ছবিঃ ডিজনিওয়াল্ড, অরলান্ডো ফ্লোরিডায় দাউদপুর চৌধুরীবংশীয় কবি লেখক ব্লগার ও পূবালী ব্যাংকার ইসফাক কুরেশী
সিলেট বিজয়ের পর হযরত শাহজালাল(রঃ) জেলার শাসনভার সেনাপতি সিকন্দার গাজির উপর অর্পণ করে নিজে ধর্ম আলোচনা ও আল্লাহর এবাদতে রত থাকেন এবং ইসলাম প্রচারের জন্য তাঁর সঙ্গী আউলিয়াদেরকে সিলেট ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের বিভিন্ন স্থানে প্রেরণ করেন। হযরত শাহ্জালালের(রঃ) নির্দেশে তাঁর অন্যতম স্নেহধন্য সাথি শাহদাউদ কুরায়শী(রঃ) সিলেট থেকে অনতিদূরে রেঙ্গা দাউদপুরে খানকা স্থাপন করে ইসলাম প্রচারে আত্মনিয়োগ করেন। তাঁর খানকায় আশ্রয় পেত, খাবার পেত ধর্মান্তরিত নওমুসলিমরা, যারা পরিবার পরিজন কর্তৃক পরিত্যক্ত হয়ে অসহায় হয়ে পড়ত। অমুসলিমরাও সাহেবে-কেরামত শাহদাউদ কুরায়শী(রঃ) কর্তৃক বিভিন্নভাবে উপকৃত হত। তাঁর বংশধরেরা পরবর্তীকালে উত্তরাধিকার সূত্রে তাঁদের পূর্বপুরুষদের আরদ্ধ দায়িত্ব পালনে সচেষ্ট ছিলেন। বৃটিশ আমলে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে জমিদারী প্রথা প্রবর্তিত হলে এ বংশীয়রা জমিদারিতে সম্পৃক্ত হয়ে পড়েন এবং সরকারের কাছ থেকে নিজেদের নামে তালুক বন্দোবস্ত নেন। জমিদারী পরিচালনার দায়িত্ব পালনের সাথে সাথে ধর্ম নির্বিশেষে প্রজাদের কল্যাণে তাঁরা অনেক ভূ-সম্পত্তি দান করেন। জমিদারীর মালিক হলেও ব্যক্তিগত জীবনে তাঁরা ছিলেন ধর্মপরায়ণ, বিনয়ী ও প্রজা বৎসল। ইদানীং কালে জনকল্যাণে দাউদ কুরায়শীর অধঃস্তন পুরুষ গৌছউদ্দীন আহমদ চৌধুরীর অবদান বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ব্রিটিশ আমলে উত্তর সিলেট মুসলিম লীগের সভাপতি হিসেবে তিনি পাকিস্তান আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা রাখেন। জনসেবায় বিশেষ অবদানের জন্য ১৯৩১ ইংরেজি সালে তিনি খান বাহাদুর উপাধি লাভ করেন। ১৯৩৭ সাল থেকে ১৯৪৭ সাল তথা তৎকালীন আসাম প্রদেশের বিভিন্ন কার্যক্রমে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন। দীর্ঘকাল উত্তর সিলেট লোকাল বোর্ডের সদস্য হিসেবে তিনি জনকল্যাণমূলক বহু কাজে নিয়োজিত ছিলেন। ১৯২০-২১ ইংরেজি সালে দেশে খেলাফত আন্দোলনের ঢেউ বয়ে যায়। খান বাহাদুর গৌছউদ্দীন আহমদ চৌধুরীর অগ্রজ কুতুবউদ্দীন আহমদ চৌধুরী খেলাফত আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন।
শাহদাউদ কুরায়শীর অন্যতম বংশধর শহিদ শামসুদ্দোহা কুরায়শী ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে ময়নামতি সেনানিবাসে শাহাদাত বরণ করেন। এ বংশের হুমায়ুন দাউদ কুরায়শী ও মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশ গ্রহণ করেন এবং গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।
খান বাহাদুর গৌছউদ্দীন আহমদ চৌধুরীর দ্বিতীয় পুত্র নূরউদ্দীন আহমদ চৌধুরী ছিলেন ফুড ডিপার্টমেন্টের ডায়রেক্টর জেনারেল, তৃতীয় পুত্র ই.এ. চৌধুরী ছিলেন বাংলাদেশ পুলিশের ইন্সপেক্টর জেনারেল, তৃতীয় পুত্র ইমামউদ্দীন আহমদ চৌধুরী ছিলেন সরকারের সচিব এবং তত্ত্ববধায়ক সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য। দেশকে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় উত্তরণে এ তত্তাবধায়ক সরকারের ভূমিকা ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সরকারি চাকুরিতে থাকাকালে তাঁরা সবাই নিজ নিজ দায়িত্ব পালনের সাথে সাথে নিজেদেরকে বিভিন্ন সমাকল্যাণমূলক কাজে নিয়োজিত রাখেন। পঞ্চম পুত্র নাসিরউদ্দীন আহমদ চৌধুরী গ্রীণডেল্টা ইন্সুরেন্স কোম্পানি লিমিটেডের প্রতিষ্ঠাতা ম্যানেজিং ডাইরেক্টর। ষষ্ঠ পুত্র শফি আহমদ চৌধুরী দেশের একজন শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ী ও শিল্পপতি। উভয়েই বিভিন্ন সমাজকল্যাণ মূলক কাজে বিশেষ অবদান রেখেছেন।
এলাকার উন্নয়নে শাহদাউদ কুরায়শীর বংশধরদের কিছু অবদান নীচে বর্ণিত হলোঃ
দাউদপুর জামে মসজিদ
শাহদাউদ কুরায়শী দাউদপুর গ্রামে আসার পর সেখানে একটি মসজিদ নির্মাণ করেন। প্রায় ৪০ বছর দাউদপুরে অবস্থানকালে তিনি নিজেকে ইবাদত বন্দেগি ও ইসলাম প্রচারে নিয়োজিত রেখেছিলেন। পরবর্তীকালে তাঁর বংশধর চৌধুরীগন নিজ ব্যয়ে মসজিদটি পাকা করেন। কয়েকশত বছর পূর্বে নির্মিত পাকা আদিম মসজিদটি জরাকীর্ণ হয়ে পড়ায় শাহদাউদ কুরায়শীর বংশধরদের উদ্যোগে সম্প্রতি তা পুন:নির্মিত হয়েছে। এ নির্মাণ কাজে দাউদ কুরায়শীর অধস্তন বিশেষভাবে নাসির চৌধুরী ও বর্তমান বংশধররা বিশেষ অবদান রাখেন। নাসির চৌধুরী লক্ষ টাকা ব্যয়ে জেনারেটর কিনে দিয়েছেন যাতে বিদ্যুৎ গেলেও তারাবি নামাজ পড়া যায়। দ্বিতল বিশিষ্ট পুনঃনির্মিত এ মসজিদটিতে অনেক মুসল্লি এক সাথে নামাজ পড়তে পারেন। দাউদপুর জামে মসজিদের পুকুর ও শৌচাগারের জায়গা পূর্বকালে পূর্ববাড়ির সফিকুর রহমান চৌধুরীর পিতা মোহাম্মদ মোফজ্জিল চৌধুরী দান করে যান। সফিকুর রহমান চৌধুরী মোতাওয়াল্লি থাকাকালে তাঁর নেতৃত্বে মসজিদের এই নির্মাণকাজ সমাধা হয়।
শাহদাউদ কুরায়শীর মাজার শরিফ
শাহদাউদ কুরায়শীর মৃত্যুর পর তাঁর দ্বারা প্রতিষ্ঠিত মসজিদের উত্তরের প্রাঙ্গনে তাঁকে সমাহিত করা হয়। শাহদাউদ কুরায়শীর বংশধর চৌধুরীগন মাজারের ব্যায় নির্বাহের জন্য জমিদারী আমলে প্রচুর জায়গা দান করেন। তাঁর মাজারটি সম্প্রতি ডাঃ নিয়াজ আহমদ চৌধুরী ছাড়াও নির্মাণ কাজে যুক্তরাজ্যে কর্মরত শওকত আহমদ কুরায়শী, মিনহাজ আহমদ চৌধুরী, নাসির উদ্দীন আহমদ চৌধুরী, ইমাম উদ্দীন আহমদ চৌধুরী ও মঈন উদ্দীন কুরায়শী উল্লেখযোগ্য অর্থ সাহায্য করেন। দিলদার আহমদ(কচি), ইসফাক চৌধুরী, প্রকৌশলী মহিউদ্দীন ও ফকীহ উদ্দীন কুরায়শী, তাহমিদ কুরেশী, শামসুদ্দোহা চৌধুরীর ছেলে বদরুদ্দোজা কুরায়শী আরও অনেকে এ কাজের ব্যয়ভার বহন সম্পৃক্ত ছিলেন।
চিত্রঃ দরগাহে হজরত শাহদাউদ কুরায়শী (রহঃ)
দাউদপুর ইদগাহ
দাউদপুর জামে মসজিদ সংলগ্ন ইদগাহটি কয়েকশত বছর পূর্বে শাহদাউদ কুরায়শীর বংশধর পূর্ববাড়ি এবং মাঝের বাড়ির চৌধুরীগণ কর্তৃক দানকৃত জমির উপর প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কয়েক বছর পূর্বে এ ইদগাহটি শফি আহমদ চৌধুরীর আর্থিক সাহায্যে পাকা ও টালি করা হয়। ফলে এলাকাবাসীদের ইদের নামাজ পড়া অনেক সহজ হয়েছে।
দাউদপুর সিনিয়র মাদ্রাসা
অত্যন্ত সুপ্রাচীন ইসলামি শিক্ষা কেন্দ্র দাউদপুর সিনিয়র মাদ্রাসা। হজরত শাহদাউদ কুরায়শী(রঃ) তাঁর জীবদ্দশায় স্বীয় খানকায় যে ধর্মীয় মক্তব প্রতিষ্ঠা করেন তা যুগে যুগে বিবর্তিত হয়ে বর্তমানে দাউদিয়া গৌছউদ্দিন সিনিয়র মাদ্রাসা নামে বিদ্যমান রয়েছে। পূর্বকালে উক্ত মাদ্রাসাটি বর্তমান ঈদগাহের কাছে বিদ্যমান ছিল। পরবর্তীকালে ১৯২০ সালে বর্তমান ভবনে তথা আধুনালুপ্ত রেঙ্গা উচ্চবিদ্যালয়ের সন্নিকটে পূর্ববাড়ি প্রদত্ত জায়গায় নিয়ে আসা হয়। পূর্ববাড়ির সফিকুর রহমান চৌধুরীর পিতা মোঃ মোফজ্জিল চৌধুরীর স্বত্তাধীকারভূক্ত পৈত্রিক জায়গায় মাদ্রাসাটি স্থাপিত হয়। দাউদপুর মৌজার ৬৫৬৭ নং দাগে অবস্থিত মাদ্রাসার ভূমির পরিমান ২.৫৪২ একর। মাদ্রাসাটি ১৯৬০ সালে দাখিল ও ১৯৭৬ সালে আলিম অনুমোদন লাভ করে। বর্তমান আকারে মাদ্রাসাটি প্রতিষ্ঠায় শাহদাউদ কুরায়শীর(রঃ) বংশধর ইসহাক রাজা চৌধুরী, উমেদ রাজা চৌধুরী, আব্দুস সালাম চৌধুরী, সাইদুর রাজা চৌধুরী, মোঃ মোহতাছিন আলী চৌধুরী, খান বাহাদুর গৌছ উদ্দিন আহমদ চৌধুরী, আব্দুল জব্বার চৌধুরী ও আব্দুল মোজাফ্ফর চৌধুরী প্রমুখের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
উত্তর ভবন
তবে বাংলাদেশ সরকারের শিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালকের ৯/৪/১৯৯১ ইং সালের পরিদর্শন রিপোর্ট মাদ্রাসাটিকে আলিম পর্যায়ে অনুমোদনের তারিখ ১লা জানুয়ারি ১৮০০ ইং সাল বলে উল্লেখ করা হয়েছে। মাদ্রাসাটি প্রথমে প্রাইমারি মাদ্রাসা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং পরে পর্যায়ক্রমে দাখিল ও আলিম পর্যায়ে উন্নীত হয়। সাবেক ডিস্ট্রিক ম্যাজিস্ট্রেট মরহুম সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর উদ্যোগে বাংলাদেশ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ৩০/১০/১৯৭৯ইং সালের প্রজ্ঞাপন নং ১০/১ এম-২১/৭৯/৪৪ অনুসারে মাদ্রাসাটি “দাউদিয়া গৌছ উদ্দীন সিনিয়র মাদ্রাসা’ নামে অনুমোদন করা হয়।
প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে শাহদাউদ কুরায়শীর বংশধরগণ মাদ্রাসাটিকে জমি-জমা দান ও আর্থিক সাহায্য করে আসছেন। রক্ষিত দলিলাদিতে দেখা যায় যে, ১৮৯১ সালের ৯ নভেম্বর তারিখে শাহদাউদ কুরায়শীর দ্বাদশ বংশধর আবুল মুজাফফর চৌধুরী বিধবা স্ত্রী ফজিরা বানু ও তাঁর কন্যা ছফর চান্দ খাতুন ওয়াক্ফ্নামা পূর্বক সিলেট সদর থানার বিন্নাকান্দি মৌজাস্থ ২৭১২/১২ মুফতি মোহাম্মদ দায়েম ৬৯৬৮/৫ নং পাট্টা বনামে মেহের চান বানু ২১ একর ১০ শতাংশ জমি মাদ্রাসার নামে দান করেন। অন্য একটি দলিলে দেখা যায় যে, ১৩৩২ বাংলা সালের ১ শ্রাবণ মসদ্দর আলী, পিতা ইউনুস, গ্রামঃ গোপাল, পরগণাঃ রেঙ্গা ওয়াক্ফ্নামা করে ৪৯৩৭/১০৯ তালুক থেকে মিঠা ৪ কেদার ৪ জষ্টি ৬ পণ জমি মোহ্তছিন আলী চৌধুরীকে মোতাওয়াল্লি করে মসজিদের নামে দান করেন। এ দলিলে উল্লেখ করা আছে যে, মোহতছিন আলী চৌধুরীর অবর্তমানে ফজিরা বানু ও ছফর চান্দ খাতুনের ওয়াকফনামায় বর্ণিত মোতওয়াল্লি এক্ষেত্রে মোতাওয়াল্লি হবেন। পরবর্তীতে শাহদাউদ কুরেশীর ১২তম বংশধর পশ্চিম চৌধুরীবাড়ির মোহাম্মদ হোসেন চৌধুরীর নিঃসন্তান কন্যা আখতারুন্নেছা ১৫ জানুয়ারি ১৯২১ সালে রেজিস্ট্রিকৃত এক ওয়াকফনামায় ওয়াকফ সম্পত্তির আয় থেকে দাউদপুর মাদ্রাসা ও দাউদপুর জামে মসজিদের জন্য অংশ নির্ধারণ করে যান।
১৯৭৮/৭৯ সালে খান বাহাদুর গৌছ উদ্দীন আহমদ চৌধুরীর কনিষ্ঠ পুত্র শফি আহমদ চৌধুরীর আর্থিক সাহায্যে মাদ্রাসাটির একটি ভবনের নীচ তলা পাকা করা হয়। পরবর্তীতে খান বাহাদুর গৌছ উদ্দীন আহমদ চৌধুরী পঞ্চম পুত্র নাসির উদ্দীন আহমদ চৌধুরী ও দ্বিতীয় পুত্র নূর উদ্দীন আহমদ চৌধুরীর বিধবা স্ত্রী জেবুন্নেসা (শওকত আরা) চৌধুরীর আর্থিক সহায়তায় দালানটির দ্বিতীয় তলার কাজ সম্পূর্ণ করা হয়।
ইমাম উদ্দীন চৌধুরীর স্ত্রী মরহুম সুরাইয়া খাতুন তাঁর নিজস্ব চার কেদার জায়গা গ্রামের মাদ্রাসায় দান করেন। মাদ্রাসাটির সরকারি অনুমোদনের জন্য বাধ্যতামূলক প্রয়োজনীয় একলক্ষ টাকার ‘রিজার্ভ ফান্ড’ এর যোগান দিয়েছেন খানবাহাদুর গৌছ উদ্দীন আহমদ চৌধুরীর দুই পুত্র ইমামউদ্দীন আহমদ চৌধুরী (২,১৫,৩৯০ টাকা) ও শফিউদ্দীন আহমদ চৌধুরী (ত্রিশ হাজার টাকা)। মাদ্রাসা সম্প্রসারণ কার্যে উত্তরদিকের ভবন নির্মাণে আমার পিতা শফিকুর রহমান চৌধুরী ও আমার চাচা হাবিবুর রহমান চৌধুরী ২০০২ সালে ভূমিদান করেন। ২০১০ সালে মাদ্রাসার পাশে শওকত আহমদ কুরায়শী ও ২০১১ সালে বদরুদ্দাজা চৌধুরী কিছু জমি ক্রয় করে মাদ্রাসায় দান করেন।
২০১৮ সালে এই বংশের আইজিপি ই এ চৌধুরীর পুত্র রিয়াজ এ চৌধুরী প্রায় দেড় কোটি টাকা ব্যায়ে উত্তর ভবনের ২য় ও ৩য় তলা ও দক্ষিণ ভবনের ২য় তলা নির্মাণ করে দেন। বর্তমানে সাহিত্যিক ইসফাক কুরেশী এই মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা পরিবারের সদস্যের দায়িত্বে আছেন। এই মাদ্রাসায় এখন দেড় হাজার ছাত্রছাত্রী অধ্যয়ন করছেন।
সাধারণ শিক্ষা
বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিক পর্যন্ত এদেশের মুসলমান সমাজে ইংরেজি শিক্ষাকে ধর্ম বিরোধী বলে গণ্য করা হত। তৎকালীন প্রথা অনুযায়ী শাহদাউদ কুরায়শীর বংশধররাও তাঁদের সন্তানদেরকে ইংরেজি শিক্ষা থেকে দূরে রাখতেন। স্কুলে আরবি ফার্সি পড়ানো পরিশিষ্টে দ্রষ্টব্য। খান বাহাদুর গৌছ উদ্দীন আহমদ চৌধুরী এ বংশের প্রথম ব্যক্তি যিনি নিজে ইংরেজি এন্ট্রাস পর্যন্ত পড়াশুনা করেছিলেন। তাঁর ছয় পুত্রদের প্রত্যেককেই তিনি ইংরেজি শিক্ষার উচ্চ শিক্ষিত করেন। এর পূর্বে ইংরেজি শিক্ষা দূরের কথা, সাধারণ শিক্ষার জন্য এ গ্রামে কোন প্রাইমারি স্কুল পর্যন্ত ছিল না। ১৯২৫ ইংরেজি সনে খান বাহাদুর গৌছ উদ্দীন আহমদ চৌধুরী ও মোঃ মোহতাছিন আলী চৌধুরী দাউদপুরে সর্বপ্রথম একটি প্রাইমারি স্কুল প্রতিষ্ঠিত করেন। দাউদপুর সরকারি প্রাইমারি স্কুল নাম নিয়ে এ স্কুলটি এখনও বিদ্যমান আছে। একেই সময় তাঁর প্রচেষ্ঠায় দাউদপুর মাদ্রাসায় মাদ্রাসা শিক্ষা ছাড়াও মাধ্যমিক ইংরেজি মাদ্রাসা চালু করা হয়। পরবর্তীতে ১৯৪৫ সালে খান বাহাদুর গৌছ উদ্দীন আহমদ চৌধুরী ও তাঁর পুত্র ই.এ. চৌধুরীর উদ্যোগে তৎকালীন দাউদিয়া এম.ই.মাদ্রাসার পাশে রেঙ্গা হাইস্কুল নাম দিয়ে একটি ইংরেজি হাইস্কুল প্রতিষ্ঠা করা হয়। উল্লেখ্য যে, অবসরপ্রাপ্ত এয়ার কমোডর গাজী লুৎফুর রহমান এ স্কুলের প্রথম ব্যাচে ১৯৫০ সালে প্রথম শ্রেণিতে মেট্রিক পাশ করেন। কয়েক বছর পরে খান বাহাদুর গৌছ উদ্দীন আহমদ চৌধুরীর ইন্তেকাল এবং তাঁর পুত্ররা উচ্চ শিক্ষা এবং সরকারি চাকুরি ইত্যাদি কারণে সিলেটের বাহিরে থাকায় পৃষ্ঠপোষকতা ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাপনার অভাবে হাইস্কুলটি বন্ধ হয়ে যায়। রাখালগঞ্জ বাজারে অবস্থিত তাদের মূল্যবান জায়গাও গৌছউদ্দিন পরিবার রাখালগঞ্জ মাদ্রাসার ব্যায় নির্বাহের জন্য দান করে দেন।
জাপান বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ স্কুল
অধ্যাপক ডাঃ নিয়াজ আহমদ চৌধুরীর উদ্যোগে ও জাপান সরকারের সহায়তায় দাউদপুর ইউনিয়নের দাউদপুর গ্রামে তাঁদের মূল্যবান ২.২৫ একর মৌরসি জমিতে ১৯৯৮ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি জাপান বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ স্কুলটি স্থাপিত হয়। ডাঃ নিয়াজ আহমদ চৌধুরী জাপানে সার্জারিতে পি.এইচ.ডি কোর্স অধ্যায়নকালে তথাকার হামামাৎসু বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্ট প্রফেসর ডঃ কাওয়াসিমার সান্নিধ্যে আসেন এবং তাঁকে দাউদপুর গ্রামে গরিব ছেলেমেয়েদের শিক্ষার জন্য জাপানিদের সহায়তায় একটি স্কুল প্রতিষ্ঠার জন্য অনুপ্রাণিত করেন। প্রফেসর কাওয়াসীমা এ লক্ষ্যে তথাকার রোটারি ক্লাব এবং অন্যান্য কয়টি প্রতিষ্ঠানের দাতাদেরকে নিয়ে “জাপান বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ স্কুল” কমিটি গঠন করে অর্থ সংগ্রহ আরম্ভ করেন। আমাদের দেশে এ রকম বিদেশী সাহায্য এনজিও এর মাধ্যমে নেয়ার বাধ্যবাধকতা থাকার কারণে ডাঃ নিয়াজ আহমদ চৌধুরী বিদেশী সাহায্য এনজিও এর মাধ্যমে নেয়ার বাধ্যবাধকতা থাকার কারণে ডাঃ নিয়াজ এ চৌধুরী ডেভলাপমেন্ট অব রুরাল এরিয়াজ (সারা) নামে একটি এনজিও সংগঠন করেন এবং এই এনজিও’র মাধ্যমে স্কুল প্রতিষ্ঠার জন্য জাপানি সাহায্য আসতে থাকে। স্কুলটির জন্য খান বাহাদুর গৌছ উদ্দীন আহমদ চৌধুরীর পরিবারের সদস্যগণ দাউদপুর গ্রামে প্রায় ৩ একর মূল্যবান জমি দান করেন। জাপানিদের অর্থ সাকুল্যে এ জমির উপর একটি দু’তলা দালান নির্মাণের পর ১৯৯৭ সালের ২৬ ফেব্র“য়ারি বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের স্পিকার জনাব হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী স্কুলটি উদ্বোধন করেন। এ অনুষ্ঠানে প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী জনাব সাইফুর রহমান এমপিসহ কয়েকজন সংসদ সদস্য এবং জাপানের কয়েকজন দাতা উপস্থিত ছিলেন। স্কুলটিতে বর্তমানে দশম শ্রেণি পর্যন্ত সরকার অনুমোদিত শিক্ষা এবং পাশাপাশি ভোকেশনাল কোর্স চালু হয়েছে। জাপানের রাষ্ট্রদূত হারিসচি স্কুলের তৃতীয় তলা নির্মাণের জন্য ৫২ লক্ষ টাকা দেন। তাহাতে কম্পিউটার ল্যাব চালু হয়। অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমান স্কুল শিক্ষার্থীদের চিত্ত বিনোদনের জন্য একটি অডিটরিয়াম সরকারের কাছ থেকে নির্মাণ করান। এখানে কিন্টারগার্ডেন হতে এস এস সি পর্যন্ত পাঠদান করা হয়। বর্তমানে স্কুলে প্রায় এক হাজার ছাত্রছাত্রী অধ্যয়ন করছেন। বিদ্যালয়টি সূচনা থেকেই ভাল রেজাল্ট করে আসছে।
দাউদপুর হাসপাতাল ও স্বাস্থ্য কেন্দ্র
খান বাহাদুর গৌছ উদ্দীন আহমদ চৌধুরীর ব্যক্তিগত উদ্যোগে ১৯৪২ সালে দাউদপুর গ্রামে একটি সরকারী “সাবসিডাইজড” ডিসপেন্সারি প্রতিষ্ঠিত হয়। হাসপাতালের জন্য জমি দান ছাড়াও তিনি তাঁর বাড়িতে ডাক্তারের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। দেশ বিভাগের পর তদানিন্তন পূর্ব বাংলা সরকারের অধীনে এ জাতীয় হাসপাতালের জন্য কোন অনুমোদন না থাকার কারণে হাসপাতালটি বন্ধ হয়ে যায়।
পরবর্তীতে তাঁর কনিষ্ঠ পুত্র শফি আহমদ চৌধুরীর উদ্যোগে একই স্থানে দাউদপুর স্বাস্থ্য কেন্দ্র স্থাপিত হয়। এ স্বাস্থ্য কেন্দ্রের জমি খান বাহাদুর গৌছ উদ্দীন আহমদ চৌধুরীর বংশধররা সরকারের কাছে ন্যস্ত করেন এবং হাসপাতালের জন্য শফি আহমদ চৌধুরী নিজ ব্যয় পাকা ভবন নির্মাণ করে দেন। কয়েক বছর আগে সরকারি ব্যয়ে হাসপাতালের ভবন সংস্কার করা হয়েছে। বর্তমানে সরকারি খরচে এটা চালু আছে।
দাউদপুর চৌধুরীবাজার
মোহাম্মদ মোফজ্জিল চৌধুরীর পিতা আবু নসর চৌধুরী অনুমানিক ১৮০০ সালে দাউদপুর চৌধুরীবাজার প্রতিষ্ঠা করেন। উক্ত বাজার প্রতিষ্ঠায় দাউদপুর গ্রামের শাহদাউদ কুরায়শীর বংশীয় অন্যান্য যে সকল জমিদার জড়িত ছিলেন তাঁরা হচ্ছেন ইসহাক রাজা চৌধুরীর পিতা উমেদ রাজা চৌধুরী, আব্দুস সালাম চৌধুরীর পিতা সাইদুর রাজা চৌধুরী, মোঃ মোহতাছিন আলী চৌধুরীর পিতা ও খান বাহাদুর গৌছ উদ্দিন আহমদ চৌধুরীর প্রপিতামহ ইয়াকুব আলী চৌধুরী, আব্দুল জব্বার চৌধুরীর পিতা আব্দুল মোজাফ্ফর চৌধুরী প্রমুখের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। বর্তমান বাজার মসজিদ ও বাজার সংলগ্ন উত্তরের কবরগাহ পূর্ববাড়ির সফিকুর রহমান চৌধুরীর পিতা মোহাম্মদ মোফজ্জিল চৌধুরীর স্বত্তাধীকারভুক্ত ও প্রদত্ত জমির উপর প্রতিষ্ঠিত।
পূর্বকালে উক্ত বাজারটি বর্তমান দাউদপুর ঈদগাহের একপ্রান্তে স্থাপিত ছিল এবং নাম ছিল চৌধুরী হাট। আসলে বুড়িবরাক পারের এই চৌধুরীহাট ছিল কয়েক যুগ আগেকার বাজার। প্রাচীনকালে এখানে কেবল শুক্রবারে সাপ্তাহিক হাট বসত। পরবর্তীকালে বাজারটি বর্তমান স্থানে স্থানান্তরিত হয় ও চৌধুরীবাজার নাম ধারণ করে। জনাব ই এ চৌধুরী ও পরিচালক মনির উদ্দিনের প্রচেষ্টায় ১৯৮৭ সালে বাজারটিতে পূবালী ব্যাংক লিমিটেডের একটি শাখা স্থাপিত হয়। দাউদপুর ইউনিয়ন অফিসও এই বাজারে রয়েছে।
একটি বাজারকে নিয়ে আমার স্মৃতিবিজড়িত সনেট। আমার কাব্য "রমণীয় পৃথিবী" হতে দিলাম। এই চৌধুরীবাজারের পূবালী ব্যাংক শাখায় আমি ১৯৯৪ সালে ব্যবস্থাপক ছিলাম। ২১ বছর পর ২০১৫ সালে আমাকে আবার সেখানে ব্যবস্থাপক করে পাঠানো হয়। আমার শৈশব, কৈশর ও যৌবনের অনেক স্মৃতি এই বাজারকে ঘিরে রয়েছে।
"হৃদয়ে অমর রবে, প্রিয় তুমি, আমার বাজার,
শৈশবে গরম হতে হে বাজার, মোদের হল্লায়।
চানাচূর চকলেটে দু’পকেট ভরে দিতে প্রায়,
কৈশোরে চাস্টলগুলো, সেজে দিত, আসর আড্ডার।
ভোট এলে সংঘগৃহে পরামর্শ বসিত সবার,
ডাকঘর “চিঠি, চিঠি” প্রতিদিন ডাকিত আমায়।
শালিস দেখতে কত যাইতাম বিচার সভায়,
চেয়ে দেখি, কুড়িবর্ষ মিশে আছে, প্রতিপদে তার।
পূর্বপুরুষের গড়া, হে আমার, চৌধুরীবাজার,
তোমার নামের মাঝে আজো ফুটে, তাহাদের মুখ।
তোমার মাটিতে দেখি, স্মৃতিজলে তাহারা উম্মুখ,
প্রেমের বন্ধনে তুমি, বেঁচে রবে, হৃদয়ে আমার।
খুকি তুমি বড় হলে, হলে আজ এলাকার চোখ,
দাউদপুরের অঙ্গে তুমি প্রসারিত তার মুখ।"
দাউদিয়া হাফিজিয়া ও ক্বারিয়া মাদ্রাসা
ডাঃ আব্দুল হক চৌধুরী তাঁর মৃত্যুর কিছুদিন পূর্বে তাঁদের পারিবারিক কবরগাহ ও ঈদগাহের মধ্যবর্তী পৈত্রিক জমি দাউদিয়া হাফিজিয়া ও ক্কারিয়া মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার জন্য দান করেন এবং উক্ত দানকৃত স্থানে ২০০০ খ্রিস্টাব্দে মাদ্রাসাটি প্রতিষ্ঠিত হয়। সেইসাথে তিনি একলক্ষ টাকার একটি চেকও মাদ্রাসা নির্মাণের জন্য আমার পিতা সফিকুর রহমান চৌধুরীর নিকট প্রদান করেন। সফিকুর রহমান চৌধুরীর নেতৃত্বে এই মাদ্রাসার নির্মাণকাজের সূচনা ও সমাপ্তি হয়। বর্তমানে গ্রামবাসী ও মঈন উদ্দিন কুরায়শীর সহায়তায় মাদ্রাসাটি দ্বিতল নিজস্ব ভবনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আলমগির কুরেশী হাড়িয়ারচর মাঠে সি এন্ড বি সড়কের পাশে তের লক্ষ টাকায় ক্রয় করে এই মাদ্রাসায় ১৫ ডেসিমেল মূল্যবান ভূমিদান করেছেন।
লতিফা-শফি চৌধুরী মহিলা ডিগ্রি কলেজ
শফি আহমদ চৌধুরী এমপি ২০০২ সালে তার সুযোগ্যা সহধর্মিনী লতিফা চৌধুরীর নামে সিলেটের দক্ষিণসুরমা উপজেলা অফিসের এক কিলোমিটার দক্ষিণে সিলেট ফেন্ছুগজ্ঞ রোডের পূর্বপাশে ২.৫ একর ভুমিতে লতিফা শফি চৌধুরী মহিলা ডিগ্রি কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। কোলাহলমুক্ত মনোরম পরিবেশে এই কলেজটির অবস্থান। শফি আহমদ চৌধুরী এখানে অনেকগুলো বহুতল ভবন নির্মাণ করে দেন।
নবনির্মিত ছয়তলা দক্ষিণ ভবন
এক সময় এস. এস. সি পাস করে এলাকার মেয়েরা শিক্ষা হতে ঝরে যেত। উক্ত কলেজটি প্রতিষ্ঠার পর রেঙ্গা অঞ্চলের মেয়েরা সহজে উচ্চশিক্ষার সুযোগ পাচ্ছেন। মাত্র ১১ জন ছাত্রী নিয়ে দাউদপুর গ্রামে যাত্রা শুরু করা লতিফা-শফি চৌধুরী মহিলা ডিগ্রি কলেজে বর্তমানে দুই সহস্রাধিক ছাত্রী অধ্যয়ন করছেন। প্রতিষ্ঠার পর থেকে কলেজটি খুব ভালো রিজাল্ট করে আসছে। এখানে বিজ্ঞান, সমাজ বিজ্ঞান, বানিজ্য ও কলা অনুষদ চালু রয়েছে।
দাউদপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়
আবুল হাসান চৌধুরীর পিতা মহতাসিন আলী চৌধুরীর দানকৃত ভুমিতে তাদের বাড়ির সম্মুখে ১৯২৫ সালে বিদ্যালয়টি স্থাপিত হয়েছে।
বর্তমানে চৌধুরীগণের প্রচেষ্টায় বিদ্যালয়টি সরকারিকরণ করা হয়েছে।
শওকত কুরেশীর ভূমিদানসহ স্কুলটিতে চৌধুরীদের দুই কিস্তিতে দানকৃত ভূমির পরিমাণ ৪৫ ডেসিমেল।
ই এ চৌধুরী টেকনিক্যাল ইন্সটিটিউট
ই এ চৌধুরীর সুযোগ্য পুত্র রিয়াজ আহমদ চৌধুরী তাঁর মহান পিতার পবিত্র স্মৃতি রক্ষার্থে নিজস্ব অর্থে কেনা প্রায় চার একর ভূমিতে সম্পূর্ণ নিজ খরচে কলেজটি নির্মাণ করেন। কলেজের নির্মাণকাজ উদ্ভোধনের তারিখ ১৪ নভেম্বর ২০২০ খ্রিস্টাব্দ। এই মহতী অনুষ্ঠানে থাকার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। একটি সাদামাটা প্যান্ডেলে একটি ছোট্ট সভা হয়। রিয়াজ আহমদ চৌধুরীর সাথে আগত নির্মাণ প্রকৌশল টিম এবং রেঙ্গা অঞ্চলের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধানগণ সেই সভায় উপস্থিত ছিলেন।
দুইটি মোকাম প্রসঙ্গ
দাউদপুর পূর্ব চৌধুরীবাড়ির উত্তর প্রান্তে ছাইদ আহমদ এর মোকাম অবস্থিত। তিনি পূর্বকালে চৌধুরীবাড়িতে অবস্থান করে সুফি সাধনায় লিপ্ত ছিলেন। অনুরূপ পশ্চিমবাড়িতে একজন সুফি অবস্থান করতেন। উক্ত বাড়ির ভিতর তার মোকাম অবস্থিত। বর্তমানে চৌধুরী বাড়ির লোকজন মোকাম দু’টি তদারক করছেন।
ভূমি প্রশাসন ও রাজস্ব ব্যবস্থায় শাহদাউদ কুরায়শীর(রঃ) বংশীয়দের ভূমিকা
মুসলিম আমলের সনদে আমাদের আর্থ সামাজিক চিত্র পাওয়া যায়। রাষ্ট্রই সাধারণ সনদের মাধ্যমে গুণীজন ও হকদার মানুষকে জমি জমা দান করে ভূমি ও কৃষি ব্যবস্থায় সম্পৃক্ত করত। সনদ প্রাপক নিজেরা অথবা অন্যদের মাধ্যমে জঙ্গল পাহাড় কেটে আবাদ করতেন, চাষাবাদ করতেন। এভাবে অনেক লোক শ্রমশক্তি বিকাশে অবদান রাখত। অনেকে কৃষি কাজে নিয়োজিত হত। উৎপাদনশীল প্রক্রিয়ায় শামিল হয়ে কৃষি খাতে সৃষ্টিশীল ভূমিকা রাখতো অনেকে। তৎকালীন ভূমি ব্যবস্থায় কল্যাণকামী, সৃষ্টিশীল ও উৎপাদনমুখী একটি সমাজ ও রাষ্ট্রীয় কাঠামোর চিত্র পাওয়া যায়। সুফি দরবেশরা বা তাঁদের বংশধরেরা এবং বিভিন্ন মাজারের খাদিমেরাও সরকারি সনদের মাধ্যমে জমিজমার মালিক হতেন। তাঁরা জনগণকে বিশেষভাবে তাঁদের ভক্তদের নিষ্করপ্রাপ্ত পাহাড় জঙ্গল কেটে জনবসতি তৈরি ও ক্ষেত খামারে সম্পৃক্ত হতে উৎসাহিত ও পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। এভাবে নিরাশ্রয় অনেকে কেবল আশ্রয়ই পেত না, বিত্তহীন অনেকেই স্বচ্ছলতাও পেত। মুসলিম শাসনামলে তাই মানুষের কল্যাণে তথা জনগণের কল্যাণে নিবেদিত ছিল দেশের ভূমি ব্যবস্থা। সনদের মাধ্য বড় বড় ভূস্বামীরাও বাড়ি ও জমি জিরাত দান করে কল্যাণকামী উৎপাদনশীল ইতিবাচক ও সৃষ্টিশীল ভূমি ও কৃষি ব্যবস্থাকে সুসংহত করেছেন। হযরত শাহদাউদ কুরায়শী বংশীয়রাও এ প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত ছিলেন। এ বংশীয় আব্দুর রউফ চৌধুরী গং ১১৯৫ পরগণাতির ৫ প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত ছিলেন। এ বংশীয় আব্দুর রউফ চৌধুরী গং ১১৯৫ পরগণাতির ৫ আষাঢ় তারিখের (১৭৮৫খৃ:) এক সনদের মাধ্যমে রেঙ্গা পরগণার সলিমুল্লার পুত্র সেকনবুকে বারইগতি মৌজার প্রায় ছয় কেদার জমি মদদমাস দান করেন। এভাবে রেঙ্গার অনেক হিন্দু ও বহু সনদ লাভ করেন। ১২১০ বাংলায় (১৮০৩খ্রি:) ১নং তালুক কাজিম মুহম্মদ থেকে তিন হাল জমি মদদমাস সনদের উল্লেখ পাওয়া যায়। এর একপক্ষ ছিলেন রেঙ্গার ইয়াজ মং ও নাজিম মং এবং অপরপক্ষ ছিলেন গোলাম জকি মজুমদারের পুত্র আহমদ আলী। উল্লেখ্য যে, তখনও (১৭৮৫ খ্রি:) চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত (১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দ) হয়নি। ঐ সময়েও রেঙ্গার ভূস্বামীগণ ভূমি প্রশাসন ও ভূমি ব্যবস্থায় যে অবদান রাখেন তা প্রথমোক্ত সনদ থেকেই প্রমাণিত হয়। এ বিষয়ে বিস্তারিত তথ্যের জন্য দেওয়ান নুরুল আনওয়ার প্রণীত “শিলালিপি ও সনদে আমাদের সমাজচিত্র” অধ্যয়ন করা যেতে পারে। দাউদ কুরায়শীর(র.) বংশীয়রা যে কল্যাণকামী, সৃষ্টিশীল, ইতিবাচক, অসাম্প্রদায়িক ও উদার ছিলেন, তা উক্ত সনদ থেকে প্রমাণিত হয়। ১১৬০ সালের (১৭৫৪ খ্রিস্টাব্দ) এক অধিকারপত্রেও এরূপ প্রমাণ পাওয়া যায়। ঐ সময়ে রেঙ্গার জনৈক রামকৃষ্ণ তর্কবাগীশ বাইরে থেকে পন্ডিত হয়ে দেশে ফিরে আসলে এক অধিকার পত্র দান করে তাঁকে সম্মানিত করে অনুপ্রাণিত ও পৃষ্ঠপোষকতা করেন রেঙ্গার মুসলিম জমিদারেরা। এ অধিকার পত্রে সমকালীন বাংলার একটি চিত্রও ফুটে উঠেছে। এজন্য নিচে তা উদ্ধৃত করা হলো:
“ইআদিকীর্দ্দ শ্রী রামকৃষ্ণ তর্কবাগীশ সদাসয়েষু লীখিতং শ্রী পরগণে রেঙ্গার (মুসলিম) জমিদারবর্গ কস্য পত্র: মিদং কার্যাঞ্চআগে-তুমি পছিম হনে পড়িয়া পন্ডিত হৈআ তর্কবাগীশ উপাদ্ধি হৈআ আমার দেশত ঘর বান্ধিআ রহীছ এতে তুমার মর্জ্জাদা এই সকলে মীলিআ করিয়া দিলাম- আমার দেশের শূদ্র লোক জে আছইন এরা শ্রাদ্ধ বিবাহ কর্ণবেদ আদি যে কর্ম করিব সে পান দিতে রাজ পন্ডিতর ইখানে পান দিতে তুমার এক গাহা পান গুআ বার্তন দিব। আর শ্রাদ্ধ আদি কস্মিত আজ পন্ডিতরে দিতে তোমার একদান দিব। এ মান্যতা তোমারে করিআ দিলাম এরে যে না করে “শুভ না পায় এতর্থে পত্র দিলাম ইতি ১১৬০ সাল ১০ পৌষ।”
উদ্ধৃতিঃ দেওয়ান নূরুল আনোয়ার হোসেন চৌধুরীর 'শিলালিপি ও সনদে আমাদের সমাজ চিত্র'।
১৭৫৭ খ্রিষ্টাব্দে পলাশীর প্রান্তরে আমাদের স্বাধীনতা সূর্য অস্তমিত হয়। ১৭৬৫ সালে ইস্টইন্ডিয়া কোম্পানি দেওয়ানি লাভ করলে দেশের ভূমি শাসন ও রাজস্ব ব্যবস্থায় আসে নেতিবাচক পরিবর্তন। আস্তে আস্তে শক্তি বৃদ্ধি করে বেনিয়া ইংরেজ কোম্পানি বহু গুণে রাজস্ব বৃদ্ধি করতে থাকে। এদেশের মুসলমানেরা বিশেষত পরাধীনতা মেনে নিতে পারেনি। এরই অংশ হিসেবে মুসলিম ভূস্বামীরা বিশেষত অসহযোগ আন্দোলন শুরু করেন। আস্তে আস্তে তা ইংরেজ কোম্পানি বিরোধ প্রতিরোধ আন্দোলনে রূপান্তরিত হতে থাকে। সিলেটের ভূস্বামীরা এক জোট হয়ে ইংরেজশাসন বিরোধী এ প্রতিরোধ আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন।
শাহদাউদ কুরায়শীর(রঃ) বংশধরদের জমিদারীঃ
শাহদাউদ কুরায়শীর(রঃ) বংশধরগণ সিলেট অঞ্চলের বিশিষ্ট জমিদার ছিলেন। সুলতানি আমল ও মোগল আমলে বিভিন্ন সময়ে বাদশাহদের কাছ থেকে তাঁরা জায়গীর স্বরূপ বিস্তৃত ভূসম্পত্তি প্রাপ্ত হন। ১৭৯৩ সালে বৃটিশ আমলে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত আইনের আওতায় তাঁরা বেশ কয়েকটি তালুকের মালিক হন। রেঙ্গা পরগনায় তাঁদের তালুকগুলো নিম্নরূপঃ
১) ৪৮২৭/১ মাং রাজা, মোহাম্মদ আলী
২) ৪৮২৮/২ তানি মোহাম্মদ
৩) ৪৮২৯/৩ আব্দুল আজিজ
৪) ৪৮৩০/৪ আব্দুর রাজ্জাক, আব্দুর রহমান
৫) ৪৮৩১/৫ হাতিম মোহাম্মদ
৬) ৪৮৩২/৬ আনছার মোহাম্মদ
৭) ৪৮৩৯/১৩ হায়দর মোহাম্মদ
৮) ৪৮৪০/১৪ মোহাম্মদ বাসের
তাছাড়া দাউদপুর পশ্চিম বাড়ির ইয়াকুব আলী চৌধুরী বৈবাহিক সূত্রে খিত্তা পরগনার খ্যাতনামা জমিদার বাউল কবি হাসন রাজার ভগ্নিপতি গোলাম হায়দার চৌধুরীর বিরাট ভূসম্পত্তির মালিক হন। পূর্ববর্তী অধ্যায়ে এ সম্মন্ধে উল্লেখ করা হয়েছে। গোলাম হায়দার চৌধুরী ৮/৩ ছালেহ মোহাম্মদ ও ১০/৫ গোলাম মোহাম্মদ নামে দুইটি বিরাট তালুকের জমিদার ছিলেন। সিলেট সদর থানার মোলারগাও, বরইকান্দি, তেতলি, টোকেরবাজার ও সালুকটিকর ইউনিয়নসমুহ এ তালুক দুটির অন্তর্গত ছিল। সিলেট শহরস্থ বর্তমান লাক্কাতুড়া ও মালিনীছড়া চা বাগান ২টিও ছিল এই জমিদারীর অন্তর্গত।
কালের বিবর্তনে হজরত শাহদাউদ কুরায়শীর বংশধরদের জমিদারীর আয়তন সংকুচিত হতে থাকে এবং প্রজাসত্ত্ব আইন -১৯৫০ কার্যকরী হওয়ার পর ১৯৫৪ সালের দিকে দেশের অন্যান্য জমিদারীর ন্যায় শাহদাউদ কুরায়শীর বংশধরদের জমিদারীও সম্পূর্ণভাবে বিলুপ্ত হয়। দেশের প্রাচীন সামন্তব্যবস্থার অবসান হওয়ার সাথে সাথে দাউদপুর গ্রাম ছেড়ে এই বংশের লোকজন দেশ-বিদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে দ্রুত ছড়িয়ে পড়েন।
এ প্রসঙ্গে সিলেট বিভাগের তৎকালীন ১৯০১ সালের বিভিন্ন পরগনা সম্পর্কে নিম্ন বর্ণিত তথ্য উপস্থাপন প্রাসঙ্গিক হবে বলে মনে করিঃ
বর্তমান সিলেট জেলা
ক্র.নং
|
পরগনার নাম
|
মৌজা বা গ্রাম সংখ্যা
|
হাল আবাদি
|
একর
|
রাজস্ব টাকা
|
তালুক
সংখ্যা
|
১
|
কৌড়িয়া
|
২৭৮
|
৯৭৬
|
৪৮৫৯৯
|
১০৫৫
|
১৭৫৫
|
২
|
ঢাকা দক্ষিণ
|
৬৬
|
৭৩৬২
|
১৫৩৫৯
|
৫২৭৮
|
১৩২৭
|
৩
|
বরায়া
|
৪৫
|
৩৬৪৬
|
১৮৭৬০
|
৪৪৫৭
|
১০১৭
|
৪
|
বনভাগ (খালিসা)
|
৫৯
|
১৮৩৩
|
৮৩৭১
|
২৪৪০
|
১০৯৫
|
৫
|
রেঙ্গা
|
৬৫
|
৬০৪৭
|
৩০৮৬৮
|
৬৭৪২
|
৯৯১
|
করিমগঞ্জ
৬
|
পঞ্চখন্ড (কালা)
|
৮৯
|
৪২৩০
|
১৭৩৬১
|
৩১৩৫
|
১১৫৬
|
মৌলভীবাজার
৭
|
আলীনগর
|
২৮০
|
২৯০৩
|
৩৪৮৫১
|
৬৯৯০
|
১৩৭৬
|
৮
|
চৌয়ালিশ
|
৬৫
|
৭৮৩১
|
৪০৪২৮
|
১১১৭০
|
২৮১২
|
৯
|
লংলা
|
৫৬
|
১৪৮৫৩
|
৮২৬৪৭
|
১৪৮৯৯
|
৩৪৯২
|
১০
|
শমশেরনগর
|
২৭৫
|
৫২৮৮
|
৬৩৮৫০
|
১০৩৪০
|
১৯৮৯
|
হবিগঞ্জ
১১
|
তরফ
|
৬৩০
|
০
|
৫০৯৯৬
|
৪৪০০০
|
১৬০১
|
১২
|
বানিয়াচং
কসবা
|
৩২২
|
৩২০২৪
|
১০৬৮৭৬
|
১০৮৬৫
|
৩৫৮৫
|
১৩
|
বেজোড়া
|
১০২
|
৯৬৬১
|
৫২৩৫৬
|
৩০৭৬
|
১২৯৪
|
১৪
|
মান্দারকান্দি
|
২৩
|
১২২৭
|
৮০৫৮
|
১৫১৯
|
১৩১৩
|
১৫
|
বানিয়াচং
|
৩১৪
|
২২০৯৫
|
১০৮৩৫৬
|
৩৮৩১
|
১৭০
|
উপরোক্ত তথ্য থেকে প্রতীয়মান হয় যে, রেঙ্গা পরগনার অবস্থান তালুক সংখ্যার দিক দিয়ে বর্তমান সিলেট বিভাগে ৫ম স্থান হলেও রাজস্বের দিক থেকে প্রথমস্থানে ছিল। হাল আবাদী ও একরের হিসাবে দ্বিতীয় স্থানে এবং মৌজা বা গ্রাম সংখ্যা হিসাবে ছিল তৃতীয় অবস্থানে।
সিলেট বিভাগে তালুক সংখ্যার দিক রেঙ্গা পরগনা ১৪তম স্থানে ছিল। কিন্তু রাজস্বের হিসাবে ছিল সপ্তম স্থানে। এ পরিপ্রেক্ষিতে ১৯০১ সালে সিলেট বিভাগে রেঙ্গা পরগনা এক গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে ছিল বলে প্রতীয়মান হয়। ১৭৮০ সালের সিলেট প্রদেশের কয়েকটি পরগনার রাজস্ব তালিকা থেকেও সিলেট বিভাগে রেঙ্গার গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান লক্ষ্য করা যায়।
সূত্রগ্রন্থ:দেওয়ান নূরুল আনোয়ার হোসেন চৌধুরীর "হজরত শাহদাউদ কুরায়শী ও তাঁর বংশধরগণ"। প্রকাশঃ ২০০০ সাল।
দাউদপুর চৌধুরীপরিবারে সংরক্ষিত প্রাচীন দলিল-দস্তাবেজ এবং কুষ্টিনামা।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন