দেখে এলাম ভারত, সেই তুলনায় বাংলাদেশ
অন্যান্য জাতিসত্ত্বার মত খাসিয়ারাও এলিট ও নন-এলিট দুই ভাগে বিভক্ত। এলিট খাসিয়ারা শিক্ষিত ও ধনী। ছেলে ও মেয়েরা জিন্সের পেন্ট ও সার্ট কিংবা ট্রাউজার পরিধান করে। চেহারা অনেকটা চীনাদের মত। তারা কিছুটা বেঁটে ও স্বল্পভাষী। মেয়েরা স্মার্ট ফর্সা ও দারুন সুন্দরী। নন এলিট খাসিয়ারা বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকা ও প্রত্যন্ত অঞ্চলে বসবাস করে। মেয়েরা ঘাঘরা (কোমর বন্ধনী), ব্লাউজ ও একফলা কাপড় পরিধান করে। এরা দারুন পরিশ্রমী। পূর্বে তাদের মধ্যে মাতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা প্রচলিত ছিল। বিয়ের পর ছেলেদেরকে শ্বশুড় বাড়ি চলে যেতে হত। বর্তমানে এইসব রীতিনীতি তেমনটি কার্যকর নেই।
শিলং ১৪৯৬ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত এক শৈলশহর। এখানে সবসময় শীতল আবহাওয়া বিরাজ করে। সিলেটের তীব্র গরম হতে বের হয়ে মেঘাচ্ছন্ন শিলংয়ের হোটেল রুমে পৌষের শীতে আপতিত হই। শিলংয়ের হোটেলে বৈদ্যুতিক পাখা বা এয়ারকন্ডিশন নেই। ঠান্ডায় লেপ গায়ে দিয়ে ঘুমাতে হয়। এখানে শীতে ডিসেম্বর বা জানুয়ারিতে মাঝে মধ্যে বরফ পড়ে। তাদের স্কুল ড্রেসে নীল সুয়েটার অন্তভুক্ত। শিলংয়ে মশা নেই। দ্রব্যমূল্য সিলেটের তুলনায় বেশী। সবজি স্বাধহীন অথচ দাম মাছ-মাংসের চেয়েও অধিক। শিলংয়ের চেরিফল অনন্য। খাসিয়ারা খাসিভাষায কথা বলে। তাদের কোন বর্ণমালা ছিল না। ইংরেজ মিশনারিরা ইংরেজি হরফে খাসিয়া ভাষা লিখার প্রচলন করে। শিলংয়ে ইংরেজি হরফে লিখা খাসিয়া পত্রিকা লোকজনকে পড়তে দেখেছি।
৭ সেপ্টেম্বর ২০১২, রোজ শুক্রবার, সহযাত্রী ইঞ্জিনিয়ার মাসুদ সাহেব ও আমরা সাইটসিয়িংয়ের জন্য ২০০০ রুপিতে ১টি সুমোজিপ ভাড়া করি। ব্রেকফার্স্ট সেরে সকাল ১০টায় হোটেল রেইনবো হতে রওয়ানা হই। হোটেল ম্যানেজার চৈত্র বসনেট গাড়িটি বন্দোবস্ত করে দেন। চৈত্র বসনেট সিলেটি ভাষায় কথা বলেন। তিনি আসামের তাজপুর শহরের বাসিন্দা। তিনি দেখতে লম্বা স্মার্ট ও সুদর্শন।
আমাদের জিপটি চেরাপুঞ্জির উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে। শিলং হতে ৫৪ কি:মি: দক্ষিণে চেরাপুঞ্জি প্রায় ১৩০০ মিটার উঁচুতে অবস্থিত। চেরাপুঞ্জি ইংরেজদের অবদান। খাসিয়া সাহিত্য ও সংস্কৃতির পীটস্থান এই চেরাপুঞ্জি। ১৮৪১ সালে এখানে মিশনারি স্কুল স্থাপিত হয়। এখানকার প্রাচীন গীর্জার নির্মাণ কাল ১৮৬৪ সাল। ইংরেজি অক্ষরে খাসিলিপির জন্ম ও হয় এখানে মিশনারিদের হাতে। চেরাবাজারকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠে বসতি। বিশ্বের সবচেয়ে বেশী বৃষ্টিপাত (বছরে ৫০০ ইঞ্চি) হয় চেরাপুঞ্জিতে।
চেরাপুঞ্জির পথে প্রথমে একটি স্পটে জিপ থামালো ড্রাইভার সজল। ড্রাইভারের বাড়ি শিলচরে ও তার মাতৃভাষা সিলেটি। পাহাড় হতে নীচে নেমে দুই বিশাল পাহাড়ের মধ্যবর্তী স্থান হতে অনিন্দসুন্দর গীরিখাদ দর্শন করি। পাথুরে পাহাড়ের বনের ঝিঁ ঝিঁ পোকার অপূর্ব শব্দধ্বনী কর্ণকে মোহিত করে। উপরে রাস্তায় এসে উল্টো দিকে পাথরের উপর বয়ে চলা অপূর্ব ঝর্ণাধারা। ঝর্ণার পারে কমলা ও লেবুর বন। নানা প্রজাতির ফুলের মেলা। এখানে দোকান নিয়ে বসা খাসিয়া মহিলাদের দোকানে চা বিস্কুট খেয়ে রওয়ানা হয়ে সেভেন সিস্টার জলপ্রপাতে পৌঁছি। এখানে সাতটি জলপ্রপাতের পানি মাইল দেড়েক নিচে ছিটকে পড়ছে। ছোট ঝর্ণার ঝকঝকে নীল পানি এসে নীচে নামছে। একটু দুরে নীচে বাংলাদেশের জলাভূমি দেখা যায়। এখানে পাহাড়ের ভিতর দিয়ে বয়ে যাওয়া এক ঝর্ণা সুড়ংপথে দৃষ্টিগোচর হয়। এই সুড়ং ঝর্ণার পানি পাহাড় হতে দূরে নিক্ষিপ্ত হয় যেন পাহাড় সজুরে প্রস্রাব করছে। এখানে জলপ্রপাতের পানি কনায় সৌররশ্মি পড়ে রংধনুর সৃষ্টি করে। প্রকৃতির এই অপার সৌন্দর্য্য দেখে মহান আল্লাহর প্রতি শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে আসে। সবশেষে চেরাপুঞ্জির বাংলাদেশ সীমায় এসে পৌঁছে পাথরের উপর যোহরের নামাজ পড়ি। সামনে এক অপূর্ব পাহাড় একজন মানুষের মত দাঁড়িয়ে আছে। এই পাহাড়ের মাথার উপর মনে হয় এক ফলের ঝুড়ি চাপানো। এযেন প্রকৃতির এক বিচিত্র সৃষ্টি। ঐ ঝুড়িওয়ালা পাহাড়কে ঘিরে গড়ে উঠেছে খাসিয়া উপাখ্যান। শুনলাম ড্রাইভারের মুখে, প্রাচীনকালে এক দৈত্য এসে খাসিয়া জনপদে হানা দিয়ে মানুষের খাবার কেড়ে নিত। একদা মানুষ অতিষ্ট হয়ে দৈত্যের খাবারে বিষ মিশিয়ে দেয়। দৈত্য খাবারে মুখ রেখে ঝুড়িটি ঐ পাহাড়ে রেখে পালিয়ে যায়। তখন হতে দৈত্যের এই খাবারের ঝুড়ি যুগ যুগ ধরে পাহাড়ের শিরোভাগে আটকে রয়েছে। তারপর সুমোগাড়ি চলে আসে মাওসমাই গোহায়। শক্তপাথরের পাহাড়ের এই গোহার ভিতর প্রায় ৩০০ ফুট সুড়ঙ্গ পথে অন্ধকারে বৈদ্যুতিক বাতির ব্যবস্থা রয়েছে। উপরের দিকে পাহাড় চুষে পানি ঝরছে। গোহামানবের কথা ইতিহাসে পড়েছি। এই প্রথম গোহামানবের আবাসস্থল পার্বত্য গোহা দেখলাম। তিনশত ফুট সুড়ঙ্গ অতিক্রম করে আমি ও পুত্র জেফার পাহাড়ের অন্যপাশ দিয়ে বেরিয়ে এলাম। কোথাও প্রশস্ত কোথাও সংকীর্ণ গোহাপথ। জীবন্ত অবস্থায় কবরের মধ্যে হাঁটার অভিজ্ঞতা এখানে হয়। সুড়ঙ্গের মধ্যে দুইটি স্টিলের সেতুও রয়েছে। স্রষ্টার সৃষ্টির এই অপূর্ব নিদর্শন দেখানোর জন্য আবারও মহান আল্লাহকে ধন্যবাদ জানাতে হয়।
মাওসামাই সুড়ঙ্গ হতে বের হয়ে আমরা দুই পরিবারের ৬ জন বাইরের হোটেলে খাবার খাই। খাসিয়াদের রান্না অপূর্ব। টমেটো স্যুপ। আমাদের সুনামগঞ্জের হাওরের বড় মাছ ও মোরগ। ড্রাইভারদেরকে হোটেল মালিকগণ ফ্রি খাবার দেন। খাবার শেষে চলে আসি শিলং শহরের নিকটস্থ এলিফেন্ট জলপ্রপাতে। ক্যালেন্ডারে শিল্পীর আঁকা জলপ্রপাতের চেয়েও সুন্দর এই জলপ্রপাত। বিশাল জলধারা সুউচ্চ পাহাড় হতে নিচের মধ্য পাহাড়ে ও মধ্যপাহাড় হতে একদম নীচের আরেক পাহাড়ে নেমে আসছে। বিশাল জলধারা ও অপূর্ব তার সুর। জলপ্রপাতের উপর দিয়ে এক পাহাড় হতে অন্য পাহাড়ে যাবার ঝুলন্ত সেতু। সেই সেতু পার হয়ে শতাধিক সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এক অপূর্ব স্বর্গীয় সুষমা। এই জলপ্রপাত ভারতের সর্বশ্রেষ্ঠ জলপ্রপাত। এই অনিন্দ্য সুন্দরের স্রষ্টা মহান আল্লাহকে আবারও ধন্যবাদ জানাই।
আমরা সন্ধিবিচ্ছেদে পড়েছি মেঘ + আলয় = মেঘালয়। মেঘালয় একসময় আসাম রাজ্যের অংশ ছিল ও বৃহৎ আসামের রাজধানী ছিল শিলং। ১৯৭২ সালে মেঘালয় আলাদা রাজ্যের মর্যাদা লাভ করে। অনিন্দ্যসুন্দর মেঘের দেশ হিসেবে ভারতীয়রা রাজ্যটির এই কাব্যিক নাম রাখেন ‘মেঘালয়’। এটি দারুন এক সৌন্দর্যময় উপত্যকা। ঘাসের জমি, জলপ্রপাত, পাহাড়, সর্পিল পাহাড়ী নদী, ঢালুখাদ আর আকর্ষণীয় এর বন্যজীবন। আসলে মেঘালয় পর্যটকদের কাছে “স্বপ্ন হল সত্যির এক রাজ্য”।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন