আমার শ্রদ্ধাভাজন পিতা সফিকুর রহমান চৌধুরী। আমার জীবনে তাঁর অবদানের কোন শেষ নেই। ২০০৭ সালের ২৪ নভেম্বর শনিবার সকাল ৮টায় পরিবার পরিজন গ্রামবাসী ও অসংখ্য গুণগ্রাহীকে শোকসাগরে ভাসিয়ে পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নেন ব্যতিক্রমি ও সরলপ্রাণ এই মানুষ, দক্ষিণসুরমা এলাকায় যার পরিচয় 'দলুমিয়া স্যার'। প্রকৃত নাম সফিকুর রহমান চৌধুরী, যিনি প্রায় অর্ধশত বছরের শিক্ষকতা জীবনের এক দশক সিলেটের দক্ষিণসুরমা দাউদপুরস্থ অধুনালুপ্ত রেঙ্গা হাইস্কুলে ও পরবর্তীকাল মোগলাবাজার রেবতী রমন উচ্চবিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন।
১৯৯০ সালে শিক্ষকতা থেকে অবসর নিয়ে পূর্বপুরুষের প্রতিষ্ঠিত দাউদপুর জামে মসজিদের মোতাওয়াল্লি ও দাউদপুর সিনিয়র মাদ্রাসার কার্যকরী কমিটির সভাপতি হিসাবে মসজিদ ও মাদ্রাসার উন্নয়নে নিরলস কাজ করে যান। তিনি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত রাখালগঞ্জ মাদ্রাসা, তুডুকখলাস্থ মনির আহমদ একাডেমি ও মোগলাবাজার রেবতী রমন উচ্চ বিদ্যালয়ের কার্যকরী কমিটির সদস্য ছিলেন। তিনি নতুন ভবন নির্মাণের জন্য দাউদপুর মাদ্রাসায় মূল্যবান ভূমিদান করেন। তাঁর স্মৃতি বিজড়িত প্রতিষ্ঠানসমূহ তাঁর প্রিয়জনরা স্মরণসভা ও মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করে তাকে হৃদয়ের স্বতঃস্পূর্ত শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।
১৯১৬ সাল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন এক উম্মাতাল দিনে ১লা অক্টোবরে তিনি দাউদপুরের এক ঐতিহ্যবাহী জমিদার পরিবারে হযরত শাহজালালের (রহঃ) আরব থেকে বের হয়ে আসা প্রথম ১২ জন সহচরের অন্যতম হযরত শাহদাউদ কুরেশীর(রহঃ) বংশে ১৬তম প্রজন্ম হিসাবে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ১৯৩৭ সালে ভাদেশ্বর পূর্ববাগ নাছির উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয় হতে মেট্রিকুলেশন, এম. সি সরকারি কলেজ, সিলেট থেকে ১৯৩৯ সালে ইন্টারমেডিয়েট ও ১৯৪১ সালে একই কলেজ থেকে বি. এ পরীক্ষা দেন।
বৃটিশ শাসনামলে বৃটিশ সেনাবাহিনীতে থাকাকালে অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দিয়ে ইংরেজদের চাকুরি ছেড়ে দেন এবং পাকিস্তান আমলে ভূমি মন্ত্রণালয়ে সরকারি চাকুরি গ্রহণ করেন। তিনি সুনামগজ্ঞ মহকুমা কানুনগো ছিলেন বেশ কয়েক বছর। পরবর্তীকালে সরকারি চাকুরি পরিত্যাগ করে এলাকায় শিক্ষা বিস্তারের মহান উদ্দেশ্যে নিয়ে দাউদপুর গ্রামে রেঙ্গা হাইস্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। তার প্রচেষ্টা ব্যর্থ হলে ১৯৫০ সালে তিনি তার প্রিয়জন এলাকার অত্যন্ত সম্মানিত ব্যক্তিত্ব বৃটিশবিরোধী আন্দোলনের নেতা শ্রীকৃপেশ চন্দ্র ভট্টাচার্য্যের অনুরোধে ভট্টাচার্য্য মহাশয়ের পূর্বপুরুষদের প্রতিষ্ঠিত মোগলাবাজার রেবতী রমন উচ্চ বিদ্যাালয়ে যোগদান করেন। পরবর্তী চল্লিশ বছর উক্ত প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ছিলেন।
তিনি নিজের পেশায় যেমন ছিলেন সৎ ও ন্যায়নিষ্ঠ, তেমনি সংসারের প্রতি একনিষ্ঠ। স্নেহ-মমতা, ভালবাসা দিয়ে একজন আদর্শ শিক্ষক হিসাবে তাঁর ছাত্রছাত্রী, ছেলেমেয়ে ও পাড়াপড়শিকে জীবনের শেষদিন পর্যন্ত মনমুগ্ধ করে গেছেন। তিনি ১৯৫৪ সালের ২৫ মার্চ পাতারিয়া দক্ষিণভাগের দেওয়ান খলিলুর রহমান চৌধুরীর কন্যা আসমতুন্নেছা চৌধুরীর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তার বড় ছেলে তাহমিদ চৌধুরী বি.এ. পাশ করে ১৯৯৩ সালে চলে যান লন্ডনে। মধ্যম ছেলে ইসফাক চৌধুরী (এম.এস.এস রাজনীতি বিজ্ঞান, এম বি এ, এবং ডিপ্লোমা ইন ইঞ্জিনিয়ারি-সিভিল টেকনোলজি) বর্তমানে পূবালী ব্যাংক লিমিটেডের সহকারী মহাব্যবস্থাপক। তার স্ত্রী ডাঃ নুরজাহান বেগম চৌধুরী সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস এবং স্ত্রীরোগ ও প্রসুতি রোগের ওপর দেড় বৎসরের পোস্ট গ্রেজুয়েশন করেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ফিলাডেলফিয়াস্থ জেফারসন আল্ট্রাসাইন্ড রিসার্স এন্ড এনালাইসিস ইন্সটিটিউট থেকে আল্টাসানোগ্রাফির উপর সার্টিফিকেট লাভ করেন। তিনি নর্থইস্ট মেডিক্যল কলেজ এবং সেন্ট্রাল ডায়াগনেস্টিকের পরিচালক। ছোটপুত্র নিশাত চৌধুরী (বি.এস.এস অনার্স এম.এস.এস. অর্থনীতি) বর্তমানে জালালাবাদ গ্যাসে ডিপুটি ব্যবস্থাপক হিসাবে কর্মরত আছেন। তার স্ত্রী ফাহমিদ হোসেন লোমা (বি.কম-অসার্স, এমকম-একাউন্টিং) ট্রাস্ট ব্যাংক লিমিটেডে সিনিয়র অফিসার হিসাবে কর্মরত ছিলেন। তার বড় মেয়ে রেহার স্বামী দরগামহল্লাবাসী মুফতি মোঃ খালিদ নির্বাহী প্রকৌশলী হিসাবে অবসর গ্রহণ করেন। রেহা ও মুফতি মোঃ খালিদ এখন আর বেঁচে নেই। মধ্যম মেয়ে সেহার স্বামী আব্দুল কুদ্দুস চৌধুরী দীর্ঘকাল তার নিজ ইউনিয়নের (হাজিপুর, কানিহাটি) চেয়ারম্যান ছিলেন। এছাড়া, তিনি রশিদ ওয়াকফ এস্টেটের বিভিন্ন বাগানে ব্যবস্থাপকের দায়িত্ব পালন করে বর্তমানে কানাডায় স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন। গোলাপগঞ্জের রণকেলী গ্রামের লিয়াকত হোসেন চৌধুরী তার ছোট মেয়ে মান্নার স্বামী।
তিনি অত্যন্ত সুশৃংখল জীবনযাপন করতেন। দেড় মাইল দূরবর্তী স্কুলে পায়ে হেঁটে আসা-যাওয়া করতেন। কখনও রিকশা কিংবা গাড়িতে উঠার পক্ষপাতি ছিলেন না। ভোরে কুরআন তেলাওয়াত ছিল তার আজন্ম অভ্যাস। নামাজ রোজা কখনও ক্বাজা হতনা। পরিবারের প্রয়োজনীয় তরি-তরকারী নিজেই সযতনে ফলাতেন। বৃক্ষরোপনেও ছিল প্রচুর আগ্রহ। ফলে ৯২ বৎসর বয়সে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত কোন ধরনের রোগ তাকে স্পর্শ করতে পারেনি। এমন কি প্রেসার, ডায়বেটিস, গ্যাসটিক কিছুই ছিলনা তার।
তিনি ১৯৯৬ সালে স্বস্ত্রীক পবিত্র হজ্ব পালন করেন। নিজের প্রয়োজনীয় কাজ ফেলে বিচার আচার ও এলাকার উন্নয়নে সময় ব্যয় করতেন। সব সময় অল্পে সন্তুষ্ট ছিলেন এবং লোভ-লালসা, হিংসা-বিদ্বেষ সবকিছুর উর্দ্ধে এক অসাধারণ মানুষ ছিলেন। খাবারদাবারে কোন পছন্দ অপছন্দ ছিলনা, প্রাকৃতিক খাবার ছিল তাঁর ঝোঁক ছিল বেশি।
তিনি তাঁর ভাগনা সাবেক আই.জি.পি. ও পূবালী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ই.এ. চৌধূরীকে দিয়ে ১৯৮৫ সালে এলাকাবাসীর সুবিধার্থে দাউদপুর-চৌধুরী বাজারে পূবালী ব্যাংকের একটি শাখা প্রতিষ্ঠা করেন। মানুষের প্রতি খুবই দরদ ও ভালবাসা ছিল তার। তিনি তার জীবনের শেষ প্রান্তে এসে দাউদপুর গ্রামের বাড়িতে এবং পুত্রের সাগরদিঘিরপারের বাসায় (জেফার ভবনে) পর্যায়ক্রমে অবস্থান করতেন।
২০০৭ সালের রমজানের কয়েকদিন পূর্বে তিনি চলে আসেন পুত্রের বাস ভবনে। রোজা শেষে চলে আসে অগ্রাহায়ণ মাস। এ সময় দাউদপুরের গ্রামের বাড়িতে ধান কাটা ও সুপারি উঠানো হয়; ধান উঠতে যাবার জন্য বাড়ি থেকে বারবার খবর আসতে থাকে। ২৩ নভেম্বর ২০০৭, সেদিন ছিল শুক্রবার, সকালের খাবার শেষে গ্রামের বাড়ি চলে যান। তিন মাস শহরে অবস্থানকালে বাড়ির ঘরে বারান্দায় ভীমরূল বাসা বাঁধে ও জনহীন ঘরে বিশাল চাকে পরিণত হয়। আমার কাছে ভীমরূলের ব্যাপারে অজানা থাকলেও ছোটভাই নিশাত বিষয়টিকে তেমন গুরুত্ব দেয়নি। বাড়িতে অবাঞ্চিত লোকজনের আনাগুণা বন্ধ হবে বিধায় সে ভীমরূলের বাসা ভেঙ্গে দেয়নি। ঐদিন সন্ধ্যায় কে বা কারা চাকে ঢিল ছুড়ে, তিনি বুঝতে পারেননি; নীচে আসামাত্র অসংখ্য ভীমরূল তার সারাটা শরীরে হুল ফোটায়।
গ্রামের চৌধুরীবাজারে আমাদের তিনটি দোকান ভাড়া দেওয়া ছিল। একটিতে ফার্মেসি পরিচালনা করতেন পল্লী চিকিৎসক সামাল উদ্দিন। সাথে সাথে মোবাইলে ফোন করে তাকে ঔষধসহ পাঠানো হয়। গাড়ি নিয়ে বাড়ি যাই, তাকে নিয়ে আসি বাসায়; সব ধরনের ঔষুধ প্রয়োগের পরও অশান্তি করছেন দেখে নিয়ে যাই সেইফওয়ে হাসপাতালে। ডাক্তার কুন্ডু বাবু রোগী দেখে রয়েল হাসপাতালে স্থানান্তরের পরামর্শ দেন। তাঁকে নিয়ে রয়েল হাসপাতালে এক কালোরাত নির্ঘুম অতিবাহিত করি। সারারাত তীব্র যন্ত্রণায় ভোগে পরদিন সকালে তিনি মৃত্যুর হিমশীতল কোলে ঢলে পড়েন।
বাদ জোহর হযরত শাহজালালের দরগা মসজিদের জানাজার পর তাকে নিয়ে যাওয়া হয় জন্মভূমি দাউদপুর গ্রামের বাড়িতে। আসরের জামাতের পর লোকে লোকারণ্য হয়ে ওঠে দাউদপুর ঈদগাহ ও মসজিদ চত্বর। এখানে দ্বিতীয় নামাজে জানাজা শেষে বড় মসজিদের সামনে পারিবারিক গোরস্থানে তাকে সমাধীস্থ করা হয়।
পশ্চিমে হযরত শাহদাউদ কুরেশীর(রহঃ) পবিত্র দরগাহ ও মসজিদ এবং পূর্বদিকে দাউদপুর মাদ্রাসা। এই দুয়ের মধ্যবর্তী অত্যন্ত পুতপবিত্র স্থানে হেমন্তের সেই উজ্জল দিনে চিরনিদ্রায় শায়িত হন তিনি। মহান আল্লাহর দরবারে আমরা তার আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি- আল্লাহ তাকে তার শ্রেষ্ঠ পুরস্কারে পুরস্কৃত করুন। ওকুর রাব্বিরহামহুমা কামা রাব্বা ইয়ানে সাগিরা। আমিন।
প্রকাশকালঃ দৈনিক সিলেটের ডাক, ২৫ নভেম্বর, ২০০৮ইং
প্রকাশকালঃ দৈনিক সিলেটের ডাক, ২৫ নভেম্বর, ২০০৮ইং
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন