Pages

প্রকাশিত গ্রন্থ-সমূহ

শুক্রবার, ১৮ মার্চ, ২০১৬

মরমীবাদ বা সুফিবাদ রহস্য

মরমিবাদ বা সুফিবাদ রহস্য
চৌধুরী ইসফাকুর রহমান কুরেশী

জীবনীসাহিত্য ও আত্মজীবনী যে কোন সাহিত্যের এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আকর্ষণীয় ধারা। আমি সাহিত্যের এই ধারার একজন মনযোগী পাঠক। শৈশবে ও কৈশোরে জীবনী সাহিত্যের একটি শাখা সুফিসাধক ও দরবেশগণের জীবনের আধ্যাত্মিক সত্ত্বা আমাকে বিমোহিত করত। একনিষ্ঠ মনে বিখ্যাত মুসলিম সুফিগণের যেমন খাজা মঈনউদ্দিন চিশতি(রঃ) বড়পীর আব্দুল কাদের জিলানি(রঃ), নিজাম উদ্দিন আউলিয়া(রাঃ), রাবেয়া বসরি(রঃ), ইবনুল আরাবি(রঃ), হাসান বসরি(রঃ), ওয়েশ করনি(রঃ) প্রমুখ বিখ্যাত সুফিগণের জীবনকাহিনী পাঠকালে সুফিবাদের প্রতি আকৃষ্ঠ হই এবং সুফিবাদ কী সেই সম্পর্কে সামান্য ধারণা লাভ করতে সচেষ্ট হই। একটি মানুষের জীবনে পাশাপাশি চারটি সত্ত্বা বিরাজমান থাকে যা মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করে। সেগুলো হচ্ছে প্রথমতঃ রাজনৈতিক সত্ত্বা, দ্বিতীয়তঃ সামাজিক সত্ত্বা, তৃতীয়তঃ অর্থনৈতিক সত্ত্বা, চতুর্থতঃ ধর্মীয় সত্ত্বা। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে দুইটি পন্থায় মানুষ পরিচালিত হয় কট্টরপন্থা ও নরম বা উদার পন্থা। কট্টরপন্থীরা বিপ্লব সংগ্রাম ও সংঘাতে বিশ্বাসী আবার উদারপন্থীরা ধীর, কোমল ও শান্তিময় পন্থায় সব পরিবর্তনের বিশ্বাস করেন।
ধর্মের ক্ষেত্রেও আমরা কট্টর ও নরম দুইটি রূপ দেখতে পাই। কট্টরপন্থীরা ধর্মের শরিয়তের কঠোর প্রবর্তনে ও ধর্মের বাহ্যিক আচার আচরণে বিশ্বাসী, আবার নরমপন্থীরা ধর্মের আভ্যন্তরীণ সৌন্দর্য্যে ও মানবপ্রেমে বিশ্বাসী। প্রভুপ্রেম ও মানবপ্রেম এদের মানসিক বৈশিষ্ট্য। মানুষের সামাজিক জীবনেও এভাবে রক্ষণশীল ও উদারপন্থী দুইটি রূপ দৃষ্টিগোচর হয়।
ধার্মিকদের মধ্যে কট্টরপন্থী ও মরমিপন্থী এই দুইটি রূপ সবধর্মে দৃষ্টিগোচর হয়ে থাকে। হিন্দুধর্মে সাধু, খ্রিষ্টান ধর্মে সেইন্ট ও ইসলাম ধর্মে সুফি বা দরবেশ নামে মরমিবাদী সাধকদের অভিহিত করা হয়। কট্টরপন্থীরা ধর্মের বাহ্যিক রূপকে প্রাধান্য দেন কিন্তু মরমিবাদীরা ধর্মের অভ্যন্তরিণ ও অন্তর্নিহিত সৌন্দর্য্যকে অনুসন্ধান করেন। কট্টরপন্থীরা চর্মচক্ষু বা বহিঃচক্ষু দিয়ে সত্যকে অবলোকন করেন মরমিবাদী তা অবলোকন করেন অন্তচক্ষু বা মনোচক্ষুর মাধ্যমে। আমাদের সিলেটের মরমি কবি হাসন রাজার গানে বিষয়টি এসেছে এভাবে নয়ন মুদিয়া দেখ রূপরে, নয়ন মুদিয়া দেখ রূপ।’ কট্টরপন্থীরা শরিয়তের চুলচেরা বিশ্লেষণ ও প্রয়োগে ব্যস্ত। অন্যদিকে মরমিবাদীরা স্রষ্টার দয়ামায়া স্নেহশীলতা ও ক্ষমাশীলতায় আস্থাশীল।
কট্টরপন্থীরা যেখানে স্রষ্টাকে এক কঠোর ও কঠিন বিচারকের আসনে অধিষ্ঠিত করেনমরমিবাদীরা সেখানে তাকে এক প্রেমময়ের রাজ সিংহাসনে বসান।
হযরত মোহাম্মদ(সঃ) পাশে একদল সাহাবি সব সময় অবস্থান করতেন যাদের বলা হত আসহাবে সুফফা। এরা সব ধরনের চাওয়া পাওয়া ফেলে রেখে রসুলের পাশে অবস্থান করতেন ও স্রষ্টার আরাধনায় নিমগ্ন থাকতেন। হজরত আবুজর গিফ্ফারি(রাঃ) ছিলেন তাদের একজন। তাঁর চিন্তাধারা অনেকটা মরমি ধারণার ধারে কাছে রয়েছে। পবিত্র গ্রন্থ ক্বোরআনে বর্ণিত হয়েছে আল্লাহ মানুষের শাহরগেরও কাছে অবস্থান করেন। অন্যস্থানে বর্ণিত হয়েছে মানুষ পূর্ব পশ্চিম উত্তর দক্ষিণ যে দিকে তাকায়না কেন সবদিকে আল্লাহ বিদ্যমান। পবিত্র ক্বোরআনে একক ও সর্বশক্তিমান আল্লাহ্র অসংখ্য গুণবাচক নাম রয়েছে, আল্লাহকে যে নামে ডাকা হয় তিনি সেইভাবে সাড়া দেনযা মানুষকে আল্লাহর মাঝে নিজেকে বিলিয়ে দিতে অনুপ্রাণিত করে। প্রকৃতপক্ষে ক্বোরআনের শিক্ষা হতেই ইসলামে সুফিবাদের উদ্ভব হয়েছে। হজরত মোহাম্মদ(স:) বলেছেন “আল্লাহর রহমত ছাড়া কেউই বেহেশতে প্রবেশ করতে পারবে না।”
সাহাবিগণ প্রশ্ন করলেন “আপনিও কি?তিনি বললেন “হ্যাঁ আমিও”। অন্যদিকে মহানবিকে(সঃ)  জিজ্ঞেস করা হল, আল্লাহ তো আপনাকে নবি হিসেবে মাহফুজ রেখেছেন। আপনার এবাদতের প্রয়োজন কি? 
তিনি জবাবে বললেন, স্রষ্টা আমার প্রতি যে করুণা প্রদর্শন করেছেন, আমি কি তাঁর জন্য কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করিব না? 
কট্টরপন্থী, এমন কি মধ্যপন্থী ধার্মিকেরা প্রার্থনা করেন “হে প্রভু আমাকে বেহেশত প্রদান করো ও দোযখ থেকে রক্ষা কর।” কিন্তু মরমিবাদী রাবেয়া বশরি(রঃ) দোয়া করতেন হে প্রভু, আমাকে এমনভাবে দোযখে প্রবেশ করাও যেন আমি একাই দোযখকে পূর্ণ করে ফেলি এবং অন্য কোন মানুষের জন্য দোযখে কোন শূন্যস্থান না থাকে।” 
কট্টরপন্থীরা বলেন ‘নেকির পাল্লা ভারী হলে মানুষ বেহেশতে যাবে, আর বদীর পাল্লা ভারী হলে সে দোযখে যাবে।” কিন্তু মরমিবাদীরা একটি হাদিস সর্বদা বিশ্বাস করেন মানুষ পাপ করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়ে, কিন্তু আল্লাহ মাফ করতে করতে কখনও ক্লান্ত শ্রান্ত হন না।” 
কট্টরপন্থীর দৃষ্টি সংকীর্ণ, মরমিবাদীর দৃষ্টি প্রসারিত। স্রষ্টার প্রতি উভয়ের ধারণার মধ্যে বিস্তর তফাত। যদিও মহান স্রষ্টা সকল ধারণার উর্ধ্বে অসীম তাঁর অস্তিত্ব। কট্টরপন্থী ও মরমিবাদী প্রত্যেকে নিজ নিজ ধারণা অনুযায়ী স্রষ্টাকে ধারণ করেন যদিও উভয়ে একই ধর্মীয় গ্রন্থ থেকে জ্ঞান আহরণ করে থাকেন। সুফিরা বেহেশত লাভের আশায় কিংবা দোযখের ভয়ে আল্লাহকে স্মরণ করেন না। তাঁরা আল্লাহকে স্মরণ করেন কেবল মাত্র আল্লাহকে পাবার ও তাঁর অসীম সত্ত্বায় নিজেকে বিলীন করে দেয়ার জন্য। 
পবিত্র কোরআন শরীফে তিন ধরণের আয়াত রয়েছে। প্রথমতঃ আদেশ নিষেধ বিষয়ক- যা আদেশ করা হয়েছে তা পালনীয় ও যা নিষেধ করা হয়েছে তা বর্জনীয়। দ্বিতীয়তঃ অতীত কাহিনি ও ইতিহাস বিষয়ক, যা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে। তৃতীয়তঃ আয়াতে আবেশায়াত বা রূপক, যার অর্থ শুধু জ্ঞানীদের কাছেই প্রকাশ পায়। অনেক সময় স্বার্থন্বেষী ভন্ড ও দুষ্ঠু প্রকৃতির লোকেরা এ ধরণের আয়াতের অপব্যাখ্যা করে মানুষকে বিভ্রান্ত করে নিজ বক্র ইচ্ছা বাস্তবায়নের চেষ্টা করে থাকে। গোলাম আহমদ কাদিয়ানি এই ধরণের আয়াতের অপব্যাখ্যা করে নিজেকে নবি পর্যন্ত দাবী করে বসেন। 
এই তৃতীয় ধরণের আয়াতগুলোতে কট্টরপন্থীদের প্রবেশাধিকার নেই। এই আয়াতগুলোর মর্ম থেকে তারা বঞ্চিত। কেবলমাত্র স্রষ্টা যাদের জ্ঞান ও অন্তদৃষ্টি দান করেছেন কেবল তারাই জ্ঞানসমুদ্র থেকে সত্য-সুধা আহরণ করেন। তবে সাধারণ মানুষের ধারণা ও বিশ্বাসের সীমাবদ্ধতার কারণে জ্ঞানী সুফিরা গুপ্তরহস্য গোপনই রাখেন। এ সম্মন্ধে অষ্টাদশ শতাব্দীর বিখ্যাত সুফি এনায়েত খান একটি সুন্দর রূপক-কাহিনি বর্ণনা করেছেন, একটি শহর সুউচ্চ প্রাচীর দিয়ে ঘেরা। প্রাচীরের ওধারে কি আছে কেউ জানে না। সবার মুখে মুখে তাই অজস্র কল্পকাহিনি। শহরের জ্ঞানী ব্যক্তিরা সিদ্ধান্ত নিলেন, তাদের মধ্যে সবচেয়ে জ্ঞানী ব্যক্তি ঐ প্রাচীরে উঠবেনতাকিয়ে দেখবেন ওপারে কি আছে। তারপর তা বর্ণনা করবেন সবার সামনে। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সবচেয়ে জ্ঞানী ব্যক্তিকে দাঁড় করানো হলো প্রাচীরের উপরে, তিনি দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন প্রাচীরের ওপাশে। ওপারের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে তিনি ঝাঁপিয়ে পড়লেন ওপারে।
তিনি আর ফিরে এলেন না। রহস্য ঘনীভূত হল। নগরবাসী তাদের সবচেয়ে জ্ঞানী ব্যক্তিকে হারালেন অথচ জানতে পারলেন না কিছুই। রহস্য উদঘাটনে আরও উদ্বেল হয়ে উঠলেন সবাই। পরামর্শ করে এবার ঠিক করলেন, পরবর্তী জ্ঞানী ব্যক্তির কোমরে দড়ি বেঁধে প্রাচীর শীর্ষে তুলে দেওয়া হবে। তিনিও যদি ওপারে ঝাঁপ দেওয়ার চেষ্টা করেন তাহলে কোমরবন্ধন টান দিয়ে নামিয়ে আনা হবে। যেই কথা সেই কাজ। জ্ঞানী ব্যক্তিকে কোমর বেঁধে প্রাচীর শীর্ষে তুলে দেওয়া হল। ওপারে দৃষ্টি ফেরানো মাত্রই তিনিও ঝাঁপ দিতে উদ্যত হলেন। হ্যাচকা টান দিয়ে নামিয়ে আনা হল তাকে। তিনি কোন আঘাত পেলেন না অথচ প্রত্যাবর্তনের পর বাকশক্তি হারিয়ে নির্বাক হয়ে গেলেন।
এখানে আধ্যাত্মিকতার রূপকে প্রকাশ করা হয়েছে এভাবে, স্রষ্টার রহস্য অবলোকনের পর যদি জনপদে প্রত্যাবর্তন করতেই হয়, তাহলে তিনি নির্বাক হয়ে যাবেন। কারণ ওপারের রহস্য এপারের ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। তাই তারা নিরূপায় হয়ে পড়েন। এই রহস্যলোকই মরমিবাদীদের চারণক্ষেত্র। তারা যা অনুধাবন করেন তা সাধারণ মানুষের বোধসীমার বাইরে। তাই তাদের প্রকাশে সবসময় রহস্যময়তা থাকে। মরমিবাদী সুফিরা যখন স্রষ্টা ও সৃষ্টির রহস্য অবলোকন করেন, তখন সাধারণ মানুষের ধারণার সঙ্গে তাদের বিস্তর তফাত এসে যায়, তাই তারা রহস্যকে ঢেকে রাখেন আর প্রকাশ্যকে প্রকাশ করেন। তাছাড়া তারা মানুষের নিজ নিজ ধারণ ক্ষমতা অনুযায়ী প্রত্যেক মানুষকে ধারণা প্রদান করেন। তাঁরা যেমন অপাত্রে দান করেন না, তেমনি সক্ষম ব্যক্তিকে বঞ্চিত করেন না।
জ্ঞানের বিশাল সমুদ্র হতে কেউ শুধু পানি পান করে তৃষ্ণা মেটান, কেউ মাছ ধরে ক্ষুধা নিবারণ করেন। আবার কেউ অতল গভীর থেকে মূল্যবান মণিমুক্তা আহরণ করেন। 
জ্ঞানী ব্যক্তিরা সাধারণ মানুষ এমনকি পাপীকেও বুঝতে পারেন। কিন্তু সাধারণের পক্ষে জ্ঞানী ব্যক্তির পরিমাপ করা সম্ভব হয় না। সাধারণ মানুষ জ্ঞানীকে অবহেলা করে কিন্তু জ্ঞানী পাপীকেও তাচ্ছিল্য করেন না। একবার একজন মরমিবাদী সুফি সাধক দুই পাহাড়ের মধ্যবর্তী সরু গলীপথ পার হচ্ছিলেন। গলীমুখে এসে দেখেন, একটি কুকুরও তখন পার হতে চাচ্ছে। সুফি সাধক ভাবলেন কুকুরটাকে তাড়িয়ে অগ্রসর হবেন, এমন সময় কুকুরটি বলে উঠলো (সুফি কুকুরের ভাষা বুঝতেন) তুমি সরে যাও আমি আগে যাব।” সুফির অন্তদৃষ্টি খুলে গেল। তিনি উপলদ্ধি করলেন “কুকুরকে অবহেলা করা ঠিক নয়, কারণ কুকুরের পাপ করার ক্ষমতা নাই কিন্তু মানুষের আছে। আমি পাপী হতে পারি কিন্তু কুকুরতো পাপী নয়। কাজেই কুকুরকে তুচ্ছ ভেবে আমার অহংকার করা সাজেনা।” তিনি সরে দাঁড়ালেন, কুকুরকে পথ ছেড়ে দিলেন। 
সুফি সাধকরা সব অহংবোধকে নিজের অন্তর হতে নিশ্চিহ্ন করে দেন। কথিত আছে মেরাজ ভ্রমণে হজরত মুহাম্মদ(সঃ) যখন স্রষ্টার সান্নিধ্যে হাজির হলেন, তখন আল্লাহতায়ালা জিজ্ঞেস করলেন ‘হে প্রিয় রসুল, কি উপহার এনেছেন? রসুল(সঃ) জবাব দিলেন “অজিজি (বিনয়)”। অহঙ্কার যেমন স্রষ্টার অলংকার, বিনয় তেমনই সৃষ্টির উপযোগী পরিচ্ছেদ। সুফিরা তাই বিনয়ী। সবধরণের অহংবোধ চূর্ণ করে তাই বিনয় প্রতিষ্ঠাই মরমিবাদীদের জীবনসংগ্রাম।
কোন কোন বিশেষ ঘটনা অন্তচক্ষু খোলে দেয়, মানুষের রূপান্তর ঘটে। পার্থিব জ্ঞানী ব্যক্তিদের মধ্যে বিশেষ জ্ঞানের (আধ্যাত্মিক) উদয় হয় এবং তার প্রবেশ ঘটে মরমিবাদে। দিল্লির বিখ্যাত দরবেশ বখতিয়ার কাকির মাযার জেয়ারতকালে নিজামউদ্দিনকে লক্ষ করে একজন সুফি বলে উঠেন হে নিজাম, তোমাকে তো দুনিয়াদারি কাজের জন্য আল্লাহ সৃষ্টি করেন নাই।’ বলেই তিনি নিজামউদ্দিনের চোখের সামনে অদৃশ্য হয়ে যান। নিজাম উদ্দিনের মনের চক্ষু খোলে যায়। তিনি আধ্যাত্মিকতা দিকে অগ্রসর হয়ে পরিণত হন বিখ্যাত নিজামউদ্দিন আউলিয়ায়। 
ইয়ামেনের রাজপুত্র শেখ আলী হজরত শাহজালালে(রঃ) আধ্যাত্মিকতায় পিতার অকালমৃত্যু অবলোকন করে রাজসিংহাসন ঘরসংসার পরিত্যাগ করে সুফিজীবনের কঠিন সাধনা জগতের দিকে অগ্রসর হন। শাহজালালের(রঃ) সঙ্গে ফকিরের বেশে ৩৫০০ মাইল দূরবর্তী সিলেটে চলে আসেন মরমি সাধনায়। বিখ্যাত সুফি সাধক মাওলানা জালালউদ্দিন রুমি। প্রথম জীবনে তিনি ছিলেন জাদরেল মাওলানা। ক্বোরআন, হাদিস, ফিকাহ শাস্ত্র বর্ণনায় তাঁর জুড়ি ছিল না। তিনি ছিলেন দেশের আলেমকুল শিরোমনি। এ নিয়ে তাঁর গর্বও ছিল। শ্রেষ্ঠ আলেম হবার অহংকারে তিনি মগ্ন ছিলেন। তিনি ভাবলেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ধর্মীয় কিতাব লিখবেন- যেখানে ধর্মের সবকিছু লিখা থাকবে। যেই কথা সেই কাজ। সুদীর্ঘ ত্রিশ বছর কঠোর পরিশ্রম করে তিনি বইটির বিশাল পাণ্ডুলিপি লিখে ফেলেন। এবার তিনি গর্বে আরও স্ফীত হন এমন বইতো সমসাময়িক কালে কেউ লিখতে পারেনি। 
মাওলানা হিসেবে তাঁর খ্যাতি ও মর্যাদা তখন শিখরে। একদিন ওজুখানায় বসে গর্বের সাথে বইটি উল্টিয়ে পাল্টিয়ে দেখছিলেন। এমন সময় জীর্ণবস্ত্র এক পাগল এসে হাজির হল। মাওলানা জিজ্ঞেস করলেন কী চাও? পাগল পাল্টা প্রশ্ন করল তোমার হাতে ওটা কী?মাওলানা গর্বভরে জবাব দিলেন “তুমি বুঝবেনা, এটা হলো জ্ঞানের বই।” অসতর্ক মুহুর্তে মাওলানার হাত থেকে বইটি তুলে নিয়ে পাগল সেটি ওজুর পানিভর্তি চৌবাচ্চার মধ্যে ফেলে দিল। মাওলানা ভীষণ ক্ষেপে গেলেন। ভৎসনা করে রাগতস্বরে বললেন এ কি করলে তুমি? তুমি কী জান কত বড় সর্বনাশ করলে? সর্বকালের জ্ঞানের শ্রেষ্ঠ বইটি তুমি নষ্ট করে ফেললে।’ 
পাগল পানির মধ্যে হাত চুবিয়ে বইটি তুলে এনে মাওলানার হাতে রাখলেন।  বইটি একটুও ভিজেনি, মনে হয় বইটি কখনও পানি স্পর্শ করতে পারেনি। অবাক বিস্ময়ে মাওলানা প্রশ্ন করলেন ‘এটা কী” পাগল জবাব দিলেন ‘এটা আমার হাল (অবস্থা)।’ বলেই পাগল দৌঁড়ে প্রস্থান করলেন। মাওলানা হতচকিত হয়ে পাগলের পিছনে পিছনে দৌঁড়াতে লাগলেন। কিছু দূর গিয়ে ধরে ফেললেন পাগলকে। মাওলানা এঘটনায় প্রচন্ড ধাক্কা খেয়ে বললেন, আপনার গভীর জ্ঞানের কাছে আমার সারাজীবনের সঞ্চিত জ্ঞান তুচ্ছ, আমি আপনার কাছে দীক্ষা নিতে চাই।’ 
শিক্ষার যেখানে শেষ, দীক্ষার সেখানে শুরু। এই পাগল ছিলেন সুফিসাধক শামস তাব্রীজ(রঃ)। সুফি মাওলানার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে বললেন তুমি বড় মাওলানা, তোমাকে কী শিখাবো, তুমি তো সবই জানো।’ কিন্তু মাওলানা রুমি নাছোড়বান্দা, মাফ চাইতে লাগলেন, আর অনুনয়-বিনয় করতে লাগলেন। সুফির মন গলল। সুফি শর্ত দিলেন “ঠিক আছে মাওলানা, তুমি কি বাজারের মধ্য দিয়ে দু’হাতে দু'বোতল মদ উঁচু করে দেখাতে দেখাতে নিয়ে আসতে পারো তাহলে বিবেচনা করা হবে।’ মাওলানার অন্তঃচক্ষু খুলে গেল। তাই তিনি রাজি হয়ে গেলেন। বাজারের মধ্যে শত শত মানুষের সামনে মাওলানা জালালউদ্দিন রুমি দু'বোতল মদ নিয়ে আসলেন। দু’পাশের মানুষ ছিঃ ছিঃ করে উঠলো। এতবড় মাওলানা নষ্ট হতে হতে শেষ পর্যন্ত মদাসক্ত হয়েছেন। মাওলানা কর্ণপাত করলেন না। তিনি মদ স্পর্শও করেননি। কিন্তু এই ঘটনায় তার অহংকার বিচুর্ণ হল, তিনি বিনয়ী হলেন। 
সুফিসাধক শামস তাব্রীজ মাওলানাকে প্রথমেই এই দীক্ষা দিলেন। মাওলানা রুমির শুরু হলো এবার নতুন জীবন, সুফি সাধনার সংগ্রাম। কট্টরপন্থী মাওলানার উত্তরণ ঘটলো সুফিজীবনে। মাওলানা রুমি ধীরে ধীরে হয়ে উঠলেন মরমি সাধক। মরমিবাদের সমুদ্রে ডুবে রচনা করলেন 'মসনবি শরিফ'। যে গ্রন্থকে কেউ কেউ বলেন দ্বিতীয় কুরআন। ভাবের গভীরতার জন্য মসনবিকে বলা হয় ফার্সি ভাষার শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ। তাব্রীজ কর্তৃক পানিতে ফেলে দেয়া ধর্মীয় পুস্তকের জন্য তিনি পরিচিত নন, তাঁর পরিচিতি মসনবি রচয়িতা হিসেবে।
আমার পূর্বপুরুষ হজরত শাহদাউদ কুরেশি(রঃ) একজন সুফিসাধক ছিলেন। শৈশব ও কৈশোরে দক্ষিণসুরমার দাউদপুর গ্রামে তাঁর মাযারে দাঁড়িয়ে সুফিসাধক হওয়ারও স্বপ্ন দেখতাম। ৩৬০ আউলিয়ার অন্যতম এই দরবেশের সমাধীপারে পশ্চিমের পাকা ইবাদতখানায় বসে আরাধনা করতাম সুফিসাধক হবার আশা নিয়ে। কিন্তু আজ হয়েছি একজন সামান্য ব্যাংকার। আসলে বইপড়ে সুফিবাদের তত্ত্ব শেখা যায়, সুফি হওয়া যায় না। সুফির সংস্পর্শে ও দীক্ষায় অবস্থান করে সুফি হতে হয়। যুগ যুগ ধরে এ নিয়মই চলে আসছে। সুফিরা শুধু ধার্মিক নন, তারা মানবতাবাদী। সুফিরা কট্টর নন, তারা উদার। সুফিসাধক হজরত শাহজালাল বিন মোহাম্মদ ইয়ামেনি(রঃ) সম্পর্কে ইবনে বতুতার বিবরণীতে আমরা এমনটিই বর্ণনা দেখতে পাই।
[প্রকাশ কাল: দৈনিক সিলেটের ডাক, শুক্রবার, ১১ নভেম্ব, ২০১১ইং ১১/১১/২০১১ইং]

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন