সোমবার, ১৮ জানুয়ারী, ২০১৬

দি নাইস ম্যাডাম অব রডআইল্যান্ড

ভাগনা ডাঃ তানভির মুন্নার বিয়েতে সপরিবারে কবি লেখক ব্লগার ও পূবালী ব্যাংকার ইসফাক কুরেশি
দি
নাইস ম্যাডাম অব রডআইল্যান্ড


জনের বাবা সমুদ্রবিজ্ঞানী। কিছুদিন হয় বদলি হয়ে এসেছেন রড আইল্যান্ডে। সমুদ্র উপকূল থেকে খানিক দূরে অনুচ্চ টিলার উপর সরকারি বাংলোটা জনদের জন্য বরাদ্দ হয়। বাংলোটা নানা প্রজাতির কুসুমবিথি অর্কিডে সুসজ্জিত। নৈসর্গিক সৌন্দর্যের মায়া জড়ানো এই বাংলোটাকে বারবার নতুনভাবে সজ্জিত করেছেন আগত সিভিলিয়ান কর্মকর্তাগণ। বাগান বিলাসের ছায়ায় সুইমিংপুল, ছোট্ট কৃত্রিম লেকের মধ্যে ফ্লাওয়ার বক্সে সাজিয়ে রাখা বৈঠকখানা, গাড়িঘরের ছাদে সবুজের আস্তরণে হলুদ ছাউনী ঢাকা হাওয়াখানা, সবমিলে কী এক অদৃশ্য স্বর্গীয় সুষমা জড়িয়ে আছে এই আমেরিকান বাসভবনটিকে।
টিলার গা ঘেষে পীচঢালা কালো রাস্তা বেয়ে সরকারি জিপটি উঠে আসে প্রায় পঞ্চাশ ফুট উপরে গাড়িঘরে, দুপাশের ম্যাপল বৃক্ষগুলো চেয়ে চেয়ে দেখে প্রতিদিন। ঝরে পড়া ম্যাপল পাতাগুলো নীচে যেন বিছিয়ে দিত লালগালিচা। এক সাংঘাতিক খেলায় মেতে উঠে জন, তার খেলনা সাইকেলটায় বসে অতিদ্রুত নেমে যেত বারান্দা হতে নীচে সদর রাস্তায়। কখনও আত্মভুলা জন একাকী সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসে নীচে, কিংবা বসে থাকে কোন এক স্টেয়ারে। দুপাশের সবুজ পাতার কুঞ্জ ফাঁক করে মুখ বের করে লাজনম্র চোখে তাকিয়ে থাকে শত সহস্র পুস্পের মালা। বাতাস ঢেউ খেলে যায় বনানী কুঞ্জলতায়। মাথার উপর মাদার বৃক্ষের চিরল পাতাগুলো ভেদ করে ছুটে আসে সূর্যের মৃদু কিরণ ছায়ার মায়াবী প্রবাহধারা। বার বছরের জন ওর বাবার মত ভালবাসে প্রকৃতিকে; তাই ছোট্ট শ্বেতাঙ্গ বালকটা কখনও রঙিন প্রজাপতি দেখে, কখনও ম্যাপল কিংবা মাদার তরুর ডালে ছুটোছুটি করা পাখিটার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে কাটিয়ে দিত দিন। টেক্সাসের যান্ত্রিক নাগরিক পরিবেশ থেকে এসে জনের দারুণ লাগছে এই নৈসর্গ। চোখ মেলে চারপাশের রূপ দেখে আনমনা হয়ে হয়ত বসে যেত কোন এক টিলার সবুজ ঘাসে, বৃক্ষের শাখাগুলো ওর মাথার উপর সুঁড়সুঁড়ি দিত, সেই সাথে আনন্দে নেচে উঠতো ওর কচি মনটা।
হঠাৎ মা ডাক দিতেন, “জন, এসোনা সোনামণি, লাঞ্চটা সেরে নাও, বাথ্টা সারবেনামায়ের ডাকে স্বম্বিত ফিরে পেত জন। বলতো- ইচ্ছে নেই ম্যাম। মায়ের পীড়াপীড়িতে অনেক পর ফিরে যেত ঘরে।
কিছুদিন বেকার কেটে যাবার পর জনের বাবা ওকে নিয়ে যান স্থানীয় স্কুলে, ক্লাস সেভেনে ভর্তি করা হয় তাকে। প্রথম ক্লাসে ঢুকতেই আসেন অল্প বয়স্কা সুন্দরী টিচার। অনিন্দ্যসুন্দরী বলেই হয়তো ছাত্ররা তাকে নাইস ম্যাডাম বলে ডাকে। সদ্য গ্রেজুয়েশন সমাপ্ত করে জয়েন করেন আটলান্টিক স্কুলে, বয়স আর কত হবে, বড়জোর উনিশ বিশ। নাইস ম্যাডাম ক্লাসে ঢুকেই এক দৃষ্টে তাকিয়ে রইলেন জনের দিকে মনে হচ্ছিলো কী যেন হারানো কিছু তিনি খুঁজে পেয়েছেন জনের মুখে। বালকেরা বিষ্ময়ের সাথে লক্ষ্য করলো দুফোঁটা অশ্র নামছে ম্যাডামের রক্তিমাভ গাল বেয়ে। রুমালে অশ্রমুছে ম্যাডাম প্রশ্ন করলেন-
তোমার নাম?
জন হেনরি।
আগে কোথায় ছিলে?
টেক্সাসে।
ড্যাড্ করেন কী?
সমুদ্র বিজ্ঞানী, বদলি হয়ে নতুন এসেছেন।
এবার ম্যাডাম প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে আবার জিজ্ঞেস করেন-
তোমার পূর্বপুরুষরা কোন দেশের অধিবাসী বলতে পারো জন?
বাবার কাছে শুনেছি গ্র্যাণ্ডফাদার সপরিবারে স্পেন থেকে এসেছিলেন।
তোমার ম্যাম কি ইউরোপীয়ান?
ড্যাড্ স্পেনে গিয়ে বিয়ে করেন। অর্থাৎ আমার ম্যামও স্পেনীশ মহিলা।
ম্যাডাম এবার বলে উঠেন- “এক্সেলেন্ট, এক্সেলেন্ট, তোমাকে দেখে আমার তাই মনে হচ্ছিলো জন। তোমার কাজল কালো চোখ, কালো কেশ, রক্তিমাভ রঙ্গ, তোমাকে সনাক্ত করতে ভুল করেনি আমার চোখ।
আমার ইতিহাসটা অনেকটা তাই; কি অদ্ভূতভাবে মিলে যাচ্ছে আমরা দুজন আমেরিকানের ইতিকথা। বলেই ম্যাডাম ছাত্রদের উদ্দেশ্যে বলতে শুরু করেন-
ইউরোপে সবেমাত্র প্রথম মহাসমর সমাপ্ত হয়েছে। এই সংঘাত বিক্ষুব্ধ অঞ্চলের প্রতি বিতৃষ্ণ মানুষ জন্মভূমির মায়া ত্যাগ করে একমুঠো শান্তির অন্বেষায় দলেদলে পালিয়ে যাচ্ছে নতুন দুনিয়ায়, সুদূর আমেরিকায়। আমার গ্র্যাণ্ডফাদার ছিলেন একজন রাজনীতিবিদ। জন্মভূমি স্পেনকে প্রাণের চেয়েও বেশি ভালবাসতেন তিনি। অথচ এক নায়ক জেনারেল ফ্রান্কোর অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে অনেকটা প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে একদিন জাহাজে চেপে আটলান্টিক পাড়ি দেন। এখানে এসেও স্পেনের জন্য অহোরাত্র হাহুতাশ করে কাটতো তার দিন। স্পেনের অব্যক্ত জীবন স্মৃতি তাকে আবেগতাড়িত করত। কখনও কখনও আটলান্টিকের পাড়ে দাঁড়িয়ে বলতেন- “হে নিষ্ঠুর আটলান্টিক, তোমার বিশাল জলরাশি আমার জন্মভূমিকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে, আমার শক্তি নেই তোমার এই বিশাল তরঙ্গমালা পাড়ি দেই। আমার যদি আলবার্টাসের মত ডানা থাকত তাহলে উড়ে উড়ে জন্মভূমি দেখে আসতাম। তবে একবার যখন পালিয়ে এসেছিআবার সেই পঙ্কিলতার রাজ্য ইউরোপে  খোজতামনা স্থায়ী বসত।
স্পেনের ভাষা, সংস্কৃতি জীবনাচরণের প্রতি আমার গ্যাণ্ডফাদারের ছিল এক অনমনীয় রক্ষণশীল মনবৃত্তি। আর মনোভাবের কারণে বাবার অনিচ্ছা সত্ত্বেও গ্র্যাণ্ডফাদার বাবাকে নিয়ে যান স্পেনে, বিয়ে করে নিয়ে আসেন আমার মাকে। দুই ভিন্ন বিপরীত পরিবেশে বড় হবার পরও কী অদ্ভূত ভাবে বাবা-মা মানিয়ে নেন নিজেদেরকে। দাদা দাদীমা আমার শৈশবেই অন্তর্ধাণ হন।
আমরা ছিলাম দুভাই বোন বলেই আবার ম্যাডামের চোখে জল। আবার জনের প্রতি এক মায়াবী দৃষ্টি। ভাইটা ছিল আমার চেয়ে ছয় বছরে ছোট। জন একেবারে তোমারই মত। তোমার পুরো নাম জন হেনরি। আর ওর নামটা ছিল জন হিমলার। ওকে আমরা সবাই সংক্ষেপে জন বলেই ডাকতাম।
সেই ছোট্ট ভাইটির জেরক্স কপি তুমি, তুমি আমাদের সেই জন। তোমার মধ্যে সেই মুখ, সেই রঙ্গ, সেই কোমল কণ্ঠস্বর সব খুঁজে পেয়েছি আমি। তুমি আমাকে আপু বলে ডাকবে জন, কখনও ম্যাডাম বলবেনা কেমন?
ধন্যবাদ, আপনাকে আপু বলেই ডাকব ম্যাডাম’- বলেই লাজুক কন্ঠে বলে উঠল জন- ‘আপু তোমার সেই ছোট্ট ভাইটি এখন কোথায়? আমি ওর সাথে ফ্রেন্ডশীপ করব।
কেন? এইতো তুমি আমার সেই গোলমুখ ভাই। সে হারানো ভাইটির কথা আর কী বলব, সব সময় সে আমার কাছে কাছে থাকত। তার সব মান-অভিমান, রাগ-অনুরাগ ছিলাম আমি; ঘরটা সাজিয়ে এলে ওসব নষ্ট করে আমার সামনে এসে হাসত। আমি কলেজে চলে গেলে আমার সাধের হারমোনিয়ামটা সে লুকিয়ে রাখত। আমি যখন রেগে যেতাম তখন ক্যান্ডি চেয়ে নিত। আমাকে অনেক জ্বালিয়ে তারপর বের করে দিত। সমুদ্র সৈকতে ঝিনুক কুঁড়াতো, ঘাস ফড়িংয়ের পিছু পিছু ছুটোছুটি করত। গত বসন্তে ওর দ্বাদশ জন্মদিন পালনের কিছুদিন পর বড় রাস্তায় সাইকেল চালানোর সময় যন্ত্রদানবের ধাক্কায় ওর কচি শরীরটা থেঁতলে যায়। নাইস ম্যাডামের মুখ দিয়ে যেন আর কথা বেরোয়না, তার মনের চোখে ভেসে উঠে ভাইটির এবড়ো-থেবড়ো নিস্পাপ দেহ। আবার মেডামের চোখে অশ্রুর ফোঁটা। 
গল্পে গল্পে সময় ফুরিয়ে যায়, ক্লাসে আর প্রাত্যহিক পাঠদান হয়নি। এমন সময় পরবর্তী ক্লাসের টিচার এসে হাজির হন। রক্তরাঙ্গা ফুলে উঠা বড় বড় দুটি চোখ মুছে নাইস ম্যাডাম সেদিন বেরিয়ে যান।
নাইস ম্যাডাম, এই সুন্দরী টিচার স্কুলের ছাত্রদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভালবাসেন জনকে। ক্লাসে ঢুকেই ওকে কুশলবার্তা জিজ্ঞেস করে পড়াশুনার খবর নেন। জনের উন্নতি অবনতির প্রতি তার সার্বক্ষণিক নজর। ঠিক যেন সে তার আত্মার আত্মীয় একজন। তার মাত্রাতিরিক্ত খবরদারীতে বিরক্তিবোধ করে জন। ক্লাসের অন্যান্য ছাত্ররাও ম্যাডামের একপেশে ব্যবহারে ঈর্ষানুভব করে। মন্তব্য ছুড়ে দেয় নিজ জাতির টানে কেমন অন্ধ ম্যাডাম!
আশপাশের সঙ্গীসাথীদের কাছে সমুদ্র চিরপরিচিত। সমুদ্রপারে দাড়ালে নীলপানির ডিগবাজি ছাড়া তেমন একটা কিছু অনুভবে আসেনা তাদের। তারা ভাবে কেমন পাগল আমেরিকার লোকজন। হাজার হাজার ডলার নষ্ট করে ছুটে আসে সাগরের লোনা পানি দেখার অভিপ্রায়ে। বসন্তে যখন পর্যটকদের ভিড় নামে তখন মনে হয় যৌবনের উম্মাদনায় কামার্ত হয়ে গেছে মাইলের পর মাইল সাগরের পার। সূর্যস্নানরত নগ্ন তরুণ তরুণীদের যৌবনের রঙ্গে-রঙ্গে জ্বলে উঠে দ্বীপের নির্জন প্রান্তর।
রড আইল্যন্ড আসার পর থেকে নীরবতা প্রিয় বালক জন সমুদ্র সৈকতের প্রতি এক তীব্র আকর্ষণ অনুভব করে। ছুটির দিনে ছুটে যায় সমুদ্র স্নানে। তরুণ-তরুণীদের ভীড় ভেঙ্গে উন্মুক্ত বাতাসের বুক চিরে হেঁটে যায় মাইলের পর মাইল। সমুদ্রের তরঙ্গমালা খেলা করে ওর হাঁটুর তলায়। ঢেউয়ের সাথে ছুটোছুটি করে তন্ময় হয়ে যেত জন। সময় দ্রুত বয়ে যায় অভুক্ত জনের ভ্রুক্ষেপ নেই। সহপাঠীদের কাছ থেকে ঝিনুকের বিভিন্ন কারুকাজ শিখে ফেলেছে সে। বাতাসের শন্শন্ গর্জনে সৈকতের ঝিনুক কুড়াতে তাই ব্যস্থ হয়ে উঠে জন।
একদিন সাগর পারে টিউলিপ ফুলের অরণ্যে ছুটোছুটি করছিলো জন। এবার টিউলিপে টিউলিপে ভরে গেছে বিস্তির্ণ সৈকত। অজস্র প্রজাতির প্রজাপতি ঝাঁক বেঁধে উড়োউড়ি করছে সেই বনে। নাইস ম্যাডাম কিছু দিন হয় যুক্তরাষ্ট্রের একটি ফ্রেমে বাঁধানো মানচিত্র জনকে উপহার দিয়েছেন। ম্যাপটাকে তিনি প্রজাপতির রঙিন পাখনা দিয়ে অপূর্ব করে সাজিয়ে দিয়েছেন। তাই কয়েকদিন ধরে অবসর-ক্ষণে প্রজাপতির ডানা সংগ্রহের নেশায় মেতে উঠে বালক জন। এমনই একক্ষণে মেঘসূর্যের লুকোচুরি খেলার মোহনীয় মুহুর্তে দূরের বাংলোটার আঙ্গিনা থেকে ছুটে আসেন অনিন্দ্যসুন্দরী এক তরুণী। টিউলিপের রমণীয় রূপ যেন হাসছিল তরুণীর মুখে। বালক জন লজ্জাবনত নয়নে চোখের তারা দুটি এদিক ওদিক করে চোর চোখে দেখছিল তরুণীটির মুখ। তার চিনতে দেরি হলনা উনি তো সেই প্রিয় আপু, নাইস ম্যাডাম। এসেই জিজ্ঞেস করেন-
একা একা করছো কি জন?
বনবাদার সাগরপার ঘুরে ঘুরে দেখছি ম্যাডাম।
আমিও একা একা প্রকৃতির বুকে লুকোচুরি খেলতে ভালবাসি জন। এই বাংলোটায় বাবা-মা আর আমি থাকি। সামনের সমাধিতে আমার সেই ভাইটিকে ঘুম পাড়িয়ে দিয়ে মনের জ্বালায় হুাহুতাশ করছেন তারা। তোমাকে পেলে দগ্ধ মনে হয়ত একটু শান্তি পেতে পারেন। তুমি যাবে কি আমার সাথে। টিচার ডাকছেন, তাঁকে কি আর না বলা যায়।
সেদিন থেকে জন নাইস ম্যাডামের ঘরের মানুষ হয়ে যায়। ম্যাডামের পক্ষ থেকে জনের জন্মদিনে নিজ হাতে তৈরি কেক নিয়ে আসেন ম্যাডাম। ম্যাডামের হাতে প্রস্তুত রকমারি নতুন নতুন স্পেনীশ খাবারে অনিচ্ছা সত্ত্বেও অংশ নিতে বাধ্য হয় জন।
ম্যাডামের স্নেহের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে উঠে জন। ছুটির দিনে ম্যাডামের হাত ধরে সৈকতে হাঁটতে হাঁটতে দূরে হারিয়ে যায় দুজন। সাগর পারের রাঙ্গা পাহাড়গুলোর সবুজের বুক চিরে কখনও কখনও হাত ধরাধরি করে ম্যাডাম জন বেয়ে উঠতেন পাহাড়ের চূড়ায়। চারপাশের সবুজ সুন্দর বনবনানী, সমুদ্রের উন্মুক্ততা, বাতাসের শন্শন্ গর্জন তাদেরকে উন্মাতাল করে দিত।
এমনি করে ম্যাডাম কিশোর জন পরস্পর অত্যন্ত অন্তরঙ্গ হয়ে উঠেন। জনও ম্যাডামকে শ্রদ্ধার পাশাপাশি ভালবাসতে শুরু করে দেয়। স্পোর্টস ড্রেস পরা জনের কাঁধে হাত রেখে, সেই স্নেহের হাত বুলিয়ে দিতেন ওর মাথায়। ম্যাডামের হৃদয়ের শীতল উষ্ণতা ভরা ভালবাসায় কোন কলংক ছিলনা, ছিল শুধু পবিত্রতার প্রচ্ছন্ন স্নেহের ফাগুধারা। ম্যাডামকে নিয়ে সাগরের ঝিনুক কুড়িয়ে নানা ধরনের খেলনা তৈরি, প্রজাপতির পাখনা সংগ্রহ করণ, বাইনোকুলারে, চোখ লাগিয়ে সামুদ্রিক পাখি দেখায় দারুণ আনন্দ পেত জন। নাইস ম্যাডাম প্রায়ই যাওয়া আসা করতেন জনদের বাসায়। ম্যাডাম অবসর সময়ে জনকে নিয়ে কখনও ছবি দেখা, কখনও ক্যারম খেলায় মেতে উঠতেন।
এমনি করে করে চারটি বছর পার হয়ে যায়। কিশোরসুলভ চপলতার স্থর পার হয় জনের। নাইস ম্যাডাম পিতামাতার ভালবাসায় জড়িয়ে সুখেই সময় যাচ্ছিলো। এমন সময় হেডকোয়ার্টার থেকে আবার জনের ড্যাডের বদলির নির্দেশ আসে।
একদিন বিদায় নিতে জন ছুটে যায় ম্যাডামের বাসায়। সে এক করুন দৃশ্য। জনকে বুকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন নাইস ম্যাডাম। ম্যাডামের মাবাবারও চোখ বেয়ে ঝরে পড়ছিল দুঃখের শিশির বিন্দু।
সে অনেক অনেক দিন, প্রায় দশটি বছর পার হয়ে গেছে। জন এখন শিক্ষা জীবনের ইতি টেনে প্রতিষ্ঠিত ব্যাংকার। নিউইয়র্কের কোন এক ব্যাংক শাখার ব্যবস্থাপক সে। চেম্বারে বসে দিনরাত প্রতিষ্ঠার স্বপ্নে বিভোর সেই বালক, আজকের মিষ্টার জন হেনরি।
কাজের ফাঁকে ফাঁকে অবসর সময়ে ওর মনের চোখে ভেসে উঠে ফেলে আসা সোনালী দিনগুলোর কথা, মনে পড়ে রডআইল্যান্ডের স্মৃতি। নাইস ম্যাডামের স্নেহ ভালবাসার কথা স্মরণ হলে চোখে অশ্রআসত জনের। যে ম্যাডাম তাকে এত ভালবাসতেন, তার উন্নতিতে আনন্দে উল্লাসিত হতেন। আজ কেন যেন জনের ভীষণ ইচ্ছে করছে, ম্যাডামকে খবরটা জানিয়ে দেই- ‘তোমার জন আজ শতাধিক স্টাফের বিরাট শাখার ব্যবস্থাপক হয়েছে।
বরফঢাকা শীত শেষ হয়েছে নিউইয়র্কে। বসন্তের উচ্ছ্বলতায় উদ্বেলিত হয়ে গেছে আমেরিকায় এই শ্রেষ্ঠ নগরী। শাখায় শাখায় কচি কচি পত্র পল্লবের সমারোহ। সারিবদ্ধ বাসার বাগানে বাগানে ফুল আর ফুল। জনের চোখে ভেসে উঠে রড আইল্যান্ডর বসন্তের স্মৃতিমালা। রড আইল্যান্ডের আকাশ, বাতাস, সাগর-সৈকত, পাহাড় বন তাকে হঠাৎ পাগল করে তুলে। দশ বছর পর রড আইল্যান্ডে যেন আবার তাকে ডাকছে। একদিন রাত্রে স্বপ্নে দেখে জন, নাইস ম্যাডাম তাঁকে বলছেন- প্রিয় জন। তুমি এখন অনেক বড় হয়েছ, প্রতিষ্ঠিত হয়েছ, একটিবার রড আইল্যন্ড এসনা, তোমাকে মনে পড়ছে, দেখার জন্য মন ছটফট করছে নাইস ম্যাডামকে স্বপ্নে দেখে আর সইতে পারেনা জন ছুটি নিয়ে চলে যায় রড আইল্যান্ডে।
অবাক বিষ্ময়ে জন লক্ষ্য করে ওর সে সাধের শহরটি দশ বছরে বদলে গেছে অনেক, সেখানে আর সেই রড আইল্যান্ড নেই। জনদের বাংলোটা আছে ঠিকই, তবে তাতে অপরিচিত নতুন অতিথি। সেই সৈকত বনলতা পাতা টিলা যেন দশবছরের ব্যবধানে ভুলে গেছে তাদের প্রিয়বন্ধু জনকে। হয়তবা ভুলে গেছে দশবছর আগের তন্বী সুন্দরী নাইস ম্যাডামকেও।
নিউইয়র্ক ফেরত মিস্টার জন সাগরপার দিয়ে হেঁটে হেঁটে ছুটে যায় নাইস ম্যাডামের সরকারি বাসায়। কিন্তু এখানেও  পরিচিত কেউ নেই। ওদের কাছে প্রশ্ন করলেও ওরা বলতে পারলনা নাইস ম্যাডামের কোন খবর। কারণ বিগত দশ বছরে এই বাসার বাসিন্দা বদল হয়ে গেছে কয়েকবার। অনেককে জিজ্ঞেস করল, কোথায় নাইস ম্যাডাম? কিন্তু বলতে পারলনা কেঊ। 
যার জন্য জনের এই আগমন, স্বপ্নে যার ডাক শুনে সে ছুটে এসেছে, তাকে অনেক খুজে না পেয়ে ভেঙ্গে পড়ে জন। অন্যমনস্ক হয়ে ছুটে যায় কৈশোরের স্মৃতিবিজড়িত সমুদ্র সৈকতে। ম্যাডামের ছোট্ট ভাইটির সমাধিপাশে এসে আৎকে উঠে জন। একটা পুরনো সমাধি ফলকে চোখ পড়তেই সাগরপারের নির্জনতা ভেদ করে প্রচন্ড ঝড় আসে জনের বুকে।
এখানে ঘুমিয়ে আছেন আমাদের
প্রিয় নাইস ম্যাডাম,
জুলিয়ান লিলি।
জন্মঃ.............
মৃত্যুঃ.............
-আটলান্টিক স্কুলের ছাত্রছাত্রীবৃন্দ।

তেইশ বছরের যুবতী ম্যাডামকে সে ফেলে গিয়েছিল দশ বছর আগে। দুবৎসর পর মারা যান ম্যাডাম, অর্থাৎ মৃত্যুকালে ওর বয়স হয়েছিল পচিশ। জন তার বয়স গুণে যায়। আশ্চর্য হয়ে যায়, যখন ওর গণনায় ধরা পড়ে, সে আজ ম্যাডামের চেয়ে বয়সে বড় হয়ে গেছে।
বিড়বিড় করে নির্জন সাগর পারে টিস্যুতে চোখ মুছে বলে উঠে জন- ম্যাডাম তোমাকে আমি আর আপু বলবোনা, আমি তোমার চেয়ে বয়সে অনেক বড় হয়ে গেছি। রাগ করনা, দশ বছর পর তুমি আজ ম্যাডাম তো নও, আপুও নও, তুমি আজ জুলিয়ান লিলি। স্বপ্নে আমাকে দেখতে চেয়েছিলে তাইতো দেখা দিয়ে শূন্য হাতে ফিরে গেলাম। বিদায় রড আইল্যান্ড। চিরবিদায় নাইস ম্যাডাম।
রচনাকাল ঃ ১৯৮৭ সাল।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন