চৌধুরী
ইসফাকুর রহমান কুরেশী
আজ এই পৃথিবী নামক গ্রহে আমরা এক স্বাধীন সার্বভৌম জাতি। প্রায়
ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের ক্ষুদ্র এই দেশটিতে গাদাগাদি হয়ে বসবাস করছে প্রায়
সাড়ে বার কোটি বাঙ্গালি। বিশ্বের ক্ষুদ্র এ জনবহুল দেশটি শতশত বৎসর বৈদেশিক জাতি ও
সরকার কর্তৃক শাসিত ও শোষিত হয়েছে। শত
যুগের পরাধীনতার শিকল ভেঙ্গে স্বাধীনতার সোনালি সূর্যের উদয় হলো এই মাত্র ২৭ বৎসর
আগে ৭১-এর ১৬ই ডিসেম্বর। আমাদের এই হতভাগা জন্মভূমির সুদীর্ঘ ইতিহাস-শোষণ নিপীড়ন
আর লুণ্ঠনের করুণ ইতিহাস। একটি স্বাধীন
রাষ্ট্রের চারটি মূল উপাদানের একটি হচ্ছে সরকার, অন্যটি
এই সরকারের সার্বভৌমত্ব। বিগত শত-শত বৎসর আমাদের এক বিশাল বাঙ্গালি জনগোষ্ঠী ছিল, নদীমাতৃক এই শ্যামল ভূখন্ডও ছিল। কিন্তু ছিলনা দু’টি উপাদান, সরকার ও সার্বভৌমত্ব। পরাধীনতার শিকলে বন্দি এ জাতি দু’শত
বৎসরের বৃটিশ ও পাকিস্তানি উপনিবেশিক শাসনামলে বার বার নিজেদের সরকার ও
সার্বভৌমত্ব কায়েমের স্বপ্ন দেখেছে। শুধু স্বপ্ন দেখেনি রক্তও দিয়েছে। তিতুমীর, ক্ষুধিরাম,
সূর্যসেন, প্রীতিলতা, রফিক,
জব্বার, সালাম, আসাদের রক্তদান এই স্বপ্ন বাস্তবায়নের ধারাবাহিক প্রয়াস মাত্র।
আর এদেশের মানুষের সেই স্বপ্নের বাস্তবায়ন ঘটে ১৯৭১ সালের ১৭ই এপ্রিল কুষ্টিয়ার
মেহেরপুরে বৈদ্যনাথতলায়। এইদিন আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার গঠিত হয়।
তখন থেকে মুজিবনগরই হলো অস্থায়ী রাজধানী। মুজিব নগরেই বাংলাদেশের তথা এ জাতীর
প্রথম সরকারের অভিষেক সম্পন্ন হয়। সেদিন এ জাতির অপূর্ণ ও দুঃসাধ্য এক সোনালি স্বপ্নের বাস্তবায়ন সুসম্পন্ন হয়।
এ সরকারের সর্বসম্মতিক্রমে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে
রাষ্ট্রপ্রধান নির্বাচিত করা হয়। তাঁর অনুপস্থিতিতে রাষ্ট্রপ্রধানের দায়িত্ব পালন
করেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম। বিপ্লবী সরকারের অন্যান্য দপ্তর নিম্নোক্তভাবে বন্টন করা
হয়।
১। প্রধামন্ত্রী ঃ জনাব তাজ উদ্দিন আহমদ
২। অর্থ দপ্তরঃ জনাব ক্যাপ্টেন মনসুর আলী
৩। স্বরাষ্ট্র দপ্তর ঃ জনাব কামরুজ্জামান
৪। পররাষ্ট্র দপ্তরঃ খন্দকার মোস্তাক আহমদ
কর্ণেল (পরে জেনারেল) আতউল গনি ওসমানীকে করা হয় বাংলাদেশ
সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান সেনাপতি। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র
পাঠ করেন অধ্যাপক ইউসুফ আলী।
১৯৭০ সালে ঐতিহাসিক নির্বাচনে বৃহত্তম রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ
সহ দেশের প্রতিটি রাজনৈতিক দল অংশগ্রহণ করে। সরকার জাতীয় পরিষদের নির্বাচনের তারিখ
স্থির করেন ৭ই ডিসেম্বর এবং প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনের তারিখ স্থির করেন ১২ ই
ডিসেম্বর। এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় পরিষদে সর্বমোট ১৬৭টি আসন লাভ করে
সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসাবে গণ্য হয় এবং ভুট্টোর পিপলস পার্টি ৮৮টি আসন লাভ করে
দ্বিতীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ দলে পরিণত হয়। বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ ও পশ্চিম পাকিস্তানে পিপলস পার্টি অধিক আসন লাভ করে।
পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদেও ৩০০টি আসনের মধ্যে
আওয়ামী লিগ ২৮৮টি আসন লাভ করে। অবশিষ্ট ১২টি আসন লাভ করে অন্যান্য দল। জাতীয় পরিষদে পূর্ব পাকিস্তানের ১৬৯টির মধ্যে ১৬৭টি লাভ করে আওয়ামী লিগ।
সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসাবে সারা পাকিস্তানের সরকার গঠনের দায়িত্ব লাভ করে আওয়ামীলীগ।
আওয়ামী লিগের এই বিজয়ে পাকিস্তানের সামরিক ও আমলাতান্ত্রিক শাসকগোষ্ঠী আতংকিত হয়ে
পড়ে এবং আওয়ামী লিগ তথা বাঙ্গালিদের হাতে পাকিস্তানের শাসনভার ছেড়ে না দেয়ার
ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। তারা জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহবান না করে দুরভিসন্ধিমূলক
রাজনৈতিক কৌশল অবলম্বন করে। পিপলস পার্টি প্রধান জুলফিকার আলী ভুট্টো সম্পূর্ণ
অগণতান্ত্রিক ভাবে নিজেকে সারা পাকিস্তানের প্রতিনিধি বলে দাবি করেন। তিনি
বঙ্গবন্ধুর ছ’দফা মানতে রাজি নন এবং প্রয়োজনে জাতীয় পরিষদ বর্জনের হুমকি দেন।
বঙ্গবন্ধু ৬ দফা ভিত্তিক শাসনতন্ত্র প্রণয়ণে অটল রইলেন। কারণ এদেশের জনগণ এর পক্ষে
সুস্পষ্ট রায় দিয়েছে।
১৯৭১ সালের জানুয়ারি মাসে ইয়াহিয়া ও ভুট্টো ঢাকায় এসে
বঙ্গবন্ধুর সাথে আলোচনায় বসেন। ১৪ই জানুয়ারি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানের ভাবী প্রধানমন্ত্রী বলে অভিহিত
করেন ও নানা টালবাহানার পর ১০ই ফেব্র“য়ারি ঘোষণা করেন যে, ৩রা মার্চ জাতীয় পরিষদের প্রথম অধিবেশন বসবে। কিন্তুু ১লা
মার্চ ইয়াইয়া আচমকা জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা
করেন। এ হটকারী ঘোষণার ফলে বাংলাদেশে প্রতিবাদ ও বিক্ষোভের ঝড় ওঠে।
৭০-এর নির্বাচনে জনগণের রায়প্রাপ্ত আওয়ামী লিগই মুজিবনগরে প্রথম সরকার
গঠন করে ও স্বাধীনতা যুদ্ধের নেতৃত্ব দান করে দেশকে স্বাধীনতার সোনালি সূর্য উপহার
দান করে ১৬ই ডিসেম্বর ১৯৭১। আর এই সরকারের প্রধান ছিলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতার অমর
কাব্যের মহাকবি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। যিনি ৭০এ সারা পাকিস্তানের
প্রধানমন্ত্রী হবার জন্য রায়প্রাপ্ত হয়েছিলেন।
১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট আমাদের প্রথম সরকারের প্রধানমন্ত্রী
বঙ্গবন্ধু দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে কতিপয় কুচক্রী গোষ্ঠীর হাতে সপরিবারে
শহিদ হন। আর এই মুজিবনগর সরকারেরই পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোস্তাকের নির্দেশে অন্য
সদস্যগণ ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারে সামরিক বাহিনীর কতিপয় ঘাতকের হাতে শহিদ হন।
এভাবে এই দেশটাকে ভালবেসে যারা সারাটা জীবন নির্ভয়ে সংগ্রাম করে গেছেন সেই
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান,
কামরুজ্জামান, মনসুর আলী,
তাজ উদ্দীন, সৈয়দ নজরুল ইসলাম তাদেরই অক্লান্ত প্রচেষ্টার ফসল এই বাংলাদেশে
এদেশীয় খুনিচক্রের হাতে শাহাদত বরণ করেন।
গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য বাংলার মানুষ ১৯৭০ সনে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে
পড়ে। আর সেই আন্দোলন দমনে অস্ত্র হাতে নিরস্ত্র মানুষের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে পাকিস্তানের বিশাল সামরিক
বাহিনী। গণহত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠনে ছারখার করে গোটা বাংলাদেশে। তাদের সাথে শরিক হয় এদেশীয় ধর্মব্যবসায়ী আলবদর, আলশামস ও রাজাকার বাহিনীর খুনিচক্র। কিন্তু কোনক্রমেই এদেশের স্বাধীনতাকে আটকে
রাখতে তারা সক্ষম হয়নি। আমরা স্বাধীন হয়েছি। কিন্তু স্বাধীনতার স্বাদ আজও পৌঁছেনি
মানুষের কাছে। অর্থনৈতিক মুক্তি আসেনি। গণতন্ত্র এখনও পূর্ণতাপ্রাপ্ত হয়নি।
জনশক্তির উন্নয়ন হয়নি। শিক্ষার হার এখনও হতাশাব্যঞ্জক। বেকারত্ব ও দারিদ্র জাতিকে
অষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে রয়েছে। আমাদের জীবনমান বিশ্বের মধ্যে নিম্নসারিতে পড়ে আছে।
বিগত সরকারগুলো তেমন কোন উন্নয়নের স্বাক্ষর রাখতে পারেনি। খুন, ধর্ষণ,
রাহাজানি, রাজনৈতিক
অস্থিরতা, হরতাল, ধর্মঘট জাতিকে স্থবির করে রেখেছে।
আমাদের গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপদান ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। শিক্ষা ও অর্থে সামর্থে স্বাবলম্বী এক সম্মানজনক
জীবন জনগণকে উপহার দানে সরকারসহ সবাইকে সচেষ্ট হতে হবে। এভাবে আমরা স্বাধীনতা ও
মুজিবনগর সরকারের মহাত্ম্যকে এদেশে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হবো।
[প্রকাশ কাল: দৈনিক সিলেটের ডাক, শুক্রবার,
১৭ এপ্রিল, ১৯৯৮ইং]
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন