শুক্রবার, ১৫ জানুয়ারী, ২০১৬

হজরত শাহজালাল বিষয়ক প্রামান্য গ্রন্থাবলী


হজরত শাহজালালের সিলেট বিজয়ের  পর ১৩০৩ খ্রিস্টাব্দ হতে ১৭০৩ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত প্রায় চার শত বৎসর তাঁর সম্পর্কে কোন ঐতিহাসিক গ্রন্থ রচিত হয়নি। শাহজালালের(র:) সিলেট আগমন, বসতি স্থাপন ও এখানে ইসলামের প্রচার ও সম্প্রসারণ এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। তাঁর আগমনের উদ্দেশ্য ছিল মহৎ ও সুদূরপ্রসারি। কিন্তু দু:খের বিষয় হচ্ছে এই মহান পুরুষের জীবন ইতিহাস কেমন যেন এক উপখ্যান হয়ে যাচ্ছে। সিলেট সহ বাংলার শাসকগণ ত্রয়োদশ ও চতুর্দশ শতাব্দীতে বারবার দিল্লির অধীনতা ছিন্ন করে স্বাধীনতা ঘোষণা করে। পনের শতকে বাংলার রাজনৈতিক পালাবদলের ফলে অনেক সঠিক তথ্য হারিয়ে গেছে ইতিহাসের পাতা থেকে। দিল্লীর সুস্পষ্ট ইতিহাস থেকে জানা যায় সম্রাট শের শাহের হাতে বাংলার হোসেনশাহি বংশ এবং মোঘল বাদশা আকবরের হাতে বাংলার কাররানী বংশ ও স্বাধীন বারো ভুঁইয়ারা ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। ষোড়শ শতকে বাংলায় মোঘল ও পাঠানদের মধ্যে ক্ষমতার লড়াইয়ে তীব্র অরাজকতার সৃষ্টি হয়। এ সময় সিলেটের দুর্বল প্রশাসন ব্যবস্থার সুযোগে খাসিয়া ও বিভিন্ন উপজাতিরা শহরে হামলা চালিয়ে হত্যা লুন্ঠন, ধর্ষন চালায়। ফলে অভিজাত শ্রেণির লোকেরা শহর ছেড়ে সুদূর দক্ষিণ দিকের গ্রামাঞ্চলের দিকে চলে যায়। এ সময়ে হজরত শাহজালালের(র:) জীবন, শাসন ব্যবস্থা ও সিলেটের বিজয় সংক্রান্ত অনেক ঐতিহাসিক নিদর্শন দলিল দস্তাবেজ নষ্ট হয়ে যায়। হজরত শাহজালালের(র:) জীবনকালে বাংলাদেশ দিল্লির অধীনতা হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় ও পরবর্তী দুইশত বৎসর প্রায় স্বাধীন থাকায় দিল্লী কেন্দ্রিক রচিত ইতিহাসে এখানকার বিবরণ তেমনটি আসেনি। ফলে সঠিক ইতিহাসের স্থান দখল করে নেয় কিংবদন্তী নির্ভর তথ্য ও মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়া কল্পকাহিনি। 
সমকালীন ইতিহাস গ্রন্থের অভাবে ইতিহাসবেত্তাদের পরবর্তীকালে প্রত্নবস্তু, শিলালিপি, সমকালীন বঙ্গভারতের ইতিহাস, ইবনে বতুতার বিবরন, বিভিন্ন স্থানের নামকরন ও লোককাহিনী ইত্যাদি বিশ্লেষণ পূর্বক শাহজালালের জীবন ইতিহাস রচনা করতে হয়েছে। শাহজালালের প্রাচীন জীবনী গ্রন্থের মধ্যে উল্লেখযোগ্য “রওজাতুস সালেহিন” দিল্লির মোঘল সম্রাট ফররুখ শিয়ারের রাজত্বকালে রচিত হয়। শাহজালালের ইতিহাস বলে এক ধরনের উপখ্যান বা লোক কাহিনি সিলেটের জনসমাজে বহুদিন ধরে প্রচলিত ছিল। পরবর্তীকালে সেইগুলোর সমন্বয়ে ১৭১৫ খ্রীষ্টাব্দে (১১২৪হিজরী) সম্রাট ফররুখ শিয়ারের রাজত্বকালে শাহজালালের অন্যতম সাথি ভারতের মধ্যপ্রদেশের নারনুলির অধিবাসী হামিদউদ্দিন নারনুলির জনৈক বংশধর “রওজাতুস সালেহিন” নামক একটি পুস্তক প্রণয়ন করেন। ইহাই হজরত শাহজালাল সম্বন্ধে সর্বপ্রথম গ্রন্থ। ১৭২১ খ্রিষ্টাব্দে (১১৩৪হিজরি) মুর্শিদাবাদের নবাব মুর্শিদ কুলি খানের সুবাদারীকালে তাঁর উদ্যোগে  শাহজালালের দরগার জনৈক খাদিম মঈন উদ্দিন “রিসালা” নামে আর একটি ইতিহাস গ্রন্থ সামান্য পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করে লিপিবদ্ধ করেন। এই আদি গ্রন্থগুলো এখন আর নাই। এই গ্রন্থগুলো সিলেটে প্রচলিত প্রবাদ ও লোককাহিনির উপর নির্ভর করে লিখিত হয়েছিল। ত্রিপুরার অধিবাসী নাছির উদ্দিন হায়দার নামক জনৈক ভদ্রলোক ১৮৬০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত সিলেটের মুন্ছেফ ছিলেন ও তিনি দরগামহল্লায় অবস্থান করে ১৮৫৮ খ্রিষ্টাব্দে ফারসি ভাষায় শাহজালালের ইতিহাস বিষয়ক গ্রন্থ “সুহলে ইয়ামেন” বা “ইয়ামেনের নক্ষত্র” রচনা করেন। পূর্ববর্তী দুই গ্রন্থের সার সংগ্রহ করে আরও অনেক তথ্য প্রমাণ যুক্ত করে তিনি পুস্তকটি প্রণয়ন করেন। এই গ্রন্থটিও মুলত: কাহিনি ও কিংবদন্তী নির্ভর। এখানে যেমন অলৌকিক কাহিনির ছড়াছড়ি, তেমনি সন তারিখ ও তথ্যে রয়েছে গড়মিল। “সুহলে ইয়ামন” এখনও সযতনে দরগায় রক্ষিত রয়েছে। “সুহলে ইয়ামেন” গ্রন্থে ৩৬০ আউলিয়ার মধ্যে ২৪০ জন আউলিয়ার নাম লিপিবদ্ধ হয়েছে। 
পরবর্তীকালে পীর ও বীর শাহজালালকে নিয়ে “সুহলে ইয়ামেন” অবলম্বনে অনেক গ্রন্থ রচিত হয়েছে। ১৮৭১ খ্রিষ্টাব্দে (১২৭৮ বাংলা) ইলাহি বখস “সুহলে ইয়ামেন” ফার্সি হতে বাংলায় “তোয়ারিখে জালালি” নামে অনুবাদ করেন। মৌলভীবাজার সদর উপজেলার চুয়াল্লিশ পরগনার দুর্লভপুর গ্রামের কাজি মোহাম্মদ আহমদ ১৮৮৫ খ্রিষ্টাব্দে “শ্রীহট্ট দর্পণ” নামক ইতিহাস গ্রন্থে শাহজালালের জীবনী আলোচনা করেন। ১৯০৫ খ্রিষ্টাব্দে গোলাপগঞ্জ উপজেলার বরায়া পরগনার বাগরখলা নিবাসী মুন্সি মোহাম্মদ আব্দুর রহিম “শ্রীহট্ট নূর” নামে শাহজালালের জীবনী লিখেন, যা হজরত শাহজালাল সম্বন্ধে একটি বিশেষ মূল্যবান গ্রন্থ। ১৯১০ খ্রিষ্টাব্দে অচ্যুত চরণ চৌধুরী “শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত” ২য় ভাগ ২য় খন্ডে শাহজালালের জীবনী লিখেন। ১৯১২ খ্রিষ্টাব্দে আবু জাকারিয়া ইব্রাহিম আলী “শ্রীহট্ট বিজয় কাব্য” রচনা করেন। ইংরেজ ঐতিহাসিক হান্টার তার “স্টেটিসটিকেল একাউন্টস অব আসাম” গ্রন্থে শাহজালালের জীবনী লিখিয়াছেন। স্পেশাল সাবরেজিষ্টার দরগামহল্লার মুফতি আজহার উদ্দিন সিদ্দিকি ১৯১৩ খ্রিষ্টাব্দে “শাহজালাল এন্ড হিজ খাদিমস” এবং ১৯৩৮ খ্রিষ্টাব্দ “শ্রীহট্টে ইসলাম জ্যোতি” প্রকাশ করেন। ১৯২৪ খ্রিষ্টাব্দে ভাদেশ্বরের আব্দুল মালিক চৌধুরী “হজরত শাহজালাল” নামক গ্রন্থ রচনা করেন। আশরাফ হোসেন সাহিত্যরত্ন পুরাতত্ত্ববিদের “সিলহটের ইতিহাস” ১৯৩৬ খ্রিষ্টাব্দে এবং লোকতত্ত্ববিদ গোলাম আকবর সাহিত্যভুষণের “ইসলাম জ্যোতি শাহজালাল” ১৯৮১ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত হয়। ১৯৮৩ খ্রিষ্টাব্দে এ.জেড.এম. শামসুল আলম সিএসপি “হজরত শায়েখ জালাল মুজররদ (র:)” প্রকাশ করেন। ১৯৮৩ খ্রিষ্টাব্দে খন্দকার মোঃ বশির উদ্দিন “হজরত শাহজালাল (রঃ)” এবং ১৯৮৪ খ্রিষ্টাব্দে আলী মাহমুদ খান “প্রাচ্যসূর্য হজরত শাহজালাল (র:)” গ্রন্থ প্রকাশ করেন। মোঃ নুরুল হক সম্পাদিত “আল ইসলাহ” শাহজালাল সংখ্যা- ১ম খন্ড, ১৩৬৪ বাংলায় প্রকাশিত হয়। ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দে সৈয়দ মুর্তজা আলী “হজরত শাহজালাল ও সিলেটের ইতিহাস” প্রকাশ করেন। ১৯৮৮ খ্রিষ্টাব্দে ডাক্তার সৈয়দ শাহ আনোয়ার “হজরত শাহজালাল(র:) সিলেট” প্রকাশ করেন। ১৯৯২ খ্রিষ্টাব্দে সৈয়দ মোস্তফা কামাল “শাহ জালাল ও তার কারামত” নামক গ্রন্থ রচনা করেন। ১৯৯৪ খ্রিষ্টাব্দে অধ্যাপক আবু খালেদ চৌধূরী “শাহজালাল” এবং ১৯৯৭ খ্রিষ্টাব্দে দেওয়ান নূরুল আনোয়ার হোসেন চৌধুরী “জালালাবাদের কথা” প্রকাশ করেন। 
২০১২ খৃষ্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে কবি ও লেখক চৌধুরী ইসফাকুর রহমান কুরেশি কতৃক তিন পর্বে "শাহজালাল(রঃ) ও শাহদাউদ কুরেশি(রঃ)" প্রকাশিত হয়। এই গ্রন্থের প্রথম পর্বে হজরত শাহজালাল(রঃ) দ্বিতীয় পর্বে ৩৬০ আউলিয়া এবং তৃতীয় পর্বে হজরত শাহদাউদ কুরেশির ইতিহাস লেখা হয়েছে। এই গ্রন্থগুলোই   শাহজালালকে(রঃ) নিয়ে লিখিত বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ও প্রামাণ্য গ্রন্থ। 
এই গ্রন্থগুলো ছাড়াও অনেক মানুষ ও লোককবি হজরত শাহজালাল সম্বন্ধে অসংখ্য ছোট্ট পুস্তিকা, গান, গজল, কবিতা, ছড়া এমনকি নাটকও রচনা করেছেন। সিলেট বিভাগসহ বাংলা ভাষাভাষী বিভিন্ন পত্রপত্রিকা ও ম্যাগাজিনে হজরত শাহজালাল(র:) বিষয়ক বিভিন্ন প্রবন্ধ, ফিচার ও কলাম প্রকাশ একটি নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা। অসংখ্য শাহজালাল গবেষক অনবরত এই ওলি আল্লাহ ও তাঁর ৩৬০ আউলিয়াকে নিয়ে সর্বদা গবেষণা, তত্ত্ব অনুসন্ধান, কবিতা, সাহিত্য ও ভক্তি সঙ্গীত চর্চা করে যাচ্ছেন। হযরত শাহজালাল (রঃ) সম্পর্কে এতই লেখালেখি, গবেষণা ও আলোচনা হচ্ছে যে, বাংলাদেশের অন্য কোন দরবেশ বা ওলিকে নিয়ে এত জ্ঞানচর্চা ও অনুশীলন কখনও হয় নাই।


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন