ফাতু বেগম ও
জাহানারা বেগমের কথাঃ
ভোটার আইডি অনুসারে ফাতু বেগমের
জন্ম ১৯৮৪ সালে ৯ ফেব্রুয়ারি সুনামগঞ্জের পাগলাবাজারের চার কিলোমিটার দক্ষিণে
বীরগাঁও নামক গ্রামে এক দরিদ্র কৃষক পরিবারে। ছয় বছর বয়সে বাবা কনাই মিয়া মারা
গেলে মা রাশিয়া বেগমের সাথে গৃহকর্মী হিসাবে ফাতু বেগম পাড়ি জমান আমার সমনদি আজিজ
এ চৌধুরীর ধানমন্ডি লেকপারের বাসায়। শীতাতপ
নিয়ন্ত্রিত বিশাল বাসায় তাঁর শৈশব টিভি দেখে দেখে মহানন্দে পার হয়। মা রাশিয়া বেগম
বাবুর্চির কাজ করেন এবং মেয়ে ফাতু বেগম আনিকা ভাবীর ফুটফরমায়েশ করে সময় পার করে।
এই বাসায় সুনামগঞ্জের বীরগাঁওবাসী সেলিনা বেগম,
মৌলভীবাজারের বল্লবপুরের জমসেদ আলী ও বরিশালের
আনোয়ার মিয়া নামে আর তিনজন গৃহকর্মী থাকায় ফাতু বেগমের তেমন কোন কাজই ছিলনা। আর
ছিলেন ফরিদপুর জেলার গাড়িচালক খোকন মিয়া। তাই অট্টালিকার শীতল হাওয়া খেয়ে খেয়ে
ফাতু বেগম বেশ আরামে বালিকাবেলা পার করে।
যৌবনের পরশ গায়ে আছর করতেই ফাতু
বেগম ঝামেলা ঘটান। তিনি সেজেগুজে পিছনের নির্জন বারান্দায় দাঁড়িয়ে গোপনে পাশের
ভবনের বাসিন্দা এক বরিশাল্যার সাথে প্রেমে লিপ্ত হন। তাঁর সাজগুজ ও বেশভূষা দেখে
বরিশাল্যা ভাবলেন আলহামদুলিল্লাহ, বড়লোকের একটা মাইয়া পেয়ে গেছি, ধনী হতে আর কতক্ষণ।
জানাজানি হলে সব ভন্ডুল হয়ে
যাবে, তাই একদিন ফাতু বেগম প্রেমিক নিয়ে পালিয়ে যান বাপের বাড়ি সুনামগঞ্জের
বীরগাঁও। বীরগাওয়ের দরিদ্র পরিবেশ দেখে ধনী হবার স্বপ্নে বিভোর বরিশাল্যার মন ঘুরে
যায়, সে পালানোর রাস্থা খোঁজে। ফাতু বেগমের ইস্টিগোষ্টি বেশ
বড় ও শক্তিশালী, তারা কাজী ডেকে এনে বরিশাল্যার ঘাড় চেপে ধরে ফাতু বেগমের সাথে বিয়ে দেন। বিয়ের কবুল পড়ে বর বলল, আকদ তো হল
এবার পাগলাবাজারে গিয়ে বিয়ের মিষ্টি নিয়ে এসে সবাইকে মিষ্টিমুখ করাবো। মিষ্টি
কিনতে গিয়ে সেই যে বউ ফেলে বর উদাও হল, আর কোনদিন ফিরে আসেনি।
ধানমন্ডিতে বেড়ে উঠা স্মার্ট
ফাতু বেগমকে বিয়ে করার সাহস আশপাশে কারো হলনা। এই বর উদাও কান্ডে গাঁয়ের সবাই ভয়
পেয়ে গেল। তাই ফাতু বেগমের জন্য তেমন কোন ভাল বিয়ের আলাপও আসে নাই। আমার পত্নীর
লালিতপালিত কাজের মেয়ে জরীর বিয়ে হয়ে গেলে ফাতু বেগম এবাসার কর্মী হন। বিয়েকান্ডে ঢাকায়ও ফাতু বেগম বিরাগভাজন। তাই ফাতু বেগমের
গতি হয় সিলেটে আমাদের বাসায়। তিনি ২০০৪ ও ২০০৫ সাল ফাতু বেগম
তাঁর দিন পার করেন আমাদের সাগরদিঘিরপারের বাসায় জেফার ভবনে।
মানুষের জীবনকাহিনী শুনতে আমার
বেশ মজা লাগে। ফাতু বেগমের কাছে তাঁর বিগত জীবনের কিছু মজার গল্প শুনি। ফাতু বেগম
জানালেন তাঁর বিয়ে হচ্ছেনা, মা-খালা-মামুরা চিন্তিত। তাঁদের সমাজে তের চৌদ্দ বছর
বয়সে মেয়েদের বিয়ে হয়, অথচ ফাতু বেগমের বয়স পঁচিশ ছোঁয়ে গেছে। একদিন বিয়ের রায়বার
এক আলাপ নিয়ে আসে। বরের নাম জমশেদ আলী, বাড়ি লামাকাজির মুল্লারগাও। বরের বয়স
পঞ্চাশ পেরিয়ে গেলেও তিনি লন্ডনি, দুই সন্থানের বাবা, আগের বউ তালাক দিয়েছেন। বড়বউ
তালাকের কারণ জানানো হল সে বাপের বাড়িতে স্বামীর অজান্তে অর্থপাচার।
বর খোরশেদ আলী রায়বারকে নিয়ে কনে
দেখতে বীরগাঁওয়ে ফাতুদের কুঠিরে হানা দেন। সাথে আসেন বরের বোনের জামাই। বুড়ো বর
খোরশেদ আলী লম্বা ও ফরসা কিন্তু টেকোমাথা।
দুই সন্থানের জনক বুড়ো জমশেদ আলীকে
বিয়ে করার ইচ্ছে যুবতী ফাতু বেগমের ছিলনা। তিনি আলাপ ফিরিয়ে দেন। কিন্তু জমশেদ আলী
নাছোড় বান্দা। দালাল মারফত কনের মোবাইল নম্বর সংগ্রহ করে ফোনে লোভ দেখানো শুরু
করেন। শাড়ি গহনা নিজে এসে কেনার আমন্ত্রণ জানান। ধীরে ধীরে বরফ গলে। ফাতু বেগম
রাজি হন। কাবিন সাব্যস্ত হয় এক লক্ষ টাকা।
কবে বিয়ে হয়েছে জানতে চাইলে ফাতু
বেগম জানান, তাঁর বিয়ে হয় ২০১০ সালের আগস্টে, শবে বরাতের পরদিন অর্থাৎ রমজানের দুই
সাপ্তাহ আগে। লাল শাড়ি পরে মুল্লারগাও এলেন ফাতু, এসেই দেখেন বরের সন্থান দুটি নয়,
পাঁচটি। বড় ছেলে ও মেয়ে তাঁর সমবয়সী। বর লন্ডনি নন, ছিলেন সৌদি আরব। শ্বশুর নেই,
তবে আছেন শ্বাশুড়ি ও দাদি শ্বাশুড়ি। বর যতটুকু ধনী শুনা গেয়েছিল তাও সঠিক নয়।
ফাতুর মামাতো ভাই গিয়ে এই বিরাট সংসার জঞ্জাল দেখে বলল, সাত সতীনের এই সংসার কেমনে
সামলাবে রে ফাতু।
ফাতু বেগম ভালই সামাল দেন। বুড়ো
স্বামী বউপাগল। জমশেদ আলী সব কাজ করেন, বউকে কিছু করতে দেন না। বউয়ের হাত পা মাথা
টিপে দেন, কাপড়চোপড় ধুয়ে দেন। বাজারে গেলে আইসক্রিম কিনে এনে দেন। মাঝে মাঝে সিলেট
গেলে চাইনিজ খাওয়ান।
বউ বাপের বাড়ি গেলে তিনি নিয়ে
যান আবার সাথে করে নিয়ে আসেন। সেখানে থাকতে দেন না। ঘন বর্ষায় পথঘাট ডুবে গেলে
জমশেদ আলী কূলে করে জল মাড়িয়ে বউকে শ্বশুরের ভিটায় নিয়ে যান।
বউ ছাড়া জমশেদ আলীর মূহূর্তও চলে
না। একদিন জমশেদ আলী ফাতুকে বললেন, আমি তোমাকে পেয়ে খুব সুখী হয়েছি। ইস যদি পয়লা
বঊয়ের জায়গায় আর আগে তোমাকে পেতাম, তাহলে আর কতনা সুখী হতাম। ফাতু জবাব দেয়, আমাকে
পাবেন কেমনে, তখন যে আমার জন্মই হয়নি।
জমশেদ আলী মেয়ের বয়সী বউকে ডাকেন
সরলা। কারণ এক জটিল সাত সতীনের সংসারে এসে ফাতু বেশ মানিয়ে নিয়েছে। জমশেদ আলী
ফাতুকে কখনও লক্ষিবউ, সোনাবউ, আবার কখনও আদর করে ডকু বোন, সোনা বোন নামেও ডাকতেন।
একদিন জমশেদ আলির সাথে এক জায়গায়
যাবার সময় গাড়িতে একজন মহিলা জিঞ্জেস করেন, সত্যি করে বলুনতো সাথের এই বুড়ো মানুষ
আপনার কি হন। ফাতু বেগম জবাব দেয়, দাদা শ্বশুর হন। মহিলা নিদ্বিধায় বিশ্বাস করে
নেন।
জমশেদ আলীর অতিরিক্ত বউপ্রেমে
শ্বাশুড়ি বিরক্ত। ফাতু বুড়ো জামাইকে বলল, সারাদিন ঘরে কেন। যাও, দিনে বাহিরে বাহিরে
থেকো, রাতে কক্ষে এসো। তোমার মা এত ঢলাঢলি ভাল চোখে দেখছেন না।
জমশেদ আলী টালি মিস্ত্রি, বহুবছর
সৌদী আরবে ছিলেন।
লন্ডনি ভেবেই ফাতু বুড়োকে বিয়ে
করেন। কিন্তু বুড়োর বিদেশ যাবার কোন খবর নেই।
বড়লোক ভেবে তুমি বুড়োকে বিয়ে
করেছি, বসে বসে খাবো, ফুর্তিতে জীবন কাটাবো। এখন দেখছি গুড়েবালি। কেন মিছেকথা বলে
আমার সর্বনাশ করেছো।
হাতজোড় করে মাফ চান জমশেদ আলী,
আমার সাথে বিয়ে না হলে তোমার আর ভাল জায়গায় অবশ্যই বিয়ে হত, তুমি আর বেশি সুখী
হতে।
এবার প্রসঙ্গ পাল্টে জমশেদ আলী
বলেন, বিশ্বাস করো ফাতু, আমার যদি প্রচুর টাকা থাকতো তাহলে তোমাকে সোনাদানায় ঢেকে
দিতাম।
দাদিশ্বাশুড়ি বলতেন, জমশেদরে এই
কচি বউ ধরে রাখতে হলে জলদি বাচ্চা নে। নইলে বিদেশ থেকে ফিরে তাঁকে পাবেনা।
বিয়ের পাঁচমাস পর জমশেদ আলী আবার
বিদেশ যান, তবে সৌদি নয় ওমান। তিনি বউয়ের গর্ভে রেখে যান দুই তিন মাসের ভ্রুন।
দেড় বছর পর দেশে ফিরেন জমশেদ
আলী। মাত্র তিন মাস বউ ও নবজাত কন্যা পাখি বেগমের সাথে কাটিয়ে আবার ফিরে যান ওমান।
সেখানে গিয়েই তিনি অসুস্থ্য হন। কাজ বন্ধ, জমি বিক্রি করে বিদেশে টাকা নিয়ে
চিকিৎসা করেন। দুইবার স্ট্রোক করে। অসুস্থ শরীর নিয়ে চারবছর পর জমশেদ আলী আবার
ফিরে আসেন দেশে।
জমশেদ আলী বুঝে ফেলেন, তিনি বেশী
দিন বাঁচবেন না। তাই বউয়ের কাছে মাফ চান, আমি তোমার জন্য কিছুই করতে পারিনি।
কাবিনের মাত্র এক লক্ষ টাকা তাও দিতে পারিনি। মেয়েটার জন্যও কিচ্ছু রাখি নাই।
জমশেদ আলী ছিলেন ভাল বাবা,
ছেলেমেয়েদেরে নিজে নাওয়া খাওয়া করাতেন। সবাইকে নিয়ে গান গাইতেন। গায়ে বিচার আচারেও
যেতেন।
একদিন ঘুম হতে জেগে জমশেদ আলী
প্রতিবেশীর সাথে জমি নিয়ে ঝগড়ায় লিপ্ত হন। এসময় আবার স্টোক হয়। সবাই তাঁকে রাগিব
রাবেয়া মেডিকেল কলেজে নিয়ে যান। সেখানেই তিনি চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।
জমশেদ আলীর মরণে ফাতু ঘরছাড়া হয়ে
কন্যা পাখি বেগমকে চলে যান বাপের বাড়ি
বীরগাঁও। বুড়ো সতীন সদম্ভে ফিরে আসেন বিগত স্বামীর ভিটায়, নিজের পাঁচ সন্তানের
মাঝে।
যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়া হতে
২০২২ সালের অক্টোবরে আমার সমন্দিক কবির চৌধুরীর দুই কন্যা ইমা ও শ্যামা আমাদের
বাসায় আসে। তাঁরা দুইতিন মাস আমাদের বাসায় থাকে। আমেরিকার খাবার তাদেরকে বেশ
মোঠাসোঠা করে ফেলে। আমি তাদেরকে আমার গাড়িতে করে জাফলং, সাদাপাথর, মাধবকুন্ড,
শ্রীমঙ্গল, হবিগঞ্জ ইত্যাদি এলাকায় নিয়ে যাই। এসময় তাঁদের কাজের জন্য আর দুইজন
কর্মী নিয়োগ করা হয়। একজন ফুলবাড়ি গ্রামের রহিমা এবং অন্যজন শ্রীহাইল গ্রামের
সুমন।
গোলাপগঞ্জের ফুলবাড়ি গ্রাম হতে জাহানারা বেগম এলেন ইমা ও শ্যামার সেবাযত্ন করতে। তিনি ফর্সা গোলাকার চেহারার সুন্দরী। বয়স চল্লিশ পার হয়ে গেছে। বাসায় আসা লোকজন তাকে নেপালী কিংবা খাসিয়া মহিলা মনে করত। ফাতু বেগম অলস ও অপরিচ্ছন্ন কিন্তু জাহানারা বেগম এর বিপরীত। ফাতু বেগম কথা বলেন মেপে মেপে। সুজা কথায় তিনি স্বল্পভাষী। জাহানারা তাঁর বিপরীত।
জাহানারা পরিস্কার পরিচ্ছন্ন ও পরিশ্রমী। তিনি তেলবাজীতেও ফাতুর চেয়ে দক্ষ। জাহানারা গোলাপগঞ্জের একটি বিউটি পার্লারে দীর্ঘদিন কাজ করেন। ডাঃ নূরজাহান বেগমকে জাহানারা প্রায়ই কনের মত করে সাজিয়ে দেন। ফাতু আমার বেগম সাহেবাকে 'আপা' ডাকলেও জাহানারা ডাকেন 'ফুফু আম্মা'। জাহানারা বলতেন, আমি খাই কিংবা না খাই, ফুফু আম্মাকে ফেলে কোথায়ও যাবনা।
জাহানারা বেগম অল্প সময়েই ডাঃ নুরজাহান বেগমের মন জয় করে নেন। একদিন আমার পত্নী
বললেন আমাদের সুমন ও জাহানারা এই দুইজন লোকই যথেষ্ট। ফাতুকে ছুটি দিয়ে দেই। দরকার
হলে আবার ডেকে নেবো। আমি বললাম তোমার ইচ্ছে।
ফাতু সেই যে ছুটিতে গেলেন আর ফেরা
হলনা জেফার ভবনে।
জাহানারা বেগম একদিন বললেন
অক্টোবর মাস এলে আমার বুকে দাউদাউ করে আগুন জ্বলে।
প্রশ্ন করি কেন?
এই মাসে আমার জলজ্যান্ত স্বামী
হার্ট এটাক করে মারা যান। একমাত্র কন্যার বয়স তখন মাত্র পাঁচ বছর। মানুষটা লম্বা
চওড়া কি জোয়ান পুরুষ ছিলেন। অতি ভদ্র ও স্নেহশীল ছিলেন। কাজ করতেন খুলনার পাটকলে।
তারপর বাপের বাড়ি ফুলবাড়ি, দুইভাইয়ের সাথে বসবাস। মা ও মেয়ের খরচ চালাতে কাজ করেন
গোলাপগঞ্জের পার্লারে। সুন্দরী জাহানারা দাবী করেন অনেক আলাপ এলেও তিনি মেয়ের কথা
ভেবে বিয়ে করেননি। তবে কে একজন ফুলবাড়িবাসী আমাকে বলেছে কোন এক বয়স্ক লন্ডনির
সাথে তাঁর বিয়ে হয়েছিল, কিন্তু সে বিয়ে টেকেনি। কোন অনুষ্ঠানে বের হলেই জাহানারা
আমার পত্নী নূরজাহান বেগমকে শাড়ি পরান এবং সুন্দর করে খোঁপা বেঁধে দেন। ডাঃ
নূরজাহান তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট।
বাসায় ফাতু আউট এবং জাহানারা ইন।
দুইতিনবার ফুলবাড়ি ও রনকেলীর আত্মীয়বাড়ি গেলে জাহানারার বাড়িতেও যাই। টিলার উপর
জনবহুল বাড়ি, তবে পাকা টিনের ঘর, পরিবেশ সুন্দর।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন