গরীবের অপমৃত্যু; সে এক ভয়ঙ্কর ব্যাপার। হত্যাকারীরা তদ্বির পার্টির হাতে দায়িত্ব দিয়ে পালিয়ে যায়। পুলিশ এসে ঠেলাগাড়ী করে ফরিদের লাশ নিয়ে আসে মর্গে। মেঝেতে পড়ে আছে লাশটা, জখমগুলোতে উঠে আসে অজস্র কালো পিঁপড়ে।
হাসপাতাল
ও থানায় যথারীতি চলে যায় প্রভাবশালীদের ঘুমের ওষুধ। এত বড় একটা হত্যাকান্ডকে গুম করে দেবার অপচেষ্টা। গোপনে লাশ নিয়ে দাফন করা হয় মানিক পীরের টিলায়। ক্ষুধা, রোগব্যাধি জীবানুর রিরুদ্ধে যুদ্ধ করে যে ফরিদ বেঁচে গিয়েছিল, সে ফরিদ মানুষ নামক কিছু সংখ্যক বিষাক্ত জীবানুর হাত হতে নিজেকে রক্ষা করতে পারলনা। যুদ্ধে হারিয়ে গেল সে। পিছনে পড়ে রইল জামিলা, কুড়েঘরের মাটিতে কান্নায় লুটিয়ে পড়ল ওর মা-বাবা, ভাইবোন। ওদের সামনে আজ এক অমাবশ্যার সীমাহীন কালো রজনী।
বস্তির ছেলে ফরিদ। সে আর ফিরে আসেনি শৈশব ও কৈশোরের নীল স্মৃতিঘেরা বরইকান্দির নোংরা কর্দমাক্ত বস্তির সেই সাধের কুড়েঘরে।
শহরতলীর এক স্যাঁতস্যাঁতে দুর্গন্ধময় অস্বাস্থ্যকর বস্তি এলাকায় একদিন জন্ম নিয়েছিল ফরিদ। বিশ পঁচিশটি ছোট্ট ছোট্ট কুঠরীতে বিভক্ত একটা লম্বা মাটির কুড়েঘর। কক্ষগুলোকে পরস্পর পৃথক করেছে বাঁশবেতের বেড়া। ফাঁক দিয়ে দেখা যায় অন্য কোঠার আদিঅন্ত। পত্রিকা এঁটে ফাঁক বন্ধের ব্যর্থ প্রচেষ্টা সর্বত্র। প্রতিটি কোঠায় রয়েছে একটি করে রান্নার চুল্লী। একই কোঠায় রান্না-বান্নাসহ গাদাগাদি করে ঘুমিয়ে থাকে বস্তির গরীব মানুষগুলো। একটিমাত্র কাঁচা পায়খানা। প্রতিদিন সকালে বদনা হাতে লাইনে দাঁড়ায় বস্তির নরনারীরা। পায়খানার ময়লা গিয়ে পড়ছে রেলের খালে। আবার এই খালের পানিতেই সুসম্পন্ন হচ্ছে বস্তিবাসীর ধোয়া মোছা, পান, আহার। চিকিৎসা শাস্ত্রের বিধিমতে এ পানি পান করে মানুষ বেঁচে থাকার কথা নয়। অথচ আজন্ম জীবানুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে কবে ওদের পাকস্থলী এতই শক্তিশালী হয়ে যায় যে নির্দ্ধিধায় হজম করে ফেলে সব ধরনের বিষাক্ত জীবানু যেন কাউয়ার পেট।
এই নোংরা ও বিশ্রী পরিবশে হেসে খেলে কেটে যায় ফরিদের শৈশব। সে দেখেছে এই বস্তির পাশ দিয়ে যাবার সময় কিভাবে ভদ্রলোকেরা নাকে রুমাল টেনে দেয়। সপ্তাহে একদিন আসে রহিম মিয়া। বস্তির মালিক, যদিও বস্তিটির অবস্থান রেলওয়ের সরকারি জায়গায়। ষণ্ডা মার্কা লোক। ঠোঁটে গোফের প্রকাণ্ড আঁটি। হাতে লাঠি নিয়ে বস্তিতে আসে লোকটি। সাথে সাথে সবাইকে সালাম দিয়ে দাঁড়াতে হয় রহিম মিয়ার সামনে। সাপ্তাহিক ভাড়া সত্তর টাকা দিয়ে দিতে হয় তখনই। এই বস্তির বেশীর ভাগ মানুষই রিকসা চালক। বাইরের জেলাগুলো থেকে এসেছে এসব ছিন্নমূল মানুষ। বাঁচার তাগিদে রিকশা টানে সিলেট শহরে। যার সংসারে লোকজন বেশী, প্রতিদিন দেড়বেলার চাল জোগাড় সম্ভব হয় না, ভাড়াও সত্তর টাকা রেডি রাখতে হয়, নতুবা রহিম মিয়া লাঠি হাতে তেড়ে আসে যেমন অবাধ্য গরু তাড়িয়ে নিয়ে যায় ক্ষিপ্ত রাখাল বালক।
এই নোংরা ও বিশ্রী পরিবশে হেসে খেলে কেটে যায় ফরিদের শৈশব। সে দেখেছে এই বস্তির পাশ দিয়ে যাবার সময় কিভাবে ভদ্রলোকেরা নাকে রুমাল টেনে দেয়। সপ্তাহে একদিন আসে রহিম মিয়া। বস্তির মালিক, যদিও বস্তিটির অবস্থান রেলওয়ের সরকারি জায়গায়। ষণ্ডা মার্কা লোক। ঠোঁটে গোফের প্রকাণ্ড আঁটি। হাতে লাঠি নিয়ে বস্তিতে আসে লোকটি। সাথে সাথে সবাইকে সালাম দিয়ে দাঁড়াতে হয় রহিম মিয়ার সামনে। সাপ্তাহিক ভাড়া সত্তর টাকা দিয়ে দিতে হয় তখনই। এই বস্তির বেশীর ভাগ মানুষই রিকসা চালক। বাইরের জেলাগুলো থেকে এসেছে এসব ছিন্নমূল মানুষ। বাঁচার তাগিদে রিকশা টানে সিলেট শহরে। যার সংসারে লোকজন বেশী, প্রতিদিন দেড়বেলার চাল জোগাড় সম্ভব হয় না, ভাড়াও সত্তর টাকা রেডি রাখতে হয়, নতুবা রহিম মিয়া লাঠি হাতে তেড়ে আসে যেমন অবাধ্য গরু তাড়িয়ে নিয়ে যায় ক্ষিপ্ত রাখাল বালক।
বাইরে এত বিশাল পৃথিবী ও ফাঁকা জায়গা থাকা সত্ত্বেও এই ছিন্ন মূল মানুষগুলোর কিছুই নাই। সর্বত্র প্রসারিত হয়ে আছে বর্জুয়ার কালো হাত। তাইতো কোনমতে গাদাগাদি করে মানুষগুলো বাস করে এই অন্ধকার, জীবনহীন সংকীর্ণ জগতে। আবার এই নোংরা জগতটার মালিকানাও ওদের নয়। মালিক রহিম মিয়ারা। একদিন ফরিদের বাবা পুরো ভাড়া রেডি রাখতে পারেনি। তিরিশ টাকা হাতে দিয়ে বলেছিল, সাহেব, মাফ কইরেন, আগামী সপ্তাহের ভাড়ার সঙ্গে বাকী চল্লিশ টাকা পরিশোধ করে দেবো। কিন্তু লোকটা দৌঁড়ে ঢুকে পড়ে ওদের ঘরে। চীৎকার করে বলে উঠে, বের হো আমার ঘর হতে। শালার বেটা, ঠিকমত ভাড়া না দিয়ে থাকতে পারবে না ওখানে। বলেই ওদের কাঠের বাক্স, কাপড়-চোপড়ে টানাটানি শুরু করে দেয় লোকটা। ফরিদের মা-বাবা জড়িয়ে ধরে ওর পা, সাহেব আমাদেরে বের করে দিলে হঠাৎ আমগো যামু কোথায়? শেষ পর্যন্ত বাবা-মাকে ধমক দিয়ে চলে যায় লোকটি। সে দিন হতে ফরিদ ভয় পেত রহিম মিয়াকে। রহিম মিয়া বস্তিতে ঢুকলেই দুরু দুরু করে কাঁপতো ওর বুক।
এই বস্তির মেয়ে-মানুষগুলোর বছর-বছর বাচ্চা হয়, মারাও যায়। হিসেব নিলে দেখা যায় প্রতিটি পরিবারে তিন চারটি শিশু মারা যাবার পর সৌভাগ্যক্রমে দুটি একটি টিকে যায়। ফরিদটা এমনই এক হতভাগা। তাইতো চালচুলোহীন মা-বাবার সব স্নেহ এসে পড়েছিল ওর উপর। শৈশবে রোগ বালাই অনেক সময় ওকে মুমূর্ষু করেছে কিন্তু হয়ত ওর মা-বাবার কথাটা স্মরণ করে ওকে নিয়ে যায় নাই। একবার ডায়রিয়া হয়ে সে মরতে বসেছিল। হাতুড়ে আখন ডাক্তারের দয়ায় সেই মরণযাত্রায় সে রক্ষা পায়। লোকটা দয়ালু। একটা ছেলেকে নির্ঘাত মৃত্যুপথযাত্রী দেখে সে একটা স্যালাইন গ্যাঁথে দেয়, টাকা চায়নি। অবশ্য অনেক কষ্টে বাবা সেই ঋণ পরিশোধ করেছিলেন। মড়কের উচ্ছিষ্ট সন্তানটির প্রতি নিঃসম্বল বাবা-মার যতন ছিল প্রচুর। একটু সর্দি কাশি হলেই টেকনিকেলের সামনের ডাক্তার বাবুর কাছ থেকে দুই টাকার পুরিয়া নিয়ে আসতেন। চর্মরোগ হলে ফুটপাতের ডাক্তারের কাছ হতে নিয়ে আসতেন ইন্ডিয়ান বাম। তবুও মাঝে মধ্যে ওর সারাটা শরীর পঁচে যেত। যন্ত্রনায় অস্থির হয়ে উঠতো, তবুও সে মরতনা। এভাবে সে টিকে যায় এই যন্ত্রনাময় জগতে।
শৈশবে বর্ণমালার বই কিনে দিয়েছিল ওর বাবা। বেশ কিছুদিন প্রথম শ্রেণীতে সে অধ্যয়নও করেছিল রেলওয়ে পাঠশালায়। ময়লা কাপড় পড়া অগোছালো ফরিদকে ঘৃণা করত সহপাঠীরা সবাই। কেউ কাছে বসতে চাইত না। তাই পিছনের ভাঙ্গা বেঞ্চিতে একাকী বসে থাকত সে। স্যারের ধমক ও বেত্রাঘাত তাকে ভীত করে দিত। তার উডুউডু মন স্কুলে বসতনা কোনমতে। পাঠশালা পড়ার শখ তাই মিঠে যায় বছর দেড়েকের মধ্যেই।
হঠাৎ বাবার কঠিন রোগ হয়। আগের মত রিকশা টানতে পারতেন না তিনি। এদিকে সংসারের খরচটাও বেড়ে যায় অনেক। মায়ের শরীরটাও ভাল থাকত না কোনদিন। অভুক্ত ঘরে বসে থাকার চেয়ে একটা কিছুতে নেমে পড়া দারুন প্রয়োজন। তাই তাকে এ বয়েসেই নেমে পড়তে হয় জীবিকার সন্ধানে বাঁচার সংগ্রামে।
বিনাপূঁজির এক ব্যবসায় নেমে পড়ে সে। কীন ব্রীজের মুখে রিকশা ঠেলা। দুর্বল শিশু বলে কেউ তাকে ডাকত না। তাই এক টাকার পরিবর্তে “ঠেলা আট আনা ঠেলা আট আনা” বলে চীৎকার করতে হত তাকে। একজন যাত্রী হলে ঠেলতো একাকী, যাত্রী সংখ্যা বেশী হলে শরীক করত আরেক ছিন্নমূল শিশুকে। এভাবে প্রতিদিন বিশ, পঁচিশ টাকা রোজগার করে এনে দিত বাবার হাতে। ‘ঠেলা লাগবে সাহেব’- বলে হয়ত ঠেলাতে শুরু করত সে কোন রিকশায়, যাত্রী গোমরামুখী ভদ্রলোক কথা বললেন না। প্রাণান্ত কষ্ট করে সে যখন রিকশাকে নিয়ে গেল গন্তব্যে অমনি গর্জে উঠলেন ভদ্রবেশী যাত্রী “কে তকে ঠেলতে বলেছে, যা পয়সা পাবি না।” দর কষা-কষি করলেই গালে এসে পড়ে চপেটাঘাত। আশপাশের মানুষগুলোও তাই। ওদের ধারনা ফরিদেরা মানুষ নয়, ইতর শ্রেণীর জীব জানোয়ার। কাজেই দোষ সব ওদের। এমনি চপেটাঘাত আর মানুষের ঘৃণাকে পুঁজি করে এগিয়ে যেতে হয় তাকে। পৃথিবীর তাবৎ ভদ্রলোক সম্পর্কে ফরিদের ধারণা- ওরা মানুষ হয়ে মানুষকে জুরে খাটাতে জানে, দিতে জানেনা কিছু। তবুও সস্তাদরে অমানুষিক খাটতে হয় তাদের, কেবলমাত্র বেঁচে থাকার জন্যে।
যে বয়সে ছেলে মেয়েরা স্কুল ড্রেসে সুসজ্জিত হয়ে স্কুলে যায়, সারাদিন মেতে থাকে আনন্দে আর হৈ হল্লায়, সে বয়সে ফরিদের ঘাম ঝরতো ক্বীনব্রীজে। বৃষ্টিতে ভিজে, রোদে পুড়ে তার পিটের মেরুদন্ড কাত হয়ে আসত। অধিক পরিশ্রমে ক্ষুধায় জ্বলে উঠতো পেঠ। ফুটপাতের পঁচা বিস্কুট অথবা রাস্থার আট আনা দামের বাসি রুটি খেয়ে গলগল করে পান করত টিউব ওয়েলের পানি। তারপর চীৎকার ‘লাগবে নি সাহেব, ঠেলা আট আনা।’ হাড় পানি করা আধুলি, ওগুলো বাঁচাতে হবে তাকে, তুলে দিতে হবে বাবা-মা ভাইবোনের মুখে ক্ষুধার অন্ন। তাইতো এই আধুলি গুলোর বড় প্রয়োজন তার। দুর্বলের ধর্ম অভিশাপ দিয়ে সরে পড়া। তাইতো কেউ ওকে ঠকালে ঝগড়া করত। চপেটাঘাত খেয়ে খোদার গজবের অভিশাপ দিয়ে সরে পড়ত আরেক ঠেলার সন্ধানে।
ঠোঁটে গোফের কালোরেখা ঈষৎ দেখা দিতে না দিতেই তাকে উঠতে হয় রিকশায়। বাবা এখন পুরোপুরী শয্যাশায়ী। অভাবের সংসার। ঘরে শান্তি নেই। সারাদিন বাবা পড়ে থাকে বস্তিতে। অন্য আর দশ-পাঁচটা অভাবী দম্পতির মত সারাদিন বাবা-মায়ের অর্থনৈতিক ঝগড়া একদম ভাল লাগে না ফরিদের। ছোট ছোট অর্ধ-ন্যাংটা ভাইবোনেরা সবকিছুর জন্য আবদার জানায় ফরিদকে। এতটুকুন বয়সে রিকশা চালক সে। রিকশা ভালভাবে টানতে পারবে কিনা এই ভয়ে স্বার্থপর যাত্রীরা সহজে উঠতে চায়না ওর রিক্সায়। চুন হতে পান খসলেই তাকে খেতে হয় ট্রাপিক পুলিশের মারধোর। খেতে হয় বখাটে যাত্রীদের চড়, থাপ্পড়। পেটের জ্বালা ভীষম জ্বালা, এই পেটের তাগিদে সবই হজম করতে হয় তাকে। মাঝে মধ্যে ইচ্ছে হয় রিকশা ছেড়ে ভাল কিছুতে চলে যাবার। কিন্তু কই কাজতো নেই। কে দেবে কাজ তাকে, সে যে নিঃসহায়। তাইতো ঐ পৈত্রিক পেশায় নেমে পড়েছে সে। বাবার মত হয়ত সারাটা জীবন ঐ তিচক্রযান টানতে হবে তাকে। ফরিদের আদৌ ভাল লাগেনা এ পেশা, লোকজন ভাবে যে মানুষটা কাঁধে করে মানুষ বয়ে নিয়ে যায়, সে যেন মানুষ নয় মধ্যযুগের ভারবাহী জন্তু জানোয়ারের নতুন সংস্করন, অর্থাৎ ওরা আধুনিক যুগের দ্বিপদ ভারবাহী জীব-জানোয়ার। এযুগের কেনা গোলাম।
ফরিদের চোখে মাঝে মধ্যে ব্যতিক্রমও ধরা পড়ে। সব মানুষ সমান হয় না সর্বত্র। কেউ কেউ অত্যন্ত দয়াবান। পকেট থেকে বের করে দেয় বড় নোট। ফেরত নেয় না, মনে হয় হাওয়ায় টাকা উড়ায়। ফরিদ ভাবে বিচিত্র এ সিলেট শহর, আর বিচিত্র এ শহরের মানুষ গুলো, কেউবা দয়ার সাগর, কেউ বা পাষান পাতর।
কোমরে গামছা বেঁধে সারাদিন কাজ করে যায় ফরিদ। এত সংগ্রাম, এত পরিশ্রমের পরও সে মেটাতে পারতনা সংসারের প্রয়োজন। ঘরে ছিলনা সুখ। রাতে ঘরে এলে অশান্তি, হয় মা-বাবার ঝগড়ার ফিরিস্তি, ভাইবোনের নিত্যনতুন আবদার। এসব শুনতে শুনতে ডালভাত গলাধঃকরণ করে ধূলাময় চৌকিতে একসময় গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন হয়ে যেত সারাদিনের পরিশ্রান্ত ফরিদ।
হরতালের দিনে ভদ্রলোকেরা হরতাল করেন, আর না খেয়ে পড়ে থাকতে হয় বস্তিবাসীকে। বের হলেই কেটে দেয় রিকশার চাকা- মরার উপর খাড়ার ঘঁ। ডানে হরতালকারী ভদ্রলোকেরা, বামে রিকশা মালিকের লাল চোখ, মধ্যভাগে অভুক্ত হয়ে পড়ে থাকে কিছু মানবসন্তান। দেশে কোন গণ্ডগোল হলেই এর সবচেয়ে বড় আঘাত এসে পড়ে এই নিঃসহায় মানব গোষ্ঠীর উপর। দেশ ও দশের প্রেমিক সবাই, লম্বা-লম্বা বক্তৃতা দেয় মাইকে অথচ এসব মানুষের কথা এক বিন্দুও ভাবে না কেউ। ওরা মরে যাচ্ছে, না বেঁচে আছে- তা নিয়ে কারো যেন কোন মাথা ব্যাথা নেই।
ঐ বস্তিরই ডাগর চোখের মেয়ে জমিলা। নাদুস-নুদুস শ্যামলা এই মেয়েটি যৌবনের সাজে সুসজ্জিত হয়ে রঙ্গ লাগিয়ে দেয় ফরিদের মনে। ওর বাবা মোমেনসিংহী, রিকশা চালায়। বাড়ন্ত মেয়েকে নিয়ে মনে মনে বড়ই আতংকিত বাবা। মেয়ের বিয়ে দেবে, ভাল বর পাবে কোথায়? কারণ ওরা জানে সম্বলওয়ালা কোন ভদ্রলোক ওদের মেয়ে নিতে আসবে না। তবে যারা আসে পরে দেখা যায় ওরা সবাই বদমায়েশ, মদ্যপ, বিয়ে নেশাগ্রস্ত অর্ধবুড়ো লম্পট। শাঁস খেয়ে আস আবার ছুড়ে ফেলে বস্তিতে। অকালে নষ্ট হয় মেয়েদের জীবন। আসলে দেহ ছাড়া আর কোন সম্বল নেই ঐ বস্তির লোকগুলোর। ওরা খুঁজে কায়িক শ্রমে অভ্যস্ত সুস্থ সবল বর। আর কিছু দেখার বড় প্রয়োজন অনুভব করে না তারা। সহায়সম্বলহীন ফরিদ ছিল কঠোর পরিশ্রমী তাগড়া জোয়ান। কাজেই বড়শীতে মাছটা লাগবে সুনিশ্চিত।
একদিন জামিলার মায়ের কাছে কথাটা ব্যক্ত করে ফরিদ- চাচিজি, জামিলাকে নিয়ে ভাববেন না, আগে ভাগে জানিয়ে রাখলাম, আমিতো আছিই। জামিলার বাবার কানে কথাটা পৌঁছা মাত্রই সানন্দে রাজী হয়ে যায়। যুবতী মেয়েটাকে নিয়ে বাবা মায়ের চিন্তার সীমা ছিলনা। একটা গতি হয়েছে ভেবে মনে মনে দারুন আনন্দিত হয় তারা। জামিলার বাবা একদা ফরিদকে ডেকে নিয়ে বলল- তোমার কাছে আমাদের মেয়েটাকে তুলে দিয়ে নিশ্চিন্ত হতে চাই বাবা, তোমার মত কী? বিয়ের খরচ টাকা হাজার পঞ্চাশেক তো লাগবেই। পাখির নীড়ে বাচ্চারা যেমন অধীর আগ্রহ ভরে অপেক্ষা করে মায়ের, যে মা ক্ষুধায় মুখে পুরে দেয় খাদ্য, তেমনি ফরিদের অপেক্ষায় বসে থাকে বস্তির কুড়ে ঘরে ওর সংসারের ছয় সাতটা প্রাণী। যাদের মুখে বহুকষ্টে অন্ন দান করে ফরিদ। কাজেই কেমন করে তার হাতে জমা হবে এত টাকা। সাহেবদের মানিব্যাগে দেখেছে, কিন্তু হাজার টাকা একসাথে কোনদিন উঠায়নি সে হাতের মুঠোয়। তবে সে কথা দিল দু-তিন মাসের মধ্যে আস্তে আস্তে জমাবে বিয়ের খরচ। তারপর বস্তিবাসীকে নিয়ে ধুমধামের সঙ্গে ঘরে নিয়ে আসবে নববধূ জামিলাকে।
অমানষিক পরিশ্রম শুরু করে দেয় ফরিদ। সংসারে রেশন কমিয়ে দেয়। একটা আধুলিও জমাতে চায় সে। মা-বাবা হঠাৎ ফরিদের এই পরিবর্তন দেখে বিষ্মিত হয়। মাঝে মধ্যে তাদের সাথে ঝগড়াও হয় ফরিদের। মা-বাবা যথেচ্ছা বকুনী দেয় ওকে। তবে মুখ ফুটে লজ্জায় প্রকৃত ঘটনা বলতে পারেনা সে ।
জামিলার রঙ্গে মন রাঙ্গিয়ে অনবরত রিকশা টানে ফরিদ। তার একটাই স্বপ্ন, সে স্বপ্ন জামিলা। একটা একটা করে তাকে হাজার টাকায় পৌছুতে হবে সত্ত্বর, নয়তো অন্য কেউ কেড়ে নেবে জামিলাকে।
সেদিন শুক্রবার। তিনটা মস্তান প্রকৃতির লোক এসে রিকশায় রিং বাজায়। ক্লান্ত ফরিদ পথের ধারে গাছের ছায়ায় বসে বিশ্রাম নিচ্ছিলো। রিকশা টানার আদৌ ইচ্ছে ছিল না তার। এই রিকশা যাবে? না টিপ আছে সাহেব। যেতে হবেই তোকে। দোকান যখন মেলেছিস, বেসাত তোকে করতেই হবে।’- বলে বলপূর্বক রিকশা টানতে বাধ্য করে তাকে, নিয়ে যায় মাহাজন পট্টির একটি মার্কেটে। একেতো তিনজন, তদুপরি ছয় টাকার নায্য ভাড়ার বদলে মাত্র দুটাকা দিয়ে সরে পড়তে চায় তারা। জামিলার স্বপ্নে বিভোর ফরিদ মাস্তানকেও একটা টাকা ছাড় দিতে রাজী নয়। সে কী সাহস, জামিলা যেন ওকে যাদু করেছে। যে যাদু ভীরু ফরিদকে করে ফেলে অনেকটা নিঃশঙ্কচিত্ত। গর্জে উঠে ফরিদ, “খবরদার, পুরো ভাড়া না দিয়ে এক পা ও এগুবেন না বলছি।” কি করবি তুই, বলে সাথে সাথে লোকগুলো এসে মারতে উদ্যত হয় ফরিদকে, ফরিদও অন্ধ হয়ে যায়। কথা কাটাকাটির ফাঁকে হাতের কাছের বাঁশ দিয়ে ভীষণ ভাবে আঘাত হানে একটা মস্তানের মাথায়। মাথা ফেঁটে রক্ত ঝরা শুরু হয়। মুহুর্তের মধ্যে আরও কিছুলোক যোগ দেয় মস্তানদের সাথে। টানা হেঁচড়া করে তাকে ঢুকায় একটা গুদাম ঘরে। চোরের মত পেটাতে পেটাতে অভুক্ত পরিশ্রান্ত ফরিদকে অজ্ঞান করে ফেলে। নাক, মুখ দিয়ে রক্ত ঝরতে থাকে তার। শৈশবকাল থেকে ফরিদ মাথার ঘাম পায়ে ফেলেছে। অথচ কোনদিন কারো কাছে হাত পাতেনি, চুরি করেনি, এমন নিষ্ঠুর মারধরের শিকারও হয়নি কোনদিন। দুটি চোখ বুজে আসে তার, জ্ঞান হারিয়ে ফেলে একসময়। এতকিছুর পরও যেন তার পাপের প্রায়শ্চিত্ত হলনা। ও মরার ভান করছে- বলাবলি করতে থাকে জালেমের দল। মৃত্যুপথযাত্রী ফরিদের সারাশরীরে পড়তে থাকে অজস্র লাথি-কিল-ঘুষি। ফরিদের প্রাণপাখি টিকতে পারলনা জগতে, উড়ে গেল নিঃসম্বল দেহটা ফেলে, এই কঠিন পাষান পৃথিবীর ক্ষণকালের মেহমানখানাকে সালাম জানিয়ে। সালাম পৃথিবী, হাজার সালাম।
রচনাকালঃ ১৯৮৬ খৃস্টাব্দ
সেদিন শুক্রবার। তিনটা মস্তান প্রকৃতির লোক এসে রিকশায় রিং বাজায়। ক্লান্ত ফরিদ পথের ধারে গাছের ছায়ায় বসে বিশ্রাম নিচ্ছিলো। রিকশা টানার আদৌ ইচ্ছে ছিল না তার। এই রিকশা যাবে? না টিপ আছে সাহেব। যেতে হবেই তোকে। দোকান যখন মেলেছিস, বেসাত তোকে করতেই হবে।’- বলে বলপূর্বক রিকশা টানতে বাধ্য করে তাকে, নিয়ে যায় মাহাজন পট্টির একটি মার্কেটে। একেতো তিনজন, তদুপরি ছয় টাকার নায্য ভাড়ার বদলে মাত্র দুটাকা দিয়ে সরে পড়তে চায় তারা। জামিলার স্বপ্নে বিভোর ফরিদ মাস্তানকেও একটা টাকা ছাড় দিতে রাজী নয়। সে কী সাহস, জামিলা যেন ওকে যাদু করেছে। যে যাদু ভীরু ফরিদকে করে ফেলে অনেকটা নিঃশঙ্কচিত্ত। গর্জে উঠে ফরিদ, “খবরদার, পুরো ভাড়া না দিয়ে এক পা ও এগুবেন না বলছি।” কি করবি তুই, বলে সাথে সাথে লোকগুলো এসে মারতে উদ্যত হয় ফরিদকে, ফরিদও অন্ধ হয়ে যায়। কথা কাটাকাটির ফাঁকে হাতের কাছের বাঁশ দিয়ে ভীষণ ভাবে আঘাত হানে একটা মস্তানের মাথায়। মাথা ফেঁটে রক্ত ঝরা শুরু হয়। মুহুর্তের মধ্যে আরও কিছুলোক যোগ দেয় মস্তানদের সাথে। টানা হেঁচড়া করে তাকে ঢুকায় একটা গুদাম ঘরে। চোরের মত পেটাতে পেটাতে অভুক্ত পরিশ্রান্ত ফরিদকে অজ্ঞান করে ফেলে। নাক, মুখ দিয়ে রক্ত ঝরতে থাকে তার। শৈশবকাল থেকে ফরিদ মাথার ঘাম পায়ে ফেলেছে। অথচ কোনদিন কারো কাছে হাত পাতেনি, চুরি করেনি, এমন নিষ্ঠুর মারধরের শিকারও হয়নি কোনদিন। দুটি চোখ বুজে আসে তার, জ্ঞান হারিয়ে ফেলে একসময়। এতকিছুর পরও যেন তার পাপের প্রায়শ্চিত্ত হলনা। ও মরার ভান করছে- বলাবলি করতে থাকে জালেমের দল। মৃত্যুপথযাত্রী ফরিদের সারাশরীরে পড়তে থাকে অজস্র লাথি-কিল-ঘুষি। ফরিদের প্রাণপাখি টিকতে পারলনা জগতে, উড়ে গেল নিঃসম্বল দেহটা ফেলে, এই কঠিন পাষান পৃথিবীর ক্ষণকালের মেহমানখানাকে সালাম জানিয়ে। সালাম পৃথিবী, হাজার সালাম।
রচনাকালঃ ১৯৮৬ খৃস্টাব্দ
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন