Pages

প্রকাশিত গ্রন্থ-সমূহ

বৃহস্পতিবার, ১৭ মার্চ, ২০১৬

রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা

রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা
চৌধুরী ইসফাকুর রহমান কুরেশী

তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাংলাদেশে এমনিতে আসে নাই। আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলোইতো এই ব্যবস্থার জন্মদাতা। বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতাগণের মধ্যে পারস্পরিক অনাস্থা ও অবিশ্বাসই কেবলমাত্র নির্বাচন পরিচালনা করার জন্য একটি অনির্বাচিত ও অগণতান্ত্রিক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে কিছু নির্দিষ্ট দিনের জন্য রাষ্ট্রের ক্ষমতা ভার অর্পনে বাধ্য করে।
১৯৯০ সালে সামরিক স্বৈরশাসক এরশাদের পতনের পর সবগুলো রাজনৈতিক দলের ঐক্যমতের ভিত্তিতে ১৯৯১ সালে বিচারপতি সাহাব উদ্দীনের নেতৃত্বে গঠিত প্রথম তত্ত্বাবধায়ক সরকার মাত্র তিন মাস সময়ের মধ্যে জাতিকে একটি অবাধ, সুষ্টু ও সুন্দর সংসদ নির্বাচন উপহার দিতে পেরেছিল, যা ইতিপূর্বে সংঘটিত সবগুলো নির্বাচনের চেয়ে গ্রহণযোগ্য বলে সর্বত্র প্রতীয়মান হয়েছিল। বাংলাদেশের বয়স বর্তমানে চল্লিশ বৎসর। এই চল্লিশ বৎসরের মধ্যে ৯০ পূর্ববর্তী বছরগুলো অতিবাহিত হয়েছে সামরিক ও আমলা শাসনে। স্বাধীনতার পরবর্তী চার বৎসর অন্যান্য সদ্য স্বাধীন দেশের মত প্রচন্ড রাজনৈতিক ঝড়ঞ্জায়। কাজেই স্বাধীনতা পরবর্তী ৪০ বৎসরে আমাদের যে রাজনৈতিক উন্নয়ন বা গণতান্ত্রিক উন্নয়ন হয়েছে-তা ঐ তত্ত্বাবধায়ক সরকারগুলোর মাধ্যমে নিরপেক্ষ ও সর্বজনগ্রাহ্য নির্বাচনগুলোর মাধ্যমেই হয়েছে। ঐ নির্বাচনগুলোর সঠিকভাবে না হলে আমাদের বুকের উপর কোন যে সামরিক কিংবা বেসামরিক স্বৈরাচার চেপে বসত তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ১৯৯৬ সালে বিচারপতি হবিবুর রহমানের নেতৃত্বেও আমরা একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে রাজনৈতিক অচলাবস্থা হতে পরিত্রাণ পেয়েছিলাম।

ক্ষমতা মানুষকে কলুষিত করে, আর নিরঙ্কুশ ক্ষমতা মানুষকে নিরঙ্কুশ কলুষিত করে। ভোটের মধ্যে সন্দেহ ও গলদ রয়ে গেলে, কিংবা যেনতেনভাবে ভোটে জিতে ক্ষমতা দখলে রাখার সুযোগ তৈরি হলে দেশে এমন এক স্বৈরশাসন ও রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরী হবে-যা দেশের শান্তি সমৃদ্ধি ও অগ্রগতিকে রুখে দাঁড়াবে। দেশের ক্রম উন্নয়নের ধারা স্তব্ধ করে দেবে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার মাধ্যমে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে পরাজিত দলগুলো সুক্ষ্ম কারচুপির অভিযোগ উত্থাপন করলেও তা জালে পানি পায়নি। নির্বাচনে হারজিত হবেইকাজেই দলগুলোকে শেষ পর্যন্ত রায় মেনে নিয়ে সংসদে বসতে বাধ্য হয়েছে। এভাবে আমরা ১৯৯১ সাল হতে মোটামুটি জননির্বাচিত সরকার ব্যবস্থার মধ্যে পরিচালিত হয়ে আসছি-যা আমাদের গণতন্ত্র চর্চায় সুদূরপ্রসারী ভূমিকা রাখবে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাংলাদেশে এমনিতে আসে নাই। আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলোইতো এই ব্যবস্থার জন্মদাতা। বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতাগণের মধ্যে পারস্পরিক অনাস্থা ও অবিশ্বাসই কেবলমাত্র নির্বাচন পরিচালনা করার জন্য একটি অনির্বাচন ও অগণতান্ত্রিক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে কিছু নির্দিষ্ট দিনের জন্য রাষ্ট্রের ক্ষমতা ভার অর্পণে বাধ্য করে। একথা সত্য যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার কোন গণতান্ত্রিক কিংবা সাংবিধানিক সরকার নহে। এই সরকার নির্বাচন পরিচালনা করার জন্য একটি আপদকালীন জরুরী সরকার। উন্নত ও গণতান্ত্রিক বিশ্বের কোথায়ও কেবলমাত্র নির্বাচন পরিচালনার জন্য এ ধরনের কোন সরকার ব্যবস্থা নেই। এমনকি আমাদের পার্শ্ববর্তী বহৎ গণতন্ত্রের দেশ ভারতেও এ ধরনের কোন সরকার ব্যবস্থার প্রয়োজন কখনও অনুভূত হয়নি। এইসব দেশের নির্বাচন কমিশন এতই স্বাধীন, স্বচ্ছ ও শক্তিশালী যে, তারা দলীয় নির্বাচিত সরকার থাকা অবস্থায়ও অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন করতে পুরোপুরি সক্ষম যা ঐসব দেশের জয়ী ও পরাজিত সব দল মেনে নেয় বা মেনে নিতে বাধ্য হয়।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে আমরা যতই অগণতান্ত্রিক কি অসাংবিধানিক বলি না কেন, এ ব্যবস্থার মাধ্যমেই ৯০ পরবর্তী সবগুলো রাজনৈতিক অচলাবস্থা থেকে আমরা বেরিয়ে আসতে পেরেছি। বাংলাদেশের রাজনীতি পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায় এ দেশের প্রায় ৭০ ভাগ মানুষ মাত্র দুইটি দলকে অর্থাৎ আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকে ভোট প্রধান করে থাকেন। বাকী ৩০ ভাগ ভোট  জাতীয় পাটি, জামাতে ইসলামী, ইসলামী ঐক্যজোট, জাসদ, বাসদ, কমিউনিস্ট পার্টি সবাই মিলে ভাগ করে নেন। পার্লামেন্টে কোন দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেও বিরোধীদলের ভোট প্রাপ্তি প্রায় কাছাকাছি থেকে যায়। অর্থাৎ বিশ্বের অধিকাংশ গণতান্ত্রিক দেশের মত আমাদের দেশেও রাজনৈতিক ব্যবস্থা ধীরে ধীরে দ্বিদলীয় ব্যবস্থার দিকে ধাবিত হচ্ছে। যেহেতু আওয়ামীলীগ ও বিএনপি এই দুই দল নির্বাচনে হারজিত যাই হউক না কেন উভয়ের পিছনে দেশের গড়ে এক তৃতীয়াংশ লোক রয়েছেন। এমতাবস্থায় সংসদ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হবে; নাকি ক্ষমতাসীন সরকারের মাধ্যমে হবে-এব্যাপারে এই দুই দলকে ঐক্যমতে আসতে হবে। বৃহৎ রাজনৈতিক দলগুলোর ঐক্যমত ব্যতিরেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা হঠাৎ বাতিল করে দেওয়া সম্ভব কিংবা সমুচীন হবে না। অতীতে খালেদা জিয়া তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া নিজের সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচন করে কিছুদিনের মাধ্যমেই ঐ সংসদ ভেঙ্গে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। অতীতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন নিয়ে সরকার ও বিরোধী দলগুলোর মধ্যে তীব্র বাধানুবাদ অনুষ্ঠিত হলেও নির্বাচনের পর দেখা গেছে সরকারী দল তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান নিয়োগ করা সত্ত্বেও নির্বাচনে জয়ী হতে পারেনি। কাজেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মাধ্যমে যে সর্বোচ্চ মাপের সঠিক নির্বাচন হয়-তা অন্য কোনভাবে সম্ভব নয়।
তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা এক ধরনের অস্বাভাবিক ব্যবস্থা হলেও বাংলাদেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থার বাস্তব প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে দীর্ঘ্যকালীন ও স্থায়ী গণতন্ত্র চর্চার স্বার্থে এ ব্যবস্থা অপরিহার্য্য। যে দল ক্ষমতায় যায় তারা তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতির বিরোধীতা করে ও যারা ক্ষমতার বাহিরে অবস্থান করে তারা ঐ ব্যবস্থার মাধ্যম ছাড়া নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করতে কোন মতেই রাজী হয় না। কাজেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া এদেশে এখনও কোন সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব নয়। আমাদের দেশে আদর্শ গণতন্ত্র চর্চার জন্য যতদিন দরকার ততোদিনই অবাধ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বহাল রাখতে হবে। যেদিন বাংলাদেশের সবগুলো রাজনৈতিক দল এক টেবিলে বসে এক সুরে বলবে-ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হবে ও আমরা নির্বাচন যাবো, কেবলমাত্র তখনই এদেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার অবসান সম্ভব। নতুবা নির্বাচন কমিশনকে সরকার যতই ক্ষমতা প্রদান করুন না কেন- তা দেশের গণতন্ত্র চর্চায় কোন কল্যাণ বয়ে আনবে না।
আমাদের দেশে যেহেতু তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীন ব্যতিরেকে সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন সম্ভব নয় কাজেই এই ব্যবস্থাকে আইনের মাধ্যমে আরও সুশৃংখল ও যুগোপযুগী করা প্রয়োজন, যাতে প্রতিটি নির্বাচিত সরকারের মেয়াদকাল শেষে অত্যন্ত স্বচ্ছ ও মসৃণভাবে জনতার রায়ের মাধ্যমে ক্ষমতা হস্তান্তর সংঘটিত হয়। নতুবা অগণতান্ত্রিক ও সুবিধাবাদী চক্র রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলে নিতে পারে। কেবলমাত্র অবাধ, স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে অত্যন্ত মসৃন ও সুষ্ঠু নিয়মে ক্ষমতার হস্তান্তরই আমাদের গণতন্ত্রের ভিত্তিকে মজবুত ও দৃঢ় করতে পারে।
[প্রকাশ কাল: দৈনিক সিলেটের ডাক, ৭ জুলাই, ২০১১ইং]

 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন