দেখে এলাম ভারতঃ সেই তুলনায় বাংলাদেশ
কবি লেখক ব্লগার ও পূবালী ব্যাংকার ইসফাক কুরেশী
বিশ্বের সপ্তম আশ্চর্য্যরে অন্যতম তাজমহল স্বচক্ষে দেখার এক তীব্র আকর্ষণ ছিল শৈশব হতে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন তাজমহল পরিদর্শন করে জাদুঘরের খাতায় মন্তব্য লিখেন- পৃথিবীর মানুষ দুইভাগে বিভক্ত, একভাগ হল যারা তাজমহল দেখেছেন এবং অন্যভাগ যারা দেখেন নি। যাক আমি, আমার সহধর্মিনী ডাঃ নূরজাহান বেগম চৌধুরী ও পুত্র জেফার ১২ সেপ্টেম্বর ২০১২ সালে ঐ প্রথম ভাগের মানুষের অন্তভুক্ত হলাম। শৈশবে গ্রামের মানুষের মুখে শুনতাম তাদের পূর্বপুরুষরা আসামে কাজ ও ঠিকাদারী করতেন। আমাদের অনেক আত্মীয় বৃটিশ আমলে আসামের নানা অঞ্চলে চাকুরী করতেন। কামরূপ কামাক্ষ্যার রহস্য জগতে এ অঞ্চলের অনেক মানুষ গিয়ে হারিয়ে যেত। লোকে বিশ্বাস করত ঐ যাদুর জগতের মেয়েরা ঐসব লোকেদের চিরতরে যাদুমন্ত্রে বন্দি করে রেখে দিত। আসলে ঐসব লোকেরা বিয়েশাদি করে আসামের জনবিরল অঞ্চলে স্থায়ীভাবে বসতি স্থাপন করতো, পথের অগম্যতার কারণে আর ফিরে আসতে সক্ষম হতনা। ১৯৪৭ সনের ১৪ই আগষ্টের আগে ঐ অঞ্চলটা আমাদের সাথে একই রাষ্ট্রের অংশ ছিল। ১৯৪৭ এর সীমারেখা আমাদেরকে চিরদিনের জন্য আলগা করে দেয়। আমরা আলাদা হয়ে প্রথমে পাকিস্তান ও পরে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের অন্তভুক্ত হলাম।
বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চলের একজন বাসিন্দা হিসেবে কাছাকাছি মেঘালয় ও আসাম অঞ্চল ও ভারতীয় সভ্যতার লীলাভূমি দিল্লি আগ্রা দেখার এক তীব্র আগ্রহে গত বৎসর পূবালী ব্যাংক হতে ছুটি নেই। কিন্তু হঠাৎ ডাঃ নূরজাহান চৌধুরী অসুস্থ হওয়ায় তাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। শেষমেষ ঢাকার স্কয়ার হাসপাতালে একই দিনে পিত্তথলী ও ফাইব্রয়েড অপারেশন হয়। তিনি মহান আল্লাহ মেহেরবানিতে সুস্থ্য হয়ে চিন্তামুক্ত হই। সেবার আর যাত্রা সম্ভব হয়নি। এ বছর সিলামের সানওয়ার আলী শিলং যাওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করলে তাকে নিয়ে লতিফ ট্রেভেলসে পাসপোর্ট জমা দেই। শেষপর্যন্ত সানওয়ার আলীকে ভিসা না দিলেও আমরা তিনজন পেয়ে যাই। সামনে চলে আসে আমার এম.বি.এ সেমিষ্টার ফাইন্যাল পরীক্ষা। পরীক্ষার আগেই যাত্রার সিন্ধান্ত নেই। কারণ দেরী হলে জেফারের পড়াশুনার ক্ষতি হয়ে যাবে।
৫ সেপ্টেম্বর ২০১২ সালে সকাল ৮টা ৩০ মিনিটে ভাড়া কারে আমাদের সাগরদিঘিরপারের বাসা হতে যাত্রা শুরু করে ৯.৩০ মিনিটে ডাউকি স্থলবন্দরে উপনীত হই। তামাবিলের কাছে সুউচ্চ পাহাড়-সারি ভারতের অংশ ও পাহাড়গুলোর পাদদেশ হতে আরম্ভ হওয়া সমতল ভূমি হচ্ছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ সীমায় দু’টি অফিসে প্রয়োজনীয় কাজ সারতে হয়। প্রথমে ইমিগ্রেশন অফিস যাহা বাংলাদেশ পুলিশ বিভাগ কর্তৃক পরিচালিত ও অন্যটি কাষ্টমস্ অফিস। অত্যন্ত ভগ্ন দৃষ্টিকটু দু’টি টিনের ঘরে অফিস দু’টি পরিচালিত হয়। দু’টি অফিসে বাথরুমে পানি নেই, অসম্ভব দুর্গন্ধ। কাজকর্ম ভীষণ স্লো ও দায়ছাড়াগোছের। কাজ সেরে ছোট্ট বিজিবি ক্যাম্প পার হয়ে বি.এস.এফ ক্যাম্পে যাই। পাগড়িপরা দাড়িওয়ালা মেশিনগানধারী শিখ অফিসার পাসপোর্ট দেখে ভারতীয় ইমিগ্রেশন অফিস দেখিয়ে দেন। পাহাড়ের ধাপে অত্যন্ত দৃষ্টিনন্দন ঢালু ছাদ বিশিষ্ট ভবন। আমলারা দারুন মনযোগী ও ব্যবহার সৌহার্দ্যপূর্ণ। বাথরুম খুবই পরিচ্ছন্ন। ভারতীয় আমলাতন্ত্র আমাদের চেয়ে যে অনেক দক্ষ ও কার্য্যকর সীমারেখা পার হওয়া মাত্রই স্পষ্ট হয়ে উঠে।
ভারতীয় ইমিগ্রেশন অফিসে দেখা হয় ইঞ্জিনিয়ার মাসুদুর রহমানের সাথে। তার বাড়ি জৈন্তার দরবস্তে। চাকুরী করেন মংলা পোর্টে। স্ত্রী ও একমাত্র কন্যাকে নিয়ে যাচ্ছেন শিলং বেড়াতে। তিনি আগে অনেকবার ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল সফর করেছেন। ভাল হিন্দি জানেন। মনে হয়েছে- তার ভ্রমণের নেশা রয়েছে। তিনি ছোট্ট ন্যানো কারে প্রতিজন ২০ রুপি ভাড়ায় আমাদেরকে নিয়ে যান ডাউকি বাজারে। সমুগাড়ি হচ্ছে টাটা কোম্পানি কর্তৃক নির্মিত পাহাড়ে চলাচলের উপযোগী এক ধরনের জিপ। সমুগাড়িতে জনপ্রতি ১০০ রূপি ভাড়ায় ডাউকি হতে শিলংয়ের দিকে রওয়ানা হই। কিছুক্ষণ পরই সুমো জিপ জাফলংয়ের সুপ্রসিদ্ধ ঝুলন্ত ব্রিজ পার হয়ে যায়। জিপটির যাত্রী সংখ্যা ১২ জন। আমরা ছাড়া বাকি লোকজন খাসিয়া। তাদের মধ্যে একজনকে বেশ শিক্ষিত মনে হয়েছে। তিনি মেঘালয়ের অর্থনীতি ও রাজনীতি বিষয়ে বেশ অবগত। রাজ্যটির বৃহৎ বাসিন্দা খাসিয়ারা সিলেটের উত্তরদিকের পাহাড়ে ও পরবর্তী নাগরিক গোষ্ঠি গারোরা আমাদের ময়মনসিংহ জেলার উত্তরে বসবাস করে। আর আছেন প্রাচীন আমল হতে বসবাস করা সামান্য সংখ্যক বাঙ্গালি জনগণ। শিলংয়ে খাসিয়াদের আধিপত্য অথচ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী সাংমাই সংখ্যালঘু গারোদের লোক। শিলং যাত্রী খাসিয়া ভদ্রলোক বাংলা জানেন। শুনলাম অনেক কিছু। এখানে প্রচুর ঘাস হয়। তাই রয়েছে ডায়রি খামার। বাংলাদেশে রপ্তানি হয় কয়লা, গ্রানাইড ও চুনাপাতর। অনিন্দ্যসুন্দর মেঘালয়া পর্যটনের এক স্বর্গরাজ্য। শিলং শহরটাকে বাদ দিলে সারাটা মেঘালয় বৃক্ষ ও সম্পদে ভরা এক জনবিরল পাহাড়ি অঞ্চল।
ঝুলন্ত ব্রীজ পার হবার পর জিপ উপরের দিকে উঠছে তো উঠছেই। মাইলখানেক নিচে বাংলাদেশের সমতল জলাভূমি। পাথুরে পাহাড়ের ধাপকেটে নির্মিত রাস্তা, যার একদিকে পাহাড় আকাশ ছুঁয়েছে, অন্যদিকে মাইল দেড়েক নিচে নেমে গেছে। কোথাও ঢালু আবার কোথাও খাড়া পাহাড়ের খাদ। গাড়ি উপরের দিকে যেয়ে যেয়ে এক পাহাড়বেষ্টিত সমতলপ্রায় ভূমিতে চলে আসে। খাসিয়াদের গ্রাম্যশহর। বাড়িগুলো মাছাংয়ের উপর নির্মিত। এই জনপদের নাম পেনিনসোলা। গাড়ি আরও উপরে উঠে আরেক জনপদে থামে, যার নাম কাশী। গাড়ির জানালার দিকে তাকিয়ে দেখছি এমন সব দৃশ্য, যা আর কখনও দেখিনি। এক পাহাড়ে রোদ, অন্য পাহাড়ে মেঘের ছায়া নীচে পাহাড়ের গায়ে বাষ্প জমে মেঘ তৈরি হচ্ছে। সাদা ঘন কুয়াশার মত মেঘ, দৃষ্টি আটকে দিচ্ছে। এক পাহাড়ের গায়ে অন্য পাহাড়ের ছায়া লুকোচুরি খেলছে। আমি বান্দরবন ও রাঙ্গামাটি ঘুরেছি। কিন্তু শিলংয়ের পাহাড়ি দৃশ্য পার্বত্য চট্টগ্রামে নেই। শক্ত পাথরের পাহাড়ে অপূর্ব সবুজের সমারোহ। পাহাড় বেয়ে নেমে আসা ঝর্ণা ও জলপ্রপাত সবই অনন্য।
ডাউকি বাজার হতে ১২ টায় ছেড়ে দেয়া সুমো জিপটি ৩টা ৩০ মিনিটে শিলং শহরের অঞ্জলি বাস টার্মিনালে এসে থামে। শিলং শহরের পুলিশ বাজারে বিদেশীদের থাকার জন্য অসংখ্য হোটেল রয়েছে। সহযাত্রী মাসুদ সাহেব ও আমি অনেক খোঁজাখুজি করে একটি হোটেল বের করি। নাম ‘রেইন বো’ হোটেল। অবস্থান পুলিশ বাজার। তিনজন থাকার মত ২ বেডের রুম। ভাড়া প্রতিদিন ৮০০ রুপি। ব্রডওয়ে হোটেল, শিলং রেস্ট হাউস, গেইস হোটেল খুবই কস্টলি। সামনের বাবা হোটেলে রুইমাছ সহ খাবার খেয়ে রুমে এসে ঘুমিয়ে পড়ি। পরদিন নর্থইষ্ট ছাত্র ইউনিয়নের ডাকে সেভেন সিস্টারের রাজ্যগুলোতে আঞ্চলিক দাবি-দাওয়া নিয়ে হরতাল। তাই রুমে বসে থাকতে হয়। হোটেল রুমটির মেঝে কাষ্ট নির্মিত, ওয়ালগুলো কাটের আবরণে চাকা। বাথরুমে গরম ও ঠান্ডাপানির লাইন রয়েছে। রুমটির টেলিভিশনের উপর কৃত্রিম গ্লাসের ছাদ। ঐ ছাদ দিয়ে দিন ও রাতে চন্দ্র ও সূর্যের প্রাকৃতিক আলো আসে, যা সত্যই অপূর্ব ও অভিনব মনে হয়।
ডাউকি বাজার হতে ১২ টায় ছেড়ে দেয়া সুমো জিপটি ৩টা ৩০ মিনিটে শিলং শহরের অঞ্জলি বাস টার্মিনালে এসে থামে। শিলং শহরের পুলিশ বাজারে বিদেশীদের থাকার জন্য অসংখ্য হোটেল রয়েছে। সহযাত্রী মাসুদ সাহেব ও আমি অনেক খোঁজাখুজি করে একটি হোটেল বের করি। নাম ‘রেইন বো’ হোটেল। অবস্থান পুলিশ বাজার। তিনজন থাকার মত ২ বেডের রুম। ভাড়া প্রতিদিন ৮০০ রুপি। ব্রডওয়ে হোটেল, শিলং রেস্ট হাউস, গেইস হোটেল খুবই কস্টলি। সামনের বাবা হোটেলে রুইমাছ সহ খাবার খেয়ে রুমে এসে ঘুমিয়ে পড়ি। পরদিন নর্থইষ্ট ছাত্র ইউনিয়নের ডাকে সেভেন সিস্টারের রাজ্যগুলোতে আঞ্চলিক দাবি-দাওয়া নিয়ে হরতাল। তাই রুমে বসে থাকতে হয়। হোটেল রুমটির মেঝে কাষ্ট নির্মিত, ওয়ালগুলো কাটের আবরণে চাকা। বাথরুমে গরম ও ঠান্ডাপানির লাইন রয়েছে। রুমটির টেলিভিশনের উপর কৃত্রিম গ্লাসের ছাদ। ঐ ছাদ দিয়ে দিন ও রাতে চন্দ্র ও সূর্যের প্রাকৃতিক আলো আসে, যা সত্যই অপূর্ব ও অভিনব মনে হয়।
পরদিন ৬ সেপ্টেম্বর ১২ তারিখে মেঘালয় বন্ধ। আমাদের হরতালে মারামারি হয়, জোরজবরদস্তি হয় কিন্তু শিলংয়ে এর কিছুই নেই। পুলিশ ও হরতালকারীর ধাওয়া পালটা ধাওয়া নেই। মানুষ স্বেচ্ছায় যান চলাচল ও দোকানপাট বন্ধ রেখেছে।
ঘুম হতে উঠে দেড়-দুই ঘন্টা নির্জন শহরে ভ্রমণ করি। শহরটা পাহাড়ি ও রাস্তাঘাট প্রশস্থ করার মত জায়গা না থাকায় কিছুটা ভীড় লেগে থাকেই। এখানে রিকশা নেই। এক রাস্তা হতে নিচে নেমে অন্য রাস্তা দিয়ে হেঁটে দূরের বসতি ঘুরে বেড়াই। সুন্দর ফুল, সুন্দর লতাপাতার পাহাড়ি শহর শিলং। এক ধরনের নীল ফুল লতাবনে ঝুলে থাকে। জীবন্ত বাঁশের গাছগুলো বেড়া তৈরি করে। রেস্ট হাউসের আগে সুন্দর পাহাড়ি লেইক পার্কে ফটো উঠাই। ৫/৭ তলা ভবনগুলো এমন ভাবে নির্মিত যে ২/১ তলা রাস্তার লেবেলের নীচে চলে যায়। বাড়িঘরগুলো বেশীর ভাগ পাহাড়ের ধাপে নির্মিত। শহরটিতে আজান শুনিনি কারণ কোন মসজিদ নেই। ২/১টা হিন্দু মন্দির চোখে পড়েছে। তবে খাসিয়ারা খ্রিষ্টান। পূর্বে তারা প্রকৃতি পূজারী ছিল। ইংরেজ শাসনামলে মিশনারিরা স্কুল, হাসপাতাল, গির্জা ইত্যাদি নির্মাণ করে তাদেরকে খ্রিষ্টধর্মে দীক্ষিত করে নেয়। এখানে সর্বত্র যিশুর প্রতিকৃতি, ভাস্কর্য্য ও মূর্তি দেখতে পাওয়া যায়।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন