Pages

প্রকাশিত গ্রন্থ-সমূহ

বৃহস্পতিবার, ১৭ মার্চ, ২০১৬

হে দুর্ভাগা দেশ আর কতকাল তুমি সইবে যন্ত্রনা

হে দুর্ভাগা দেশ আর কতকাল
তুমি সইবে যন্ত্রনা
চৌধুরী ইসফাকুর রহমান কুরেশী

বর্তমানে একথা নি:সন্দেহে বলা যায় যে, দেশের চলমান রাজিৈনতক কালচারে সন্তুষ্ট নন এদেশের সচেতন জনগণ। বাংলাদেশে সংসদীয় গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়ার প্রশ্নে জনগণ সরকার ও বিরোধী দলের যে ইতিবাচক ভূমিকা আশা করেছিল সেই প্রত্যাশা আজ মলিন হয়ে যাচ্ছে। যে জাতীয় সংসদ হচ্ছে সকল জাতীয় কর্মকান্ডের কেন্দ্রস্থল সেখানেও বিরাজ করছে স্থবিরতা। অভিযোগ, পাল্টা অভিযোগ। অথচ গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে হলে সংসদকে সকল জাতীয় কর্মকান্ডের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করা প্রয়োজন। এজন্য প্রয়োজন প্রতিটি রাজনৈতিক দলের সত্যিকারের গণতন্ত্র চর্চা। প্রকৃত পক্ষে বাংলাদেশে গণতন্ত্রের চর্চা খুবই অল্প দিনের সংসদীয় গণতন্ত্র এদেশে প্রতিষ্ঠিত ছিল হাতে গোনা মাত্র কয়েকটি বৎসর। ৭২ থেকে বাকশাল কায়েম পর্যন্ত আড়াই বৎসর। ৯০ থেকে ৯৫, খালেদা জিয়ার ৫ বৎসর, আর বর্তমান হাসিনা সরকারের আড়াই বৎসর। অর্থাৎ মোট ১০ বৎসর। স্বাধীনতা পরবর্তী ২৭ বৎসরের ইতিহাসে মাত্র ১০ বৎসর এদেশে সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত ছিল, বাদবাকী ১৭ বৎসর এদেশে সামরিক ও আধা সামরিকতন্ত্র অব্যাহত ছিল। আমাদের স্বাধীনতার ২৭ বৎসর পার হলেও বিভিন্ন সময়ে মার্শাল ল’, রাজনৈতিক হত্যাকান্ড, ষড়যন্ত্র, ক্যু রাজনীতিবিদদের ক্ষমতালিপ্সা ও স্বার্থপরতা নির্বাচন পদ্ধতির ত্র“টি সহ বিভিন্ন কারণে এদেশে গণতন্ত্র বিঘিœত হয়েছে। গণতন্ত্রের মানসপুত্র বৃটেনে গণতন্ত্রের ইতিহাস ৪০০ বৎসরের। প্রতিবেশী ভারতে ৫০ বৎসরের আর আমাদের মাত্র ১০ বৎসরের। আমাদেরকে হাটি, হাটি পা, পা করে এগিয়ে যেতে হবে সামনের পানে, অনেক দূরে এক অনন্ত ভবিষ্যতের রাজ্যে।

প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ ও সাহিত্যিক আবুল মনসুর আহমদ বলেছেন ‘গণতন্ত্রের দু’টি পা, একটি হচ্ছে সরকারী দল, অন্যটি হচ্ছে বিরোধী দল।’ একটি মানুষকে সুদীর্ঘ পথ অতিক্রম করতে হলে প্রয়োজন দু’টি পায়ের ক্ষিপ্রতা ও সম্মিলিত প্রয়াস। নতুবা এক পা বিশিষ্ট বকের মত ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। একটি গণতান্ত্রিক দেশকেও সর্বক্ষেত্রে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হলে গণতন্ত্রের দু’টি পা, সরকারী দল ও বিরোধী দলের ক্ষিপ্রতা ও দক্ষতার সম্মিলিত প্রয়াস প্রয়োজন। অথচ দু:খজনক হলেও সত্য, আমাদের গণতন্ত্রের এই দু’টি পায়ের মধ্যে কোন সমন্বয় ও সহযোগিতা নেই। তাইতো আমরা ক্রমে ক্রমে পিছিয়ে পড়েছি।
গণতন্ত্রের অন্যতম নাম সহনশীলতা। সহনশীলতা সবার জন্য প্রয়োজন, সরকারী-বিরোধী-সবার জন্য। অথচ এদেশে প্রধান প্রধান রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরা মাঠে-ময়দানে ভাষণে একে অন্যকে হুমকি দেন, ধম্কী দেন। রাজপথে কর্মী বাহিনী নিয়ে একে অন্যের মুখোমুখি হন। পরম সহিঞ্চুতা যা আমাদের রাজনীতবিদ তথা আমাদের মধ্যে থাকতো তবে আমরা বিগত ২৭ বৎসরে অনেক এগিয়ে যেতাম। অথচ এই দীর্ঘ সময়ে দেশ খুব এগোয়নি। আন্দোলন, হরতাল তথা রাজনৈতিক দল গুলির আত্মঘাতি হানাহানির কারণে দেশ এগুতে পারেনি। আওয়ামীলীগ করেছে জাতীয় পার্টি করেছে, বিএনপি করেছে, জামাতিরা করেছে। দেশে অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রশ্নে সবগুলো দলেরই ঐক্যমত্য রয়েছে। অথচ অর্থনীতিকে মারাত্মকভাবে আঘাতকারী হরতালকে কেউই বাদ দিতে পারছেনা।
বিশ্ববিখ্যাত অর্থনীতিবিদ, বাঙ্গালী জাতির গর্ব, এ বৎসরের নবেল পুরস্কার বিজয়ী প্রথম এশীয় অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন গণতন্ত্রকে দুর্ভিক্ষ প্রতিকার ও প্রতিরোধের প্রধান হাতিয়ার হিসাবে সনাক্ত করেছেন। ১৯৪৩ সনের দুর্ভিক্ষের পর ভারতে বিগত ৫০ বৎসরের গণতন্ত্রের ইতিহাসে আর দুর্ভিক্ষ হয়নি। বৃটিশ শাসনে যে ভারত সর্বদা দুর্ভিক্ষের শিকার হত, গণতান্ত্রিক ভারতে কয়েকগুণ মানুষ বৃদ্ধির পরও সেই দুর্ভিক্ষ নেই বরং ভারত বর্তমানে একটি খাদ্য উদ্ধৃত্ত দেশে পরিণত হয়েছে। কিছুদিন আগে আমাদের দেশে সংঘটিত হয়েছে শতাব্দীর ভয়াবহতম বন্যা। কৃষকরা দু’টি ফসল ঘরে তুলতে পারেনি, গ্রাম বাংলার ঘরে ঘরে অন্নের অভাব। সরকার খাদ্য সংস্থানে ব্যতিব্যস্ত। সুদীর্ঘ বন্যা কবলিত সময়ে সরকার ও বিরোধীদল কথাযুদ্ধে লিপ্ত হলেও কোন ধ্বংসাত্মক কর্মসূচী হয়নি। বিরোধী দল শুভবুদ্ধির পরিয় দিয়েছে, কোন উত্তেজনায় জড়ায়নি বরং সরকার বিরোধী দলগুলো দুর্দশাগ্রস্থ মানুষের কাছে দাঁড়িয়েছে।
অথচ বর্তমানে আমরা এসব কি দেখছি? আমাদের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ কি দেশে একটা দুর্ভিক্ষ দেখতে চান। নতুবা এরকম এক নাজুক মুহুর্তে তারা কেন হরতাল, অবরোধ ও উত্তেজনায় জড়িয়ে পড়ছেন? কেন সরকার ও বিরোধী দল এমন পরিবেশ সৃষ্টি করছেন যাতে দেশ হরতালে অবরোধে স্থবির হয়ে পড়ে? শতশত বৎসরের উপনিবেশ এই দুর্ভাগা দেশের কি কোন ভাবমূর্তি নেই বিশ্বের কাছে। এই প্রথম বাংলাদেশ একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উইলস্কাপ ক্রিকেট টুনামেন্ট করার সুযোগ পেল। এটা শুধু সরকারের একার কৃতিত্ব ও দায়িত্ব নয়, বরং এই অনুষ্ঠান সফল করে তোলার দায়িত্ব সরকার ও বিরোধী দল সহ আপামর জনগণের। বিশ্বের অসংখ্য রাষ্ট্রের কোটি কোটি মানুষ স্যাটেলাইটে চ্যেনেলের মাধ্যমে উপভোগ করছে এই প্রতিযোগিতা, সেই সাথে বিশ্বের ঘরে ঘরে পৌঁছে যাচ্ছে বাংলাদেশ। অথচ কথা হলো তারা কোন বাংলাদেশকে দেখবে? তারা কি দেখবে রাজনৈতিক হানাহানিতে লিপ্ত, হরতাল সংঘাতে বিপর্যস্ত বাংলাদেশকে, না সত্য, সুন্দর সুসভ্য, সুশৃংখল বাংলাদেশকে।
আমাদের কালচার-সংস্কৃতি, ইতিহাস-ঐতিহ্যকে বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরার এক সুবর্ণ সুযোগ এভাবে রাজনৈতিক নেতৃত্বের অরাজকতার কারণে নষ্ট হয়ে যাবে। আমাদের ভাল ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠার স্থলে বিদেশীদের কাছে মন্দ ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠিত হবেএকেতো বিশ্বের কাছে আমাদের পরিচিতি বন্যা খরার দেশ হিসেবে, নতুবা চড়ড়ৎবংঃ পড়ঁহঃৎু ড়ভ ঃযব ড়িৎষফ হিসাবে। তদুপরি আমরা যদি আমাদের ক্রিয়াকর্মের মাধ্যমে আরও কয়েকটি ‘অপ পরিচিতি’ সৃষ্টি করি, তবে স্বাধীন জাতি হিসেবে আমাদের বাঁচা-মরা সমান হয়ে যাবে।
আজ আমাদের সবচেয়ে প্রয়োজন গণতন্ত্র। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও উজ্জ্বল ভাবমূর্তি। এককথায় রাজনৈতিক উত্তেজনাহীন স্থায়ী, স্থিতিশীল গণতান্ত্রিক সরকার পদ্ধতি ও দায়িত্বশীল বিরোধী দল। রাজনৈতিক স্থিতি যদি আমাদের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ অব্যাহত রাখতে ব্যর্থ হন, তবে দেশে বিদেশী বিনিয়োগ আসবে না, পর্যটক আসবেনা। রপ্তানী কমে যাবে, শিল্প উৎপাদন ব্যাহত হবে, ব্যবসা তথা উৎপন্ন দ্রব্যের সরবরাহ ও প্রবাহ ব্যাহত হবে, দেশের সুনাম নষ্ট হবে, সবশেষে দেখা যাবে দেশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বিফল হচ্ছে।
বিশ্বের জাতিগুলো এগিয়ে যাচ্ছে। আমাদেরও এগিয়ে যেতে হবেএজন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক নেতৃত্বের সদিচ্ছা ও সুস্পষ্ট অঙ্গীকার। একই সাথে সব ভেদাভেদ ভুলে চাই সম্মিলিত প্রয়াস। কারণ দেশের রাজনৈতিক ক্ষমতায় কেউ চিরদিন থাকবেনা। আজকের সরকারী দল-কালকে বিরোধী দল পরিণত হবে। আর বিরোধী দল পরিণত হবে সরকারী দলে। ক্ষমতার রদবদল হবে। অথচ দেশ থাকবে ও জনগণ থাকবে। কাজেই ক্ষমতা কিংবা ক্ষমতার বাইরে যেখানেই রাজনৈতিক দল গুলো অবস্থান করুক না কেন সবার উদ্ধে জাতি ও দেশের স্বার্থকে স্থান দিতে হবে। বর্তমান সরকারের ২৩ জুন ’৯৬ থেকে প্রায় ২৮ মাস পার হয়ে গেছে। আর ২৯ মাস পর নতুন নির্বাচনের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। কাজেই সরকার ও বিরোধী রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের উচিত এখন থেকে জনগণের কাছে চলে যাওয়া ও নিজের ভুল ত্র“টি আত্মদর্শন।
অবাধ ভোটে সরকার প্রতিষ্ঠা বা হটানোর যুগে বর্তমানে প্রবেশ করেছে বাংলাদেশ। কাজেই গণতন্ত্র, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন, দারিদ্র-বিমোচন তথা দেশ ও জনগণের সার্বিক উন্নয়ন ও যুগের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সরকার ও বিরোধী রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ দূরদর্শী ও বৈজ্ঞানিক পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
[প্রকাশ কাল: দৈনিক সিলেটের ডাক, ২৬ নভেম্বর, ১৯৯৮ইং]
 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন