তৃতীয়বার যুক্তরাষ্ট্র যাত্রা- সাউথ ক্যারোলিনা, ইংল্যান্ড ও ওয়েলস সফর পর্ব- চার
২৭ জুন ২০১৭ সাল। আজ লন্ডনের আকাশ মেঘাচ্ছন্ন, বাহিরে শীতল বাতাস বইছে। ব্রাইটন
সীবিচে যাবার পরিকল্পনা তাই বাতিল হয়ে গেল। সকালে বিশাল ফুড মার্কেটে যাই। বিশ্বের
প্রায় সব দেশের ফল ও তৈরী খাবার এই বাজারে পাওয়া যায়। এখানে সব খাবারই একদর এবং
ভেজালমুক্ত। ধনী দেশ তাই বাজারে পৃথিবীর উৎকৃষ্ট ফলমূল আমদানী করে সাজানো হয়। ভাবী বিলকিস চৌধুরী আমাদেরকে পরিবেশনের জন্য প্রায় সব ধরনের ফল কিনতে থাকেন। বাসায় এসে এসব নূতন ফলের
স্বাধ গ্রহন করি। ফলগুলোর খানিক বিবরন দিলাম।
Blue berry ফলটি সুস্বাধু ও মিষ্ট।
বর্ন- গাড় নীল ও গোলাকার। ফলে কোন বীজ নেই। Stow berry লাল লিচুর মত
ফলটির স্বাধ টকমিষ্টি। Apricots হলুদ-গোলাপী
ফলটি দেখতে আপেল কূলের মত। Saron Fruit ফলটি হলুদ টমেটোর মত।
Plam গাড় কালচে লাল ফলটি স্বাধে কষ্টি ও মিষ্টি। দেখতে বড়
আঙ্গুরের চেয়ে বড় ও গোলাকার। Fassion fruit আমড়ার মত সবুজ
বেগুনী মিশ্রন। Nectrins Fruit আপেলের মত তবে ভিতরের স্বাস
ঘন। বর্ন গাঢ় গোলাপী এবং স্বাধে মিষ্ট। Pear বিভিন্ন ধরনের
নাশপাতি। স্বাধে পানসে মিষ্টি। Flat peach Fruit এক ধরনের
চেপ্টা নাশপাতি ফল। Kiwi Fruit টকফল, চাটনী
করে খাওয়া যায়। Raj berry ছোট ছোট গোলাকার ফলটির বর্ন Stow
berry এর মত গাঢ় লাল।
মহান করুনাময়ের অশেষ শোকরিয়া তিনি বড়ভাবীর সৌজন্যে
পৃথিবীর এত এত ফলমূলের স্বাধ আমাদেরকে উপহার দেন।
ভাইয়ের বাসা হতে ডাগেনহাম ইস্ট রেলস্টেশনের দূরত্ব
এতোই অল্প যে চার মিনিট হেঁটে পৌঁছা যায়। টিকেট সংগ্রহ করে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমেই
প্লেটফরম। মিনিটে মিনিটে অটোমেটিক, চালকবিহীন বৈদ্যুতিক ট্রেন চলাচল করছে। প্রতি পাঁচ মিনিট পরপর
একই লাইনে একই দিকে ট্রেন যায়। ‘নেক্সট স্টেশন ইজ অলগেইট’
এইরূপ উচ্চারিত সংকেত আসে প্রতিটি স্টেশনে এবং মানুষ দুই মিনিটের
মধ্যে উঠানামার পালা শেষ করে। ট্রেনে আফ্রিকান, এশিয়ান,
ইউরোপিয়ান সব ধরনের ও জাতের লোকজন রয়েছেন। এদেশের ভাষা মূলতঃ ইংলিশ
হলেও ট্রেনে নানা ভাষার বিচিত্র ধ্বনী ও শব্দ শোনা যায়। বিশেষ বিশেষ সময়ে ট্রেনে
ভীড় হলেও অন্য সময় অল্প অল্প যাত্রি নিয়ে ট্রেন চলাচল করে থাকে। ভীড়ের সময় আগে
আসলে সিট মেলে নতুবা দাঁড়াতে হয়। সাদারা ভদ্র, তাই নিজেরা
দাঁড়িয়ে থাকেন ও ভিন দেশীদের বসার সুযোগ করে দেন। প্রতি ৪/৫ মিনিট পরপর এক একটা
স্টেশন আসে ও যাত্রিরা চোখের পলকে উঠানামা করেন।
আমাদের গন্তব্য ব্রিটিশ ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়াম, যাদুঘরটি চারটি জোনে বিভক্ত, লাল, সবুজ, হলুদ এবং নীল জোন।
প্রতিটা জোনই বিশাল এলাকা জুড়ে বিস্তৃত। ভিতরে ঢুকেই নীল তিমির (Blue
Whale) এক বিশাল ফসিল পর্যবেক্ষণ করি। মাছটি দৈর্ঘ্যে শত ফুটের কম
হবেনা। সম্ভবতঃ মাছটির ওজনও কয়েক টনের উপরে হবে। এই তিমি মাছের সদ্য প্রসূত
বাচ্চাও একটি হাতির চেয়ে বড় হয়। এখানে যে সব প্রাণীর ফসিল ও নমুনা দেখি তার মধ্যে
রয়েছে শোকর জাতীয় প্রাণী (Manafees), বড় ইদুঁর (Hyraxes),
বন ছাগল (Yak), গন্ডার (Dainucher
Rehino) ইত্যাদি অনেক প্রজাতি যা লিখে শেষ করা সম্ভব নয়।
এই পার্কে যান্ত্রিক উপায়ে একদম অবিকল জীবন্ত ডায়ানুসার দেখানো হয়। এই বিশাল ডায়ানুসারের হুঙ্কার শুনে মনে হলো এরা পৃথিবীতে জীবিত থাকলে হয়তো মানুষদের খেয়ে সাবাড় করে দিত। তবে মানুষ যেখানে পৃথিবীতে প্রায় দেড় লক্ষ বছর টিকে আছে, সেখানে ডায়ানুসার টিকে ছিলো উনিশ কোটি বছর। মানুষের চেয়ে বহুগুণ বেশি সময় এরা পৃথিবীতে রাজত্ব করে উল্কাপিন্ডের আঘাত অথবা কোন প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়।
হিউম্যান বায়োলজি ডিপার্টমেন্ট এ মানুষের নার্ভ সিস্টেম, ব্লাড সেল, পরিপাকতন্ত্র, হার্ড, কিডনী, ফুসফুস, চোখ, কান কিভাবে কাজ করে তা যান্ত্রিক উপায়ে দেখানো হয়। এখানে ঢুকে একজন সাধারণ মানুষও একজন চিকিৎসকের মতো মানববডির ক্রিয়াকলাপ শিখে নিতে পারবে।
এখানে বিভিন্ন ধরনের সাপ। পাখি ও সরিসৃপের ফসিল ও
তৈরি নমুনা পর্যবেক্ষণ করি। সবশেষে পৃথিবী শ্রেষ্ঠ প্রকৃতি বিজ্ঞানী ডারউইনের নামে
স্থাপিত ডারউইন সেন্টারে প্রবেশ করি।
পৃথিবীতে মহাকাশ হতে পড়া অসংখ্য উল্কাপিন্ড স্পর্শ ও দর্শন করি।
একটিকে মনে হলো শক্ত লোহায় পিন্ড।
যান্ত্রিক উপায়ে এখানে আগ্নেয়গীরি হতে অগ্নি উৎপাত ও লাভাপ্রবাহ দেখানো হয়। এখানে লাল জ্বলন্ত লাভার স্রোত দেখার সৌভাগ্য হয়। এবার একটি ঘরে প্রবেশ করি। একটু পরে মানবসৃষ্ট ভূমিকম্প শুরু হয়। চেয়ার, টেবিল, আলমিরা সব দোলে উঠে। উপরের ফেন, ঝুলন্ত ঝাঁড়বাতি সব এপাশ ওপাশ দোলতে শুরু করে। মনে হলো এই ভূমিকম্পে ভবন ধ্বসে সবাই মারা পড়বে। এভাবে প্রায় ১০/১৫ মিনিট ভূমিকম্প হলো। নিচের মাটি যেন সরে যাচ্ছিলো, ভূমিকম্প ধীরে ধীরে বন্ধ হলে সবাই যেন উৎকণ্ঠার চোরাবালি হতে মুক্তি পান। ভাতিজা আজফার বলল, তারা লন্ডনে কোনদিন ভুমিকম্প হতে দেখেনি। আসলে বৃটেন ভুমিকম্প মুক্ত দেশ। এখানে জাপান বা কার্লিফোনিয়ার মত এত ভূয়ালোড়ন হয়না। এমন কি আমাদের সিলেটও বছরে দুইচার বার ভুমিকম্পে কেঁপে উঠে।এই মিউজিয়াম এতো বড় যে দেখতে হলে সারা দিনের প্রয়োজন এবং শিখতে হলে অন্ততঃ ছয়মাস লাগবে। তাই আকর্ষণীয় অংশটুকু তুলে ধরলাম। এটি মিউজিয়াম হলেও একটা জ্ঞান সমুদ্র। এই জ্ঞানসমুদ্রে ঢুকেই মহান আল্লাহকে বললাম- রব্বি জিদনী ইলমা। হে আমার রব তোমার এই নিদর্শনসমূহ হতে যতোটুকু সম্ভব জ্ঞান আমাকে দান কর।
হেরড’স মার্কেট পৃথিবীর অন্যতম অভিজাত ব্যবসা কেন্দ্র। ন্যাশনাল
নেচার মিউজিয়াম হতে বের হয়ে বাংলাদেশ হাইকমিশনের সামনে আসি। পাশে সোনালী ব্যাংকের
লন্ডন অফিস। নিকটস্থ ভবনে পূবালী ব্যাংকের এক্সচেঞ্জ অফিস ছিল, বর্তমানে পূবালী ব্যাংক নেই। ছয় কোটি টাকা লোকসান দিয়ে উঠে এসেছে। এখন ঐ
স্থানেই প্রাইম ব্যাংকের একটি এক্সচেঞ্জ হাউস সুন্দরভাবে ব্যবসা পরিচালনা করছে এবং তদের কাছে জানলাম ভাল প্রফিটও করে যাচ্ছে তারা।
হেরড’স মার্কেটে ঢুকলাম। বনেদি ডিজাইনে
নির্মিত ১৩ তলা ভবন। প্রতি তলা ঘুরে আসতে অন্ততঃ দুই ঘণ্টা সময় লাগে। কাজেই পুরো
হেরড’স মার্কেট ঘুরে দেখতে পুরো দুই দিন লাগবে। এক এক তলায়
এক এক জাতের পণ্যের সমাহার রয়েছে। এই মার্কেটে বিশ্বের অতি উন্নত ও বিরল ব্রেন্ডের
মালামাল রয়েছে। একটি ম্যানিব্যাগ হাতে নিয়ে দেখলাম দাম লিখা বাংলাদেশী দশ হাজার
টাকা। এখানে একজোড়া জুতার দামও পঞ্চাশ-ষাট লক্ষ টাকা রয়েছে। একটি হিরার লকেট
দেখলাম দাম সাত কোটি টাকা। আমার সব সম্পদ বিক্রি করেও তা কেনা সম্ভব নয়। অথচ
নিশ্চয়ই ক্রেতা আছে, নইলে এত হীরে এভাবে সাজিয়ে রাখতো না। এই
মার্কেটের ক্রেতা দুনিয়ার বিভিন্ন দেশের রাজা-রাজড়া, উজির-মন্ত্রী
ও ধনকুবেররা। আমাদের মতো প্রজা লোকজনের পক্ষে পণ্য কিনা দুঃসাধ্য। তবে মার্কেটে ৭ম
তলায় কাপড়ের বাজার কিছুটা সস্তা মনে হয়েছে। এখানে সাধারণ ধনীরাও হাত ঢুকাতে পারেন।
এই মার্কেটের বর্তমান মালিক একজন ফরাসী মুসলিম। তিনি ফ্রান্সে একজন আলজেরীয়
অভিবাসী ছিলেন। তার পুত্র ডোডি আল ফাদ ছিলেন প্রিন্সেস ডায়নার প্রেমিক, যিনি প্যারিসে এক রহস্যময় সড়ক দুর্ঘটনায় ডায়নার সাথে নিহত হন।(চলবে)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন