৭ই নভেম্বর-বিপ্লব ও সংহতি দিবস না অন্য কিছু
সি.আই.আর
কুরেশী সেফাক
বিগত ২১ বৎসর যাবত ৭ই’ নভেম্বর ‘জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস’
হিসাবে পালিত হয়ে আসছে। বিএনপি আমলে উক্ত দিনটিতে জাতীয় ছুটিও ঘোষিত হয় এবং জাতীয় প্রচার মাধ্যমে রেডিও, টিভি ইত্যাদিতে উক্ত দিনটির নানা মহাত্ম্য প্রদান পূর্বক
অসংখ্য ফিচার প্রচার করা হয়। কাজেই উক্ত দিনটি সম্পর্কে জনমনে নানা ভ্রান্ত ধারণা
ও প্রশ্নের উদয় হয়। ৭ই নভেম্বর আসলেই কি কোন মহৎ ‘বিপ্লব’ জাতীয় ঘটনা সংঘটিত
হয়েছিল কিংবা ভবিষ্যতে এই ‘বিপ্লবের’ ফলাফল কি ছিল সে সম্পর্কে তথ্য সন্ধানী
মানুষের মনে নানা প্রশ্নের উদয় হওয়া স্বাভাবিক।
১৯৭১ সালে এদেশের স্বাধীনতা বিরোধী চক্র পরাজিত হয়। পাক সেনারা
নি:শর্ত আত্মসমর্ম্পনে বাধ্য হয়। দেশ স্বাধীন হলেও স্বাধীনতা চক্র দেশের
স্বাধীনতাকে মনে প্রাণে মেনে নিতে পারেনি। কাজেই এই স্বাধীনতা বিরোধী চক্র
পরবর্তীতে সংঘঠিত হয়ে গোপন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। যাতে স্বাধীনতার পক্ষের শক্তিকে
নিশ্চিহ্ন করে রাষ্ট্রকে আবার পাকিস্তানের ধর্মীয় সামরিকতান্ত্রিক ও আমলা নির্ভর
রাষ্ট্রে পরিণত করা যায়। গণতন্ত্রকে ধ্বংস করে দেশকে একটি ধর্মীয় সামরিক লেবাস
প্রদান করা, স্বাধীনতার যুদ্ধের মূলনীতি সমূহকে
উচ্ছেদ করা, জাতীয়তার অপব্যাখ্যাকরণ, সর্বোপরি ধর্মকে রাজনৈতিক স্বার্থ ও সুবিধা হাছিলের হাতিয়ারে
পরিণত করা। এই মৌলবাদী ও স্বাধীনতা বিরোধী চক্র তাদের উদ্দেশ্যেকে যথাযথ
বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যেই ১৯৭৫ সালে ১৫ই আগস্ট সেনাবাহিনীর কিছু সংখ্যক দুস্কৃতিকারী
জুনিয়র অফিসারের মাধ্যমে রাতের অন্ধকারে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে
সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যা করে। ষড়যন্ত্রকারীদের নাটেরগুরু খন্দকার মোস্তাক ক্ষমতায়
বসেন। সামরিক বাহিনীতে তখন ভীষণ বিশৃংখলা শুরু হয় ও চেইন অব কমান্ড ভেঙ্গে পড়ে।
বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারী জুনিয়র অফিসাররা যথেচ্ছ অনিয়ম, ষড়যন্ত্র
ও বিশৃংখলা শুরু করে। দেশে এবং সেনাবাহিনীর মধ্যে আইন ও শৃংখলা তিরোহিত হয়।
রাজনীতিতে কতিপয় সেনানায়কের অবৈধ হস্তক্ষেপ সার্বিক অবস্থাকে জটিল করে তুলে।
ষড়যন্ত্রকারীরা তাদের একই উদ্দেশ্যকে বাস্তবায়নের জন্য ৩রা নভেম্বর ঢাকা কেন্দ্রীয়
কারাগারে খন্দকার মোস্তাকের নির্দেশে স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী জাতীয় চার
নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম,
কামরুজ্জামান, মনসুর আলী ও তাজ উদ্দিন আহমদকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করে। এই
চারজন নেতা বাংলাদেশের স্বাধীনতার মূল চার স্থপতি ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের
আনুগত্য ও ঘনিষ্ট সহচর। এদের হত্যার উদ্দেশ্যে ছিল একটাই-জাতিকে নেতৃত্বশূণ্য করা।
যাতে এদেশ আর এগুতে পারে না।
এদেশের যাতে আর কোন অগ্রগতি না হয়। সেই সাথে আর এক
উদ্দেশ্যে ছিল স্বাধীহীনতার চেতনার ধারক বা বাহক প্রতিভাবান কেউ যেন অবশেষে না
থাকে। গণতন্ত্র, ধর্ম নিরপেক্ষতা ও বাঙালী জাতীয়তা যাতে
নিশ্চিহ্ন করা যায়। সেই উদ্দেশ্যেকে সামনে রেখে ঠান্ডা মাথায় ষড়যন্ত্রকারীরা এ সব
জঘন্য হত্যাকান্ড সংঘটিত করে। এমনই এক বিশৃংখল অবস্থায় দেশে শান্তি শৃংখলা
প্রতিষ্ঠায় এক অভ্যুন্থান সংঘটিত করেন ৭১-এর স্বাধীনতা যুদ্ধের অকুতোভয় সেনানায়ক
‘কে-ফোর্সের’ অধিনায়ক খালেদ মোশাররফ। স্বাধীনতা যুদ্ধের এই মহান নায়ক খন্দকার
মোস্তাক চক্রের আচরণ মেনে নিতে পাারেননি। তিনি দেশকে আবার স্বাভাবিক পর্যায়ে আনতে
চেয়েছিলেন। অথচ দুঃখজনক হলে সত্য,
তিনি তার সহযোগী শাফায়েত জামিল ও
অন্যান্য অনুসারী সহ ৭ই নভেম্বর নিষ্ঠুরভাবে নিহত হন। আর এই ঘটনার পরই জিয়াউর
রহমান ক্ষমতা দখল করে সামরিক শাসন জারী করেন। ৭ই নভেম্বরের কি উপহার দিলো জাতিকে?
৭ই নভেম্বর প্রত্যক্ষ অবদান হলো দেশের সামরিক শাসনের সূত্রপাত।
এতদিন রাজনীতিবিদরা রাজনীতি করতেন। গণপ্রতিনিধিরা ক্ষমতা যেতেন, ১৫ই আগস্টের পরও সামরিক বাহিনী সরাসরি ক্ষমতা দখলে সাহসী হয়নি।
অথচ ৭ই নভেম্বরের পর রাজনীতিতে সেনা বাহিনীর হস্তক্ষেপ শুরু হয়। এবং এই ধারা
প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে পরবর্তী ১৫ বৎসর অর্থাৎ ১৯৯০ সালে এরশাদের পতন পর্যন্ত
অব্যাহত থাকে। উন্নত বিশ্বের কোথাও রাজনীতি সেনাবাহিনীর বিষয় নয়। রাজনীতি
সেনাবাহিনীর নৈতিক চরিত্র ধ্বংস করে। যে সেনাবাহিনীর দায়িত্ব হচ্ছে জনগনের সংশ্রব
থেকে দূরে ব্যারাকে থেকে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা, তারা রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়লে বিতর্কিত ও কলুষিত হয় তাদের কর্তব্য
পালন। ৭১-এর স্বাধীনতা যুদ্ধে আমাদের যে দেশপ্রেমিক সেনা বাহিনী জীবন উৎসর্গ করে
দেশকে স্বাধীন করে সেই মহান সেনাবাহিনী কতিপয় ক্ষমতা লিপ্সু উচ্চভিলাষী সেনানায়কের
রাজনৈতিক উচ্চাকাংখা পুরণের হাতিয়ারে পরণত হয়’-৭৫ এর ৭ নভেম্বরের পর।
১৯৭৫-এর ৭ই নভেম্বর এর আরেক ফল হচ্ছে সেনাবাহিনীেিত বিনা
বিচারে অসংখ্য মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী নিরপরাধ সৈনিক হত্যাকান্ড। ৭১-এর
মুক্তিযুদ্ধে ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশারফের অবদান জিয়াউর রহানের অবদানের চেয়ে কোন
অংশে কম ছিল না। জিয়া যেমন ছিলেন জেড ফোর্সের অধিনায়ক। খালেদ মোশাররফও ছিলেন ‘কে’
ফোর্সের দুর্র্ধর্ষ অধিনায়ক। ৭ই নভেম্বর কেড়ে নেয় সাহসী মুক্তিযোদ্ধা শাফায়াত
জামিলকে। ৭ই নভেম্বরের জের হিসাবে নিহত হন,
স্বাধীনতা যুদ্ধে একটি পা হারানো বীর
সৈনিক মুক্তিযুদ্ধের ১১জন সেক্টর কমান্ডারের অন্যতম কর্ণেল তাহের। ৭ই নভেম্বরের
জের হিসাবে বিমান ও স্থল বহিনীর অসংখ্য সৈনিক ও অফিসার বিনা বিচারে হত্যাকান্ডের
শিকার হন।
৭ই নভেম্বরের অন্যতম সূদুর প্রসারী ফল হলো বাংলাদেশের
রাজনীতিতে স্বাধীনতা বিরোধী রাজাকার আল-বদরদের পুনরুত্থান এবং মৌলবাদী আচার আচরণের
পুনঃপ্রকাশ। ৭ই নভেম্বর দেশে সুবিধাবাদী রাজনীতির সূচনা করে। লোভ ললসা দেখিয়ে
বিভিন্ন দলের সুবিধাবাদীদের দলে ভিড়ানোর রাজনীতি তখনই শুরু হয়। স্বাধীনতা বিরোধী
যারা চায়নি বাংলাদেশ স্বাধীন হোক,
তারাই মন্ত্রিত্বের আসনে আসীন হবার
সুযোগ লাভ করে। ৭ই নভেম্বর ৭২ এর সুন্দর সংবিধানকে কেটেকুটে রাষ্ট্রকে মৌলবাদ ঘেষা
এক অপজাতীয়তার শিকলে বন্দি করে ফেলে। ৭ই নভেম্বর দেশের অসংখ্য বীর দেশপ্রেমিক
সৈনিক ও মুক্তিযোদ্ধার চরিত্রে মিথ্যা কলঙ্গ লেপনে সহায়ক হয়।
৭ই নভেম্বর এদেশে মানুষের ভোট অধিকারও হরনের একটি দিন। ৭ই
নভেম্বরের পর ‘হ্যাঁ’ ভোট বা ‘না’ ভোট সহ নানাধরনের ভোট চুরি, জালিয়াতি ও ষড়যন্ত্রের রাজনীতির সূচনা হয়, যা ১৯৯০ সাল পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। কাজেই ৭ই নভেম্বর ‘জাতীয়
বিপ্লব ও সংহতি দিবস’ হিসাবে পালন কাম্য হতে পারে না।
[প্রকাশ কাল: দৈনিক সিলেটের ডাক, ৭ নভেম্বর,
১৯৯৭ইং]
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন