Pages

প্রকাশিত গ্রন্থ-সমূহ

বৃহস্পতিবার, ১৭ মার্চ, ২০১৬

বাংলার রাজনীতিতে দূর্যোগের ঘনঘটা

বাংলার রাজনীতিতে দূর্যোগের ঘনঘটা
চৌধুরী ইসফাকুর রহমান কুরেশী

রাজনীতি ছাড়া রাষ্ট্র চলে না, কাজেই বিশ্বের প্রতিটি স্বাধীন রাষ্ট্রেই রাজনীতি থাকবে- এটাই স্বাভাবিক। রাজনৈতিক নেতৃত্বই হচ্ছে একটি দেশের সার্বিক উন্নয়নের উপরি কাঠামো। এই উপরি কাঠামোর অধীন নিম্ন কাঠামো হচ্ছে আমলতন্ত্র। রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রধান কাজ হচ্ছে দেশ ও জনগণের সার্বিক আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে পরিকল্পনা প্রণয়ন ও আমলাতন্ত্রের মাধ্যমে তা বাস্তবায়ন করে রাষ্ট্রের সর্বাঙ্গীন উন্নতি সাধন করা। আর এই রাজনৈতিক নেতৃত্বের আগমন ঘটবে জনগণের সম্মতি নিয়ে, জনগণের উন্নয়নের জন্য জনগণেরই দ্বারা। এই দর্শন থেকে গণতন্ত্রের ধারণা দেশে দেশে জন্ম নেয়। রাষ্ট্রের জনগণই হচ্ছেন রাষ্ট্রের প্রকৃত মালিক। কাজেই দেশ ও জনগণের উন্নতি সাধন ও সেবা প্রদানই রাজনীতিবিদদের একমাত্র লক্ষ্য হওয়া উচিত। কিন্তু আমাদের দেশের বর্তমান রাজনীতিতে আমরা কি দেখতে পাচ্ছি? আমাদের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলো যারা এদেশের রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা করেন। তাদের কাছে দেশ ও জনগণের উন্নয়ন কতটুকু গুরুত্বপূর্ণ তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ রয়েছে। কারণ তাদের কার্যকলাপ থেকে মনে হয় না তাদের মধ্যে একটুও দেশ প্রেম রয়েছে। তাদের মধ্যে ক্ষমতা লাভ কিংবা ক্ষমতা ধরে রাখার উগ্র বাসনা এতই প্রবল যে, প্রয়োজনে দেশটাকে অগ্নিকুন্ডে নিক্ষেপ করেও ক্ষমতায় যাওয়া চাই। রাজনীতিবিদদের এই মনোভাবের কারনেই ৯০ এর অভ্যুত্থানের পর তত্ত্ববধায়ক সরকার পদ্ধতির মাধ্যমে মোটামুটি নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তনের সাংবিধানিক বিধান সৃষ্টির পরও দেশটিতে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আসছে না।

রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ছাড়া এই অনগ্রসর দরিদ্র দেশটির মানুষের উন্নয়ন সম্ভব নয়- তা জানা সত্ত্বে বিভিন্ন দলের রাজনৈতিক নেতৃত্ব এদেশের একটি স্থায়ী স্থিতিশীল সুন্দর রাজনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে আন্তরিক নন। গণতন্ত্রের জন্য সবচেয়ে বেশী প্রয়োজন রাজনৈতিক সহিঞ্চুতা, সমঝোতা ও জাতীয় সংসদে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে সবকিছুর সুষ্ঠু সমাধান। উন্নত বিশ্বের রাষ্ট্রগুলোও গণতন্ত্রের মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে। বৃটেন, জার্মানী, জাপান, ফ্রান্স ইত্যাদি রাষ্ট্রগুলোও গণতন্ত্র চর্চার মাধ্যমে দিনের পর দিন সামনের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। তাদের দেশের মানুষের জীবন যাত্রার মান ধাপে ধাপে উচ্চ শিখিরে উঠে যাচ্ছে। তাদের দৃষ্টিতে আমরা তাদের চেয়ে কয়েক যুগ পেছনে পড়ে আছি। অর্থাৎ আমাদের জাতির কর্ণধার রাজনৈতিক নেতৃত্ব দেশের উন্নয়নের চেয়ে পরস্পরের প্রতি কাঁদা ছুড়াছুড়ি, বাকবিতন্ডা ও সহিংসতা নিয়ে ব্যস্ত। কোন রাজনৈতিক দল, কতজন সমাজ বিরোধী সন্ত্রাসীকে হাত করবেন, তার প্রতিয়োগিতায় লিপ্ত। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ছাতার নিচে বসে অনেক চোর, ডাকাত, খুনী সন্ত্রাসী তাদের অপরাধ কাজ নির্দ্ধিধায় চালিয়ে যাচ্ছে। এই হচ্ছে বর্তমানের বাংলাদেশ। এখানে দেশের জনগণের জীবন সম্পদ ও সম্ভ্রমের নিরাপত্তা দিতে পারছেনা রাজনৈতিক নেতৃত্ব। বরং তাদের পালিত সন্ত্রাসীগন কতৃক চাঁদাবাজী, জমি দখল, বোমাবাজি, খুন খরাপীর শিকার হচ্ছে নিরিহ মানুষ। রাজনৈতিক দলগুলোর এ হিংসাত্মক মনোভাবের মধ্যে এই দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আসবে কিভাবে? লোকে বলে- নিরক্ষর ও অভুক্ত মানুষকে নিয়ে গণতন্ত্র হয়না। ঠিক একইভাবে সহিষ্ণুতা ও সমঝোতা ছাড়াও গণতন্ত্র হয়না। দেশে গণতন্ত্র ও স্থিতিশীল রাজনৈতিক ব্যবস্থা কার্যকর করার জন্য প্রয়োজন ১০০ ভাগ শিক্ষিত ও দারিদ্রমুক্ত জনগণ। রাজনৈতিক দলগুলো যদি সত্যিই এই দেশে গণতন্ত্র চান তাহলে এ দেশের ১০০ ভাগ মানুষকে শিক্ষিত করতে হবে ও বেকারত্বের হার শূন্যে নিয়ে আসতে হবে। শুধু ক্ষমতার চেয়ারে বসে যাবার নামই গণতন্ত্র নয়। সরকার ও বিরোধী নেত্রীর মাত্র ১৭ দিনের ক্ষমতা হস্তান্তরের মতবিভেদকে কেন্দ্র করে দিনের পর দিন হরতাল ডেকে দেশের তেরটা বাজিয়ে গণতন্ত্র হয়না। দেশপ্রেমের পরীক্ষা হয়না। ক্ষমতা কারও বংশগত সম্পত্তি নয়। ক্ষমতাকে দেশের নেত্রীগণ যদি তাদের বাপ-দাদা, কিংবা স্বামীর সম্পদ মনে করেন তাহলে এদেশে স্থায়ী গণতন্ত্র ও সাংবিধানিক স্থিতিশীল রাজনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব হবে না। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে এমন ব্যবস্থা গ্রহণ প্রয়োজন যাত কেহ দুই মেয়েদের (৫+৫ বৎসর) বেশী প্রধানমন্ত্রী কিংবা পার্টিপ্রধান পদে  থাকতে না পারেন। যাতে বংশগত কিংবা উত্তরাধিকার সূত্রে নয় বরং দলের সবচেয়ে যোগ্য ব্যক্তি প্রধান চেয়ারের দায়িত্ব নিতে পারেন। তাহলে বংশগত রাজনীতির কোন্দলে সমগ্র জাতির উপর হরতাল-নৈরাজ্যের যে অপছায়া নেমে আসে তা হতে জাতি মুক্ত হতে পারবে।
হরতাল-নৈরাজ্য, আইন শৃংখলার অবনতি আমাদের রাজনীতিবিদদের জন্য উদ্বেগের কিছু নয়। কারণ তাতে তাদের কিছুই যায় আসে না। তাদের ধন সম্পদ, মর্যাদা অত্যন্ত সুরক্ষিত। রাজ প্রসাদে তাদের বাস। রাষ্ট্রীয় সুযোগ সুবিধা সবচেয়ে বেশী ভোগ করছেন তারাই। আর আমরা জনগণ, যাদের ভাগ্যে সুযোগ সুবিধা নেই, পেটে অন্ন নেই, গায়ে বস্ত্র নেই, রোগে চিকিৎসা নেই- এই আমাদেরকে জিম্মি করেই সব রাজনীতি। পেটের ধান্ধায় বের হবার অপরাধে বোমা মেরে কিংবা পেট্টোল ঢেলে পোষ্য সন্ত্রাসীরা খেটে খাওয়া জনতাকে হত্যা করে অবলিলায়। যে জনগণের জন্য রাজনীতি, সে রাজনীতিই যদি খুন করে রাজনীতি নিরপেক্ষ খেটে খাওয়া মানুষকে, তাহলে এই রাজনীতির কি বা প্রয়োজন। একজন নেত্রী বলেছিলেন, ঝড়ের পর শান্তি আসবে। কিন্তু এই যে ঝড়ে খুন হয়ে যাওয়া এতগুলো মানুষের পরিবারে কিভাবে শান্তি আসবে- তার সঠিক জবাব কি দিতে পারবেন ঐ নেত্রী।
দেশের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের প্রতি আমরা, অসহায় জনগণের উদাত্ত আহবান, সামনে নির্বাচন, দয়া করে আর মারামারি না করে নির্বাচন মুখী হন। জনগণের রায় নিতে মাঠে নেমে পড়–ন। জনগণ শান্তি ও স্বস্তি চায়। কিভাবে সুষ্ঠু ও সম্পূর্ণ নিরপেক্ষভাবে জনগণ তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারে তার ব্যবস্থা করুন। সত্যিই যদি আপনারা দেশের উন্নতি ও গণতন্ত্র চান, তাহলে সহিংষতার পথ পরিহার করে সহিষ্ণুতা ও সমঝোতার পথে আসুন। তাহলে জনগণের কাছে আপনাদের মর্যাদা ও গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি পাবে। গণতন্ত্র মানুষের কাছে অর্থবহ হয়ে উঠবে।
[প্রকাশ কাল: দৈনিক সিলেটের ডাক, ১৮ এপ্রিল, ২০০১ইং]


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন