Pages

প্রকাশিত গ্রন্থ-সমূহ

বৃহস্পতিবার, ১৭ মার্চ, ২০১৬

ছাত্রদের অমূল্য জীবন বাঁচাতে রাজনীতি থেকে সরে আসতে হবে

ছাত্রদের অমূল্য জীবন বাঁচাতে
রাজনীতি থেকে সরে আসতে হবে
চৌধুরী ইসফাকুর রহমান কুরেশী

২৪ মে ’৯৮। ভোরে থমকে দাড়ালো আমার বিবেক। সিলেট মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের লাশকাটা ঘরে পড়ে আছে এক কচি ছাত্রের লাশ। বয়স আর কত হবে বড়জোর বিশ/ বাইশ। জীবন আজও পূর্ণতা পায়নি, জীবনের স্বপ্নগুলো আজও ডানা মেলেনি, অথচ ছাত্ররাজনীতির হিংস্র থাবা অল্প বয়সে কেড়ে নিলো ছেলেটির প্রাণ। ছেলেটির মা-বাবা হয়ত তখনও জানে না, তাদের প্রাণপ্রিয় পুত্রটি এই পৃথিবীতে বেঁচে নেই। মাতৃজটরে ধারণকারী মা কিংবা জন্মদাতা বাবা যিনি কৈশর থেকে কোলে-পিঠে করে ছেলেটিকে মানুষ করেছেন, মেডিকেল কলেজে পাঠিয়ে অপেক্ষা করছেন, কখন তাদের সন্তান ডাক্তার হয়ে বেরিয়ে আসবে, সংসারের অভাব ঘুচাবে, মা-বাবার মুখ উজ্জ্বল করবে, তাদের সে স্বপ্নের ছেলেটি আজ ফিরে যাবে তাদের কাছে তবে ডাক্তার হয়ে নয়, লাশ হয়ে। আলমারকাজুলের এম্বুলেন্সে লাশ নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, পিছনে পিছনে পুলিশের কনভয়।
এই দিন অফিস থেকে ফিরছি। পথে দেখা হলো ডাঃ আদিল ভাইয়ের সাথে। (ডাঃ আদিলুজ্জামান, লেকচারার ফরেনসিক মেডিসিন) এ প্রসঙ্গে জিজ্ঞেস করতেই জানালেন, একজন নয়, দুইজন ছাত্রের পোস্ট মর্টেম করে ফিরছেন তিনি। আরেকজন মরণাপন্ন। হ্যাঁ পরদিন আরেকজন মারা যায়। এভাবে ঝরে পড়ে দু’টি ছাত্রের লাশ।

এই হচ্ছে আমাদের প্রিয় জন্মভূমি দুর্ভাগা বাংলাদেশের ছাত্র রাজনীতির মরণ খেলার একটি বাস্তব চিত্র। এটি একটি খন্ডিত চিত্র। অথচ ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের এই ক্ষুদ্র রাষ্ট্রটির প্রতিটি শহরের প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অহরহ এ ধরনের সন্ত্রাসী রাজনীতির হত্যার শিকার হচ্ছে কচিপ্রাণ, অপরিপক্ক ছেলেরা। কিছুদিন পূর্বে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের হোস্টেলে দুর্বৃত্তদের হামলায় ভর্তি হতে আসা এক ছেলে নিহত হয়। সন্ত্রাসীদের গুলীবর্ষণে নিহত হয় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের রাজনীতি নিরপেক্ষ এক মেধাবী ছাত্র। যে ছেলেটি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক বাবার একমাত্র সন্তান। মাসখানেক আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নিহত হন সাংবাদিকতা বিভাগের মেধাবী ছাত্র পার্থ প্রতীম- যার হাতের মেহদীর রঙ্গ তখনও মুছেনি। যার নবপরিণতা স্ত্রীর গর্ভে নতুন বার্তা অথচ জন্মের পর সন্তানটি দেখতে পাবে না তার বাবাকে। এভাবে আর কত কাল ছাত্ররা অনর্থক প্রাণ হারাবে, আর নেতাদের স্বার্থ রক্ষার হাতিয়ার হিসাবে তাদের অমূল্য জীবন বিসর্জন দেবে? প্রতি বছর অগণিত ছাত্র নিহত হচ্ছে, তার চেয়েও বেশী পঙ্গু হচ্ছে, অথচ টনক নড়ছে না আমাদের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের। প্রতিটি ছাত্র হত্যাকান্ডের পর রাজনৈতিক দলগুলো তাদের দায়দায়িত্ব পালন করে পক্ষে-বিপক্ষে বক্তৃতা বিবৃতির মধ্যে। কোন হত্যাকান্ডের নিরপেক্ষ তদন্ত কিংবা বিচার হয় না। হত্যাকারী সন্ত্রাসীরা আটক হলেও গডফাদারের দাপটে বের হয়ে এসে আবার সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়ে। কোন সন্ত্রাসী খুনীকে শাস্তি পেতে হয় না এই দেশে।
উন্নত বিশ্বের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলোতে কোন ছাত্র রাজনীতি নেই। সেখানে ছাত্ররা রাজনীতি নয় বরং অধ্যয়নে গভীর ভাবে আত্মনিয়োগ করে থাকে। এমনকি আমাদের পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র ভারত ও পাকিস্তানে ছাত্র রাজনীতির নামে কোন ছাত্রকে প্রাণ হারাতে হয় না। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে সেশন জটের শিকার হতে হয় না। অথচ ছাত্র রাজনীতির জন্য আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ১৮ মাসে বছর পার  করতে হয়। আর একারণেই আমাদের দেশে প্রায় লক্ষাধিক ছাত্র-ছাত্রী ভারতে অধ্যায়ন করছে। সন্ত্রাসী, অব্যবস্থাপনা ও শিক্ষার মান ক্রমহ্রাসের কারণে বর্তমানে বাংলাদেশের গরীব ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষেরা সন্তানদের শিক্ষার জন্য ভারতের দিকে ঝুঁকে পড়ছে। সেখানে পড়তে গিয়ে অন্তত: প্রাণটাতো হারাতে হবে না। এখন আসি উচ্চ বিত্তের হিসাবে। এদেশের উচ্চবিত্ত এলিট শ্রেণীর মানুষেরা তাদের সন্তানদের সুশিক্ষার জন্য পাঠিয়ে দেন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জাপান, অস্ট্রেলিয়া ইত্যাদি উন্নত দেশগুলোতে। তাদের ছেলেরা যথাসময়ে পরিপূর্ণ শিক্ষা নিয়ে ফিরে এসে জুড়ে বসে গুরুত্বপূর্ণ আসন। কিংবা স্থায়ীভাবে রয়ে যায় উন্নত দেশগুলোতে। তারা ফিরে আসার গরজ অনুভব করে না- এই অনগ্রসর দেশে।
অন্যদিকে, সেশন জট, রাজনীতি, খুন-জখমের শিকার হয় এদেশের কৃষক শ্রমিকসহ আপামর আমজনতার সন্তানেরা। এদের না হয় শিক্ষা, না হয় চাকুরী। ধুকে ধুকে আঠারো মাসি বছর পেরিয়ে যখন বের হয় তখন পেরিয়ে যায় চাকুরীর বয়স-বড়জোর মাস্টার কিংবা কিরানী। যেন পূর্ণিমার চাঁদ তখন ঝলসানো রুটি।
আওয়ামীলীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি ও জামায়াত নেতৃবৃন্দের প্রতি আমাদের আকুল আবেদন, আপনারার কোমল মতি সরলপ্রাণ ছাত্রদের নিয়ে রাজনীতির মরণখেলা দয়া করে বন্ধ করুন। জীবন ও জগত সম্পর্কে অত্যন্ত অনভিজ্ঞ ও বয়সে স্বল্প মাথা গরম এসব ছেলেরা না বুঝে সমাজনীতি, না বুঝে দর্শন, না বুঝে রাজ্য, না বুঝে রাজনীতি। অথচ ফাঁকা আদর্শের বুলি আওড়িয়ে কখনও নীতির চেতনা, কখনও আদর্শের বাণী, কখনও ধর্মীয় শহীদি চেতনা, আবার কখনও স্বাধীনতা কিংবা সমাজতন্ত্রের চেতনার উল্টাপাল্টা ঝান্ডা উড়িয়ে ছাত্রদের অসংখ্য দল-উপদলে ভাগ করা হয়। বিভক্ত করা হয়, পরস্পর পরস্পরকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য সুকৌশলে উদ্দীপ্ত করা হয়। আর এর মাধ্যমে রাজনৈতিক ফায়দা হাছিলের অনৈতিক খেলায় মগ্ন হয় আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো। আমাদের মহামান্য রাষ্ট্রপতি সাহাবউদ্দিন আহমদ বহুদিন যাবৎ ছাত্রদেরকে তাদের লেজুড় হিসাবে ব্যবহার না করার জন্য সকল রাজনৈতিক দলগুলোকে আহবান জানিয়ে আসছেন, অথচ কেউই তার কথায় কর্ণপাত করছে বলে মনে হয় না। জানিনা, আমাদের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ অল্পবয়স্ক ছাত্রদের আর কত লাশ দেখতে চান। রক্ত আর লাশের সিঁড়ি বেয়ে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠা হাসিলের জন্য আর কত ছাত্রকে তারা বলীর পাঠা বানাবেন? তবে হ্যাঁ এক সময় ছাত্র রাজনীতি এদেশের জন্য প্রয়োজন ছিল। ’৭১ এর আগে ছাত্ররা শতদলে বিভক্ত না হয়ে স্বাধীনতার জন্য ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন করেছিল। ’৯০-এর স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে জাতির সচেতন অংশ ছাত্ররা ঐক্যবদ্ধ হয়ে অসাংবিধানিক সামরিক স্বৈরাচার এরশাদের পতন ঘটাতে সক্ষম হয়েছিল। বিশেষ মুহুর্তে বিশেষ বিশেষ কারণে সচেতন অংশ হিসেবে ছাত্রদের ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে আসা প্রয়োজন। কিন্তু সবসময় ছাত্রদের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের লেজুড় হিসাবে ব্যবহৃত হয়ে লেখাপড়া বন্ধ রেখে রাজনীতিতে আবদ্ধ হওয়া ঠিক নয়। ’৯০ থেকে দেশে সাংবিধানিক শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। নির্বাচন পদ্ধতি অবাধ ও নিরপেক্ষ হয়েছে। দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ও সাংবিধানিক শাসন ব্যবস্থায় দেশ পরিচালিত হচ্ছে। এমতাবস্থায় ছাত্র রাজনীতির প্রয়োজনও ফুরিয়ে আসছে। বর্তমানে প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অরাজনৈতিক সংসদ প্রবর্তন করা উচিত। যেখানে কোন রাজনৈতিক দল নয় বরং নেতারা নিজ নিজ জনপ্রিয়তা ও কর্মদক্ষতার গুণে সাধারণ ছাত্রগণ কর্তৃক নির্বাচিত হবেন। কলেজের সাংসদগণের প্রকাশ্য কোন রাজনৈতিক দলীয় পরিচিত থাকবে না। কলেজগুলোতে কোন প্রকার রাজনৈতিক মিটিং, শোভাযাত্রা, পোস্টারিং, ওয়াল লিখন চলবে না। দেশে যদি কখনও সংবিধান লঙ্গন পূর্বক একদলীয় স্বৈরশাসন কিংবা সামরিক শাসন কিংবা অগণতান্ত্রিক শাসনের সূত্রপাত হয়, কেবল সেই সংকটময় মুহুর্তে ছাত্ররা দলমত নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে আসতে পারে নতুবা ছাত্রদের দলীয় রাজনীতি থেকে নিজেদেরকে সযতনে সরিয়ে রাখা উচিত।
[প্রকাশ কাল: দৈনিক সিলেটের ডাক, ১৭ জুন, ১৯৯৮ইং]



কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন