কবি লেখক ব্লগার ও পূবালী ব্যাংকার ইসফাক কুরেশী
রঙ্গি ঝি। নানির পিছু পিছু ছুটা ছুটি করে তার দিন যায়। আমার নানাবাড়ির কিনারায় নানার দাতব্য জমিতে রঙ্গি ঝির কুড়েঘর। মেয়ে কাজলকে বিয়ে দেন ধরে বেঁধে আনা এক নোয়াখাল্ল্যার সাথে। বউ কাজল ও কন্যা হাসনাকে ফেলে রেখে একদিন লোকটি উদাও। আর কোন খবর মেলে নি তার। নানাবাড়িতে আমরা যে ক'জন ছেলেমেয়ে খেলাধুলা হৈ হল্লা করে সুন্দর শৈশব কাটাতাম তাদের একজন এই হাসনা।
হাসনা ফর্সা নাদুসনুদুস বালিকা। সুন্দর চেহারা, চোখ দু'টি ডাগর জবা ফুল। কথার ফুলঝরি ফুটে সদা তার ঠুটে। সে চঞ্চলা এক পল্লী বালিকা।
পাশের বাড়ির ধনী গৃহস্থ মাসুকের বাপ। মাসুকের মা মারা যান ক্যান্সারে, বুড়ির লাশ কবরে রেখে এসেই মাসুকের বাপ ঘটক খোঁজেন, জাত বেজাত হউক, ফকির মিসকিন হউক, আমার কোন আপত্তি নেই। তবে কনে যেন হয় ফর্সা সুন্দরী কচি ডাব।
কিন্তু বাদ সাধলো জোয়ান পোলাটা, এসব কি করছো বাবা, তোমার জন্য সমাজে মুখ দেখাতে পারছি না আমরা। বুড়ো বয়সে পুতের শক্ত ধমক খেয়ে বেশ কিছুদিন ঠান্ডা থাকে মাসুকের বাপ। বউহীনতার জ্বালা তিনি জানান দেন সবাইকে। কিন্তু কে শুনে কার কষ্টের কাহিনি, লোকজন বলে, তুমি বুড়ো মানুষ বরং পোলাটার সময় হয়েছে, ওকে বিয়ে দাও, ওর বউ এসে ঘর সামলাবে।
পাবলিকের নানা উল্টা পাল্টা বয়ান শুনে বিরক্ত বুড়ো বলল, পুত্রবধু ঘর সামলাবে বটে কিন্তু আমারে সামলাবে কে। আমার কি তাকত নেই, সব কি আমার শেষ হয়ে গেছে। কুড়ির পুড়ি এখনও আমার কাছে হার মানবে।
বিয়ে পাগলা বুড়োকে কত আর কত শাসাবে পুত্র মাসুক। এবার সে হাল ছেড়ে দিল।
অনেক টাকাকড়ি খসায়ে ঘটক ফেল, এবার রঙ্গি ঝির পিছু নিল মাসুকের বাপ। তোমার নাতনি সুখী হবে, রাজরানি হবে, সোনার পালঙ্গে বসে পায়ের উপর পা তুলে খাবে, আর কত কি।
অনেক টাকাকড়ি খসায়ে ঘটক ফেল, এবার রঙ্গি ঝির পিছু নিল মাসুকের বাপ। তোমার নাতনি সুখী হবে, রাজরানি হবে, সোনার পালঙ্গে বসে পায়ের উপর পা তুলে খাবে, আর কত কি।
একদিন মামা বললেন হাসনার বিয়ে ঠিকঠাক। আমাদের গোল্লাছুট খেলার সাথি হাসনার বিয়ের সংবাদটা শুনে আমরা হতবাক। সবাই রঙ্গি ঝিকে ধমকান, এতটুকুন কচি মেয়ে, এত সাত সকালে বিয়ে দেওনের এত তাড়া কেন?
রঙ্গি ঝি বয়ান ছাড়লেন, এই দুনিয়ার ভিত্তে হাঙ্গা বিয়ে কত হয়। আমরা গরিব মানুষ, বিয়ে একখান দিলেই অয়। গরিবের ঘরে সুন্দরী মাইয়া, দিন পোহালে ডাঙ্গর হবে, মিঠা রসগোল্লায় পিপড়ে পড়বে, তখন পাহারা দিবে কেডায়।
রঙ্গি ঝির যুক্তি মধুর। মামার বুঝতে কোন অসুবিধা হল না, ধনসম্পদ জবর মিঠা। এর পিয়াস সহজে মেঠে না, যার যা আছে তাতে তার খাই খাই যায় না। যতই থাকুক তার আর চাই। অন্যের সম্পদ, টাকা পয়সা, ধনরত্নের গল্প শুনলে সবার অতৃপ্ত হৃদয় হাহাকার করে উঠে। জিবে পানি জমে যায়।
এই ধনের মৌ মৌ গন্ধে অন্ধ নানি শেষমেষ বালিকা হাসনাকে বুড়োর পিঞ্জিরায় ছুড়ে দেন। বুড়োর সাথে সংসার খেলা খেলতে হবে, তাই বালিকা হাসনার সাথে আমাদের পুতুল খেলার আসর আহারে জিন্দেগির জন্য সাঙ্গ হয়ে গেল।
এই ধনের মৌ মৌ গন্ধে অন্ধ নানি শেষমেষ বালিকা হাসনাকে বুড়োর পিঞ্জিরায় ছুড়ে দেন। বুড়োর সাথে সংসার খেলা খেলতে হবে, তাই বালিকা হাসনার সাথে আমাদের পুতুল খেলার আসর আহারে জিন্দেগির জন্য সাঙ্গ হয়ে গেল।
রঙ্গি ঝি এখন দারুন সুখী, পান সুপারীতে সারাদিন জাবর কাটেন আর ইন্ডিয়ান পাতার বিড়িতে দেন সুখটান। বড়লোক নাতিন জামাই পানবিড়ির যে অভাব নাই।
নানিজান এলে মাসুকের বাপ নতুন বালিকা বউকে ধমক দেন, হেই হাসনা, তুই কই? জলদি আয়, নানিরে চা দে, পান দে, নাস্তা দে।
বছর ঘুরতে না ঘুরতে নাতিনের পেডে বাচ্চা এলো। সবাই বলল, বাচ্চার পেডে বাচ্চা, একটা বাচ্চা মেয়ে আরেকটা বাচ্চা জন্মদিয়ে পুষবে কেমনে।
রঙ্গি ঝি হাসনাকে শক্ত ঝাড়ি দেন, তুই হেইদিন্যার ছেমড়ি, তর বয়স এখনো অয়নি চৌদ্দ বছর। এর ভিত্তে কিয়েরলাই বাজাই দিলি। ইয়ানতুন পত্তিদিন পিল খাইবি হারামজাদি।
হাসনা কাঁদে, চোখ মুছে মুছে বলে, উনি মুরব্বী মানুষ বাজানের লগের অন, তানেরে আমার ডর লাগে, বিষ বিষ লাগে, আমি আর তানোর ঘর করতে পারতাম নো।
রঙ্গি ঝি আঙ্গুল উচিয়ে বলেন, চুপ কর ছেমরি, তুই বুড়া মানুষের লগে আছস। ঝামেলা পাকাস না, বুড়ো মানুষটার জোয়ানকি রোজ রোজ মিঠায় দিবি কিন্তু। নইলে মানুষটা ঝামেলা বাঁধাবে। কড়ি থাকলে তর মত ছেমড়ির অভাব নেই। লোকটা যদি মুতা বিয়া কইরা ফালায়। মুতা বিয়া অহনো বহু দেশে হয়।
মুতা বিয়া না ছাই, হাসনা রঙ্গিজানের কথাবাত্তার কিছুই বুঝে না। আপন মনে কয় হাসনা, শুনো নানিজান, এমন বিয়া করাইছ একখান, আমি ভাবিয়া হই পেরেশান। পাকনা চুল বাছি আর ভাবি, উনি আমার স্বামীজান, না শ্বশুর-আব্বাজান।
পাশের চা বাগানে গিয়ে রাতে পাতলা তরলে চুমুক মারার পুরানো অভ্যাস মাসুকের বাপকে আবার চেপে ধরে। এক রাতে সে নেশায় ঢুলু ঢুলু হয়ে বাড়ি ফিরে। শোবার ঘর মনে করে সে ঢুকে পরে গোয়ালঘরে। বিদেশি হাতিমার্কা গাভীটার লেজ ধরে বিলি কাটে আর বলে, হাসনা আমার সোনার ময়না গো, তুমি পত্তিদিন মাথায় চুলের দুইটি বেনী বাঁধো, আজ বেধেছো মাত্র একটি। আদর করে লেজে ঠোঁট ছোঁয়ায়ে চুমা খেতেই গাভীর বিয়াল্লিশ মন ওজনের লাত্থি উপহার আসে। প্রেমাদরের তুহফা খেয়ে সে লাটিমের মত দূরে ছিটকে পড়ে। বুড়োর গোঙ্গানী শুনে ছুটে আসে বাড়ির সবাই। ধরাধরি করে বুড়োকে নিয়ে শোয়ানো হয় বিছানায়।
বিহানে মাসুকের উঠোনে মানুষের ভীড়। কান পেতে শুনি কে একজন বলছে, বুড়ো বয়সে অস্টেলিয়ান মোঠা গাভীর হেভীওয়েট লাত্থী সইতে পারে নি মাসুকের বাপ। হার্টফেল করে সে পরপারে পাড়ি দিয়েছে।
রঙ্গি ঝি এবার হন্তদন্ত হয়ে ফিরলেন আমার নানাবাড়ির দরবারে। কাঁদো কাঁদো গলায় বললেন, আমার নাতিনটার পেডে বাচ্চা তুইয়া বুড়োটা চইল্লা গেল। এখন আমার নাতিনটার কি হবেগো মাইজি, কি হবে।
আনমনা নানি বড় বড় নিঃশ্বাস ফেলে বলে যান,
এত বারণের পরো ঘাটের মড়ার হাতে নাতিন দিলি, এবার ঠেলা সামলা। আমরারে লুকাইয়া লুকাইয়া হাসনারে বিয়া দিছিস। রঙ্গি তুই খুব সেয়ানা। বেশী সেয়ানায় ডুব দিয়া হাগে, ময়লা ভাসি মাথায় লাগে। এখন কান্নাকাটি করে কোন লাভ নাই রে রঙ্গি, কোন লাভ নাই। হাসনা আর তর দুই দুইয়ে চারপা তুই বান্দিয়া দিছত কদম্বের ডালে, গাল নয়, এবার কপাল ভাসবো তোমরার নয়নের জলে।
এত বারণের পরো ঘাটের মড়ার হাতে নাতিন দিলি, এবার ঠেলা সামলা। আমরারে লুকাইয়া লুকাইয়া হাসনারে বিয়া দিছিস। রঙ্গি তুই খুব সেয়ানা। বেশী সেয়ানায় ডুব দিয়া হাগে, ময়লা ভাসি মাথায় লাগে। এখন কান্নাকাটি করে কোন লাভ নাই রে রঙ্গি, কোন লাভ নাই। হাসনা আর তর দুই দুইয়ে চারপা তুই বান্দিয়া দিছত কদম্বের ডালে, গাল নয়, এবার কপাল ভাসবো তোমরার নয়নের জলে।
রচনাকালঃ জানুয়ারি--২০১৬ সাল।
বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ দাদা, দাদি, নানা ও নানি চারজনের মধ্যে আমি কেবল নানি রফিকুন্নেছা চৌধুরীর স্নেহমমতা পাই। তিনি আজ নেই। আমি আপনাদের সবার দোয়া চাই তিনি যেন জান্নাতবাসী হন। গল্পটি কাল্পনিক। রঙ্গি ঝিও একটি অলীক চরিত্র, তবে এনামে নানাবাড়ির এইজন ঝি ছিলেন যিনি খুবই ভাল মানুষ। এই নামটি কেন যেন ভাল লেগে গেল তাই এই গল্পে ব্যবহার করলাম। রঙ্গি ঝিকে আল্লাহ্ মাফ করুন। আমিন। নিচে আমার নানির একটি ফটো দিলাম।
আমার নানি রফিকুন্নেছা চৌধুরী
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন