উন্নয়ন বান্ধব রাজনৈতিক সংস্কৃতি চাই
চৌধুরী
ইসফাকুর রহমান কুরেশী
[আমাকে-আমৃত্যু এদেশেই কাটাতে হবে।
এদেশের ভাল মন্দ নিয়ে এ জন্য ভাবতে হয় আমাকে। আমরা রাষ্ট্রের অর্থনীতি ধ্বংসকারী
হরতাল যেমন চাই না, তেমনি ভোট জালিয়াতি বা কারচুপি করে কেউ
ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হোক তাও কামনা করি না। সাড়ে চৌদ্দ কোটি মানুষের এই দেশ, কোন পরিবার ব্যক্তি কিংবা গোষ্ঠির ব্যক্তিগত সম্পদ নয়। এটা
আমার, আপনার সবার। এখানে যারা রাজনীতি
পরিচালনা করেন তাদের উচিত জনগণের ইচ্ছা অনিচ্ছাকে মূল্য দেওয়া এবং সবার উপরে
দরিদ্র দেশটির উন্নয়ন ও অগ্রগতিকে বড় করে দেখা।]
উন্নয়ন বান্ধব রাজনীতি হচ্ছে সেই রাজনীতি যে রাজনীতি নিছক
ক্ষমতা চর্চা নয় বরং দেশ,
মানুষ ও রাষ্ট্রের সার্বিক উন্নয়নে কাজ
করে থাকে। প্রাচীন ও মধ্যযুগে পৃথিবীতে রাজতন্ত্র প্রচলিত ছিল। যিনি রাজা হতেন, তিনি রাজনৈতিক ক্ষমতাকে নিজের আরও অনেক সম্পদের মত একটি
ব্যক্তিগত সম্পত্তি মনে করতেন। রাজা মারা গেলে পুত্র উত্তরাধিকারীসূত্রে রাষ্ট্র
ক্ষমতার মালিক হতেন। সে যুগে কৃতদাসরাও মালিকের সম্পদের একটি অংশ বলে বিবেচিত হত।
বর্তমান যুগে মানুষ বেচাকেনা হয় না ও রাজতন্ত্রের ইতি হয়েছে। এখনকার যুগে রাজনৈতিক
ক্ষমতা কোন ব্যক্তির ব্যক্তিগত সম্পদ নয় বরং এই ক্ষমতার মালিক দেশের জনগণ। প্রাচীন
রাজনীতি পরিচালিত হত সম্রাট বা রাজার অঙ্গুলী নির্দেশে, রাজনীতিতে মানুষের অংশগ্রহণের কোন সুযোগ ছিল না বা মানুষের
ইচ্ছা অনিচ্ছার কোন মূল্যই ছিল না। রাষ্ট্রের তহবিল রাজার ইচ্ছায় রাজকীয় বিলাসীতায়
ব্যয় করা হত। সম্রাট শাহজাহানের আমলে ভারতবর্ষের প্রায় পাঁচ বছরের রাজস্ব সম্রাটের
স্ত্রীর সমাধি নির্মাণে ঢেলে দেওয়া হয়। অথচ তখনও ভারতবর্ষে প্রান্তিক পর্যায়ে
অবস্থানকারী মানুষরা অনাহারে-অর্ধাহারে দিনযাপন করত।
বর্তমান যুগ গণতন্ত্রের। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মাধ্যমে
বর্তমান বিশ্বের উন্নত রাষ্ট্রগুলো পরিচালিত হচ্ছে। রাজতন্ত্র, সামরিক শাসন,
একদলীয় সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা সবকিছু
অতিক্রম করে মানুষ শেষ পর্যন্ত গণতন্ত্রের দিকে ধাবিত হচ্ছে। কারণ গণতন্ত্র এমন এক
ব্যবস্থা যেখানে ভোটের মাধ্যমে শাসক নির্বাচিত হন। গণনির্বাচিত আইন সভা আইন প্রণয়ন
করে রাজনীতিকে যুগের সাথে খাপ খাওয়ানোর ব্যবস্থা করে দেয়। রাজতন্ত্রের যুগে পিতাকে
হত্যা করে পুত্র রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করত এবং রক্তপাত ছাড়া ক্ষমতা পরিবর্তনের কোন
সুযোগই ছিল না। অথচ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ভোটের মাধ্যমে অত্যন্ত স্বচ্ছভাবে
ক্ষমতার হস্তান্তর সংঘটিত হয়।
আধুনিক গণতন্ত্রের মূল লক্ষ্য হচ্ছে রাষ্ট্র ও জনগণের সার্বিক
উন্নয়ন। অথচ আমাদের দেশে জন্মের চল্লিশ বছর পরও আমরা যে নোংরা রাজনীতি চর্চা সরকার
ও বিরোধীদলের মধ্যে পর্যবেক্ষণ করছি তাতে কেবল ক্ষমতাচর্চা ছাড়া আর কিছুই
পরিলক্ষিত হচ্ছে না। গণতন্ত্র হচ্ছে ভিন্নমত,
ভিন্নপথ, ভিন্ন
দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে একটি সুন্দর সমন্বয়। অথচ আমাদের রাজনীতিতে সেই সমন্নয়টা নেই।
সব সময় একটা কোন্দলীয় হিংসাত্মক কার্যকলাপ নিয়ে আমাদের রাজনীতি ব্যতিব্যস্ত। এখানে উন্নয়নের ভাবনা অল্পই দৃষ্টিগোচর
হয়। এই দেশের মালিক হচ্ছেন দেশের জনগণ। এই জনগণ চায় সরকার ও বিরোধী রাজনীতিবিদগণ
আলাপ আলোচনার মাধ্যমে সব সমস্যার সমাধান করুক। জনগণকে কষ্ট দিয়ে কিংবা দেশের
উন্নয়ন ক্ষতিগ্রস্থ করে কোন রাজনৈতিক কার্যকলাপ দেশে পরিচালিত হউক তা জনগণ চায় না। কিছুদিন পূর্বে সিলেটের
ডাক একটি নিবন্ধে ব্রিগেডিয়ার জোবায়ের সিদ্দিকীও এ ব্যাপারে আলোচনা করেছেন।
গণতন্ত্র যে সবগুলো রাজনৈতিক দলের সংসদে কিংবা বাইরে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে এক
ধরনের ঐক্যমতের চর্চা তাহা তিনি সুন্দর ভাবে উপস্থাপন করেছেন। আলাপ-আলোচনা, সর্বমতের সমন্বয় সাধন ও স্বচ্ছ ভোট ব্যবস্থা গণতন্ত্রের মূল
ভিত্তি। গণতন্ত্রে অসহিষ্ণুতা,
জোর জবরদস্তি কিংবা অন্যায় কিছু চাপিয়ে
দেয়ার স্থান নেই।
এবার মূল বিষয়ে আসছি। বিগত কিছুদিন পূর্বে হরতালে হরতালে দেশ
মোট ছয় কার্যদিবসের (শুক্র ও শনি দুইদিনসহ) জন্য স্থবির হয়ে পড়ে। আমাদের দেশের
কোন্দলীয় ও অসহিষ্ণু রাজনীতির ফসল হচ্ছে এই হরতাল। এই হরতালের প্রধান কারণ হচ্ছে
রাজনীতিবিদগণের ঐক্যমতে না আসতে পারার ব্যর্থতা, পারস্পরিক
আস্থাহীনতা ও অন্ধ ক্ষমতােেলালুপতা ও হিংসা। আমার বোনের পরিবার পাঁচ বছর পর দেশে এসে আটকা পড়েন ঢাকা
বিমানবন্দরে। তার ভাগিনা ডাক্তার অনেক কষ্টে এম্বুলেন্স পাঠিয়ে নিয়ে আসে
লালমাটিয়ার বাসায়। যে মানুষগুলো বিদেশে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে অক্লান্ত পরিশ্রম করে
দেশের অর্থনীতিকে সচল রাখছেন,
দীর্ঘদিন অধীর অপেক্ষার পর দেশে ফিরে
বিমানবন্দরে তিনি বিড়ম্বনার শিকার হন। একমাত্র ছেলেটিকে দেশে এনে বিয়ে দিতে যে
বিড়ম্বনার শিকার হন আমার বোন,
মনে হয় না আর কোন ছেলেমেয়েকে এদেশে এনে
বিয়ে দেয়ার চিন্তা করবেন। ঠিক করে রাখা গায়ে হলুদের দিন হরতাল। রোববার বৌভাতের দিন
হরতাল। আত্মীয়-স্বজনকে দাওয়াত দেবেন,
সময় অল্প অথচ হরতাল। তার দেশে আসার স্বাদ
ছিকেয় উঠালো আমাদের সম্মানীত রাজনীতির হরতাল। উত্তর বাংলায় তরকারী সবজি পচে কৃষকের
মাথায় হাত। ঢাকা, সিলেটে শাক সবজির হাহাকার। শবজি, আম,
মাছের সারিবদ্ধ ট্রাকে লক্ষ লক্ষ টাকার
কাঁচামাল পচে নষ্ট হচ্ছে। গার্মেন্টস ও নিটওয়্যার ফ্যাক্টরীর উৎপন্ন পোশাক লীড টাইমের
মধ্যে চট্টগ্রাম বন্দরে শিপমেন্ট করতে হবে নতুবা অর্ডার বাতিল হয়ে গেলে সমুদয়
পোশাক জলের দরে দেশের বাজারে বিক্রি করে দিতে হবে। ফ্যাক্টরীগুলোর মালিক তথা দেশের
ক্ষতি হবে লক্ষ লক্ষ ডলার। শ্রমিকদের যথাসময়ে বেতন দিতে পারবে না মালিক। শুরু হবে
তান্ডব। মুখ তুবড়ে পড়বে রপ্তানী বাণিজ্য।
যে রপ্তানী বাণিজ্য তীব্র প্রতিযোগীতা করে বিশ্ববাজারে ঠিকে থাকার সংগ্রামে লিপ্ত
রয়েছে তা দেশের কোন্দলীয় নোংরা রাজনীতির কারণে পথ হারাবে। এদেশের যে উন্নয়ন হয়েছে
তা এদেশের প্রতিটি মানুষের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফসল। আমাদের রাজনৈতিক উদ্যোগের চেয়েও
অসংখ্য পরিশ্রমী, সৃজনশীল মানুষ ও উদ্যোক্তাগণের
ব্যক্তিগত কর্মউম্মাদনার সমষ্টিগত প্রচেষ্টার মাধ্যমেই আমাদের দেশ প্রতিবছর ছয়
শতাংশের বেশী হারে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। এ দেশের উন্নয়ন
করে যাচ্ছেন কৃষক ও শ্রমিক শ্রেণী। তারা নিরলস পরিশ্রম করে নীরব নিভৃতে এই দেশটা
কে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। পাশাপাশি উদ্যোক্তা ও বুদ্ধিজীবী শ্রেণী তাদের দিক
নির্দেশনা দিচ্ছেন। দেশের উন্নয়নের জন্য তারা নি:স্বার্থ প্রচেষ্টা চালিয়ে
যাচ্ছেন। আর সবধরণের সব দলের রাজনীতিবিদগণ ক্ষমতার লাটিম হয়ে অন্ধের মত ঘুরছেন।
দেশের উন্নয়ন নয় নরং ক্ষমতাই যেন তাদের কাছে মুখ্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এক সময়
আমাদের দেশটাকে মনে করা হত অনিশ্চয়তার দেশ। আমাদের অনেক বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়-স্বজন অনেকে আত্মরক্ষার জন্য এদেশ ছেড়ে বিদেশে দলে দলে
পলায়ন করেন। আর আমি আমার জন্মভূমি উনিশ পুরুষের লীলাভূমি এই দেশটাকে ছেড়ে বিদেশে
পালাতে পারিনি। কেন যেন এই দেশ,
এই মাটি, এই
জীবন ব্যবস্থা, এই ভাষা, সংস্কৃতি
ও বিশ্বাসবোধকে চিরতরে ফেলে ভিন জাতির মানুষের মাঝে বিলীন হয়ে নিজেকে হারাতে চায়নি
আমার মন। তাইতো দেশের উন্নয়নে আনন্দিত হই। আমাকে আমৃত্যু এদেশের কাটাতে হবে। এ
দেশের ভাল মন্দ নিয়ে এ জন্য ভাবতে হয় আমাকে। আমরা রাষ্ট্রের অর্থনীতি ধ্বংসকারী
হরতাল যেমন চাই না, তেমনি ভোট জালিয়াতি বা কারচুপি করে কেউ
ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হোক তাও কামনা করি না। সাড়ে চৌদ্দ কোটি মানুষের এই দেশ, কোন পরিবার,
ব্যক্তি কিংবা গোষ্ঠির ব্যক্তিগত সম্পদ
নয়। এটা আমার, আপনার সবার। এখানে যারা রাজনীতি
পরিচালনা করেন, তাদের উচিত জনগণের ইচ্ছা অনিচ্ছাকে
মূল্য দেওয়া এবং সবার উপরে দরিদ্র দেশটির উন্নয়ন ও অগ্রগতিকে বড় করে দেখা। দেশের
রাজনীতিকে অস্থিরতা হতে মুক্ত করে দেশের ও জনগণের স্বার্থে সম্মানজনক পন্থায়
রাজনীতি পরিচালনা করা। কোন ধরণের কোন্দল নয় বরং উন্নয়নের রাজনীতি আমরা সরকার ও
বিরোধী দলীয় রাজনীতিবিদগণের কাছে আশা করে বিদায় নিচ্ছি।
[প্রকাশ কাল: দৈনিক সিলেটের ডাক, রোববার,
৪ সেপ্টেম্বর, ২০১১ইং]
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন