সোমবার, ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৩

ডাঃ নুরজাহান বেগম চৌধুরীর নানা রোগ, এক নিদারূন বিপদের মুখোমুখি আমরা

 

ডাঃ নুরজাহান বেগম চৌধুরীর নানা রোগ, এক নিদারূন বিপদের মুখোমুখি আমরা

২০১০ সালে নভেম্বরে হজ্জ পালনকালে একদিন সকালে মসজিদে নববী হতে আমরা হোটেলে ফিরছিলাম। পথে একটি বাঙ্গালী হোটেলে খেতে ঢুকি। এমন সময় পেটে এক প্রচন্ড ব্যথা হয়ে নুরজাহান বেগম অঞ্জান হয়ে যাবার মত অবস্থায় পড়েন। আমরা মনে করলাম দেরীতে খাওয়ায় হয়ত গ্যাস্টিকের শিকার হয়েছেন। দেশে এসে কিছুদিন পর আবার একি অবস্থার শিকার হলে তিনি আল্ট্রাসনগ্রাফি করান। ধরা পড়ল পিত্ততলীতে প্রচুর পাতর হয়ে গেছে। এক সময় ঋতুকালে দীর্ঘ্যদিন ধরে তার প্রচুর রক্ত বেরিয়ে যেত এবং শরীরে রক্তশূন্যতা সৃষ্টি হত। তার স্থুলদেহটা এক সময় শুকিয়ে কাট হয়ে যায়, সেইসাথে শরীরের ওজনও কমতে থাকে।

এবার বাচ্চাদানীতে ফাইব্রয়েড ধরা পড়ল। ডাঃ নুরজাহান বেগম চৌধুরী প্রতিদিন অনেক অনেক রোগী দেখতেন, এবার নিজের রোগ নিয়ে বেশ দুশ্চিন্তায় পড়লেন। আমি তাকে আমাদের নর্থইস্ট মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করলাম। চিকিৎসকরা সবাই প্রাণের চেয়েও ঘনিষ্ঠ স্বজন। তারা টিম গঠন করে চিকিৎসায় নামলেন। ওজন কমে আসা, শুকিয়ে যাওয়া, রক্তশূন্যতা তিনটিই চিকিৎসকদের দুশ্চিন্তায় ফেলে দিল। নর্থইস্ট মেডিক্যাল কলেজের কয়েকজন স্টাফ রক্তদান করে আমাদেরকে কৃতঞ্জতাপাশে আবদ্ধ করলেন।

এবার আমরা উন্নত চিকিৎসার জন্য ছূটে গেলাম রাজধানী ঢাকায়। উঠলাম ঢাকায় আমাদের সব সময়ের আশ্রয়স্থল আমার ছোট সমনদি আজিজ আহমদ চৌধুরীর ধানমন্ডির বাসায়। এই বাসা হতে ১৫ মিনিট হেটে গেলেই প্রান্তপথে স্কয়ার হাসপাতালের অবস্থান। এখানে এসে আমরা মেডিসিন বিশেষঞ্জ ডাঃ মাহবুব আহমদের এপয়েনমেন্ট নিলাম। ডাঃ মাহবুব সিলেটের লোক, তার পৈত্রিক বাসা সিলেট শহরের হাউজিং এস্টেট। তিনি পরীক্ষা করে রোগীর সামনেই বললেন, রোগের অবস্থা জটিল ফিউচার ডার্ক। খুবসম্ভব তিনি ধারনা করলেন ‘No answer’  নামীয় রোগটি তার হয়ে গেছে। চিকিৎসকের চোখেমুখে হতাশার ছায়া দেখে নুরজাহান বেগমের দুশ্চিন্তা বেড়ে গেল আর কয়েকগুন। এসময়ে যখন প্রচন্ড মনোবলের দরকার, সেখানে নুরজাহান বেগম তার স্বাভাবিক মনোবলও হারিয়ে ফেললেন।  

ডাঃ মাহবুব সাহেব রোগ পরীক্ষার জন্য রোগিণীকে স্কয়ার হাসপাতালে ভর্তি করে দেন। পরদিন একটার পর একটা পরীক্ষা চলে। বিকেলে একজন মহিলা চিকিৎসক রোগিনীর হউল এবডমেন আল্ট্রাসনোগ্রাফি করেন। তার রিপোর্টে বাচ্চাদানীতে ছোট ছোট কিছু টিউমার ধরা পড়ল। পিত্ততলীতে প্রচুর ঠাসা পাতরের খবর আসল। কিন্তু এই সনোলজিষ্টের কিডনী বিষয়ক রিপোর্ট হল মারাত্মক দুর্ভাবনার, তিনি রিপোর্ট করলেন একটি কিডনির উপর টিউমার দেখা যাচ্ছে। আমার বেগম সাহেবা নিজেও একজন সনোলজিষ্ট, অথচ এই রিপোর্ট পড়ে ধরে নিলেন, তাকে যমরোগে পেয়ে গেছে। তার জীবনের আর বেশি দেন বাকী নেই। তিনি ধারনা করলেন তার একটি কিডনী নষ্ট হয়ে গেছে, অন্যটি দিয়ে কোনমতে বেচে আছেন। সেইটিও যখন শেষ হয়ে যাবে, তিনিও তখন নিঃশেষ হয়ে যাবেন।

ঢাকার স্কয়ার হাসপাতালের কেবিনে সে একটি রাত আমার জীবনের এক কঠিন রাতে পরিনত হয়। আমি তাকে বুঝাতে ব্যর্থ হই যে এখনও আর পরীক্ষা রয়ে গেছে। এখনও চুড়ান্ত রিপোর্ট হয়নি। তার তখন একটিমাত্র শব্দ, জেফারের বাপ আমি আর নেই আমার দিন শেষ। সেদিন রাতে ডাঃ নুরজাহান অস্বাভাবিক আচরণ আরম্ভ করেন। বার বার হাত দুটি মুষ্টিবদ্ধ করতে থাকেন। বিছানায় বসে একবার এপাশে একবার ওপাশে হেলেদুলে পড়তে থাকেন। তার হাত পা শরীর জমে ঠান্ডা ও শক্ত হয়ে যাচ্ছিল। পাগলিনীর মত এলোমেলো চুল মাথার চারপাশে ঝুলতে থাকে। ভয়ে ও দুশ্চিন্তায় তার ঘুম উদাও হয়ে যায়। আমি কেবল খতমে ইউনুসের দোয়া পড়ে তার শরীরে ফুঁৎকার দিয়ে বুঝানোর চেষ্টা করে যাই। কিন্তু কে শুনে কার কথা।

ডাঃ নুরজাহান শেষরাতে আমাকে বললেন, আমি মারা গেলে আমার জেফারকে তুমি দেখবা, ওকে উপযুক্ত করে মানুষ করবা। আমি বললাম, সে কেবল তোমার নয় আমারও সন্থান, তাকে নিয়ে তোমার চিন্তার কোন কারণ নেই। আমি বেচে থাকলে ইনশাহ আল্লাহ তার কোন সমস্যা হবেনা। ভোরের আজানের পর আমার বেগম সাহেবা স্বপ্রনোদিত হয়ে আমাকে আরেকটি অনুমতি দিলেন, আমিতো নিশ্চিত মারা যাব, তোমার বয়স অল্প, কাজেই দেখে শুনে একজন ভাল মেয়েকে বিয়ে করে নিও, তবে আমার ছেলের যেন কোন অসুবিধা তৈরী না হয়। আমি বললাম এসব চিন্তা বাদ দাও, আজকাল সব রোগের ঔষধ আবিস্কার হয়ে গেছে। মহান আল্লাহকে ডাক, দরকার হলে সিঙ্গাপুর যাব, খারাপ রোগ হলেও ইনশাহ আল্লাহ ভাল হয়ে যাবে।

আমি ও আজিজ ভাই সিন্ধান্ত নিলাম, খারাপ কিছুর চুড়ান্ত রিপোর্ট আসলে সাথে সাথে উন্নত চিকিৎসায় সিঙ্গাপুর নিয়ে যাব। প্রয়োজন হলে আমার বিনিয়োগ করা স্কয়ারফার্মার সব শেয়ার বিক্রি করে দেব। আমার এবং নুরজাহান বেগমের পাসপোর্ট নিয়ে সিলেট হতে ছুটে আসে আমার ছোটভাই নিশাত ও বালকপুত্র জেফার।

একসাথে এত এত রোগ ধরা পড়ল যে চিকিৎসকরা চোখে অন্ধকার দেখলেন। তারা ভাবনায় পড়লেন এত এত রোগের বাহক এই চিকিৎসক রোগিনীর কোন রোগটি আগে ধরবেন, কোনটির চিকিৎসা পরে করবেন। তবে তাদের প্রধান চিন্তার বিষয় হয়ে গেল কিডনি।

পরদিন একজন দক্ষ অভিঞ্জ সনোলজিস্ট এসে আবার পরীক্ষা করলেন। তিনি কিডনিতে কোন টিউমারের ছায়া পেলেন না। দুই জন সনোলজিস্টের রিপোর্ট ভিন্ন হওয়ায় এবার কিডনির সিটিস্কেন করা হল ও কিডনি ফাংশন পরিমাপের জন্য একধরনের তরল ঔষধ স্যালাইনের মত রক্তে ঢুকিয়ে এক্স রে করা হল। তবে পরদিন কিডনি সিটিস্ক্যানের ভাল রিপোর্ট আসে- কিডনিতে কোন টিউমার পাওয়া যায় নি।  

কিন্তু কিডনি ফাংশন টেস্টে দেখা গেল দুই কিডনির একটি সম্পূর্ণ ভাল আছে কিন্তু অন্যটির ফাংশন অল্প এবং নিচের মূত্রথলীগামী নালীটি অস্বাভাবিক চিকন হয়ে আছে। তাই এবারও চিন্তা গেলনা, একটি কিডনিতে কেন এই ক্রুটি দেখা যাচ্ছে। সিলেটে আমাদের পূর্বপরিচিত কিডনি বিশেষজ্ঞ ও সার্জন ডাঃ জুলকিফল ভালভাবে কিছুই বললেন না। কেবল বললেন সমস্যা হলে দেখবেন, অপারেশন করবেন।

কয়েকদিনের চিকিৎসায় কিছুটা সুস্থ হয়ে উঠলে ডাঃ মাহবুব আহমদ বললেন, সিলেটে গিয়ে সব কাজকর্ম শেষ করে কিছুদিন রেস্ট নিয়ে আসেন। তখন আমরা যা করার করব।

এবার আমরা সিলেট ফিরে আসলাম। ডাঃ নুরজাহানকে মৃত্যুভয় এমনভাবে পেয়ে বসেছে যে, তা সরানো যাচ্ছেনা। তার মনোবল নেমে এসেছে শূন্যের কোঠায়। জেফার ভবনে এসে তিনি তীব্র মানসিক অশান্তিতে পড়েন। ঘুম কমে যায়, যখন তখন আমার আম্মা ও ছোটখালাকে জড়িয়ে ধরতেন। তিনি ক্লিনিকে ও চেম্বারে রোগী দেখার আগ্রহ হারিয়ে ফেললেন। আমি তার এই দুর্বিসহ অশান্তি তাড়াতে তাকে কর্মব্যস্ত রাখার চেষ্টা করতাম। সময় পেলে কার চালিয়ে তাকে কর্মক্ষেত্রে নিয়ে ঘুরতাম। একদিন তাকে লাউয়াই গ্রামের শাহার মিয়া ভাইয়ের বাড়িতে দাওয়াত খাওয়াতে নিয়ে গেলাম। মাঝে মাঝে আমার অফিসে নিয়ে সামনের চেয়ারে বসিয়ে রাখতাম। সকালে ঘুম ভাঙ্গামাত্র এই মানসিক অশান্তি আরম্ভ হয়ত। রাতে চোখে ঘুম আসলে খানিক শান্তি পাওয়া যেত। কিন্তু প্রচন্ড দুশ্চিন্তায় তেমন প্রগাড় ঘুম হত না।

এখন শুরু হল তার অতীত জীবনের স্মৃতিময় স্থানগুলো ঘুরে দেখার আবদার। একদিন নিয়ে গেলাম তার পৈত্রিক গ্রাম সাচান, চারখাই। প্রিয়মানুষ এসার মা, নজরুল এদেরকে দান খায়রাত করলেন। বাড়ির পরিচিত সবাইকে দেখে নিলেন যেন এটা শেষ দেখা। এবার আমি তাকে নিয়ে একদিন সুনামগঞ্জ শহরে গেলাম। তিনি তার বাবার কর্মক্ষেত্র সুরমাপারের ফুড অফিসে নিয়ে যান। কেঊ চিনলনা, আমরাও পরিচয় দিলামনা। কেবল বললাম আমাদের পিতা এক সময় এই অফিসে চাকুরী করতেন। কিছক্ষন ঘুরেফিরে বেরিয়ে আসলাম। সুনামগঞ্জ পাঠশালাও ঘুরে দেখলেন। এক সময় তিনি তার সুনামগঞ্জ স্কুলের তার সহপাঠিনী দীবার বাসায় নিয়ে যান। দিবার বাবা মোহাম্মদ আলী ছিলেন সুনামগঞ্জ জেলা গভমেন্ট হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক। তিনি সুনামগঞ্জের খুব পরিচিত একজন সম্মানী লোক ছিলেন। সিলেট সরকারী মহিলা কলেজের প্রভাষক দিবাদের বাড়িতে সপরিবারে নুরজাহান বেগমের জীবনের কিশোরীবেলার বেশ কিছুকাল কেটেছিল। সুনামগঞ্জ শহরের খালিবাড়িটি তিনি ঘুরে ঘুরে দেখলেন। এই বাড়িতে আজ কেউ নেই। সুনামগঞ্জ সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ের সম্মানীত ক্রীড়া শিক্ষক ও প্রধান শিক্ষক মোহাম্মদ আলী সাহেব ও তার পত্নীকে আমি অতিশীপর বৃদ্ধ সময়ে দেখেছি। তাদের সন্তানরা একে একে সবাই যুক্তরাষ্টে চলে যান। সবশেষে এবাড়ির আজীবন বাসিন্ধা দুজন শ্রদ্ধাভাজন প্রবীন-প্রবীনা পরপারে পাড়ি জমালে বাড়িটি জনশূন্য হয়ে যায়। এবার জামাইপাড়া এসে আরেক স্মৃতিময় ফুফুর বাসায় আসলাম। বাসাটি আমার শ্বশুরের খালাতো বোনের, যেখানে নুরজাহান বেগমের আনন্দ ব্যদনার অনেকগুলো বছর ফুফুর আদর সোহাগে কেটেছে। এখানে দুতলা বাড়িতে সপরিবারে একজন ফুফুতো ভাই এবং বৃদ্ধা ফুফু বসবাস করছেন। এক দঙ্গল ফুফুতো ভাই বোনরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে দেশ দেশান্তরে চলে গেলেও এখনও খবরাখবর রাখেন। তাদের গ্রামের বাড়ি জগন্নাথপুর উপজেলার ভাটিগ্রাম সিদ্দেশ্বর।

এবার নুরজাহান বেগম চৌধুরীর আবদার পূর্ন করতে এক শুক্রবারে লাল কারটি নিয়ে ছুটলাম জেলাশহর মৌলভীবাজারে। এই শহর তার অনেক স্মৃতির শহর। গেলাম আলী আমজাদ বালিকা বিদ্যালয়ে, মনে পড়ে পুকুরপারের এই স্কুলে তার আগে একবার এক ছাত্রী পুনর্মিলনি অনুষ্ঠানে আমাকে নিয়ে গিয়েছিলেন। সেখানে ডাঃ নাহিদ ইলোরাসহ অনেকের সাথে দেখা হয়েছিল। এবার আমি গিয়ে ঢুকলাম মুসলিম কোয়ার্টার পাড়ায়। এইপাড়ার ডাঃ নুরজাহান বেগম তার বাল্যকালের বেশ কয়েকটি বছর পার করেন। পাড়ার ভিতর ডুকে একেবারে শেষপ্রান্তে একটি বর্গাকার সুন্দর কাজলদিঘি, চারপার পাকাকরে বাধানো। এই দিঘির পারে একটি হাল ফ্যাশনের মসজিদ। মসজিদের পানে তাকিয়ে নুরজাহান বললেন, এই মসজিদের একজন কালো ইমাম ছিলেন যার মেয়ে পাঠশালায় তার সহপাঠিনী ছিল। এই সামনের মসজিদের পুকুরে এই মেয়ের সাথে জলকেলি করে তিনি বাল্যকালে শিখেছিলেন সাতার। এখানে অবস্থানকালে ফুফুতো বোনের স্বামী এডভোকেট সৈয়দ আনোয়ার মহমুদের বাসায় দৌড়ে গিয়ে নাস্তা করা, ডাঃ সাদীর বাবা ডাঃ সৈয়দ আফসর মহমুদের কাছে রোগ হলে ছুটে যাওয়া, বিনে ভিজিটে যখন তখন তার সেবা গ্রহণ ইত্যাদি ইত্যাদি কাহিনিমালা। এসব যেন একজন অন্তিম যাত্রির স্মৃতিহাতড়ে বেরিয়ে আসা করুণ বিবরণ।   

কয়েকমাস আমাদের খুব অশান্তিতে পার হল। নুরজাহান বেগম জানেন না তার কি হয়েছে? চিকিৎসকরাও পরিস্কার করে কিছু বলে নাই। সামান্য যা বলেছে তাও হতাশাজনক। একসাথে এত রোগ হয়েছে যে রোগিনীর ধারনা পার পাওয়া খুবই কঠিন হবে। আবার চিকিৎসার জন্য ছূটলাম ঢাকায়, মাসটি ফেব্রুয়ারি ও বছরটি ২০১২ সাল। বিদায়ের দিন আমার আম্মা আসমতুন্নেছা চৌধুরী এবং বড়বোন রেহাকে জড়িয়ে ধরে তিনি প্রচুর কান্নাকাটি করলেন, যেন বহু যতনে গড়া এই সংসার হতে এযেন শেষ বিদায়। নিচতলা হতে আমার বন্ধু মাহবুব আহমদের পত্নী, তিনতলা হতে ডাঃ গাজি সাহেবের পত্নীরা এসে সান্তনা দিলেন।

আবার ধানমন্ডি আসলাম, আজিজ ভাই ও আমি তাকে নিয়ে সেই স্কয়ার হাসপাতালে হাজির হলাম। ডাঃ মাহবুব আহমদ আমাদেরকে আর তিনজন চিকিৎসকের বরাবরে সোপর্দ করলেন, তারা কিডনীর জুলকিফল আহমদ, সার্জারির সানোয়ার আলী এবং গাইনির রাজিয়া সুলতানা। ডাঃ সানোয়ার আলী ও ডাঃ রাজিয়া সুলতানা যুগল দম্পতি। তারা দুইজনই এফসিফিএস এবং দেশের স্বনামধন্য চিকিৎসক। একদিন দেখলাম এই চারজন বিশেষঞ্জ পরস্পর আলোচনা করলেন এবং ডাঃ সানোয়ার আলী এসে আমাদেরকে বললেন, আমরা সিন্ধান্ত নিয়েছি একসাথে ফাইভ্রয়েড ও পিত্তপাতর অপারেশন করব। আমার নেতৃত্বে প্রথমে লেপারস্কোপির মাধ্যমে পিত্তপাতর এবং ডাঃ রাজিয়া সুলতানার নেতৃত্বে লেপারস্কোপির মাধ্যমে বাচ্চাদানীর টিউমার ফাইভ্রয়েড অপসারণ করা হবে। নুরজাহান বেগমের মনোবলের যে করুন অবস্থা তাই আমি এবং আজিজ ভাই দুইদিবসে ভিন্ন অপারেশনে নাগিয়ে একদিনেই করার সম্মতি দিলাম। রোগিনীকে বাহিরের একটি কক্ষে এনেস্থেশিয়া দিয়ে অপারেশন থিয়েটারে ঢুকানো হল। বড় অপারেশন, তাই আজিজ ভাইয়ের পরিচিত একজন যুবক একব্যাগ রক্ত দেন। হঠাৎ রক্তের প্রয়োজন হলে রক্তদানের জন্য বাহিরে তৈরি থাকেন শ্রীমঙ্গলের আমাদের প্রিয় মিরুভাইয়ের দুইজন সুদর্শন কিশোর পুত্র। তবে অপারেশন করতে কোন রক্ত দেবার দরকার হয়নি। সংগৃহীত সেই এক ব্যাগ রক্ত আমরা অন্য একজন রোগীকে দান করে দেই। একসাথে দুইটি অপারেশন, তাই আমি, আজিজ ভাই, নিশাত ও জেফার উদ্ভিগ্ন হয়ে বাহিরে পায়চারী করি। বিকেলে চিকনদেহী ডাঃ রাজিয়া সুলতানা অপারেশন থিয়েটারের বাহিরে এসে বললেন, অপারেশন ভাল হয়েছে, রোগিনীর জ্ঞান ফিরে এসেছে। আমি তাকে জিঞ্জেস করি খারাপ কিছু হয়নিতো? না, খারাপ কিছু মনে হয় নি, বলে রাজিয়া সুলতানা প্রস্থান করলেন।

একটু পরই হালকা নীলাভ কাপড়ে ঢাকা রোগিণীকে চাকাযুক্ত বেডে করে বেরিয়ে আনা হল। রাতে পোষ্ট অপারেটিভে রেখে পরদিন তাকে বেডে আনা হল। পরদিন আমরা তাকে বেডে রেখে বাহিরে নাস্তা করতে যাই। এসেই দেখলাম তার শিয়রে রাখা মোবাইলটা চূরি হয়ে গেছে। আমার মোবাইল হতে রিং করামাত্র একজন নারী রিসিভ করলেন, আঞ্চলিক ভাষার কথাবার্তা শোনে মনে হল কোন অশিক্ষিত মহিলা হবে। তাকে অনুরোধ করলাম এই সেটে আমাদের প্রচুর জরুরী ফোন নম্বার আছে, সেটটি ফেরত দিলে তাকে পুরস্কৃত করব। কিন্তু তারপরই যোগাযোগ চিরদিনের জন্য বন্ধ হয়ে গেল।

চার পাচ দিন পর সেলাই কেটে আমাদেরকে ছেড়ে দেওয়া হল। তিনটি রোগের দুইটি বিদায় নেওয়ায় নুরজাহান বেগমের মনে একটি প্রশান্তি ফিরে এল। বিগত এক বছরের সুতীব্র দুশ্চিন্তার শতকরা সত্তুরভাগ বিদায় হল। এবার কেবল কিডনি নিয়ে ভাবনা। ডাঃ জুলকিফল এসে রোগী দেখলেন। তিনি এবার বললেন, আপনার কিডনি নিয়ে ভাবনার কিছু নেই। একটি কিডনির নিচের আপনার এই সরুনালী জন্মগত হতে পারে, অনেকেরই এমন হয়ে থাকে। কোন অসুবিধা হলে অপারেশন করে এই নালী বড় করে দেব, এখন কিছু করার দরকার নেই। আজ ২০১৯ সাল পর্যন্ত এই অপারেশনের সাত বছর পেরিয়ে গেছে কিন্তু কিডনিতে কোন সমস্যাই হয়নি। ঢাকায় টেস্ট করা না হলে কিডনির এই চিকন নালীর খবরই আমরা জানতাম না। 

প্রায় দুইলক্ষ আশী হাজার টাকা বিল পরিশোধ করলাম। আমার অফিসের কেঊ কেঊ বললেন, কুরেশী সাহেব আপনি পূবালী ব্যাংকের কর্মচারী কল্যাণ ফান্ড অথবা সি এস আর ফান্ড হতে চিকিৎসার জন্য সাহায্যের আবেদন করতে পারেন। আমি ডাঃ নুরজাহান বেগম চৌধুরীকে বিষয়টি নিয়ে কথা বলতেই তিনি জবাব দেন, আমি সারাজীবন হাজার হাজার টাকা গরিব মানুষকে সাহায্য করেছি আর আজ কিনা আমার চিকিৎসার জন্য ব্যাংকের গরিবদের ফান্ড হতে সাহায্য নেব। না তা কোনমতে মেনে নেওয়া যায়না। আমি তাই এখানেই থেমে গেলাম।

কিছুদিন পরই দেখলাম সিলেট স্টেডিয়াম মার্কেটে প্র্যাকটিস করতেন এমন একজন প্রবীণ ডাঃ এইচ আলী মারা যান। এক সময়ের লন্ডন প্রবাসী এই চিকিৎসক আওয়ামী লিগ করতেন। তিনি ছিলেন শতভাগ স্বচ্ছল এবং হাউজিং এস্টেটে তার নিজস্ব বাসাও রয়েছে। অথচ তার পত্নী প্রধানমন্ত্রীর লিল্লাহ তহবিল হতে দশ লক্ষ টাকা অনুদান গ্রহণ করেন।

পুরাপুরি সুস্থ্য হবার পর একসময় ডাঃ নুরজাহান বেগম চৌধুরীকে বললাম, তোমার অনুমতি পেয়ে গেছি, এবার একটা বিয়ে করে ফেলি। কিন্তু দেখলাম তার সেই অভিমত এখন আর আগের জায়গায় নেই। কৌতুকচ্ছোলে বললাম অনেক আগে আরেক জন সুন্দরী বিয়ে করার অনুমতি স্কয়ার হাসপাতালের কেবিনে বসে বিনে আবদারে পেয়ে গেলাম, কিন্তু পুড়া কপাল আমার সেই মহাসুযোগটা তখনই কাজে না লাগিয়ে কি ভূলটা না করলাম।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন