Pages

প্রকাশিত গ্রন্থ-সমূহ

বৃহস্পতিবার, ১৭ মার্চ, ২০১৬

স্মৃতিচারণ ঐতিহ্যবাহী রেবতী রমন উচ্চ বিদ্যালয়ের শতবর্ষে পদার্পন

স্মৃতিচারণ
ঐতিহ্যবাহী রেবতী রমন উচ্চ বিদ্যালয়ের শতবর্ষে পদার্পন
চৌধুরী ইসফাকুর রহমান কুরেশী

সে অনেক দিন আগে ১৯৮১ সালে এসএসসি পাস করার পর একদিন কৈশোরের অজস্র মধুর স্মৃতি বিজড়িত প্রাণপ্রিয় স্কুল এবং স্কুলের স্যার ও জুনিয়র সাথীদের ফেলে অশ্র“ভেজা নয়নে আমরা বেরিয়ে পড়ি জীবনের ডাকে। তারপর কোথায় যেন হারিয়ে গেল জীবনের সোনালী সাতাশটি বছর- কাজ আর ব্যস্ততার এক স্বপ্নময় দয়ামায়াহীন যান্ত্রিকতার নেশার জগতে। ১৯৭৬ সালে পাঠশালার পাঠ শেষ করে ভর্তি হই ক্লাশ সিক্সে, রেঙ্গা পরগনার পাঁচ-ছয়টি পাঠশালার ছাত্ররা এসে জড় হই মোগলাবাজার রেবতী রমন উচ্চ বিদ্যালয়ে। প্রথম দিকে প্রতিটি পাঠশালা ও এলাকার ছাত্ররা আলাদা আলাদাভাবে জোটবদ্ধ হয়ে থাকলেও পরবর্তীতে আমরা পরস্পরের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে যাই। দাউদপুরের চেরাগ, ছয়ফুল, ফয়জুল, নেগালের আজিজ, বিলাল, পুলক, মইজউদ্দিন, তুরুকখলার টিপু, মুক্তার, কামাল, সেলিম, মইন, দুলু, দিপা ও শাহানা, কোনাচরের মদন, দেলওয়ার (বর্তমানে জেলা পরিষদে কর্মরত) তিরাশীগাঁওয়ের সুব্রত, ছত্তিঘরের মখলিছ, সালেহ ও ওদুদ (অল্প বয়সে মারা যান আল্লাহ তাকে জান্নাতবাসী করুন), খালেরমুখের মকবুল, ছোট ওদুদ ও ফারুক। পরবর্তীকালে বিভিন্ন ক্লাসে যারা সহপাঠিতে পরিণত হন আমার স্মৃতিতে যারা উজ্জ্বল হয়ে আছেন তমাল ভট্টাচার্য্য, মিনার, উলালমহলের আহাদ স্কুল মাঠের পাশের বাড়ির খলিল ভাই, মোগলাবাজার রেলষ্টেশনের পশ্চিমের বাড়ির মামুনুর, বিশ্ব পাল, সালাহ উদ্দিন, বোন মান্না, ইসমতারা ও সুপ্রা।

১৯৭৬ সালের প্রথম দিকে এক শীতকালে আমাদের দাউদপুরের গ্রামের বাড়ি থেকে প্রায় ৩ কিলোমিটার দূরবর্তী রেবতী রমন উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হই। আমার পিতা জনাব সফিকুর রহমান চৌধুরী (দলু মিয়া) ছিলেন উক্ত স্কুলের শিক্ষক। খালাতো ভাই তারেক, বোন মান্না ও আমি পিতার সাথে বাড়ি থেকে বের হয়ে প্রথমে বল্ডার বিছানো রাস্তা দিয়ে হেঁটে মাইল খানেক পার হয়ে নেগালের গহীন অরণ্যময় ছায়াঘেরা সুদীর্ঘ রাস্তা পার হয়ে তারপরই স্কুলে উপণীত হই। তখনকার দিনে রিকশা ছিল না, পায়ে হেঁটে এই রাস্তা প্রতিদিন অতিক্রম করতে হত। দুই একটা বরই গাছ ছাড়া রাস্তার পাশে তেমন কোন ছায়াবৃক্ষও ছিল না। প্রচন্ড গরমের দিনে বরই গাছগুলোর নিচে থেমে থেমে ক্লান্তি দূর করে অগ্রসর হতে হতো। মাঝে মধ্যে মোগলাবাজার তিমুখা হতে আমরা দলবেঁধে পাহাড় লাইনের বাসে চড়ে চৌধুরী বাজার আসতাম, ভাড়া ছিল ফ্রি। হেলপার হেনড্রিল ঘুরায়ে মুরিরটিন মার্কা বাসগুলো স্টার্ট করতো, কখনও কখনও পেসেনজারগণ নেমে ধাক্কা দিয়ে বাস চালু করতেন। গাড়িতে বালতি ভরা পানি রাখা হত, হেলপার কিছু দূর পরপর ইঞ্জিনে পানি ঢালতো, পিছনে ধুলা উড়িয়ে বাস অগ্রসর হত। তখনকার দিনে সামনের ড্রাইভিং সিট ও আপার সিটের ভাড়া ছিলো বেশী। গাড়ির ভিতর জাম হয়ে যেত। অনেক লোক ও বেশীরভাগ ছেলেরা বাসের ছাদে উঠে পড়তো। আমাদের সময় প্রধান শিক্ষক ছিলেন শ্রী রাম চন্দ্র ভট্টাচার্য্য, বয়সের ভারে জর্জরিত সাদা ধুতি ও পায়জামা পরতেন। তার মেয়ে কৃষ্ণা ছিলো আমাদের সহপাঠিনি। তপন স্যার বাংলা, নিতু স্যার সমাজ বিজ্ঞান, আব্বা ইংরেজী, দেবু স্যার কৃষিকথা ও মৌলভী (বজলুর রহমান) স্যার ধর্মশিক্ষা পড়াতেন। তখনকার দিনে ছাত্ররা অনেকে লুঙ্গি পরে এমনকি খালি পায়েও স্কুলে আসতেন- এতে দোষের কিছু ছিলো না। অমেলেন্দু স্যার ছিলেন অত্যন্ত সুদর্শন, তিনি এবং হারান স্যার বিজ্ঞান ও গণিত পড়াতেন। আমি সপ্তম শ্রেণীতে থাকাবস্থায় হারান স্যার সোনালী ব্যাংকে ও অষ্টম শ্রেণীতে উঠে আমার প্রিয় শিক্ষক অমেলেন্দু স্যার ফেঞ্চুগঞ্জ সারকারখানা স্কুলে চলে যান। বিদায় সম্বর্ধনায় স্যারসহ আমরা সবাই অশ্র“সিক্ত হই। আমি আমার জীবনের বর্তমান অবস্থানে ওঠে আসার জন্য একজন মহান মানুষের কাছে সীমাহীনভাবে ঋণী, যার সাধনা ও পরিশ্রম আমার পরবর্তী জীবনের ভিত মজবুতভাবে তৈরী করে দিয়েছিলো, যিনি অষ্টম শ্রেণী থেকে ১৯৮১ সালে এস.এস.সি পরীক্ষা দেবার পূর্ব পর্যন্ত গণিত, বিজ্ঞান ও অন্যান্য জটিল বিষয় প্রাইভেটভাবে শিক্ষা দেন অথচ আমার পিতার কাছ থেকে একটি টাকাও টিউশন ফি নেননি। তিনি হচ্ছেন আমার প্রাণপ্রিয় শিক্ষক শ্রী গুনেন্দ্র চক্রবর্তী। তখন আমাদের আর্থিক অবস্থা তেমন ভাল ছিলোনা, তাঁর এই মহানুভবতা আমার শিক্ষাজীবনকে এগিয়ে নিতে যারপরনাই সহায়তা করেছে।
আমরা নবম শ্রেণীতে অধ্যয়নকালে তিনি প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব লাভ করেন এবং আজও এই সুযোগ্য স্যার উক্ত বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব অত্যন্ত দক্ষতার সাথে পালন করে যাচ্ছেন। সেকালে ধর্মশিক্ষার ক্লাসে মাথায় টুপি পরতে হত। মৌলভী স্যার (বজলুর রহমান) আমরা সবাই জোহরের নামাজ পড়ছি কিনা তদারকি করতেন। ধরবাবু স্যারকে আমরা ভয় পেতাম ও সমীহ করতাম। আমি ও টিপু পর্যায়ক্রমে প্রতি বৎসর প্রথম দ্বিতীয় হতাম। টঙ্গাইলের কাজি স্যার বেঁচে নেই কিন্তু তিনি আমাদেরকে এমনভাবে টেনস শিক্ষা দেন যা আজও মগজে গেঁথে আছে। কটনদা পুকুরপারে খুব সুন্দর গাঁদাফুল চাষ করতেন, যার হলুদ রঙ্গ এখনও চোখে ভাসে। তার নির্মিত ব্যাঘ্র ভাস্কর্য কিংবা সালাম প্রদানকারী কাঠের বানর তার প্রতিভার স্বাক্ষর বহন করতো।
আমার পিতা শফিকুর রহমান চৌধুরী (দলু মিয়া স্যার) ভূগোল ও ইংরেজীতে দক্ষতা ছিলো অসাধারণ। যে কোন ইংলিশ শব্দের অর্থ তিনি ডিকসোনারী ছাড়াই বলে দিতে পারতেন। স্কুলের বিশেষ বিশেষ অনুষ্ঠানে প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি সর্বজন শ্রদ্ধেয় শ্রী কৃপেশ চন্দ্র ভট্টাচার্য্য মহাশয় অত্যন্ত তেজষ্যি ভাষায় জ্ঞানগর্ভ বক্তব্য রাখতেন। পাশ দিয়ে বহমান কেশরখালী নদীর বুক চিরে পাল তুলে ডিঙ্গি নৌকা, বালু ও পাথরবাহী খোলা নৌকা, জালসহ জেলে নৌকা, সেতু হতে দুষ্ট ছেলেদের নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ার দৃশ্য যেন আজও চোখে উঁকি দিচ্ছে। রেবতী রমন উচ্চ বিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে দুইবার দুর্ঘটনার শিকার হই। প্রথম বার ১৯৭৬ সালে স্কুল থেবে বাড়ি ফেরার পথে সিরাজপুরে বাস উল্টে পাশের খাদে পড়ে যায়। আহত হই, রক্তে ভিজে বাড়ি ফিরি। ডান ব্র“য়ের শেষ প্রান্তে এখনও সেই দাগ রয়ে গেছে। দ্বিতীয়বার ১৯৮০ সালে বিজ্ঞানাগারে কাজ করার সময় এসিডের বোতল উল্টে গায়ে এসে পড়ে, যার চিহ্ন ডান হাতে এখনও রয়ে গেছে। আনন্দ ফুর্তি, খেলাধুলা, হৈ-হুল্লোরের মধ্যে এভাবে কৈশোরের পাঁচ ছয়টি সোনালী বৎসর হঠাৎ হারিয়ে যায়। আমাদের সময় স্কুলের মাঠ আমরা মুলাক্ষেত উপড়ে স্কুলের দখলে নিয়ে আসি। কিছু দুঃখজনক ঘটনাও ঘটে, আমাদের সহপাঠি শশাঙ্কের দাদা সদাহাস্য তরুণ স্কুল ছাত্র হাবিলদা একদিন আত্মহনন করেন। সহপাঠি ছাড়াও যাদের কথা মনে পড়ে তারা হচ্ছেন মোগলা বাজারের তাপসদা (এডভোকেট) ও কল্যানদা, দিপক, বিজিত পাল ও বিশ্ব পাল, বিশারদবাবু, সায়েকুল ভাই ও জাহাঙ্গীর আলম মুসিক সাহেব খালেমুখের হান্নান ভাই (ফেমিলি প্লেনিং এ কর্মরত)। আরও অনেকের নাম ভুলে গিয়েছি কিন্তু মুখচ্ছবি এখনও নয়নে ভাসছে। ১৯০৮ সালে প্রতিষ্ঠিত আমাদের প্রিয় স্কুলটি এই বৎসর তার শতবর্ষ পূর্তি পালন করতে যাচ্ছে। অথচ আমার পিতা এই স্কুলের শিক্ষক সফিকুর রহমান চৌধুরী, যিনি তার জীবনের বেশিরভাগ সময় এই স্কুলে অতিবাহিত করেছেন তিনি মাত্র কিছুদিনের জন্য শতবর্ষ পূর্তি অনুষ্ঠানটি দেখে যেতে পারেননি। গত ২৪শে নভেম্বর ২০০৭ সালে ৯২ বৎসর বয়সে পরলোক গমনকারী এই মহান শিক্ষকের স্মৃতির প্রতি এই শতবর্ষ পূর্তি উপলক্ষে গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করছি। আজ হতে শতবর্ষ আগে ১৯০৮ সালে নেগালের প্রখ্যাত জমিদার রায়বাহাদুর রমেশ চন্দ্র ভট্টাচার্য্য তার পিতা রেবতী রমন ভট্টাচার্য্যরে নামে স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করেন। তারপ্রতিও শ্রদ্ধা নিবেদন করছি।
শহুরে ব্যস্ত জীবনে অতীতের সোনালী দিন ও সোনার মানুষগুলোর স্মৃতি মনে হলে নষ্টালজিয়ায় ভোগী, কিছুক্ষণের জন্য হিপনোটাইজড হয়ে পড়ি-নিজের অজান্তে গুণগুণ করে গেয়ে উঠি “কোথায় হারিয়ে গেল সোনালী সে দিনগুলো, আজ আর নেই, আজ আর নেই।”

[প্রকাশ কাল: দৈনিক সিলেটের ডাক, ৩১ জানুয়ারী, ২০০৯ইং, স্কুলের শতবর্ষ ফুর্তি ম্যাগাজিন ২০০৮ইং]

 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন