শুক্রবার, ২১ জুন, ২০২৪

স্মৃতিতে পুবালী ব্যাংক আঞ্চলিক অফিস ও মহিলা কলেজ শাখাঃ

 

স্মৃতিতে পুবালী ব্যাংক আঞ্চলিক অফিস ও মহিলা কলেজ শাখাঃ

অবস্থানকালঃ ২৭ আগষ্ট ১৯৯০ সাল হতে ১ মার্চ ১৯৯৩ সাল সময়ঃ ২ বৎসর ৬ মাস ২ দিন।

২৭ আগস্ট ১৯৯০ সালে আমি চাকুরীতে যোগদান করতে ছূটলাম বন্দরবাজারে অবস্থিত পুবালী ব্যাংক লিমিটেড, সিলেট আঞ্চলিক অফিসে। পুবালী ব্যাংকের নিজস্ব পাঁচতলা ভবনের চারতলায় সিঁড়ি বেয়ে উঠে আঞ্চলিক অফিসে প্রবেশ করি। তখন পুবালী ব্যাংকের আঞ্চলিক প্রধান ছিলেন উপমহাব্যবস্থাপক আব্দুল মজিদ, যাকে আমি অনেকবার ইতিপূর্বে জনাব ই এ চৌধুরীর সাথে দাউদপুরের বাড়িতে যেতে দেখেছি। তিনি বললেন, আপনাকে মহিলা কলেজ শাখায় দিলে কেমন হয়। এই মহিলা কলেজ শাখা কোথায় আমার কোন ধারনা ছিলনা। মনে হল এটি হয়ত কলেজের ভিতরে হবে, তাই ভাবলাম মেয়েদের আড্ডাখানায় এক শিক্ষিত পরিবেশে কাজ করা যাবে

আমি উত্তর দিলাম স্যার আপনার ইচ্ছে হলে দিতে পারেন। মজিদ স্যার তখন বললেন আজ ও কাল দুইদিন এই অফিসে অবস্থান করবেন এবং ২৮ আগস্ট বিকেলে আপনি ছাড়পত্র নিয়ে পরদিন মহিলা কলেজ শাখায় যোগদান করবেন। দাউদপুর হতে ২৯ আগষ্ট আমি সিলেট মহিলা কলেজ শাখায় গিয়ে সকাল ৯ ঘটিকায় ব্যবস্থাপক রুস্তম আলী স্যারের কাছে জয়েনিং রিপোর্ট পেশকরি।

হাসিখুশি রুস্তম আলী স্যার ছোটখাট হালকা পাতলা লোক। তার বাড়ি কুমিল্লার লাকসামে, তিনি ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় হতে অনার্স ও মাস্টার্স। আমি পরিচয় প্রদান করলে তিনি আমাকে চাকুরিসংক্রান্ত কিছু উপদেশ দিয়ে বললেন আপনি তো একটু নিচের লেবেলে ঢুকে গেছেন, এখান হতে উপরে উঠা বেশ কঠিন। জুনিয়র অফিসারে ঢুকে ব্যাংকের আকাশছুঁয়া খুব কম মানুষের ভাগ্যে জুটে।

এইদিনই আমি বুঝলাম ব্যাংকে সিনিয়র অফিসার, অফিসার ও জুনিয়র অফিসার এই তিন পদে অফিসার নিয়োগ করা হয়। ১৯৯০ সালে পুবালী ব্যাংকে যোগদানকারী ব্যাচটি একটি ভাগ্যহীন ব্যাচ। সেই বছর পত্রিকায় সিনিয়র অফিসার পদে নিয়োগের বিজ্ঞাপন দেওয়া হলেও তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক আব্দুল মতিন খান সিনিয়র অফিসার নিয়োগ বাদ দেন এবং সবাইকে কেবল অফিসার ও জুনিয়র অফিসার এই দুইপদে নিয়োগ দেন। ফলে প্রথমেই এক কিংবা দূই পদ নিশ্চিতভাবে নিচে নিয়োগপত্র পাই। অথচ ১৯৮৭,  ১৯৮৮ কিংবা ১৯৮৯ সালে ব্যাংকে ঢুকলে এই ধাক্কা খেতে হত না। তাছাড়া এই  ভাগ্যহীন ব্যাচের শিক্ষানবিশ কালও একের স্থলে দুই বৎসর করে দেওয়া হয়

যোগদানের প্রথমদিনই বুঝলাম পুবালী ব্যাংকে আমি এক শুভঙ্করের ফাঁকিতে পড়ে গেছি। মনে মনে ভাবি এখানে আমি কিছুদিন সময় কাটাতে এসেছি, সময়ে সুযোগ পেলেই পাততাড়ি গুটাবো। অথচ সেই শুভঙ্করের ফাঁকির চোরাবালিতে হাবুডুবু খেয়ে সারাটা চাকুরি জীবন পার করতে হল। তখন মনে হল বছর দেড়েক আগে গ্রিনডেল্টা ইন্সুরেন্স কোম্পানিতে সিনিয়র অফিসারে যোগদান না করে আমি কি ভূলটা করেছি। আমার আত্মীয়স্বজন ও প্রতিবেশীদের মালিকানাধীন পূবালীতে সারাজীবন পার করে আজ প্রৌঢ় বয়সে হিসেব করলে দেখি অন্যদের তুলনায় যেই লাউ সেই কদু ছাড়া কোন সুযোগ সুবিধা আমার ভাগ্যে জুটেনি। এমন কি বাহিরের জগতের লোকজনে প্রচুর সম্মান এবং সহানুভূতি পেলেও এখানে আমাকে শেষদিকে সব ধরণের হেনস্থা ও অপমানের মুখোমুখি হয়ে কাজ করতে হয় ব্যাংকে থাকা আমার নিজের আত্মীয়সম্পর্কীয় লোকজনের নানা অন্যায় আচরণের কারণে   

দাউদপুর হতে আগের মত সকালে বের হয়ে ভূদৌঁড় দিয়ে ৯টায় এসে অফিসে ঢুকতাম। বিকেল ৫টার পর দাউদপুর ফিরতাম। ভাউচার চিনতে আমাকে প্রথমে টোকেন ইস্যুতে বসান হল। পাশে বসতেন কর্মচারী সাথী পাঠক দিদি। খুব ধৈর্যশীলা শান্তসুবোধ সাথীদি তার পদের চেয়ে বড়পদের কাজ অনায়াসে করে যেতেন, এমন কি প্রয়োজনে ক্লিনক্যাশও মিলাতেন। আমি ব্যাংকের প্রাথমিক কাজগুলো তাঁর কাছে শিখে নেই। সাথীদিদির স্বামী ছিলেন সিলাম উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং পুত্র বিনায়ক পূবালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপক।

সাথী দিদি আজ নেই। তার জীবনের শেষবেলায় পাঁচছয় বৎসর মরণব্যাধী স্থন ক্যান্সারের সাথে অতি মনোবল নিয়ে যুদ্ধ করেন এবং সেইসাথে ব্যাংকের চাকুরিও চালিয়ে যান। অক্টোবর ২০১৮ তে তিনি চাকুরি জীবন পুর্ণ করে সিলেট স্টেডিয়াম শাখা হতে যথারীতি অবসর গ্রহ করেন। একদিন স্টেডিয়াম শাখায় তার বিদায় সম্বর্ধণা হয়। অল্প বয়সে চাকুরিতে ঢুকে সারাজীবন সংগ্রাম করে প্রশান্ত চিত্তে সাথীদি ফিরলেন ঘরে। কিন্তু তিনি আর বিশ্রাম নিতে পারলেন না। কিছুদিনের মধ্যেই ঈশ্বর তাকে আদর করে তাঁর কাছে নিয়ে যান 

সহকর্মী শ্যামলী নন্দী ছিলেন মেঘবর কন্যা, লম্বা কাজল কালো চূল, মায়াবী চেহারা ও স্পষ্টসাধু বাচনঙ্গি তার বুদ্ধিমত্তা ও স্মার্টনেস প্রকাশ করত। হিন্দুদের মধ্যে সেকেন্ড লাইন ভাইবোনের মধ্যে বিয়েসাদি হয়না। শ্যামলী নন্দী বলতেন মুসলমানদের সেকেন্ড লাইন ভাইবোনের মধ্যে বিয়ে হচ্ছে শুনলে আমার মনে কি যেন একটা কিত কিত করে। শ্যামলী দিদিও খুব ভাগ্যবতী, এসএসসি পাস করে টাইপিষ্ট পদে ব্যাংকে ঢুকে আজ লাখ টাকা বেতনের এসপিও।

নোয়াখালীর যুবক কবির আহমদ ছিলেন ক্যাশিয়ার কাম ক্লার্কগৌরবর্ণ কবির আহদের অংক মেলানোর ব্রেন খুব একটা ভাল ছিলনা, তাই কাজে প্রচুর ভুলভ্রান্তি হত। তিনি নোয়াখালীর আঞ্চলিক ভাষায় গান গাইতেন, ‘বরের চাইতে কইন্যা বড়, ই বিয়ার কি ডেফ আছে। আর হুনলাম কইন্যার মা হ্যালদি উঠে তালগাছে’শুনেছি কবির সাহেব এক সময় ব্যাংকের চাকুরি ছেড়ে দেন ও অল্প বয়সে মারা যান।

কর্মপাগল হারাধন নাথের বাড়ি ছিল ছাগলনাইয়া, ফেনী তিনি ১৫/২০ বছর ধরে সিলেট অঞ্চলে হাবুডুবু খাচ্ছেন, হেড অফিসে বদলির আবেদন করেছেন কিন্তু কাজ হচ্ছে না। মেয়েরা বিয়ের উপযুক্ত অথচ বাবা বছরের পর বছর সিলেটে। আমাকে ধরলেন আমার চাচাত ভাই ই এ চৌধুরীকে দিয়ে তাকে চট্টগ্রাম কিংবা ফেনী যাবার যেন একটা উপায় করে দেই। এই কাজের অগ্রিম এনাম স্বরূপ আমাকে হাত করতে তিনি প্রতিমাসে আমার দুই একটা লেজার ব্যালেন্সিং করে দিতেন। 

একবার ব্যাংকের প্রশিক্ষণে ঢাকা যাই। এক ফাঁকে চেয়ারম্যান অফিসে গিয়ে চাচাতো ভাই ই এ চৌধুরীর সাথে দেখা করি ও আসার সময় হারাধনের আবেদনপত্র তার হাতে দিলে তিনি একটু বিরক্ত হয়ে হাতে নেন আমার কিছুটা সন্দেহ ছিল কাজটা হবে তো? কিন্তু মাস দেড়েক যেতে না যেতেই হারাধন নাথের বদলির আদেশ আসে সিডিয়ে শাখা চট্টগ্রামে বদলির আদেশ পেয়ে হারাধন আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলেন, কার তখন আঞ্চলিক বদলি আজকের মত এত সহজ ছিল না। তিনি আবেগ আপ্লুতকন্ঠে বললেন কোরেশী সাহেব, ভগবান আপনার মঙ্গল করুন। আমি বললাম, বলুন কোরেশীকে নয়, আল্লাহ ই এ চৌধুরীর মঙ্গল করুন। জবাব দেন, ভগবান আপনারা দুনোজনের মঙ্গল করুন।  

এখানে ক্যাশ কাউন্টারে কাজ করতেন নোয়াখালীর বেখাপ্পা চেহারার ক্যাশ অফিসার ফরিদ আহমদ। ফরিদ আহমদ কাজে দক্ষ, ক্যাশে ভূল হত কম। ক্যাশ ইনচার্জ ছিলেন বয়স্ক হবিগঞ্জি লোক এম এ মন্নান, যিনি অংকে এতই কাচা ছিলেন যে তার পক্ষে তিন লাইনের একটা যোগ মিলানো ছিল অসম্ভবযোগ-বিয়োগের কাজ তুষামুদি করে অন্যকে দিয়ে করিয়ে নিতেন। মনে মনে ভাবতাম এত দূর্বল গাণিতিক মস্তিস্ক নিয়ে তিনি সারাজীবন ব্যাংকে চাকুরি করলেন কেমন করে? শেষে বুঝলাম এই ধূর্ত মানুষটি টিকে আছেন কেবল চাপার জুরেবাকপটু এই চাপাবাজ মানুষটি কোন পরিশ্রম না করেই সারাজীবন ব্যাংকে কেবল উন্নতি করেন কোন টেবিলকাজ না করেও এসএসসি পাস এম এ মন্নান বরইকান্দি শাখার ব্যবস্থাপক হন এবং সিনিয়র প্রিন্সিপাল অফিসার হিসাবে অবসর গ্রহ করেন। একেই বলে তৈলশক্তি। 

এই এম এ মান্নান সাহেব যতরপুরে এক হিন্দুবাড়ি ভাড়া নিয়ে নাকি দখল করে বসেন। তার একটা গু ছিল, নিজের অতীত অপকটে স্বীকার করে তিনি আমাকে বলতেন, ‘চৌধুরী সাব, আমি কোনমতে মেট্রিক পাশ করে লাঙল জোয়াল ফেলে শুন্যহাতে হবিগঞ্জ হতে পূবালী ব্যাংকের ক্যাশিয়ার হয়ে সিলেটে আসি, আজ এই শহরে আমার গাড়ি বাড়ি সবই এই রত্নপ্রসবা পুবালী ব্যাংকে বসে হয়ে গেছে। মন্নান সাহেব বদলি হলে আসেন কুমিল্লার কাজি সফিক। সদাহাস্য কাজি সফিক ছিলেন কথাবার্তায় স্মার্ট কাজে দক্ষ সুদর্শন লোক। ফরিদা নামক একজন মহিলা সারাদিন পরিস্কার কর্ম ও ফুটফরমায়েশ কাজ করতেন।

প্রিন্সিপাল অফিসার রুস্তুম আলী স্যারের বাসা ছিল শিবগঞ্জ, তার দুই ছেলে। একদিন আমরা তার ছেলেদের খতনা অনুষ্ঠানে গেলাম। ধুমধাম করে খানাপিনা হল। আমরা কিছু প্রাইজবন্ড উপহার দেই। মজার ব্যাপার হল এই প্রাইজবন্ড হতে স্যার পঞ্চাশ হাজার টাকা লটারি জিতে যান রুস্তুম আলী স্যার ছিলেন ধার্মিক ও আত্মমর্যাদাবোধ সম্পন্ন মানুষ। তিনি সিলেট জালালাবাদ হোমিও কলেজ হতে ডি এইচ এম এস ডিগ্রি নেন। ৭ মার্চ ১৯৯২ সালে রুস্তুম আলী স্যার মহিলা কলেজ শাখা হতে বদলি হয়ে ঢাকা চলে যান। পরবর্তীকালে প্রধান কার্যালয়ে উপমহাব্যবস্থাপক পদে থাকাকালে বারবার পদোন্নতি হতে বাদপড়ায় তিনি হতাশাগ্রস্থ হয়ে পড়েন এবং চাকুরী ছেড়ে হোমিওপ্যাথি পেশায় চলে যান।

পরদিন ৮ মার্চ ১৯৯২, মহিলা কলেজ শাখার ব্যবস্থাপকের দায়িত্বভার গ্রহ করেন আমার অন্যতম প্রিয় ব্যক্তিত্ব ফরিদ উদ্দিন। তাঁর গ্রামের বাড়ি জকিগঞ্জ উপজেলার গঙ্গাজল গ্রামে। ফরিদ উদ্দিন স্যার ন্যায়নিষ্ঠ ও সৎ লোক। তার আদর্শ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি গরম মানুষ ও কোন ধরনের হাংকি পাংকি পছন্দ করতেন না। তিনি গর্বের সাথে বলতেন আমি সোনালী ব্যাংকের অফিসার ও সোনালী ব্যাংকের স্বনামধন্য প্রাক্তন মহাব্যবস্থাপক মুফতি বদরু উদ্দিন স্যারের কাছে ব্যাংকিং শিখে এসেছি এই মুফতি বদরু উদ্দিন ছিলেন দরগামহল্লার আমার আপন ফুফু্তো ভাই, যাকে আমরা ডাকনামে বলতাম ‘এখলাস ভাই’আমি ১৯ মার্চ ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত এক বৎসর দুই মাস ফরিদ উদ্দিন স্যারের সহিত মহিলা কলেজ শাখায় কাজ করি।

ফরিদ উদ্দিন স্যার কারণে অকারণে হঠাৎ রেগে যেতেন, যা পরে তার জন্য ক্ষতির কার হয়ে যেত। শ্যামলী নন্দীর স্বামী একবার পত্নীর কাছে ফোন করলে ফরিদ স্যার ফোন ধরেন। শ্যামলীদিকে ডেকে না দিয়ে তার স্বামীকে বললেন, বউ চাকুরিতে দিছেন, এত ফোনালাপ কিসের? সে কাজ করছে, তাঁকে ডেকে দেওয়া যাবেনা। ফরিদ স্যার শ্যামলীর কর্তার সাথে ফোনে বাকবিতণ্ডায় লিপ্ত হন। সেইদিন আমি শ্যামলীদিকে কাঁদতে দেখি। স্যারের নিষ্টুর বকুনী খেয়ে পরিস্কার কর্মী ফরিদাও মাঝে মাঝে হাউমাউ করে কাঁদততবে ফরিদ স্যার ব্যাংকের স্বার্থে কঠোর হলেও কোনদিন কলম দিয়ে লোকের উপকার ছাড়া অপকার করেননি। ফরিদ স্যারের বেগমের একজন আত্মীয়া নারী নাকি সিলেট শাখায় কাজ করতেন। এই নারীকর্মী অফিসে আসতে প্রায়ই দেরি করতেন। একদিন এই অপরাধে স্যারের হাতে এই শ্যালিকা চরমভাবে অপদস্ত হন। তিনি মেডামের কাছে দুলাভাইয়ের বিরুদ্ধে নালিশ জানাতে ছুটে যান ফরিদ স্যারের পিরমহল্লার বাসায়। বেগম সাহেবা সব অভিযোগ শুনে আত্মীয়াকে সান্তনা দিয়ে বললেন, বোন তুমি অফিসে নির্যাতিত, আর আমি বাসায় নির্যাতনের শিকার। আমি সারাজীবন ধর্য্য ধরেছি। কি আর করবা বোন, তুমিও ধর্য্য ধর, আল্লাহপাক ধর্যশীলদের সহায়। 

উপমহাব্যবস্থাপক ফরিদ উদ্দিন স্যার ছিলেন অতিমাত্রায় আত্মসম্মানি ও আত্মভিমানী লোক। ২০১০ সালে তার চাকুরি এক বছরের জন্য বর্ধিত হলে এইসময় কোন এক কারণে তিনি ব্যাংক পরিচালকদের কোপানলে পড়েন। খুবসম্ভব কতিপয় পরিচালক সিলেট এলে তিনি তাঁর মায়ের অসুস্থতার কারণে বিমানবন্দরে উপস্থিত হতে পারেননি। কোন এক ওজর দেখিয়ে ক্ষমা চাইলেই অনেক সুযোগ সুবিধাসহ তিনি রক্ষা পেতেন। কিন্তু তিনি মাফ চাননি এবং সিলেটের অঞ্চলপ্রধানের আসন হতে বিদায় গ্রহ করেন। বিদায়কালে বিধিনুযায়ী ব্যাংকের তরফে একটি গাড়ি উপহার পেতেন, তাও হারান। শিখগুরু অর্জুনের মত ফরিদ উদ্দিন স্যার শির দিলেন তো শের দিলেন না।

১৯৯০ সালের ২৭ আগস্ট আমি চাকুরিতে যোগদানের পর ধীরে ধীরে এরশাদ বিরোধী আন্দোলন তীব্র আকার ধার করে নবেম্বর মাসে বিরোধীদলের সম্মিলিত হরতালে অফিস আদালত বন্ধ হয়ে আসে সিলেট কেন্দ্রীয় শহিদমিনারের কাছে ছিল শাখাটির অবস্থান। লাগাতার হরতালে জিন্দাবাজারে দুতলা অফিসের নিচে সারাদিন পুলিশ ও ছাত্রজনতার সংঘর্ষ চলত। জনতার ঢিলে বিমান অফিসসহ চারপাশের ভবনের গ্লাস ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যায়। তাই অফিসে লোকজন ঢুকানো ছিল খুবই বিপদজনকআবার হরতালে অনুপস্থিত থাকলে চাকুরি থাকবেনা। দাউদপুর হতে খানিকপথ যানবাহনে, খানিকপথ হেঁটে অনেক কষ্টকরে এসে অফিসে নিস্কর্মা সারাদিন বসে থাকতাম। ২৭ নভেম্বর ডাঃ মিলন ঢাকার শহিদ হলে আন্দোলনের আগুনে পেট্রোল পড়ে। শাখার নিচে শহিদমিনারে দাঙ্গাপুলিশ উপরে আমরা, কপাটবদ্ধ অফিসে তখন শ্বাসরুদ্ধকর এক অবস্থা সৃষ্টি হত

ডিসেম্বর ১৯৯০ সালে দেশের সামরিক ও বেসামরিক আমলাতন্ত্র এরশাদ সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাহিরে চলে যায় এবং একনায়ক হোসেন মোঃ এরশাদের পতন ঘটে দেশবাসী বহুদিনের এক দুর্বিসহ অচলাবস্থা হতে মুক্তিলাভ করে স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেলেন এরশাদের পতনের পর নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য বিচারপতি সাহাব উদ্দিনের অধীনে তত্ত্ববধায়ক সরকার গঠিত হলে আমাদের বংশের চাচাত ভাই, সাবেক সচিব, ইমাম উদ্দিন চৌধুরী এই সরকারের বানিজ্য উপদেষ্টা হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯১ সালে নির্বাচনে জিতে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি সরকার গঠন করে পরবর্তী পাঁচ বছর দেশের শাসনকার্য পরিচালনা করে।

মহিলা কলেজ শাখায় অবস্থানকালে আমি ব্যাংকের বিভিন্ন প্রশিক্ষণে ছয়বার ঢাকা গমন করি। কাষ্টমার সার্ভিস, ফরেইন এক্সচেঞ্জ, রিফ্রেসার কোর্স, মানি লন্ডারিং ইত্যাদি নামের প্রতিটি প্রশিক্ষ দুই থেকে পাঁচ ছয় দিন পর্যন্ত সংঘটিত হত। চাকুরিতে যোগদানের পর ঢাকা সদরঘাটে ২৫ মে ১৯৯১ সাল হতে আমাদের ১৩ দিনের ভিত্তি প্রশিক্ষ অনুষ্ঠিত হয়।

পুরান ঢাকার সদরঘাটে ব্যাংকের নিজস্ব ভবনের পাঁচতলায় ছিল ব্যাংকের প্রশিক্ষ ইন্সটিটিউট। এখানে থাকারও বন্দোবস্ত করা ছিল। এখানে অবস্থান করে লালবাগের কেল্লা, পরীবিবির মাজার ও মোগল যাদুঘর, আহসান মঞ্জিল, বাহদুরশাহ পার্ক, হোসনি দালান, সদরঘাটসহ পুরান ঢাকার সব ঐতিহাসিক নিদর্শন ঘুরে দেখি। ঝাকড়া চুলের ভাস্কর রাসার সাথেও একদিন দেখা হয় ব্যাংকের প্রশিক্ষ ইন্সটিটিউট পরে হেডঅফিসে চলে গেলে সেখানেও প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ করি। এসব প্রশিক্ষণে বিভিন্ন সময় আহমদ এনায়েত মঞ্জুর, অমল কান্তি দাস, জাহাঙ্গীর আহমদ, ওমর ফারুক, এফ এম আলমগীর হোসেন প্রমুখ আমার শরিক ছিলেন। আমার দাউদপুর গ্রামের সচিব ডঃ ক্ষণদা মোহন দাসের ভাই অমল কান্তি দাস রসায়নে মাস্টার্স করে পূবালী ব্যাংকে যোগদান করেন এবং পরে অস্ট্রেলিয়া চলে যান। তিনি ছিলেন ছোটখাট আবয়ব, আমি তাঁকে সহজে কোলে তুলে নিতাম। 

পুবালী ব্যাংক ট্রেইনিং ইন্সটিটিউটের প্রিন্সিপাল এম এ জলিল ছিলেন খুব রসিক লোক। তিনি নানা খুশগল্পে ক্লাস জমিয়ে রাখতেন। আমাদের প্রাক্তন এম ডি হেলাল আহমদ চৌধুরী যখন ক্লাস নিতেন, তখন তার আকর্ষণীয় জ্ঞানগর্ব বক্তব্যে ক্লাসে নীরবতা নেমে আসত। তিনি একটা কথা সব সময় বলতেন যা আমি কোনদিন ভুলে যাইনি। তিনি বলতেন Hardwork has no substitute. তিনি বড় বড় মানুষের উদাহর দিয়ে বলতেন তারা যে খুব মেধাবী ছিলেন তা নয়, বরং সততা, নিষ্টা ও কঠোর পরিশ্রম তাদেরকে স্মরণীয় ও বরণীয় করে উচ্চতার শিখরে নিয়ে গেছে। কিন্তু পরবর্তীকালে আমি এর ব্যতিক্রম দেখেছি, কেবল তার বর্ণিত এই গুগুলোর মাধ্যমে অনেকের পক্ষে উন্নতি করা সম্ভব হয় না, সাথে দাওয়ারও প্রয়োজন হয়। মামুর জুর কিংবা তৈলমর্দণের মত বলকারক ঔষধ যারা যথাযত মালিশ করতে জানেন তারাই সফলকাম হন। হেলাল স্যার প্রায়ই মাইন্ডসেটের কথা বলতেন। তিনি বলতেন কোন লক্ষ্যমাত্রায় উপনীত হতে হলে আগেই বিষয়টি অর্জনে মনস্থির করে নিতে হবে।

হেলাল আহমদ চৌধুরী স্যার জকিগঞ্জ উপজেলার দুহাল নামক গ্রামে এক সম্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহ করেন। তাঁর সিলেট শহরের বাসা আমার কাছে সুবিদবাজার। তিনি ছিলেন একজন বিসিএস ক্যাডার। সদ্য স্বাধীন দেশের সরকার তাকে সরকারি পুবালী ব্যাংকে নিয়োগ দেন। তিনি দক্ষতার সাথে বহু বছর পূবালী ব্যাংকের এমডির দায়িত্ব পালন করেন। তিনি এখন সরকারি বাসিক ব্যাংকের চেয়ারমেনের দায়িত্বে আছেন। মোহাম্মদ মোস্তাফিজুর রহমান ছিলেন ঋণবিশেষজ্ঞ জ্ঞানী বক্তা, তিনি মোল্লা  নাসিরুদ্দিন হোজ্জার হাসির গল্প দিয়ে ক্লাস শুরু করতেন। পরে তিনি ব্যাংকের ডিএমডি হয়ে  অবসর গ্রহ করেন।

কোন এক প্রশিক্ষণে গিয়ে আমি ছোটবোন মান্নার শাহজাহানপুরের বাসায় উঠি। মুন্না ও লিজা তখন ছোট শিশু। ঢাকা মেডিকেল কলেজে গিয়ে আমাদের পাশের গ্রাম শ্রীরামপুরের ডাঃ আলাউদ্দিনের কাছে বামকান দেখাই। তিনি আমাকে ভর্তি করে বামকানের পর্দা অপারেশন করেনপরে একদিন ঢাকা মেডিকেলে দেখাতে গেলে তাকে ছাত্র পরিবেষ্টিত পাই। তিনি ‘এই লোকটি, এই লোকটি’ বলে তাচ্ছুল্যে করে তার ছাত্রদের সাথে আমার রোগ নিয়ে আলাপ করলে আমি বেশ মনঃকষ্ট অনুভব করি আমি কোন পরিবারের লোক তিনি ভাল করেই জানতেন, তাছাড়া আমার পত্নী ডাঃ নুরজাহান বেগম চৌধুরী তার মেডিকেল ছাত্রী ছিলেন। তাঁর বৃদ্ধা মায়ের চিকিৎসায় সিলেটের বাসায়ও যান। এরপর আমি আর কখনও তার কাছে যাইনি।

১৯৯১ সালের ৭ম সেপ্টেম্বর আমি সিলেটের ঐতিহ্যবাহী কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদের জীবন সদস্য হই। আমার জীবন সদস্য নং আ- ১৪৫০। 

১৯৩৬ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর দরগামহল্লায় শাহজালালের(রহঃ) দরগাহের মোতাওয়াল্লি এ জেড আব্দুল্লার নেতৃত্বে কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদ স্থাপিত হয়। আমি ১৯৮০ সালে সিলেট মোবাইল পাঠাগারের প্রতিষ্ঠাতা আমার এক দুলাভাই মনিরউদ্দিন চৌধুরীর হাত ধরে মুফতিবাড়ি, দরগামহল্লা ফুফুর বাসা হতে কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদে যাই।

মনির দুলাভাই একজন আমোদে হাসিখুশি লোক ছিলেন। সব সময় তিনি তার পাশে লোকের আড্ডা জমিয়ে রাখতেন। এই জ্ঞানী মানুষটি প্রচুর লিখতেন ও মাইকে দাড়িয়ে সুন্দর ভাষ দিতে পারতেন। তার ইতিহাস বিদ্যা ছিল প্রখর। আমি দরগায় আসলে ইতিহাস জানতে আমার ফুফার ভাতিজি বর পাশের বাসার আলোর ফেরিওয়ালা মনির দুলাভাইয়ের কাছে প্রায়ই ধর্ণা দিতাম।

বাল্যকাল হতেই আমি একজন বইপাগল লোক। একদিন কিশোর আমাকে মনির দুলাভাই তার কর্মক্ষেত্র মুসলিম সাহিত্য সংসদে নিয়ে যান। মনির দুলাভাইয়ের সাথে হেঁটে হেঁটে দরগার পুর্বগেটে সংসদে ঢুকে এত বইয়ের সমুদ্র দেখে আমি অবাক হয়ে যাইবইয়ের এত বড় রাজ্য আমি জীবনে আর কোনদিন দেখিনি। মনের আবেগে এক তাকিয়া হতে অন্য তাকিয়ায় কিশোর আমি হেঁটে হেঁটে একটার পর একটা বই হাতে নিয়ে নাম ও সুচীপত্র পড়তে থাকি। মন চাইছিল সব মজার বই একসাথে পড়ে সাবাড় করে ফেলি।

সেই সময়ে বিটিভি ছাড়া আর কোন টিভি চ্যানেল ছিলনা। সারামাসে মাত্র একটি সিনেমা, একরাতে ছায়াছবির গানের অনুষ্ঠান ‘ঝিলিমিলি’ ও ফজলে লোহানীর ‘যদি কিছু মনে না করেন’ এরমত হাতেগুনা গুটিকয় অনুষ্ঠান হত। এসব অনুষ্ঠান দেখার জন্য মানুষ দিনের পর দিন উদগ্রীব হয়ে বসে থাকতেন। হাতেগুণা কয়েকজন নায়ক নায়িকা, গায়ক গায়িকার মুখশ্রী দেখে দেখে মানুষ বিটিভি দেখার স্বাধ মেঠাত। শাসকশ্রেণীর লোকদের নানা গুণগান, স্থুতি বাক্য, তুষামুদির বন্যায় জনগণের কান জ্বালাপালা করত। এরশাদ, বেগম রওশন এরশাদ এবং চাটুকার মন্ত্রীদের একমাত্র চ্যানেল বিটিভিতে বারংবার দেখে দেখে বিরক্ত হয়ে লোকে টেলিভিশনকে বলত ‘মিয়া বিবি গোলামের বাস্ক’বেতারের অবস্থাও ছিল তথৈবচ।

আজকের অনলাইন নেটওয়ার্কের এই মোহনীয় স্বর্গরাজ্যের অস্থিত্বও সেদিনের মানুষের কাছে ছিল কল্পনাতীতঅতএব মানুষ যাবে কোথায়? তাই সেদিনের মানুষের কাছে বই ই ছিল ধ্যান, জ্ঞান, আনন্দ, বিনোদন সব। এই আমার শুরু হল এক প্রজ্জলিত প্রদীপ মনির চৌধুরীর হাত ধরে কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদ নামক আলোর ঘরে যাত্রা। আজও এই যাত্রা থামেনি। এই আলোর ঘরের আলোক বন্যায় আমি এত আলোকিত হই যে এই আলোতে আজও আমি পথ চিনে নেই।

এই ঘরের রংমঞ্চের হাজার স্মৃতি মনে পড়ে, এখানে  জননেতা দেওয়ান ফরিদ গাজী, লেখক রাঘিব হোসেন চৌধুরী, লেখক মনির উদ্দিন, সাংবাদিক আব্দুল হামিদ মানিক, আফতাব চৌধুরী, আজিজুল হক মানিক, সেলিম আউয়াল, আব্দুল মুকিত অপিসহ অনেক সুধীজনকে জ্ঞানের আড্ডায় বসতে দেখেছি। একদিন কলেজ সহপাঠি সিদ্দিকুর রহমান নির্ঝর এই মুসলিম সাহিত্য সংসদের নির্জন এক টেবিলে বসে বইপাঠে নিবিষ্ট আবুল মাল আব্দুল মুহিতকে দেখিয়ে বলল, হেই সেফাক, এই দেখ সাবেক অর্থমন্ত্রী বসে বই পড়ছেন। নির্ঝর আর বলল, প্রেসিডেন্ট এরশাদ তাকে বিদেশ হতে ধরে বেঁধে এনে অর্থমন্ত্রী করেনকিন্তু এরশাদের সাথে তার মতের মিল না হওয়ায় পদত্যাগ করে আবার বিদেশে চলে যান। আমি এই প্রথম আবুল মাল আব্দুল মুহিতের মুখ দেখি। এখানে সিলেটের আর অনেক বরেণ্য ব্যাক্তিত্বকে বিভিন্ন সময়ে একমনে বই পড়তে দেখেছি

আমি সংসদের আড্ডাখানায় খুব একটা বসতামনা। আমার হাতে সময় থাকত সীমিত, তাই বসে বসে বই পড়ে কিংবা দরকারি বইটি হাতে নিয়ে বেরিয়ে আসতাম। কলেজ জীবনে একদিন দুপুরে সংসদে বসে মোঘলসম্রাট বাবুরের আত্মজীবনী ‘তুজুখে বাবুর’ হাতে নেই। বইটি আমাকে এতই আত্মনিমগ্ন করল যে কিভাবে দিন পার হয়ে রাত্রি নেমে আসে বুঝতেই পারিনি।

সাপ্তাহিক বৃহস্পতিবারের সাহিত্যসভায় অংশগ্রহ করার সৌভাগ্য সময়ের দন্যতায় খুব একটা সম্ভব হয়নি। একদিন কবি কালাম আজাদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত একটি সভায় আমার স্বরচিত কবিতা পাঠ করি। অন্য একদিন গল্পকার সেলিম আউয়ালের সভাপতিত্বে পরিচালিত সভায় আমার লিখা একটি ছোটগল্প পড়ে শুনাই। ২০১৩ সালে সংসদের বাৎসরিক সাধার সমাবেশে বক্তব্য রাখার সৌভাগ্যও আমার হয়েছিল। আমি সে বৎসর আমার লিখা ‘ইসফাক কুরায়শী রচনাসমগ্র’ এর পাচটি কপি উপহার প্রদান করি, যা এই সভায় সম্মানের সাথে স্মর করা হয়।

বেশ কয়েকবার ভোটের লাইনে দাড়িয়ে সংসদ কমিটি নির্বাচনে ভোট প্রদানের স্মৃতিও আমার বেশ মনে পড়ে। তখন প্রার্থিরা জনে জনে গিয়ে ভোট চাইতেন এবং সংসদ আঙ্গিনা ব্যানার পোস্টারে ছেয়ে যেত। সংসদের বইমেলা ও ভোট অনুষ্ঠানে এক উৎসবমুখর আবস্থা বিরাজ করত। সিলেট অঞ্চলের যতসব কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও লেখক লেখিকাদের হৈ চৈ, মঞ্চ বক্তব্য, কানাঘুষা, আনন্দব্যদনা, স্মৃতিচার কেমুসাসের বইমেলা ও নির্বাচন অনুষ্ঠানকে এক প্রাবন্ত কিংবদন্তি অনুষ্ঠানে পরিত। আমার স্মৃতিময় এই প্রতিষ্ঠানের জীবন সদস্য হওয়া যতই তুচ্ছ ঘটনা হউক না কেন তা আমার কাছে একটা বড় ও মহৎ কিছু হবার মত আমার সাধার জীবনে ঘটা এক অসাধার ঐতিহাসিক ঘটনা বলেই মনে হয়। 

পূবালী ব্যাংকে চাকুরী স্থায়ীকরণের জন্য ২৬ জুন ১৯৯২ সালে আমাদের লিখিত পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। আমরা এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলে ১লা সেপ্টেম্বর ১৯৯২ সালে আমার চাকুরী স্থায়ীকর কার্যকর হয়। এই পরীক্ষায় অনেকে আটকাও পড়েন। শিক্ষানবিশ সিনিয়র অফিসার মইনুল হোসেন চোধুরী ও দিলদার আহমদ ভাইয়ের মত লোকও পরীক্ষায় আটকা পড়ে যান। এই শাখায় অবস্থানকালে  হতাশাগ্রস্থ আমি চাকুরী ছেড়ে লন্ডনে যেতে আবার সেখানকার একটি কলেজে ব্যাংকিং বিষয়ে ভর্তি হই। কিন্তু এবারও স্পন্সর দুর্বলতায় ভিসা পেতে ব্যর্থ হই।

চাকুরীতে যোগদান করেই আমি দাউদপুরের ঘরের কিছু পাকার কাজ করি। বড়ঘরের মেঝে সহ উত্তরের একটি কোঠা ও পাকঘর নির্মা হয়। আমাদের গ্রামের কোনারপাড়ার কুটই আলী মিস্ত্রি কাজ করেন। জুনিয়র অফিসারের কনসলিডেটেড বেতন ছিল ২৩৬৩/=টাকা। মনে পড়ে আমার এক মাসের বেতন এই ২৩৬৩/= টাকায় আমি তখন তিন হাজার ইট কিনি। এত বৎসর পর আজ আমি যখন হিসেব মিলাই তখন দেখি বারবার এত বেতন বৃদ্ধির পরও জুনিয়র অফিসারের বেতন এই তিন হাজার ইটের দামের সমানই রয়ে গেছে।

তখন রুস্তম আলী ব্যবস্থাপক স্যারের আমল, ছাতকের একজন লন্ডনি একদিন এসে তার হিসাবের স্থিতি বাইশ লক্ষ টাকা উঠাতে চানস্যার বললেন এত নগদ  টাকা আমাদের হাতে নেই। কালকে আসেন আমরা সিলেট শাখা হতে এনে দেব। পরদিন লোকটি আসলে তাকে ২২ লক্ষ টাকা পরিশোধ করা হয়। টাকা পেয়ে এই গ্রাম্যলন্ডনি অনেকক্ষ ধরে টাকাগুলো গুণেগুণে দেখে বললেন আজ আমার টাকা লাগবেনা আবার জমা করে দেন। লোকটি চলে যাবার পর ক্যাশ ইনচার্জ আব্দুল মন্নান স্যার বললেন, এই এতটাকা একসাথে উঠায়ে আবার জমাকরণের মুজেজা কি কেউ বলতে পারেন? ভদ্রলোক পরীক্ষা করলেন লন্ডন হতে পাঠানো তার টাকাগুলো একাউন্টে ঠিকঠিক আছে কিনা। টাকাগুলো গুণেগুণে যখন দেখলেন বাইশ লক্ষ ঠিক আছে তখন নিশ্চিত হলেন  নিশ্চয়ই কোন ধরনের খেয়ানত হয়নি। ব্যবস্থাপক রুস্তম আলী খুশি হয়ে বললেন, শোকরিয়া, আল্লাহর রহমতে আমাদের ২২ লাখ টাকা ডিপোজিট চলে যায়নি।

ব্যাংকের পাশে মোতালেব ভিলা। এই ভিলার মালিক মোতালেব মিয়া একজন দাম্ভিক নিচমনা লোক। লাল মাতাল চোখের এই কাল লোকটা প্রতিদিন ব্যাংকে এসে দেশেবিদেশে তার টেলিফোন করার কাজ মাগনা সেরে নিতলোকটা বেতমিজ হওয়ায় ম্যানেজার শত বিরক্ত হলেও কিছু বলার সাহস করতেন না। রোজ রোজ এসে টেলিফোনটি সে তার বাপের সম্পদের মত ব্যবহার করতকালো এই লোকটার একটা অদ্ভুদ গর্ব ছিল যে, তার ভাই সামরিক শাসক এরশাদের গোলাপগঞ্জ ও বিয়ানীবাজারের এমপি গৌছ, এই এমপি একজন খুনী, সে কদমতলীর আজাদ বখতকে গোলশান হোটেলে জুয়ার আসরে পিস্তল দিয়ে খুন করে।

মোতালেব মিয়া বেশ অহঙ্কার করে তার কীর্তিমান ভাইয়ের এই খুনের কাহিনি বলত যেন তার বাহাদুর ভাই একটা খুব ভাল সুনামের কাজ করেছে। মোতালেব মিয়া এই আত্মঅহংকারে নিমগ্ন থাকাকালেই একদিন তার কানাডা পলাতক এমপি ভাইয়ের বিরুদ্ধে মৃত্যুদন্ডের রায় ঘোষিত হয়। অদ্ভুদ দেশ কানাডা, তাদের দেশে মৃত্যুদন্ডের বিধান না থাকায় তারা মৃত্যুদন্ড প্রাপ্ত পৃথিবীব সব ভয়ঙ্কর অপরাধীদেরকে রাজনৈতিক আশ্রয় ও নাগরিত্ব দেয়। এমনকি বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনী নুর চৌধুরীর মত অপরাধীকেও তারা জামাই আদরে আশ্রয় প্রদান করে। এরশাদের এই খুনী এমপি গৌছ কানাডা হতে এখন দেশে এলেই তাকে গলায় ফাঁসির দড়ি পরতে হবে। আমার ভাবতে অবাক লাগত এসব বাজে লোকেরা তাদের অপকর্ম লোকসমক্ষে প্রকাশ করাকে লজ্জার কাজতো মনে করতই না বরং মনে করত দশজনের কাছে বলিয়া বেড়ানোর মত দারু অহংকারের কাজ।

এই মহিলা কলেজ শাখায় অনেক নামী দামী লোকজনও আসতেন এখানে প্রায়ই বিচারপতি রনধীর শর্মা ও তার পত্নী রেবা সেন আসতেন সিলেট মহিলা কলেজ প্রতিষ্ঠাকালে রেবা সেন এই কলেজে অবৈতনিক প্রভাষকের দায়িত্ব পালন করেন। সেসময় তিনি এখানে হিসাব খোলেন। তাদের জ্ঞানগরিমা ও শিষ্টাচার আমাদেরকে বিমুগ্ধ করত। আমাদের একজন অতিপ্রিয় ঋণগ্রাহক মোহাম্মদ জামান ভাই, যিনি ছাতক হতে হিজরত করে সিলেটে আসেন। সদাহাস্য জামান ভাইয়ের প্রকৃত নাম হুশিয়ার আলী। সিলেটে এসে ব্যবসা বানিজ্যে তিনি খুবই উন্নতি করেন, গাড়িবাড়ির মালিক হন। হুশিয়ার আলী ভাই খুব উদারমনের মানুষ, তিনি এফিডেভিট করে নিজেকে একটি  মানানসই নাম উপহার দেন, সুন্দর এই নামটি হলো মোহাম্মদ মাসুদ জামান।

আমার অনুজ নিশাত চৌধুরী ১৯৯০ সালে এসএসসি (বিজ্ঞান) পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হয়। আমি তাকে এম সি কলেজে ভর্তি করে দেই। একই পরিবার হতে আমার পিতা সফিক চৌধুরী ১৯৩৯ সালে, আমি ১৯৮১ সালে ও নিশাত চৌধুরী ১৯৯০ সালে এম সি কলেজের একাদশ(বিজ্ঞান) শ্রেণিতে ভর্তি হয়। এম সি কলেজের হোস্টেলে সিট না পেয়ে তাকে টিলাগড়ের একটি মেছে পাঠিয়ে দেই। সে ১৯৯২ সালে এইচ এস সি(বিজ্ঞান) দ্বিতীয় বিভাগে পাশ করে।

এই মহিলা কলেজ শাখায় থাকাকালে ১৯৯১ সালের কোন একদিন মোগলাবাজার রেবতী রমন উচ্চবিদ্যালয়ে আমার পিতা সফিকুর রহমান চৌধুরীর বিদায় সম্বর্ধণা অনুষ্ঠিত হয়। এখানে তিনি তার সুদীর্ঘকালের শিক্ষকতা জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটান। ১৯৯০ সালের ২৭ আগষ্ট ব্যাংকের চাকুরিতে ঢুকেই আমি তাকে অবসর গ্রহণে পাঠাই। বহুদিন কোন খবর নেই হঠাৎ স্কুল হতে একদিন জানান হল তার বিদায় সম্বর্ধণা হবে। তখন প্রধানশিক্ষক ছিলেন সবার প্রিয় শ্রীগুনেন্দ্র চক্রবর্তী স্যার। স্কুলের রাস্তাপাশের উত্তরের ঢালাই ভবনে সম্বর্ধণা অনুষ্ঠান হয়।

রি-ইউনিয়নের মত এই অনুষ্ঠানটি আব্বার নতুন ও পুরাতন ছাত্রদের এক বিশাল মিলনমেলায় পরিত হয়। বড় হলঘর পুর্ণ হয়ে অনেকে বাহিরে বারান্দায় দাড়িয়ে থাকেন। অনেক বক্তা আব্বার অনেক গুণাগু বর্ণনা করে অনেক স্মৃতিচার করলেন। তারা বক্তব্যে নিজেরা কাঁদলেন, অন্যদেরকেও কাঁদালেন। এই অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি হয়ে হন আমার আদর্শ শিক্ষক, এমসি কলেজের বাংলা বিভাগীয় প্রধান ডঃ শফিউদ্দিন। বক্তব্যে  ডঃ শফিউদ্দিন স্যার বললেন, আমি বিষ্মিত মফস্বলের একজন হাইস্কুল শিক্ষক ছাত্রদের কাছে যে এত জনপ্রিয় হতে পারেন, এত শ্রদ্ধাভাজন হতে পারেন, এখানে না এলে তা আমার বিশ্বাসই হতনা।

অজস্র অজস্র মানপত্র, পুষ্প্যমাল্য ও উপহারে ঘরের একটি কো ভরে যায়। এসব শ্রদ্ধাঞ্জলি বিতর করে করে হেডস্যার গুনেন্দ্র চক্রবর্তী ও শফিউদ্দিন স্যার হাঁফিয়ে উঠেন। কেউকেউ বক্তব্যে বললেন মানুষের ভালবাসাই তো জীবনের সার্থকতা। স্যারের জীবন সার্থক, তিনি জীবনভর মানুষের শ্রদ্ধা ও ভালবাসা পেয়েছেন। অনুষ্ঠান শেষে আব্বা সফিক চৌধুরীকে নিয়ে রাতে যখন ঘরে ফিরি, তখন বারবার মনে পড়ে কবি জীবনানন্দ দাসের ‘বনলতা সেন’ কাব্যের কয়েকটি লাইন “সমস্ত দিনের শেষে শিশিরের শব্দের মতন,/ সন্ধ্যা আসে, ডানায় রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলে চিল।/ পৃথিবীর সব রঙ নিভে গেলে পান্ডুলিপি করে আয়োজন,/ তখন গল্পের তরে জোনাকির রঙ্গে ঝিলমিল,/ সবপাখি ঘরে আসে- সব নদী- ফুরায় এজীবনের সব লেনদেন”

১৯৯২ সালে এই শাখায় থাকাকালে ভারতে ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদ ভাঙ্গার মত ঘৃণ্য ঘটনা ঘটে। সারা ভারতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় শতশত নিরিহ মানুষ নিহত হন। এর কিছুটা উত্তাপ বাংলাদেশে এসে পড়ে। বাবরি মসজিদ ভাঙ্গার প্রতিবাদে একদিন পূবালী ব্যাংক মহিলা কলেজ শাখার সামনের রাস্তা দিয়ে হাজার হাজার মানুষের এক বিশাল জঙ্গি মিছিল বয়ে যায়। মিছিলটি এত বড় ও জঙ্গি ছিল যে এধরনের মিছিল আমি সিলেটে আর কখনও দেখিনি। 

সিলেটের হিন্দু মন্দিরগুলোয় কিছু উশৃংখল মিছিলকারী লোকজন হালকা অগ্নিসংযোগ, ডিল নিক্ষেপ ও ভাংচুর করে। চারদিকে পুলিশ ও ফায়ার সার্বিসের গাড়ি উচ্চশব্দে হর্ণ বাজিয়ে ছুটোছুটি করতে থাকে। জানালা দিয়ে এই বিশাল জঙ্গি মিছিল দেখে আমাদের হিন্দু সহকর্মী শ্যামলীদি ও সাথীদি ভয়ে কাঁপতে শুরু করেন। আমরা দরজা জানালা সব শক্তভাবে বন্ধ করে দেই ও তাদেরকে সাহস দিয়ে বলি কোন ভয় করবেন না, আমরা জীবিতাবস্থায় আপনাদেরকে কেউ কিছু করতে পারবেনা। 

শ্যামলী দিদির দুলাভাই বি কে দাস বাবু পিডিবির নির্বাহী প্রকৌশলী। তাঁরা দুইবোন কালীবাড়িতে একই বাসায় থাকেন। শ্যামলী দিদি তাঁর বোনের দুই তরুণী কন্যাকে নিয়ে ভীষণ উদ্ভিগ্ন। আমি শ্যামলী দিদিকে অভয় দিয়ে বললাম, সিলেটের হিন্দু মুসলিম সবাই ভালমানুষ, তাঁরা এত বদ হতে পারবেনা, এত নিচে নামতে পারবেনা, নিশ্চিত থাকুন দিদি। আমার কথায় শ্যামলী দিদির চোখেমুখে বেশ প্রশান্তির ছায়া দেখা গেল। আমার কথাই সঠিক হল, এত অরাজকতার পরও সেদিন সিলেটে কেউ কারো গায়ে হাত তুলেনি, কিংবা কোন মহিলাও লাঞ্চিত হতে শুনিনি। 

সন্ধ্যারাতে সিলেট শহরের ভূতুড়ে পরিবেশ যথেষ্ট শান্ত হয়ে গেল, সারাদিনের উত্তেজনাময় ঝড়তুফানের পর সিলেট শহর জুড়ে এক থমথমে নিস্থব্ধতা নেমে এলো। ফরিদউদ্দিন স্যার তখন বিশ্বস্থ লোক মারফত শ্যামলীদি ও সাথীদিকে তাঁদের নিজনিজ বাসায় পৌঁছে দেন। আমি সেদিন অনেক রাত করে দাউদপুরের গ্রামের বাড়িতে ফিরে যাই। বিশাল জমিদার বাড়িটায় পা রেখে মনে হল সব ঠিকঠাক, কেমন যেন সুনসান নীরবতা, শান্তির নিস্থব্ধ ঘুমে সবকিছু, উত্তাল শহরের অশান্ত গরমের কোন ছিটেফুটো নেই এখানে, যেন দেশে আজ কিছুই ঘটেনি।

বাবরি মসজিদ ভাঙ্গার প্রতিবাদে দাউদপুর চৌধুরীবাজারে কোন এক শুক্রবার বিকেলে জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। এই জনসভায় আমি বক্তব্যে বলি ভারতে ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদ ভাঙ্গা নিঃসন্দেহে একটি চরম নিন্দনীয় ও গর্হিত কাজ, যারা বাবরি মসজিদ ভেঙ্গেছে তাঁরা গুরুতর অন্যায় কাজ করেছে কিন্তু এই ঘটনায় আমাদের বাংলাদেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের কোন লোকজন জড়িত নন। এটা ভারতের আভ্যন্তরীণ ব্যাপার, ভারতে সংঘটিত কিছু দুবৃত্তের এই অপকর্মের দ্বায়ভার আমাদের দেশের সাধার নিরীহ হিন্দু লোকজনের উপর কোনমতেই চাপানো যায়না। ইন্ডিয়ার এই ঘৃণ্য ঘটনায় আমাদের দেশের শান্তি শৃংখলা যেন বিনষ্ট না হয়। আমরা এই ঘটনার নিন্দা ও প্রতিবাদ করি, কিন্তু তা যেন শান্তিপুর্ণ হয় এবং কোনমতে হিংসাবিদ্বেষ বা সাম্প্রদায়িকতায় পরিণত না হয়। আমাদের দেশে জাতিধর্মবর্ণ নির্বিশেষে প্রতিটি মানুষের জানমাল ও ইজ্জতের নিরাপত্তা রক্ষা করা আমাদের সমাজের সকলের মানি দায়িত্ব। এই দায়িত্ব পালনে আমরা যেন সদা সচেষ্ট থাকি। অবশ্য কিছুদিন পর উগ্রবাদীদের বাবরি মসজিদ ভাঙ্গার উত্তাপ ধীরে ধীরে কমে কমে শীতল হয়। দেশে সুখ ও শান্তি ফিরে আসে।

ব্যবস্থাপক ফরিদউদ্দিন স্যার আমাকে খুব স্নেহ করতেন। একবার তিনি জন্ডিস রোগে আক্রান্ত হয়ে বেশ কয়েকদিন অফিসে আসতে পারেন নি। আমি তখন ফাজিলচিস্ত মহল্লার সর্বশেষ বাসাটিতে গিয়ে তাকে দেখে আসি। তার পাশের বাসায় তখন থাকতেন আমাদের আরেকজন ব্যবস্থাপক বড়লেখার বর্নি গ্রামের এম এ মান্নান ডিজিএম স্যার

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন