পার্বত্য শান্তিচুক্তি একটি পর্যালোচনা
চৌধুরী
ইসফাকুর রহমান কুরেশী
পার্বত্য চট্টগ্রাম বাংলাদেশের এক সম্ভাবনাময় ও গুরুত্বপূর্ণ
অঞ্চল। আয়তন প্রায় ৫ হাজার বর্গমাইল। আমাদের সিলেট বিভাগের চেয়ে খানিকটা বড় ও
দেশের মোট আয়তনের প্রায় এক দশমাংশ। ১৯৪৭ সালে ইংরেজরা চলে যাবার সময় উপজাতীয় ও
বৌদ্ধ অধ্যুষিত অঞ্চল আমরা লাভ করি অপ্রত্যাশিতভাবে। তখন এই অঞ্চলে বাঙ্গালীর
সংখ্যা ছিল মোট জনসংখ্যার মাত্র ৩%। বাকী ৯৭% মানুষই ছিল উপজাতীয়। এই অঞ্চলে চাকমা, মারমা সহ প্রায় কুড়িটি উপজাতীয় মানুষের বাস। তবে চাকমারাই
সংখ্যাগরিষ্ঠ ও সর্বাপেক্ষা শিক্ষিত সম্প্রদায়। বৃটিশরা দুটি কারণে এ অঞ্চল
আমাদেরকে দিয়ে যায়, প্রথমত: চট্টগ্রামবন্দর রক্ষায় এলাকাটা
আমাদের জন্য বাঞ্জনীয় ছিল,
দ্বিতীয়ত: ভারতের সঙ্গে এই অঞ্চলের
সন্তোষজনক যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিলনা। পার্বত্য চট্টগ্রাম ছাড়া বাংলাদেশ অসম্পূর্ণ
থেকে যেত। পার্বত্য চট্টগ্রাম আমাদের সৌভাগ্যের চাবিকাটি হতে পারত। অথচ সেখানে
দু’যুগের বেশী সময় ধরে চলছে হানাহানি সংঘাত ও রক্তপাত। মারা যাচ্ছে হাজার হাজার
মানুষ, ব্যহত হচ্ছে উন্নয়ন, অপচয় হচ্ছে গরীব দেশটির অর্থের। অথচ অঞ্চলটিতে শান্তি ও
স্থিতিশীলতা বজায় থাকলে,
পর্যটক, খনিজ
সম্পদ ও ব্যবসা বানিজ্য অঞ্চলটি দেশের এক অগ্রগামী এলাকায় পরিণত হত। এই সম্ভাবনাময়
অঞ্চলটিতে আমাদের আয়ের চেয়ে ব্যয় হচ্ছে অনেক অনেক বেশী। যা আমাদের গরীব দেশটির
সামগ্রিক অর্থনীতিকে বিপর্যস্ত করছে। কাজেই পার্বত্য চট্টগ্রামের বিদ্রোহী
পাহাড়ীদের সহিত একটি শান্তি চুক্তিতে উপনীত হয়ে ঐ অঞ্চলে স্থায়ী শান্তি ও
স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠা অবশ্যই প্রয়োজন। তবে এই শান্তি চুক্তি সরকার ও বিরোধী দলের
সর্বসম্মতিক্রমে হওয়া বাঞ্চনীয়। কারণ আজকের সরকারী দল সবসময় ক্ষমতায় থাকবে না।
আগামীতে বিএনপি যদি ক্ষমতায় এসে চুক্তির শর্তাবলী পালনে অনীহা দেখায় তবে সবকিছু
আবার ভন্ডুল হয়ে যাবে। শান্তির আশা তিরোহিত হবে।
পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি স্থাপনে অবশ্যই পাহাড়ীদের বিদ্রোহ
ও অসন্তোষের মূল কারণ খুঁজতে হবে এবং এগুলোর ন্যায়সঙ্গত সমাধানের জন্য উদ্যোগি হতে
হবে। সবশেষে এই সমাধানে আমাদের যেতে হবে যেখানে বসবাসরত বাঙ্গালী ও পাহাড়ী উভয়ের
পরস্পরের স্বার্থকে রক্ষা করে।
আয়ুব আমলে যখন কাপ্তাই লেক সৃষ্টি করা হয় তখন রাঙ্গামাটি শহরের
আশপাশে প্রায় ৬/৭ শত বর্গমাইল এলাকা স্থায়ীভাবে জলমগ্ন হয়ে যায়। চাকমা উপজাতির শত
শত লোক হারায় বসতবাড়ী ও জুমক্ষেত। তৎকালীন সরকার এই সব মানুষের যথাযত পুর্নবাসন
করেনি। অনেকে উদ্বাস্ত হিসাবে ভারতে চলে যায়। শুরু হয় অসন্তোষ। ট্রাইবাল অঞ্চল
হিসাবে বৃটিশ শাসন আমলেও তারা যথেষ্ট স্বায়ত্বশাসন ভোগ করতো। যা পাকিস্তান আমলে
রহিত হয়ে যায়। স্বাধীনতার পর পাহাড়ী এম.পি মানবেন্দ্র নারায়ন লারমা পাহাড়ীদের
স্বায়ত্বশাসন ও সংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য রক্ষায় কিছু দাবী দাওয়া বঙ্গবন্ধুর কাছে
উত্থাপন করেও খুব একটা সুবিধা আদায় করতে সক্ষম হননি। পরবর্তীতে তার নেতৃত্বের গঠিত
হয় পাবর্ত্য সজসংহতি সমিতি ও তাদের সশস্ত্র সংগঠন “শান্তিবাহিনী”। চল্লিশের দশক
হতে বাংলাদেশে শুরু হয় জনসংখ্যা বিস্ফোরণ। ১৯৪৭এ ৪ কোটি হতে ৯৭ এ সাড়ে ১২কোটি।
বৃদ্ধি প্রায় সাড়ে ৮ কোটি মানুষ। অথচ বৃটেনের মত উন্নত দেশটিতে এই পঞ্চাশ বছরে মানুষ
বেড়েছে মাত্র ১ কোটি। এই উপচে পড়া লোকদের বিরাট এক অংশকে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান
পার্বত্য চট্টগ্রামে বাস করার জন্য পাঠালেন। তাঁর ধারনা ছিল জনবিরল পার্বত্য
চট্টগ্রাম এই উপচে পড়া ছিন্নমূল বাঙ্গালীদের বিরাট একটি অংশ ধারণ করতে পারবে।
এভাবে বাঙ্গালীর সংখ্যা গিয়ে ৪৮% এ উপনীত হলো। এভাবে হাজার হাজার ছিন্নমূল
বাঙ্গালীর আগমনে পার্বত্য এলাকায় সামাজিক বিশৃংখলা শুরু হলো। পাহাড়ীরা তাদের নিজ
অঞ্চলে সংখ্যালঘুতে পরিণতহবার ভয়ে আশংকাগ্রস্ত হলো। তারা তাদের নিজস্ব ধর্ম
সংস্কৃতি-কৃষ্টি ইত্যাদি নিয়েও উৎকণ্ঠিত হয়ে
জনসংহতি সমিতির পতাকাতলে সমবেত হয়ে শান্তিবাহিনীর মাধমে সশস্ত্র সংগ্রামে
লিপ্ত হলো।
যে কোন বিরোধ মীমাংসায় উভয় পক্ষকে কিছু না কিছু ছাড় দিয়ে
সমঝোতায় উপনীত হতে হয়। কাজেই একথা সত্য যে, শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরে সরকার ও জনসংহতি সমিতিকে তাদের মূল
দাবী দাওয়া থেকে অনেকটা ছাড় দিতে হয়েছে। জন সংহতির মূলদাবী বাঙ্গালীদের সম্পূর্ণ
বহিস্কার থেকে তারা সরে এসেছে। ‘স্বাধীনতা লাভ ও সেনানিবাস উচ্ছেদের দাবীও তারা
প্রত্যাহার করে নিয়েছে। এতদিন বসতি স্থাপনকারী বাঙ্গালীরা শান্তিবাহিনীর ভয়ভীতির
মধ্যে ছিল। তারা এখন নির্বিঘেœ
শান্তিতে পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাস
করতে পারবে। অন্যদিকে এরশাদ আমলে তিন পাবর্ত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পদ
উপজাতীয়দের জন্য বরাদ্দ করা হয়। বর্তমানে তিন পার্বত্য জেলা নিয়ে পার্বত্য পরিষদ
গঠিত হবে। সেখানেও ১৮ সদস্য পদের মধ্যে ১২টি পাহাড়ীদের জন্য বরাদ্দ করা হয়। পার্বত্য পরিষদের চেয়ারম্যানও হবেন
উপজাতীয়। এসব হচ্ছে সরকারের পক্ষেছাড়। তাছাড়া উপজাতীয়দের জন্য সরকার আলাদা উপজাতীয়
মন্ত্রণালয় ও ১ জন মন্ত্রির কোঠাও
বরাদ্দ করেছেন। পার্বত্য পরিষদের
চেয়ারম্যানও হবেন উপজাতীয়। এসব হচ্ছে সরকারের পক্ষে ছাড়। তাছাড়া উপজাতীয়দের জন্য
সরকার আলাদা উপজাতীয় মন্ত্রণালয় ও ১জন মন্ত্রির কোঠাও বরাদ্দ করেছেন। যেহেতু
উপজাতীয়রা বাংলাদেশে অবাঙ্গালী সংখ্যালঘু ও পশ্চাৎপদ শ্রেণী। কাজেই তাদের জন্য ্
কোটা বরাদ্ধ অন্যায় কিছু নয়। অধিকন্তু এর মাধ্যমে উপজাতীয়দের এলিট গোষ্ঠীকে
বাংলাদেশের মূলস্রোতের সাথে মিলিয়ে দেয়া ও দেশের প্রতি গাঢ় সম্পর্ক সৃষ্টির
মাধ্যমে দেশপ্রেমে উদ্ধুদ্ধ করা সম্ভব হবে। বাঙ্গালীরা পার্বত্য অঞ্চলে জমিজমা
একদম কিনতে পারবেনা এধারনাও ভুল। বরং বিনিয়োগকারীরা পাহাড়ী পরিষদের অনুমোদন
সাপেক্ষে জমি কিনতে পারে। পাহাড়ী পরিষদে ৬জন বাঙ্গালী সদস্যও রয়েছেন।
বর্তমান শ্রীলঙ্কার দিকে থাকালে দেখা যায় তৎকালীন লঙ্কা সরকার
তামিল সমস্যাকে গুরুত্ব দেয়নি। অথচ এই জাতিগত সমস্যায় জর্জরিত হয়ে উপমহাদেশের
সবচেয়ে শিক্ষিত (৮০%) ও অন্যতম স্বাবলম্বি রাষ্ট্র হওয়া সত্ত্বে শ্রীলঙ্কা আজ
ধ্বংসের মুখোমুখী। উন্নয়ন বন্ধ,
রক্ত বন্যায় দেশটি সয়লাব। কাজেই জাতিগত
বিরোধ জিইয়ে রেখে জাতিকে ক্রমাগত রক্তপাত ও ধ্বংসের পথে নিয়ে যাওয়া কখনও
বুদ্ধিমানের কাজ নয়।
আজ শান্তিচুক্তি নিয়ে পক্ষে বিপক্ষে প্রচারণা চলছে। দেশের
বিশেরভাগ দায়িত্বশীল পত্রিকা যেমন ইত্তেফাক,
জনকণ্ঠ, ভোরের
কাগজ, আজকের কাগজ, খবর,
বাংলা বাজার ইত্যাদি পত্রিকা
শান্তিচুক্তিকে ঐতিহাসিক চুক্তি হিসাবে স্বাগত জানায়।
দেশ বিদেশেও চুক্তিটি প্রশংসিত হয়েছে। পার্বত্য পরিষদকে আমরা যুক্তরাষ্ট্রের ধারার
একটা নতুন ও অভিনব মডেল হিসেবে কল্পনা করতে পারি। বাঙ্গালীদের বাংলাদেশে ভিন্নজাতি
উপজাতীয়দের তাদের সংস্কৃতি কৃষ্টির স্বাতন্ত্র বজায় রেখে এজাতি স্বত্তায় নিজেদের
বিলীন করে দেবার এক নতুন ব্যবস্থা। যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় অঙ্গরাজ্যগুলো যথেষ্ট
আইনগত ক্ষমতা ভোগ করে ও তা সংবিধানই প্রতিপালন এবং সংরক্ষণ করে। আমাদের সদ্য
সমাপ্ত শান্তিচুক্তির মাধ্যমে সম্পাদিত পার্বত্য স্বায়ত্বশাসনও অনেকটা অনুরূপ।
পার্বত্য শান্তিচুক্তি নিয়ে দেশে যে অস্থিরতার সৃষ্টি হয়েছে তা
অনভিপ্রেত। সুদীর্ঘ দুই যুগের জিইয়ে রাখা সমস্যার সমাধান সর্বসম্মতিক্রমে জাতীয়
সংসদের মাধ্যমে সম্পন্ন হলে অবশ্যই জাতির জন্য মঙ্গলজনক হতো। সরকার এত জটিল ও স্পর্শকাতর
বিষয়টাকে কেন জাতীয় সংসদকে পাশকাটিয়ে সম্পাদন করল তা নিয়ে বির্তক সৃষ্টি হয়েছে।
গণতন্ত্রে জাতীয় সংসদ হচ্ছে সব কিছুর প্রাণকেন্দ্র। সংসদকে পাশকাটিয়ে কোন
গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি সম্পাদন গণতন্ত্রকে দুর্বল করে তোলে। এ দেশের ১২ কোটি মানুষ
গণতন্ত্র চায়। গণতন্ত্রের মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রাম সহ সারাদেশে শান্তিময় ও
স্থিতিশীল সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় তারা বিশ্বাসী। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা
শান্তিচুক্তিকে ভাইয়ে ভাইয়ে ঝগড়ায় মিমাংসা হিসেবে অভিহত করেছেন। শান্তিচুক্তির
শর্তাদি বাস্তবায়নে সরকার ও জনসংহতি সমিতি উভয়ের আন্তরিকতা ও স্বদিচ্ছা এবং উদার মনোভাবের
উপর নির্ভর করছে পার্বত্য চট্টগ্রামের স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা, সমৃদ্ধি ও উন্নয়ন।
[প্রকাশ কাল: দৈনিক সিলেটের ডাক, ২০ জানুয়ারী,
১৯৯৮ইং]
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন