরু, মুলতানের শায়খ আরিফ, গুজরাটের শায়েখ জোনায়েদ, আজমিরের মুহাম্মদ শরিফ, মধ্যপ্রদেশের নার্নুসের হেলিম উদ্দিন, দক্ষিণাত্যের সায়্যিদ কাশিম প্রমুখ প্রসিদ্ধ ওলিগন বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।।
খাজা নিজামউদ্দিন ভারতের যুক্তপ্রদেশের বদায়ূন নগরীতে জন্মগ্রহন করেন। তার পিতা খাজা দানিয়েল ছিলেন কামেল ওলি। নিজামউদ্দিন পাঁচ বছর বয়সে পিতাকে হারান এবং বিধবা মাতাই লালন পালন করেন ও শিক্ষিত করে তোলেন। ছেলেকে উচ্চশিক্ষা প্রদানের জন্য মাতা তাকে দিল্লিতে নিয়ে আসেন। উচ্চশিক্ষা সমাপ্ত করে নিজাম উদ্দিন শহরের সর্বপ্রধান কাজির পদে অধিষ্টিত হন। একদা তিনি দিল্লির সুবিখ্যাত আউলিয়া খাজা কুতুবউদ্দিন বখতিয়ার কাকীর মাজার জিয়ারত করছিলেন, এমন সময় জনৈক দরবেশ প্রকৃতির লোক তাকে বললেন “হে নিজাম ! আল্লাহ তোমাকে জগতে পাঠিয়েছেন ধর্মীয় কাজের জন্য, দুনিয়াদারী কাজ তো তোমার শোভা পায়না।” খাজা সাহেব কথাটি শুনে পশ্চাতে তাকিয়ে দেখলেন তাকে উপদেশ প্রদানকারী দরবেশ কোথায় যেন অদৃশ্য হয়ে গেছেন। এই ঘটনায় নিজাম উদ্দিনের মনে একটা আমুল পরিবর্তন এসে গেল। তিনি চাকুরী পরিত্যাগ করে প্রথমে জন্মভুমি বাদায়ুন যান অতঃপর অযোধ্যায় এসে প্রখ্যাত দরবেশ ফরিদ উদ্দিন মাসউদের মুরিদ হয়ে ইলমে মারেফতে দীক্ষা নিয়ে আল্লাহর ধ্যানে নিমগ্ন হন। এভাবে কিছুদিন সাধনা করার পর গুরু খাজা ফরিদ উদ্দিনের নির্দেশে ইসলাম প্রচার ও মানুষকে আধ্ম্যাতিক দীক্ষা প্রদানের জন্য নিজাম উদ্দিন দিল্লিতে আস্থানা স্থাপন করে করেন। খাজা নিজাম উদ্দিন তথাকার অসংখ্য লোককে ধর্মপথে আনয়ন করেন ও দিল্লির অনেক গন্যমান্য ব্যক্তি তার নিকট মুরিদ হন।
তখন দিল্লিতে পানির খুব অভাব ছিল। তখনকার দিল্লির সম্রাট গিয়াস উদ্দিন ও খাজা নিজাম উদ্দিন উভয়ে পৃথকভাবে দুইটি দিঘি খননের ইচ্ছা পোষন করেন। সম্রাট দিল্লির প্রত্যেক মজুরকে তার দিঘি খননে অংশ নিতে আদেশ দেন যাতে খাজা সাহেবের পুকুর খনন মজুরের অভাবে বন্ধ থাকে।
ইতিমধ্যে বাংলাদেশে বিদ্রোহের খবর শোনে সম্রাট বিদ্রোহ দমনে বাংলাদেশে রওয়ানা হলে মজুরগন সম্রাটের দিঘি খননের কাজ ফেলে রেখে খাজা সাহেবের পুকুর খননে অংশ নেয়। কিছুদিন পর খবর আসল সম্রাট দিল্লি ফিরে আসছেন। সম্রাট দিল্লির সন্নিকটে চলে এলে মজুরগন অত্যন্ত চিন্তিত ও ভীত হয়ে পড়ল। সম্রাট যদি দেখতে পান মজুরগন তার কাজ বন্ধ রেখে খাজা সাহেবের কাজ করছে, তখন হয়ত তাদের কঠোর শাস্থি প্রদান করবেন।
মজুরগন সমবেত হয়ে খাজা সাহেবকে তাদের চিন্তা ও ভয়ের কারন জানালে তিনি শুধু বললেন, তোমাদের কোন ভয় নাই। তোমরা নিশ্চিন্ত মনে কাজ করে যাও। দিল্লি হনুজ দুরকাওয়াস্ত অর্থাৎ দিল্লি এখনও অনেক দুরে আছে। ভারত সম্রাট গিয়াস উদ্দিন বিজয়ীর বেশে দিল্লির নিকটে এলে শাহজাদা জুনা খান তাকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য এক প্রকান্ড কাটের মন্ডপ তৈরী করলেন। সেই মন্ডপটির নীচ দিয়ে গমনকালে হঠাৎ তা ভেঙ্গে পড়ে সম্রাট গিয়াস উদ্দিন মৃত্যুবরন করেন। ঐতিহাসিকগনের মতে ক্ষমতালোভী শাহজাদা জুনা খান তাকে ষড়যন্ত্র করে হত্যা করেন। এই জুনা খান ছিলেন ইতিহাসের পাগলা রাজা দিল্লির সম্রাট মোহাম্মদ বিন তুঘলক। খাজা সাহেবের কথাই সত্য হল। দিল্লি চিরদিনের জন্য সম্রাটের দূরেই রয়ে গেল।
একদা নিজামউদ্দিন শুনতে পেলেন যে দিল্লিতে কে একজন মহাপুরুষ পদার্পন করেছেন। পোষাক পরিচ্ছেদে তাকে আরবের অধিবাসী বলে মনে হয়। তার অলৌকিক ক্ষমতা ও অসম্ভব খোদাপ্রেমের কাহিনী শোনা যায়। এই দরবেশ স্ত্রীসঙ্গ বর্জিত। তিনি চাদর দিয়ে মস্তক ও মুখমন্ডল আবৃত করে পথ চলেন যাতে আল্লাহর নিষিদ্ধ কোন বস্তু তার দৃষ্টিতে পড়ে অন্তর কলুষিত না হয়। তিনি একজন বালককে সব সময় কাছে রাখেন ও স্নেহ করেন। তাকে দেখলেই একজন মহাসাধক বলে মনে হয় ও শ্রদ্ধায় মস্তক অবনত হয়ে আসে।
এই নবাগত মহাপুরুষ সম্পর্কে নিজাম উদ্দিনের মনে সন্দেহের উদয় হলে তিনি নিতান্ত কৌতুহলী হয়ে দুইজন মুরিদকে তার সঠিক পরিচয় অবগত হওয়ার জন্য পাঠিয়ে দেন। এদিকে আধ্যাত্মিক শক্তিবলে বলিয়ান শাহজালাল খাজা নিজাম উদ্দিনের মনের অভিপ্রায় বুঝতে পারেন। তাই নিজাম উদ্দিনের প্রেরিত লোক তার নিকট উপস্থিত হলে তিনি চুলা হতে একখন্ড জ্বলন্ত অঙ্গার উঠিয়ে তুলায় জড়িয়ে একটি কৌটায় ভরে খাজা সাহেবের মুরিদদ্বয়কে দিয়ে বললেন, এটা তোমাদের পীর সাহেবকে প্রদান করবে।
নিজাম উদ্দিন কৌটা খোলে জ্বলন্ত অঙ্গার ও অদগ্ধ তুলা পাশাপাশি দেখে বুঝতে পারলেন যে আগন্তুক মহাপুরুষ তার চেয়েও অনেক উঁচুদরের ওলি। পীর নিজাম উদ্দিনের তুলা সদৃশ সাদা ও কোমল অন্তঃকরনে শাহজালালের প্রতি অনর্থক সন্দেহের অঙ্গার জ্বলে উঠে, কামেলিয়াত প্রাপ্ত শাহজালালের পক্ষে তা বুঝতে পারা আশ্চর্য্যের বিষয় নয়। আবার এই কৌটা খোলে অদগ্ধ অবস্থায় তুলা দেখে নিজাম উদ্দিন বুঝতে পারেন প্রেরক শাহজালাল পৃথিবীর সব অমঙ্গলের প্রজ্জ্বলিত অগ্নিশিখার মধ্যেও অদগ্ধ তুলার মত নিজের ব্যক্তিত্ব ও মানুষ্যত্বকে রক্ষা করিতে পেরেছেন।
লজ্জিত ও অনুতপ্ত নিজাম উদ্দিন নিজেকে অপরাধী মনে করে শাহজালালের নিকট উপহারস্বরূপ একজোড়া কবুতর নিয়ে হাজির হন এবং ক্ষমা প্রর্থনা করে শাহজালালকে তাঁর আতিথ্য গ্রহনের অনুরোধ করে নিজের আস্থানায় নিয়ে যান। অতঃপর শাহজালাল যতদিন দিল্লিতে ছিলেন, ততোদিন নিজাম উদ্দিনের আস্থানায় অবস্থান করেন। সেই মধ্যযুগে এখনকার মত দেশে দেশে হোটেল বা রিসোর্ট ছিল না। কাজেই পশ্চিম হতে ভারতে ইসলাম প্রচারে আগত দরবেশ দলের পক্ষে হজরত নিজাম উদ্দিনের মত বিখ্যাত আউলিয়ার সরাইখানায় কিছুদিনের জন্য অবস্থান খুবই স্বাভাবিক ঘটনা মনে হয়।
নিজাম উদ্দিন আউলিয়া ৭২৫ হিজরিতে পরলোকগমন করেন ও দিল্লিতে সমাহিত হন। নিজাম উদ্দিন আউলিয়ার মৃত্যুর প্রায় কুড়ি বছর পর ৭৪৭ হিজরি তথা ১৩৪৬ খ্রিস্টাব্দে হজরত শাহজালাল সিলেটে ইন্তেকাল করেন।
নিজাম উদ্দিন কতৃক প্রদত্ত কবুতর দুটি শাহজালাল সাথে করে সিলেটে নিয়ে আসেন। বর্তমান সিলেট অঞ্চলে কাজলবর্নের যে সকল কবুতর দেখা যায় তারা এই কপোতেরই বংশধর। এই কবুতর জালালি কবুতর নামে পরিচিত এবং এই অঞ্চলের হিন্দু মুসলমান সবাই এই কবুতরকে সম্মান করে আশ্রয় দিত ও মাংস ভক্ষন করত না। সিলেট বিভাগের মানুষ জালালি কবুতরকে মঙ্গলের প্রতীক হিসাবে বিবেচনা করে থাকে। সিলেটের লোকগীতিতে এই কবুতর বর্নিত হয়েছে এইভাবে- 'কত রোগী হইলা ভালা খাইয়া ঝর্নার পানি; কাজল বরন কইতর উড়ে মুইছা মনের গ্লানী।' কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, বর্তমানে এই মঙ্গলের প্রতীক ও হজরত শাহজালালের জীবন্ত স্মৃতি এই কবুতরগুলোকে দুষ্ট প্রকৃতির লোকেরা এমনভাবে নিধন করছে যে, খুবদ্রুত এদের বংশ বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। পূর্বকালে কিনব্রিজ ও মানুষের বাসাবাড়ীর ছাদে এই কবুতরগুলোকে বাসা বাঁধতে দেখা যেত। হজরতের স্মৃতিধন্য এই কবতুরগুলোকে রক্ষার ব্যবস্থা করা না হলে অদূর ভবিষ্যতে সিলেট হতে এই সুন্দর প্রজাতির কবুতর নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে।
দৃষ্টি আকর্ষনঃ আমি এই লেখাটি একদম খাঁটি ইতিহাস দাবী করব না, এটি ইতিহাসের সাথে কিংবদন্তি এবং লোককাহিনীর কিছুটা সংমিশ্রন, তবে এখানে অনেক ঐতিহাসিক তথ্য-প্রমাণাধিও রয়েছে। কিংবদন্তি এবং লোককাহিনী সাধারনতঃ পুরোপুরি মিথ্যার উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠে না এবং তা বিখ্যাত বিখ্যাত মানুষকেই কেন্দ্র করে তৈরী হয়ে থাকে।
মাশাআল্লাহ খুবই সুন্দর ও তথ্যবহুল পোষ্ট
উত্তরমুছুনআমাকে অনুপ্রেরণা দান করার জন্য অশেষ শুভেচ্ছো জানাই।
মুছুন