রবিবার, ২৬ জুলাই, ২০২০

যুক্তরাষ্ট্রে পঞ্চম অভিযাত্রাঃ কুয়েত, নিউইয়র্ক এবং ফ্লোরিডার ডিজনিওয়াল্ড সফরঃ পর্ব- দুই


যুক্তরাষ্ট্রে পঞ্চম অভিযাত্রাঃ কুয়েত, নিউইয়র্ক এবং ফ্লোরিডার ডিজনিওয়াল্ড সফরঃ পর্ব- দুই

অসুস্থ একজন বেয়াইনকে সিলেট হতে বয়ে নিয়ে জনসেবা করতে গিয়ে জে.এফ.কে.তে এক উটকো ঝামেলায় পড়ে আমরা মারাত্মক দুশ্চিন্তার আগুনে প্রায় চারঘণ্টা জ্বলেপুড়ে ছারখার হই, সেইসাথে পঞ্চাশ হাজার টাকা অযথা খোয়াই, একেই বলে জনসেবার বিড়ম্বনা।

বিড়ম্বনার এখানেই শেষ নয়, পরে উড়ালযানে নিউইয়র্ক হতে ফ্লোরিডা যেতে দেখি যুক্তরাষ্ট্রের সবকটি এয়ারপোর্টে জেফারকে সারি থেকে আলাদা করে মেশিনে ডুকায়ে ঘণ্টা দেড়ঘণ্টা পরীক্ষা করছে। কতৃপক্ষের আচরণটা এমন যে জেফার যেন একজন সন্দেহভাজন অপরাধী। লাইনের সব লোকজনকে দ্রুত ছেড়ে দিয়ে আমাদেরে পরীক্ষা করছে, যা সহজে শেষ হচ্ছেনা। আমাদের প্লেন ছেড়ে দেবে এদিকেও যেন তাদের কোন খেয়ালই নেই। আমরা তৃতীয় বিশ্বের একটি গরীব দেশের লোক, তদুপরি দেশটি মুসলিম। তাই বলে কি আমরা তাদের কাছে এত অবজ্ঞা অবহেলার পাত্র। নুরজাহান বললেন, জেফারকে নিয়ে আমেরিকার ভিতরে আর প্লেনে ঘুরাফেরা করা যাবেনা। জেফারকে জেএফকের ইমিগ্রেশনে ফেলে রেখে আমার ভাগনার শ্বাশুড়ি দ্রুত চলে যাবার কারনেই অভিভাবকহীন জেফারকে কতৃপক্ষ খুবসম্ভব সন্দেহের তালিকায় ফেলে দেয়, নতুবা যুক্তরাষ্ট্রের সবকটি এয়ারপোর্টে তারসাথে কেন এমন বিদগুটে অসদাচারন করবে ওরা।    

জে.এফ.কে.তে তিন-চার ঘন্টা অপেক্ষার পর আবার সিকিউরিটির সাথে ঠেলাঠেলি করে জেফারের আটক কক্ষের দিকে যাবার চেষ্টা করি। একজন হোমল্যান্ড সিকিউরিটি অফিসার এগিয়ে এলে তাকে বললাম, Please give me chance to meet with my son who is staying here এবার অফিসারটি জেফারকে আমার সামনে নিয়ে আসে এবং সে আমাদের ফেসবুক পরীক্ষা করে। তারা আমার নোঠখাতা পড়ে দেখে এবং জানতে চায় জেফার কেন বারবার বাংলাদেশে আসা যাওয়া করছে। আমরা প্রমান দেখিয়ে বললাম সে বাংলাদেশের একটি মেডিক্যাল কলেজে পড়ছে, লেখাপড়া শেষ হলেই স্থায়ীভাবে যুক্তরাষ্ট্রে চলে আসবে। শেষমেশ তাদের হাত থেকে আমরা রেহাই পেলাম।   

আমাদের গন্তব্য আজিজ ভাইয়ের বাসাটি জে.এফ.কে এয়ারপোর্ট হতে খুববেশী দূরে নয়। বের হয়ে মাত্র বিশবাইশ মিনিটে ওজনপার্কে অবস্থিত আজিজ ভাইয়ের  বাসায় পৌঁছে যাই।

৭জুলাই ২০১৯। নিউইয়র্কের এই দিনটি ছিল শুক্রবার। আমরা সবাই দলবেঁধে ওজনপার্ক মসজিদে জুম্মার নামাজ পড়ি। মান্নান সুপার মার্কেটে মালামাল কিনি, এখানে গতবারের মত এবারও আমার বাসার সাবেক ভাড়াটিয়া কানাইঘাটের ফজল মিয়ার সাথে দেখা হয়।

জেফার ও আমাকে বিকেলে আরিক গাড়ি চালিয়ে ‘আমেরিকান বক্সিং এন্ড ফিটনেস ক্লাবে’ নিয়ে যায়। আরিক এই ক্লাবের একজন মেম্বার। এই মেম্বারসীপের জন্য তাকে একটা মাসিক চাঁদা দিতে হয়। সাথে ছিলেন আরিকের একজন ল্যাটিন বন্ধু। এখানে দড়িলাফ হতে শুরু করে ধারাবাহিক বেশ কিছু ব্যায়াম করানো হয়। খাবারের ছড়াছড়ির দেশ আমেরিকা। তাই স্থুলতা এখানে এক মৌলিক স্বাস্থ্য সমস্যা। এই ক্লাবে দেহের ওজন নিয়ন্ত্রনের ব্যবস্থা করা হয়। ওজন পরীক্ষা করে যথাযত খাবার তালিকা নির্ধারন করে দেয়া হয়। মেম্বারদের মানসিক স্বাস্থ্য কেমন যাচ্ছে, তাও দেখা হয় ও প্রতিকার করা হয়। এখানে কুস্তি ও ব্যাডমিন্টন খেলার ইন্ডোর ব্যবস্থা এবং কুস্তিমঞ্চ রয়েছে। আরিক জ্যাকেট পরে তার ল্যাটিন বন্ধুর সাথে মঞ্চে গিয়ে কুস্তি প্র্যাকটিস করে। এসি ঘরের ভিতর সবাই ঘেমে ভিজে চুপসে যান। আমি ও জেফার আর অনেক আমেরিকানদের সাথে দড়িলাফ দিয়ে হাফিয়ে উঠি।

এই আমেরিকান ক্লাবের ইন্সটাক্টর একজন নীলচোখের শ্বেতাঙ্গ। হাফপ্যান্ট ও গ্যাঞ্জিপরা ক্লিনসেভ লোকটাকে দেখতে তরুণই লাগে। গড়িতে করে বাসায় ফিরছি। আরিকের ল্যাটিন বন্ধুটি আমাকে বিস্মিত করে বলল, This guy is young man of ninety, some days ago we have taken his birthday cake.আসলে উন্নত দেশের মানুষ আমাদের চেয়ে গড়ে বাচে বেশী এবং সহজে বুড়ো হয়না। এমনকি তারা বুড়ো হতেও চায়না। বুড়ো শব্দটিকে তারা মনেপ্রানে ঘৃনা করে। কাউকে ‘বুড়ো’ বললে সে আপনার প্রতি সিরিয়াস ক্রুদ্ধ হবে। ধরে নেবে তাকে বুড়ো ডেকেছেন তো গালী দিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ট ট্রাম্প তার প্রতিপক্ষ উত্তর কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট কিম জন উনকে টাট্টা করে বললেন ‘মিস্টার রকেটম্যান’, ওমনি তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে কিম পালটা হুমকি দেন তাকে রকেটম্যান বলে হাসিটাট্টা করলে বয়স্ক মার্কিন প্রেসিডেন্টকে কোন ছাড় দিবেন না, ট্রামকে বলে দিবেন ‘আমেরিকান ওল্ডম্যান’।

আপনি যদি মিস্টার ইয়াংম্যান কিংবা মিসেস ইয়াং লেডি বলে সম্বোধন করেন তাহলে পশ্চিমা দেশের বুড়ো বুড়িরা নিদ্বিধায় খুশী হবে এবং আপনাকে সহজেই আপন করে নেবে। 

বুড়োত্ব ঢেকে দিতে যত ধরনের প্রচেষ্টা আছে, পশ্চিমারা অবলীলায় সব করে যান। এসময় তারা ক্লিনসেভ করা বাড়িয়ে দেন, ঠুটে গাঢ় লিপিস্টিক দেন, জমকালো পোষাক পরেন। চামড়ার বলিরেখা মুছে দিতে প্লাস্টিক সার্জারি করেন এবং যৌবন ধরে রাখার জন্য ভিটামিন-ই খান। অথচ আমরা বুড়ো হলে সাদা কাপড় পরি, দাড়ি রাখি, চাকচিক্য পরিহার করি। তাই বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে পশ্চিমারা যে আচরণ করেন তা আমাদের দেশের মানব চরিত্রের একদম বিপরীত। আমরা বুড়ো হওয়াকে হাসিমুখে মেনে নেই, আল্লাহের ডাকে সাড়া দিয়ে পরপারে চলে যাবার প্রস্তুতি নেই, কেবলার দিকে মুখ ফিরাই কিন্তু তারা তা তেমনটি করেনা।

ইপক আমার রনকেলীর খালাত বোন কলি আপার ছেলে। রাতে সে তার গাড়িতে করে আমাদেরকে মামাত বোন রিপনের বাসায় নিয়ে যায়। ইপক একসময় ডাচবাংলা ব্যাংকে চাকুরী করত। এখন সে আমেরিকায় আছে। দেশে ডাচবাংলা ব্যাংকের ভাল চাকুরী ছেড়ে এখানে এসে কি পেলে? আমার এই প্রশ্নের জবাবে ইপক বলল, এখানে শান্তি পেয়েছি। ডাচবাংলার চাকুরীতে কোন শান্তি ছিলনা। এখানে কাজ হতে বাসায় ফিরে অনাবিল শান্তিতে নির্ভেজাল ঘুম হয়। আমার বড় মামা মামির বহুদিন পর এবাসায় সাথে দেখা হল। ভাগ্নি মুনিয়াত এবং নিয়ামাকে আবার পেলাম।আমার এবারের ভ্রমণ টার্গেট ডিজনীওয়াল্ড, অরলান্ডো, ফ্লোরিডা। সব তথ্য আগেই ইন্টারনেটে নিয়েছি। এবার ডিজনীওয়াল্ড সফরের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পালা।

৮জুন ২০১৪, শনিবার। রাতে ওরলান্ডো যাবার জন্য ৭২৫ ডলার করে প্লেনের টিকেট পাই, কিন্তু রিপন অফিসে থাকায় ডেবিট কাডের অভাবে বুকিং করতে পারিনি। পরদিন সকালে মামাত বোন আরফার বাসায় যাই, সেখানে বুকিং করতে গিয়ে দেখি একই টিকেটের দাম বেড়ে ১০০০ডলার হয়ে গেছে। এদেশে প্লেনের টিকেটের দাম চাহিদার সাথে এভাবেই আকাশ-পাতাল উঠানামা করে। আমাদের অপেক্ষার সময় নেই, তাই ভাগ্নি রাইসার ডেবিট কাডে ৩০০০ডলার পরিশোধ করে আমাদের তিনজনের ফ্লোরিডা যাবার রিটার্ন টিকেট করি। ডিজনীওয়াল্ডের কাছে মেরিন ড্রাইভ সড়কের সেরালাগো হোটেল এন্ড রিসোর্টে তিনজনের একটি ফেমিলি কটেজ ১১ হতে ১৪ জুন চাররাতের জন্য বুকিং করি।

এইদিন দুপুরে ইপক আমাদেরকে ওজনপার্কে আমাদের মূল স্টেশনে পৌছে দেয়। বিকেলে আসেন সুমির সুদর্শন ও শিক্ষিত আজাদ কাশ্মিরী স্বামী যিনি পাকিস্থান এম্বেসির একজন ডিপ্লোমেট। সুমি আমার বড় সম্মন্দি কবির আহমদ চৌধুরীর কন্যা।

৯জুন ২০১৯, রবিবার। দুপুরে ইপক এসে আমাদেরকে খালাতো ভাই সাহেদ ও খালাতো বোন শিবলী খানমের বাসায় নিয়ে যায়। একটি গাড় সবুজ পাহাড়ি এলাকায় এই বাসার অবস্থান। বাসার এক কক্ষে ভাগ্নির বিয়ের গায়েহলুদ অনুষ্টান অয়োজনের প্রস্তুতি দেখে আসি। কাছেই আমার চাচাত শালিকা মনাচাচার মেয়ের বাসায় যাই। সে হাতে তৈরি নানাপদের নাস্তা পরিবেশন করে। এই শালিকার স্বামীর বাড়ি ফেন্সুগঞ্জের ঘিলাছড়া। ইপকের বাসায় গিয়ে একই ভবনের অন্য ফ্ল্যাটে আমার খালাত বোন এলি আপার সাথে দেখা করি। এলি আপার স্বামী ইঞ্জিনিয়ার কামাল এ চৌধুরীর বাড়ি জকিগঞ্জের গনিপুর। মুন্সিপাড়ায় বড় বাসা ফেলে এসে আমেরিকার ছোট ফ্ল্যাটে ছটফট করছেন। ইপকের ফ্ল্যাটে রাত কাটাই। তার দুই শিশুপুত্র ইয়াকিদ ও আরবিদ স্কুলে যায়। ইপকের স্ত্রী মৌলভীবাজারের বেকামুরার কন্যা। তিনি এম পি গিয়াস উদ্দিন চৌধুরীর ভাতিজী। এই গুনবতী কন্যা আমাদের খুব সেবাযত্ন করেন। তিনি রাতে রান্না করে প্রচুর মাছ ভাত রোস্ট পোলাও এবং ফল হীমবক্সে প্যাকিং করে দেন। শেষরাতে ইপক আমাদেরকে প্রায় ঘন্টাখানিক কার চালিয়ে হার্ডসন ব্রিজ পেরিয়ে নিউজার্সির নিউআর্ক এয়ারপোর্টে নিয়ে যায়। স্পিরিট এয়ারের ছোট প্লেনটি বাহাত্তুর জন যাত্রি নিয়ে দশ হাজার ফুট উপর দিয়ে ফ্লোরিডার দিকে যাত্রা করে। নিচে আটলান্টিক মহাসাগর ও সবুজ উপকুল পরিস্কার দেখা যাচ্ছে। এমনকি সমুদ্রগামী বেশ কয়েকটি নদীকে আটলান্টিকে মিলিত হবার দৃশ্যও চোখে পড়ে। প্লেনে নুরজাহান পানি কিনতে চাইলে ডেবিট কার্ডের অভাবে কেনা সম্ভব হয়নি। নগদ ডলারে এখানে কিছুই কেনার ব্যবস্থা নেই। একজন আমেরিকানকে ডলার দিলে তিনি তার কার্ড দিয়ে এক বোতল পানি কিনে দেন। প্রায় সাড়ে তিন ঘন্টা পর ডিজনীওয়াল্ডের শহর ওরলান্ডোর আকাশে এসে যাই। প্লেনটি ওরলান্ডোর আকাশে চক্কর দিলে নিচে নদী সাগর ও ঝিল পরিবেষ্টিত বাংলাদেশের মত চিরসবুজ অরলান্ডোকে অপুর্ব সুন্দর একটি শহর মনে হল। দুইটি নদী যেন শহরটাকে আবর্তন করে মিলিত হয়ে দূর সাগরে গিয়ে পড়েছে।(চলবে)


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন