Pages

প্রকাশিত গ্রন্থ-সমূহ

বৃহস্পতিবার, ১৭ মার্চ, ২০১৬

আর কোন নাগাসাকী হিরোসীমা নয়

আর কোন নাগাসাকী হিরোসীমা নয়
চৌধুরী ইসফাকুর রহমান কুরেশী

আজ আমাদের ঘরের পাশে পারমাণবিক অস্ত্রের বিষাক্ত থাবা ধ্বংসাত্মক প্রভাব বিস্তার করছে। শত শত বৎসরে ্মানুষের অক্লান্ত পরিশ্রমে গড়ে উঠা ভারত ও পাকিস্তানের শহর বন্দর ও সভ্যতা আজ এক ধ্বংসের মুখে নিক্ষিপ্ত হতে যাচ্ছে। ১৯৪৫ সালে যুক্তরাষ্ট্র যখন জাপানের নাগাসাকী ও হিরোসীমা নগরে দু’টি ক্ষুদ্রকার আনবিক বোমা বর্ষন করে তখনই এই পারমাণবিক দানবের মারাত্মক ধ্বংস ক্ষমতা মানুষ আঁচ করতে সমর্থ হয়। মুহুর্তের মধ্যে দু’টি নগরীর প্রায় দুই লক্ষাধিক মানুষ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। পরবর্তীকালে এই পারমাণবিক বিস্ফোরণের মারাত্মক রেডিয়েশনের শিকার হয়ে হাজার হাজার মানুষ ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। এখনও এইসব শহরে রেডিয়েশন আক্রান্ত মানুষের উদরে পঙ্গু ও বিকলাঙ্গ সন্তান জন্ম হচ্ছে। এই অভিশাপ সম্ভবতঃ পরবর্তী কয়েক যুগ এইসব নিরপরাধ মানুষকে বহন করতে হবে। তাছাড়া, এই নগর দু’টির ভবন সড়ক সহ পুরো অবকাঠামো ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল।
পাকিস্তানের সীমানা হতে মাত্র ৯০ মাইল পূর্বে গত ১১ মে রাজস্থানের মরুভূমির ভূগর্বে ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বাজপেয়ী পরপর তিনটি পারমাণবিক বিস্ফোরণ ঘটান। বিশ্বব্যাপী প্রবল নিন্দাকে উপেক্ষা করে ২ দিন পর আর দু’টি বিস্ফোরণের মাধ্যমে পরীক্ষাকার্যের আপাততঃ সমাপ্তি ঘোষণা করেন। ১৯৭৪ সালে প্রথম পারমাণবিক বিস্ফোরণ ঘটানোর পর এতদিন ভারত নিরব ছিল। সফল ক্ষেপনাস্ত্র ‘অগ্নি’ ও ‘পথ্বি’ উৎক্ষেপণের প্রতিক্রিয়া স্বরূপ কিছুদিন পূর্বে পাকিস্তান ‘ঘুরী’ ক্ষেপনাস্ত্র উৎক্ষেপণের করে, যা ১৫০০ কিঃমিঃ দূরত্ব অতিক্রম করে ভারতের অধিকাংশ গুরুত্বপূর্ণ নগরে আঘাত হানতে সক্ষম। এভাবে যে এক অস্ত্র প্রতিযোগিতার ধারাবাহিকতায় ভারত পারমাণবিক বিস্ফোরণ ঘটায় তা বলার অপেক্ষা রাখেনা। এখন পাকিস্তানের পাল্টা জবাব দেবার পালা। এঘটনার অনেক আগেই পাকিস্তানের দু’একজন বিজ্ঞানী বলেছিলেন, পাকিস্তান ইচ্ছে করলেই পারমাণবিক বিস্ফোরণ ঘটাতে সক্ষম। বর্তমানে পাকিস্তানের উগ্রপন্থি গোষ্ঠি, এমন কি জনসাধারণও নিজেদের নিরাপত্তা ও ভারতকে উপযুক্ত জবাব দানের জন্য পারমাণবিক বিস্ফোরণ ঘটানোর জন্য তীব্র চাপ প্রয়োগ করে। কাজেই পাকিস্তানও পারমাণবিক পরীক্ষার মাধ্যমে পারমাণবিক শক্তিধর রাষ্ট্র হিসাবে আবির্ভূত হয়। এভাবে এই দক্ষিণ এশিয়ার যে এক মারাত্মক ও ধ্বংসাত্মক পারমাণবিক অস্ত্র প্রতিযোগিতা ও সমরচর্চায় লিপ্ত হলো যা ভারত ও পাকিস্তান কারো জন্য মঙ্গল বয়ে আনবে না বরং উভয় দেশকে নিশ্চিহ্ন হবার ভয় ও শঙ্কার মুখে নিক্ষেপ করবে।

বর্তমান যুগের সত্য হচ্ছে, এ যুগ এক রাষ্ট্র কর্তৃক সমর বলে অন্য রাষ্ট্র দখলের যুগ নয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী ঘটনাসমূহ থেকে প্রমাণীত হয়েছে, কোন দেশ কর্তৃক সমরশক্তি বলে অন্যদেশকে স্থায়ীভাবে পদানত করা সম্ভব নয়। যদি সম্ভব হত, তাহলে আমেরিকার মত পরাশক্তি ভিয়েতনামের গেরিলাদের মার খেয়ে পালাতো না। রাশিয়া আফগানিস্তানের মুজাহীদদের মার খেয়ে পাততাড়ি গোটাতো না। সাদ্দাম হোসেন ক্ষুদ্র রাষ্ট্র কুয়েত স্থায়ীভাবে পদানত করে দিত। কাজেই ভারত কিংবা পাকিস্তান যদি সামরিক শক্তি বলে একে অন্যকে পদানত করার চিন্তা ভাবনা করে তা নিতান্তই ভুল। আর ভারত বলছে চীনের মোকাবেলায় তারা পারমাণবিক শক্তি সজ্জিত হচ্ছে। কিন্তু চীন যে ভারতের মত বিশাল রাষ্ট্রকে সমরবলে দখল করতে আসবে তা একেবারেই ভুল ধারণা। কারণ চীনারা ইচ্ছে করলে তাদের পাশ্ববর্তী ক্ষুদ্র রাষ্ট্র যেমন তাইওয়ান, লাওস, উ:কুরিয়া ইত্যাদি রাষ্ট্র ভারতের চেয়ে আরও সহজে দখল করে নিতে সক্ষম। অথচ সেসব- জাতিগোষ্ঠীর ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাষ্ট্র সমূহও শক্তি প্রয়োগে যাচ্ছে না। কাজেই চীনভীতি দেখিয়ে ভারতকে পারমাণবিক অস্ত্র সজ্জিত করণের এই ঝুঁকিবহুল ও ব্যয়বহুল পদক্ষেপ গ্রহণ দরিদ্র পীড়িত ভারতবাসীর জন্য এই দুর্ভাগ্যই বলতে হবে।
নাগাসাকি ও হিরোসীমার নিক্ষিপ্ত বোমার চেয়ে বর্তমানে আরও হাজার হাজার গুণ শক্তিশালী পারমাণবিক বোমা বিশ্বে মজুত রয়েছে। ধারণা করা হয়, বর্তমান বিশ্বে যে পারমাণবিক বোমার মজুত রয়েছে তার ধ্বংস ক্ষমতা ১৫০০০ মেঘাটন যা দিয়ে বিশ্বকে কয়েকবার ধ্বংস করে দেওয়া সম্ভব। বিশ্বের ৫টি পারমাণবিক শক্তিধর রাষ্ট্র হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীন, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স। তাছাড়া আরও প্রায় ২০টি রাষ্ট্রের হাতে পারমাণবিক বোমা নির্মাণের প্রযুক্তি ও ক্ষমতা রয়েছে বলে ধারণা করা হয়। ভারত, পাকিস্তান, ইসরায়েল, উ:কুরিয়া, ইরান ইত্যাদি দেশ পারমাণবিক অস্ত্র নির্মাণের চেষ্টায় রয়েছে। তন্মধ্যে ভারত ও পাকিস্তান সদ্য সমাপ্ত পরীক্ষার মাধ্যমে নিজেদেরকে পারমাণবিক শক্তিধর রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। পারমাণবিক অস্ত্র প্রতিযোগিতার এই তীব্র উত্তেজনায় যদি ভুলবশত: পারমাণবিক যুদ্ধের সূচনা হয়, তবে পৃথিবী ও সভ্যতা ধ্বংস হয়ে যাবে। সারাটা বিশ্বে ‘পারমাণবিক শীত’ নেমে এসে আবার বরফের যুগ সূচনা হবে। বৃক্ষ লতা ও প্রাণীমন্ডল ধ্বংস হয়ে বিশ্বটা, বুধ, শুক্র, মঙ্গল ইত্যাদি গ্রহণের মত এক মৃত গ্রহে পরিণত হবে।
পৃথিবীর ৭টি মহাদেশের মধ্যে দক্ষিণ আমেরিকা, আফ্রিকা ও অষ্ট্রেলিয়া মহাদেশের রাষ্ট্রসমূহ নিজেদেরকে পারমাণবিক অস্ত্রমুক্ত রাষ্ট্র হিসাবে রেখেছে। উঃ আমেরিকা মহাদেশে কেবলমাত্র যুক্তরাষ্ট্র ব্যতিত অন্য সকল দেশ পারমাণবিক অস্ত্রমুক্ত রয়েছে। ইউরোপের পারমাণবিক শক্তিধর তিনটি রাষ্ট্র হচ্ছে বৃটেন, ফ্রান্স ও রাশিয়া। এশিয়ার চীনের সাথে যুক্ত হলো ভারত। এশিয়ায় জাপান ও ইউরোপে জার্মানী, ইটালী, আমেরিকায় কানাডা ইত্যাদি রাষ্ট্রসমূহের পারমাণবিক অস্ত্র নির্মাণের মত প্রয়োজনীয় বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তিজ্ঞান ও পুরোপুরী অর্থনৈতিক সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও তারা সযতনে নিজেদের এই ধ্বংসাত্মক ক্রিয়াকলাপ থেকে সরিয়ে রেখে নিজেদের জ্ঞানগরিমা ও অর্থনীতিকে সভ্যতা ও মানবজাতির উন্নয়নে ব্যয় করছে। মানুষের জীবন যাত্রার মান উন্নয়ন ও সভ্যতার উৎকর্ষতা ঘটানোর প্রতিযোগিতায় লিপ্ত রয়েছে। কিন্তু দুর্ভাগ্য শত শত বৎসরের উপনিবেশ দক্ষিণ এশিয়া তথা ভারত ও পাকিস্তানের এই সব দেশের রাষ্ট্রনায়কদের মূল লক্ষ্য সমরচর্চা আর গৌন উদ্দেশ্য হচ্ছে অর্থনৈতিক উন্নয়ন দারিদ্র বিমোচন, জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন। যেসব দেশ এখনও সুন্দরভাবে একটা স্ক্রু নির্মাণ করতে সক্ষম নয় অথচ তারা আজ পারমাণবিক অস্ত্র নির্মাণে মহাব্যস্ত হয়ে উঠেছে। পাকিস্তানের সামরিক খাতে ব্যয়ের পরিমাণ শিক্ষা ও স্বাস্থ্য মোট ব্যয়ের সমান। আর ভারতের সামরিক ব্যয় উক্ত দেশের শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাতের মোট ব্যয়ের দুই তৃতীয়াংশ। ঐঁসধহ উবাবষড়ঢ়সবহঃ রহ ঝড়ঁঃয অংরধ ১৯৯৭ শীর্ষক প্রতিবেদনে ড: মাহবুবুল হক দেখিয়েছেন, এসব দেশের দ্রুত পিছিয়ে পড়ার প্রধান কারণ হচ্ছে দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধি রোধ ও সার্বজনীন শিক্ষা বিস্তারে অবহেলা এবং সামরিক খাতে জাতীয় আয়ের বিরাট একটা অংশের অপচয় মূলক ব্যয়। স্নায়ুযুদ্ধের অবসানে ১৯৮৭-৯৪ সময়ে সারা বিশ্বে সামরিক ব্যয়ের পরিমাণ ৩৭% কমেছে, শুধু বেড়েছে দরিদ্র ও বেকারত্বের কষাঘাতে জর্জরিত দক্ষিণ এশিয়ার দেশ সমূহে। এই সময়ে নেপাল ০.৮ শতাংশ থেকে ১.১% বাংলাদেশে ১.৩% থেকে ১.৫% শ্রীলঙ্কায় ২.৭% থেকে ৪.৭% পাকিস্তানে ৫.২% থেকে ৬.৬% ও ভারতে মোট দেশজ উৎপাদনের ২.৬% থেকে বেড়েছে ৩.৬%। শ্রীলঙ্কায় গত ক’বছরে সামরিক খাতে ব্যয় বাড়াতে গিয়ে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতকে কমাতে হচ্ছে। বাংলাদেশেও সামরিক খাতে ব্যয় ক্রমাগত বাড়ানো হচ্ছে।
বর্তমান যুগে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, যোগাযোগ ও মিডিয়া উন্নয়নের এক বৈপ্লবিক পরিবর্তনের যুগ। ইউরোপ সহ সারাটা পৃথিবী সুসংহত ও ঐক্যবদ্ধ হচ্ছে। মানুষের জীবন যাত্রার মান অব্যাহতভাবে উন্নত হচ্ছে। শিল্প, সংস্কৃতি, বৈজ্ঞানিক উন্নয়ন ও জীবনযাত্রার উন্নয়নে এক বিপুল সম্ভাবনার দ্বার যখন মানুষের কাছে অবারিত হচ্ছে তখন এই মৃত্যু প্রতিযোগিতা দক্ষিণ এশিয়াকে পিছনের দিকে ঠেলে নিয়ে যাবে-তা বলার অপেক্ষা রাখেনা। তাছাড়া, উগ্র মৌলবাদ, উগ্র জাতীয়তাবাদ এসব দেশের রাজনীতিতে ধাপে ধাপে যে গণতান্ত্রিক উন্নয়ন সাধিত হয়েছে তা নস্যাৎ করে দিতে পারে। গণতন্ত্রের ছদ্মাবরণে জার্মানী কিংবা ইটালীর মত এসব দেশে যে কোন সময় মৌলবাদ ও উগ্রজাতীয়তাবাদ ফ্যাসিস্ট ব্যবস্থার জন্ম দিতে পারে। যা এসব দেশের অগ্রগতিকে চিরতরে ধ্বংস করে দেবে।
দক্ষিণ এশিয়ার উন্নয়নের স্বার্থে এইসব দেশের কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, বৈজ্ঞানিকসহ শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষকে সমরচর্চা ও পারমাণবিক অস্ত্র প্রতিযোগিতার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করে যাওয়া প্রয়োজন। বিভীষিকাপূর্ণ পারমাণবিক অস্ত্রের বিরুদ্ধে পাশ্চাত্য বুদ্ধিজীবিরা যে আন্দোলন সূচনা করেন তাতে সম্পৃক্ত রয়েছেন বারট্রান্ড রাসেল, বিজ্ঞানী আইনস্টাইন, পাবলো পিকাসো, কবি নেরুদার মত প্রখ্যাত মনীষিরা। আমরা যুদ্ধ চাই না, শান্তি ও অগ্রগতি চাই। বিশ্বের ১/৫ ভাগ মানুষ চরম দরিদ্র সীমার নিচে রয়েছে। যার বেশীর ভাগের বাস এই দক্ষিণ এশিয়ায়। আমরা সামরিক খাতে অপব্যয় চাইনা- আমরা এসব হতদরিদ্র মানুষের ভাগ্য উন্নয়ন চাই। আমাদের ঘরের পাশে এই মরণ প্রতিযোগিতায় আমরা বাংলাদেশবাসী দারুণ উদ্বিগ্ন ও মর্মাহত। 

[প্রকাশ কাল: দৈনিক সিলেটের ডাক, ১৬ জুন, ১৯৯৮ইং]
 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন