Pages

প্রকাশিত গ্রন্থ-সমূহ

বৃহস্পতিবার, ১৭ মার্চ, ২০১৬

নির্বাচনে কেমন প্রার্থীকে ভোট দিবেন?

নির্বাচনে কেমন প্রার্থীকে ভোট দিবেন?
চৌধুরী ইসফাকুর রহমান কুরেশী

জাতীয় সংসদ নির্বাচন ২৯শে ডিসেম্বর ২০০৮ এবং উপজেলা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে ২২ শে জানুয়ারী ২০০৯। বাংলাদেশের মানুষ অনেক ভোট দেখেছে, অনেক ভোট দিয়েছে। যখন ভোট আসে তখন ভোট প্রার্থীরা একদম ভিক্ষুকের বেশ ধরে জনে জনে ভোট ভিক্ষায় বের হন। মানুষের সাম নে মাথায় টুপি, গায়ে খদ্দরের পাঞ্জাবী পরিহিত অত্যন্ত ভদ্রগোছের একজন মানুষ এসে যখন বিনয়ীর বেশ ধরে খাড়া হন তখন মানুষ ভাবেন এ যেন মানুষ নন, স্বর্গের ফেরেশতা। সামনে পড়া মাত্রই বুকে জড়িয়ে ধরেন সবাইকে। অত্যন্ত মুক্ত হস্তের দয়ার সাগর এই মানুষটি চাহিবামাত্র সবকিছু বিলিয়ে দেন সবাইকে। যখন জনতার সামনে বক্তৃতা দেন মুখে তার মধু ঝরে, মুগ্ধ জনতার মুহূর্মুহু হাততালি আর জিন্দাবাদে কেঁপে ওঠে জনসভা। কর্মীরা নেতার প্রসংশায় পঞ্চমুখ, নেতা এলেন, দেখলেন, জয় করলেন। রাস্তায় রাস্তায় গাড়ীতে মাইকে নেতার জন দরদ আর সমাজসেবার গানের বন্যা বইতে থাকে। আমার ভাই, তোমার ভাই, সবার সেরা তমুখ ভাই, আর কত কি। গ্রাম বাংলায় যখন কাল বৈশাখীর ঝড় আসে, কৃষকের নড়বড়ে বাঁশের কুঁড়েঘরগুলো ঝড়ে কেঁপে উঠে, তখন কৃষকেরা আজান দেন ও ঝড়ের কবল হতে বাঁচার জন্য নিজের সাধ্যের অধিক অনেক কিছু মানত করে বসেন।
পরে যখন ঝড় শেষ, তখন মানতও শেষ। আমাদের ভোটভিখারীদের অবস্থা তাই, নির্বাচনের দিন পর্যন্ত সবার সব দাবীদাওয়া তারা মেনে নেন, এ ভাবে রাস্তাঘাট, হাটবাজার, মসজিদ মন্দির সবকিছুই দিয়ে দেন তিনি, আর নিবাাচনের পরদিন থোকে তাকে খুঁজে পাওয়া ভার। তখন মানুষ তার কাছে গেলে ‘জরুরী কাজ’ অথবা ‘জরুরী মিটিংয়ের’ জন্য দেখাই করতে পারেন না। এদেশের প্রতিটি অঞ্চলের জনহিতকর উন্নয়নমূলক কার্যবলী সম্পাদন হয় জনগণের টেক্সের টাকায়। সব সময়ই এদেশের কৃষকরা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে খাদ্যশস্য ফলাচ্ছে, শ্রমিক শ্রম দিয়ে উৎপাদন বাড়াচ্ছে, পদে পদে জনগণ হরেক রকম খাজনা দিয়্যে রাষ্ট্রের কোষাগার পূর্ণ করছে। যিনিই ক্ষমতায় আসেন না কেন সবার আমলেই জনগণ টেক্স দিয়ে যাচ্ছেন, অথচ ক্ষমতা আসীনরা এমন হাবভাব দেখান যে মনে হয় তাদের বাবার টাকা দিয়ে বিভিন্ন এলাকায় যতসব কাজকর্ম করাচ্ছেন। জনগণের টেক্সের টকা খরচ করে রাস্তার ধারে ধারে মার্বেল পাথরে নিজেদের নাম খোঁদাই করেন। গরীবদে শের হাজার হাজার টাকা এভাবে অপচয় করে এক ধরনের আত্মতৃপ্তি লাভ করেন। অথচ জনগণ নেতাদের এভাবে ইলিশের তৈল দিয়ে ইলিশ ভাঁজার জন্য নির্বাচিত করেনি।
নিবাচনের পর জনগণ একদিন ছবিসহ পত্রিকা পাতায় দেখতে পেলো তাদের ভোটে নির্বাচিত ফেরেস্তার মত মাসুষটি এমপি হোস্টেলে মাতাল অবস্থায় মক্ষীরাণীসহ ধরা পড়েছেন আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে, কিংবা তার কারখানার ছাদ থেকে বরে হয়ে আসছে রিলিফের টিন, কিংবা তিনি ক্ষমতার দম্ভে বুদ হয়ে পিটাচ্ছেন সাংবাদিক অথবা প্রতিপক্ষের কোন লোককে কিংবা তিনি দখল করে নিচ্ছেন সরকারী জমি, নদীর তীর, হাট-মাঠ ঘাট সব। মানুষ দেখতে পেলো এলাকার যতসব গুন্ডা পান্ডা সন্ত্রাসী বদ লোকেরা তাদের নির্বাচিত মহাপুরুষ লোকটিকে কেন্দ্র করে গড়ে তুলেছে এক ক্লাস কমিটি। সন্ত্রাস ডাকাতি চাঁদাবাজিতে লিপ্ত এই কমিটির লোকজন। অথবা এমপি সাহেবের মিছিল থেকে প্রতিপক্ষের মিছিলে গুলি ছুড়ছে সন্ত্রাসীরা। জনগণের ভোটে নির্বাচিত মহামানব আশপাশে সংঘটিত কোন খুনের মামলার এক নম্বর আসামী। অভি কিংবা গৌসের মত অনেক সাংসদ মানুষ খুন করে পালিয়ে যায় বিদেশে। বিচারে মৃত্যুদন্ডও হয় অনেকের। চারদিকে এই নির্বাচিত লোকটি মার মার, কাট কাট, খাই খাই সাজ। মানুষ তখন লজ্জা পায় আর ভাবে না বুঝে এ কোন লোকটাকে দিলাম মুল্যবান ভোট। অথচ তখন কিছু করার থাকে না আর। যারা জনগনের ভোট নিয়ে আইন সভার সদস্য হন, দেশ ও জনগনের জন্য আইন প্রণেতা হতে, আর তিনিই এক সময় পরিণত হবেন আইন হননকারীতে।
পরবর্তী ভোটে তিনি আবার আসেন এই বলে, সব ষড়যন্ত্র তিনি বিরোধীদলের ষড়যন্তের শিকার, তিনি কোন অন্যায় করেননি- তিনি মিথ্যা অপবাদের বলী। মানুষ তখন দেখতে পায় যে রিক্ত মানুষটিকে তারা নির্বাচিত করেছিলো আজ তিনি আর রিক্ত নন। চাঁদা আর পার্সেন্টেজের কালো টাকায় তিনি অর্থ সম্পদে তখন টইটম্বুর। আঙ্গুল ফুলে একেবারে বটগাছ। আমাদের অতীতের নির্বাচিত সাংসদদের ইতিহাস অনেকটা এরকমই। আমরা সব সময় খারাপ লোকদের যে নির্বাচিত করেছি- তা নয়, অনেক ভাল লোকও সাংসদ হয়েছেন। যারা নিজস্ব অর্থ ব্যয়ে নিজ নিজ এলাকায় অনেক হাসপাতাল, স্কুল, কলেজ মসজিদ মাদ্রাসা করেছেন, জনগণের সুখে-দু:খে শরিক হয়েছেন। অনেক অনেক ভালো কাজ করে মানুষের হৃদয়ে স্থায়ীভাবে স্থান করে নিয়েছেন। সাংসদরা দেশের জন্য আইন রচনা  করেন, কাজেই রাজনীতি অর্থনীতি সমাজনীতি ইতিহাস ইত্যাদি বিষয়ে তার গভীর জ্ঞান থাকা প্রয়োজন। কাজেই শিক্ষিত লোকদের ভোট দেওয়া উচিত। অতীতে অনেক দুর্নীতিগ্রস্থ লোক সাংসদ নির্বাচিত হবার কারণে নিজের স্বার্থরক্ষার জন্য তারা আইন সংস্কার কিংবা আইন রচনায় ন্যায়নীতি ও জাতীয় স্বার্থ অনুসরণ করেনি। ফলে এদেশের আইনের এলোমেলো জাল কেটে ইুঁদুরের মত সন্ত্রাসি, দুর্নীতিবাজ প্রভাবশালী ভদ্রবেশী অপরাধীরা পার পেয়ে যায়, দুর্নীতিদমন কমিশন কিংবা বিচার বিভাগের করার কিছু থাকে না। এই আইনে কেবল আটকা পড়ে চুনোপুটিরা। জঙ্গীবাদ কিংবা চরমপন্থীদের সাথে সংশ্লিষ্ট লোকদের ভোট প্রদান কোনক্রমেই উচিত নয়। জঙ্গীবাদ যেকোন রাষ্ট্রকে ধ্বংস করে দিতে পারে- বর্তমানের আফগানিস্তান ও পাকিস্তান তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। অতীতের মত আমাদের আর ভুল করা চবে না, এবার অবশ্যই শিক্ষিত, সৎ ও সাদা মনের লোকদের নির্বাচিত করতে হবে, নতুবা ‘না’ বাক্সে ‘না’ ভোট প্রদান করা উচিত হবে।


[প্রকাশ কাল: দৈনিক সিলেটের ডাক, ২৮ ডিসেম্বর, ২০০৮ইং]

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন