আবুল গফুর কিন্ডারগার্টেন স্কুল ও কিছু স্মৃতিঃ
১৯৮১ সালে বিজ্ঞানে এস এস সি পাশ করে
ছুটে যাই বর্তমান এম সি কলেজে। তখনকার দিনে জালালাবাদ সেনানিবাস কলেজ, স্কলার্স
হোম, ব্লুবার্ড কলেজ ইত্যাদি ছিলনা। তাই এম সি কলেজই ছিল সিলেট বিভাগে এইচ এস সি
বিজ্ঞান অধ্যয়নের সেরা প্রতিষ্ঠান। এম সি কলেজে ভর্তি হতে এস এস সি তে ৫০০
নম্বারের বেশি পেতে হত। সিলেট বিভাগের সেরা হাজারখানেক ছাত্রছাত্রী ভর্তি পরীক্ষা দেন। তবে
আমরা ৩০০ জন ভর্তি হবার সুযোগ পাই।
এই তিনশত জনের একজন আমার প্রিয়
সহপাঠী বন্ধু মিয়া আশিক। জীবনসংগ্রামে আমার সেই সাথীরা আজ ছড়িয়ে আছেন দেশে
বিদেশে নানা পেশায়, নানা ব্যবসায়। কলেজ জীবনে মিয়া আশিক ছিলেন আমাদের ফুটবল দলের
নেতা। সুঠাম দেহের অধিকারী দক্ষ ফুটবলার মিয়া আশিক নিজ প্রতিভায় পুরো এম সি কলেজের
খেলাধুলা এবং ফুটবল টিম পরিচালনার দায়িত্ব
পান। এম সি
কলেজ মাঠে বিকেলে ফুটবল খেলে আমরা ঘেমে ভিজে বাসায় ফিরতাম।
বন্ধু মিয়া আশিক আজ যুক্তরাজ্যের
ব্যবসায়ী। দেশে এলেই তিনি আমাকে ফোন করেন। কিছুদিন আগে অফিসে বসে তাঁর টেলিফোন
পাই, ইসফাক কুরেশি আমি দেশে এসেছি, আমার স্কুলের বার্ষিক পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান
হবে, তোমাকে চাই।
এম সি কলেজের সিলেটের সব সহপাঠীরা
নিমন্ত্রণ পেয়েছেন। আমার ভাগনাবন্ধু খায়রুল আক্তার চৌধুরীকে ফোন করে বললাম, চলো
আমরা একসাথে এই অনুষ্ঠানে যাবো। ১লা অক্টোবর ২০২২ শনিবার সাগরদিঘিপারের বাসা হতে আমার
কার নিয়ে বের হই। কারে সঙ্গি হন এম সি কলেজের অর্থনীতি বিভাগ প্রধান অধ্যাপক
তুতুউর রহমান। চন্ডিপুলে এসে বনফুলে বসে আমরা নাস্তা করি। এখানে গাড়ি নিয়ে হাজির
হন দক্ষিণসুরমা সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধানশিক্ষিকা বন্ধু নুসরাত হক, ব্যাংকার বন্ধু
মাসুদে রাব্বানী, এম সি কলেজ ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার্স ২০তম ব্যাচের সহপাঠী
পারভেজ আলম এবং বুরজান চাবাগানের ব্যবস্থাপক সহপাঠী বন্ধু কামরুজ্জামান তুতু। আমার লালকারকে অনুসরণ
করে প্রিয়বন্ধুদের পাঁচটি কার একসাথে ঢাকা মহাসড়ক দিয়ে যাত্রা শুরু করে।
মেঘহীন উজ্জ্বল দিন, দুপাশে সবুজ
ধানক্ষেত। চার মাইল পথ পেরিয়ে লালাবাজারের বেশ আগে পুলিশ প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। এই
প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের ডানপাশ দিয়েই একটি মেঠোপথ পশ্চিম দিকে ঢুকে গেছে। ঢাকা- সিলেট
মহাসড়কে তিরচিহ্ন দেয়া একটি সাইনবোর্ড ‘আব্দুল গফুর কিন্ডারগার্টেন স্কুল’। সড়কটি
একসময় ইট বিছানো ছিল, এখন ভেঙ্গেচুরে কেবল ইটের কঙ্কাল ছড়িয়ে আছে।
সিলেট জেলার দক্ষিণসুরমা উপজেলার
একটি মনোরম গ্রাম লালরগাও। চারপাশে সবুজ খোলা প্রান্তর। শান্ত
ভদ্র মানুষের আনাগুনা, কোলাহলমুক্ত, একেবারে ছায়াঢাকা, পাখি ডাকা সিলেট শহরের
সন্নিকটে এক অজপাড়াগা। গ্রাম ও শহরের দুই ধরনের সব সুবিধা পাবার মত একটি উপুযুক্ত
স্থান।
এক কিলোমিটার ভিতরে যেয়ে হাতের
বামপাশে পেয়ে যাই ‘আব্দুল গফুর কিন্ডারগার্টেন স্কুল’। প্রায় দেড় বিঘা জায়গায়
দুইটি ভবন, পিছনে প্রাঙ্গণ। লাউড স্পিকারে অনুষ্ঠান হচ্ছে। ছয়জন বন্ধু খায়রুল,
তুতুউর, পারভেজ, মাসুদ, নুসরাত এবং আমি সরাসরি অনুষ্ঠান সভায় ঢুকে যাই। ভিতরে
ঢুকেই সহপাঠী বন্ধু আব্দুল লতিফের সাথে দেখা হয়, যিনি মদন মোহন কলেজ ও সিলেট
ইন্টারন্যশনাল বিশ্ববিদ্যালয়ের বানিজ্যিক গণিতের অধ্যাপক ছিলেন। তিনি
একজন গ্রন্থকার ও মালঞ্চ বইঘরের সত্ত্বাধিকারী। পেয়ে যাই বিয়ানীবাজার হতে আসা
সহপাঠী বন্ধু বেলাল উদ্দিনকে, তিনি একজন কবি ও হাইস্কুলের স্বনামধন্য শিক্ষক। আব্দুল গফুর
কিন্ডারগার্টেন স্কুলের ছোট্ট মিলনায়তনে ছাত্র-ছাত্রী ও
অভিভাবকের ভিড়, আসন খালী নেই। নুসরাত নারীকোঠায় একটা সিট পেয়ে গেলেও আমরা আঙ্গিনায়
গিয়ে বসলাম।
এই স্কুলটি বন্ধু মিয়া আশিক তাঁর
শ্রদ্ধেয় বাবা আব্দুল গফুরের স্মরণে নামকরণ করেছেন এবং যে বৃত্তি তিনি মেধাবী ও
গরীব শিক্ষার্থীদেরে দিচ্ছেন খায়রুন্নেসা মেমোরিয়াল স্কলার্সশিপ এওয়ার্ড, তা করেছেন জন্মদাত্রী মাতা মোসাম্মত খয়রুন্নেসার
স্মরণে। পবিত্র কুরানে আল্লাহ বলেছেন, মানুষ খুব কমই কৃতজ্ঞ হয়। আমরা যেমন মহান
আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞ হইনা, তেমনি মাবাবার আত্মত্যাগও ভূলে যাই। আজকাল
অতিশিক্ষিতরা বুড়ো মাবাবাকে পাঠিয়ে দেন বৃদ্ধাশ্রমে। এই তাঁদের কৃতজ্ঞতা।
কৃতজ্ঞতা মানুষের একটি বড়গুণ, আমার
বন্ধু মিয়া আশিক এই স্কুল ও বৃত্তির নামকরণের মাধ্যমে তাঁর মাবাবার প্রতি
দ্বায়বদ্ধতা ও কৃতজ্ঞতা নামক মহান গুণটি
প্রকাশ করেছেন। ধন্য মাবাবার সত্যিই তিনি ধন্য সন্থান।
আমরা সবাই একে একে পুরস্কার বিতরণীতে
যোগ দিলাম, বক্তব্য রাখলাম, ছাত্রছাত্রী ও অভিভাবকগণের সহিত মিলিত হলাম, তাঁদের
হাতে বৃত্তি ও ক্রেস্ট তুলে দিলাম। আমি বক্তব্যে
আশির্বাদ করি আমার বন্ধুর এই আলোর বাতিঘর যেন প্রজন্ম প্রজন্ম ধরে টিকে রয়।
মিয়া আশিকের সুরম্য ডুপ্লেক্স
বাংলোবাড়িতে ভাল খাবারদাবার হয়, একবার নয়, বারবার। দু’তলায় টেবিল টেনিস
খেলা হয়, ভাবীর হাতে তৈরী নানাপদের বাহারী খাবারের প্রশংসা না করে পারিনা। মিয়া
আশিক একজন মহান মানুষ, যিনি বিদেশের আরাম আয়েশ ফেলে নিজের শিকড় বাংলাদেশে ফিরে এসে
সমাজসেবা করছেন, নিজের এলাকাবাসীকে শিক্ষিত হতে সহায়তা করছেন, যা সত্যিই প্রশংসনীয়। সে
দিন বন্ধু মিয়া আশিকের পরিবারের রাজকীয় মেহমানদারী সারাদিন উপভোগ করে বেশ রাতে
সিলেট ফিরে গেলাম। পরদিন রাতে স্কুলের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে তিনি আমাদেরকে
আমন্ত্রণ জানান। আমরা সবাই ব্যস্ত হওয়ায় যেতে পারিনি। তবে আমাদের সহপাঠী গুণী
শিল্পী সেলিম চৌধুরী আসেন সুদূর শমসেরনগর হতে।
আমাদের বন্ধু মিয়া আশিকের শালিকা জিবা
খানম ও একমাত্র পুত্র ইশতিয়াক জামিলের ব্যবহারে আমরা বিমুগ্ধ হই। নিজ সন্তান ইশতিয়াককেও
নিজের মত করে গড়ে তুলেছেন মিয়া আশিক। ছেলেও বাবার মত বড়মনের অধিকারী। সে এই বিদ্যাপীঠকে টিকিয়ে
রাখতে সর্বচেষ্টা করবে নিশ্চিত। আমার বন্ধু মিয়া আশিক একজন দৃঢ়চেতা
লোক, নিজ
বিবেকে যা ভাল মনে করেন, তাই করে যান নিষ্ঠায়। তিনি সিন্ধান্তে অটুট, তাই তাঁর বিজয়
অনিবার্য্য।
ভাল কাজের ফলাফল ভাল ছাড়া আর কি হতে
পারে- আল কুরান।
আমাদের প্রিয় বন্ধু মিয়া আশিক সফল
হউন। মহান আল্লাহ তাঁর সদিচ্ছা পুরণ করুন। আব্দুল গফুর কিন্ডারগার্টেন স্কুল সেরা
প্রতিষ্ঠানে পরিণত হউক। আমিন।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন