বৃহস্পতিবার, ১৭ মার্চ, ২০১৬

যার শূণ্যতা দগ্ধ করে প্রতিক্ষণ

যার শূণ্যতা দগ্ধ করে প্রতিক্ষণ
চৌধুরী ইসফাকুর রহমান কুরেশী

২৯ জুন ’৯৮। সিলেট ডাক হাতে নিয়ে চমকে উঠি। তখন ঘড়িতে বেলা ১২টা। পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় এক করুণ সংবাদ একটু পরেই তার জন্মভূমি লক্ষণাবন্দে তাকে দাফন করা হবে। তিনি আর কেউ নন-আমাদের প্রাণপ্রিয় শিক্ষক শ্রদ্ধেয় মইন স্যার। পত্রিকায় ছবির মধ্যে কি সকরুণ নয়নে চেয়ে আছেন তিনি। সেই সুন্দর মুখ, সুন্দর চোখ, সুতীক্ষè চাহনি যা কোন দিন ভুলবার নয়।
১৯৭৪ সাল। আমি তখন তুড়–কখলা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্র। ক্লাস ফোরে পড়ছি। তখনই এই পাঠশালায় তাঁর প্রথম জয়েনিং। একদিন জানালেন তিনি একদা আমার বাবার ছাত্র ছিলেন। নিজ শিক্ষকের সন্তান বলে আমার প্রতি তার ছিল আলাদা এক অনুরাগ, আলাদা এক দৃষ্টি। তাঁর কড়া শাসনে হৃদয়ে ভীতিভাব থাকলেও তার প্রতি ছিল সবার এক অদৃশ্য আকর্ষণ। আমাদেরকে শুধু শিক্ষা দান নয়, আমাদের সার্বিক উন্নয়নে তার ছিল কড়া নজর। পাঠশালা ছেড়ে এসেছি সেই ৭৬ সনে, অথচ কিছুদিন পূর্বেও স্যারের সামনে পড়লে মাথা নুয়ে আসতো ভক্তি ও শ্রদ্ধায়।
আমাদের প্রিয় শিক্ষক মইন স্যার ছিলেন একজন আদর্শ মানুষ। ১৯৫২ সালে গোলাপগঞ্জ থানার লক্ষèণাবন্দ ইউনিয়নের টিলাময় লালমাটিয়া গ্রাম ফুলসাইন্দে তাঁর জন্ম। মাত্র ২২ বৎসর বয়সে ১৯৭৪ সালে সিলেট শহরের সন্নিকটস্থ দাউদপুর ইউনিয়নের তুড়–কখলা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তাঁর শিক্ষকতা জীবনের শুরু। আর ’৯৮ সালের ২৬ জুন এখানেই তার জীবনের সমাপ্তি সুচিত হয়।

মানুষকে আপন করে নেওয়ার এক অদ্ভুত ক্ষমতা ছিল মইন স্যারের। কেউ কাছে আসলেই আপন হয়ে তে তার। সিলেট সদর থানার দাউদপুর ইউনিয়নের মানুষও তাঁর হাতেগড়া ছাত্ররা তাঁর অকাল বিদায়ের শোকে শোকাচ্ছন্ন। সবার সাথে ছিল তাঁর এক মধুর সম্পর্ক। চলনে বলনে এত মার্জিত ও ভদ্র এরকম একটা মানুষ বর্তমানে সমাজে খুজে বের করা বেশ কঠিন। তিনি ধার্মিক ছিলেন কিন্তু তাঁর মধ্যে কোন ধর্মান্ধতা ছিল না। বর্তমান কালের ফাঁকিবাজীর যুগে বাস করেও স্যার ছিলেন নিজ দায়িত্বের প্রতি দারুণভাবে সিরিয়াস। তাঁর প্রচেষ্টায় দাউদপুর ইউনিয়নের এই অখ্যাত প্রাইমারী স্কুলটি দক্ষিন সুরমার এক শ্রেষ্ঠ প্রাথমিক বিদ্যাপীঠে পরিণত হয়েছে। কোন কোন মানুষ আছেন-যাদেরকে ভুলা যায়না কোন দিন। তাঁরা তাদের কর্ম, চিন্তা ও চেতনার মাধ্যমে মানুষের হৃদয়ে এমনভাবে দাগ কাটেন যে দাগ কখনও মুছে ফেলা সম্ভব হয়না। মইন স্যার ছিলেন এমনই একজন মানুষ। লোকের সাথে তিনি মিশেছেন, মানুষকে ভালবেসেছেন কিন্তু আবার নিজ ব্যক্তিত্বের দূরত্ব বজায় রেখে চলেছেন।  তাই তো কোনদিন তার সম্পর্কে কোন মন্দ কথা কেউ বলতে পারেনি। পরচর্চ্চা, পরশ্রীকাততা, হিংসা-বিদ্বেষহীন এক অনুপম চরিত্রের মানুষ ছিলেন তিনি। আমি যতটুকু জানি মিথ্যাচার বা কলুষতা এই সত্য সুন্দর মানুষটিকে কখনও স্পর্শ করতে পারেনি। এই সোনার মানুষটি মাত্র ৪৬ বৎসর বয়সে আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন চিরদিনের ঠিকানায়।
জন্মিলে মরিতে হবে, কে কোথা অমর কবে?
চিরস্থির, করে নীড়; হায়রে জীবন নদে।”
আমরাও একদিন সেই ঠিকানায় চলে যাবো তবুও আমাদের হৃদয়ে স্যারের এই অকাল মৃত্যু সইতে পারছে না। আমরা মঈন স্যারের বিদেহী আত্মার শান্তি ও মাগফেরাত কামনা করি। আল্লাহ তাকে বেহেশত নসিব করুন ও তাঁর পরিবার পরিজনকে এই শোক সহিবার শক্তি দান করুন।

[প্রকাশ কাল: দৈনিক সিলেটের ডাক, ২৮ জুলাই, ১৯৯৮ইং]

 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন