সোমবার, ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৩

পূবালী ব্যাংক লিমিটেড বার্ষিক ব্যবস্থাপক সম্মেলন-২০১১ সিলেট

 

পূবালী ব্যাংক লিমিটেড বার্ষিক ব্যবস্থাপক সম্মেলন-২০১১ সিলেট

ব্যবস্থাপনা পরিচালক খোন্দকার ইব্রাহীম খালেদের আমলে পুবালী ব্যাংকে আমি ব্যবস্থাপক থাকাকালে দুই বছরই ঢাকার নিউ ইস্কাটনে বিয়াম অডিটরিয়ামে এসে মাত্র একদিনের বার্ষিক ব্যবস্থাপক সম্মেলনে যোগদান করি। তারপর প্রতিবছর কক্সবাজারে গিয়ে খুব ফুর্তি করে এই সম্মেলনে অংশ নিতাম। তখন সম্মেলনের সময় বেড়ে হয় দুইদিন, সেই সাথে ঘুরাঘুরি করার জন্য ব্যাংকের পর্ষদ আর একদিন বরাদ্ধ দেন। আসা যাওয়ার দুইদিন যোগ হয়ে এযেন সর্বমোঠ পাঁচদিনের এক কুম্ভমেলায় পরিনত হয়। কক্সবাজার বারবার যেতে যেতে সবার একটা বিরক্তি এসে যায়। এই বিরক্তির রেস ব্যাংকের উপরের মহলেও গিয়ে পড়ে। পুবালী ব্যাংকের বোর্ডে সিলেটি সদস্যদের ছড়াছড়ি, তদুপরি এমডি হেলাল আহমদ চৌধুরী মহোদয়ও সিলেটের লোক। চট্টগ্রামের পর সিলেটই বাংলাদেশের সবচেয়ে পর্যটন সম্ভাবনাময় এলাকা। ব্যাংকের অনেকেই কোনদিন সিলেটে আসেননি। তাই সব লোকজনেরও রয়েছে সিলেট দেখার এক অদম্য উৎসাহ। ২০১০ সালের কক্সেসবাজার সম্মেলনে বসে শুনলাম পরের বছরের বার্ষিক সম্মেলন হবে সিলেটে। এই সংবাদে সবার সাথে আমিও বেশ আনন্দ অনুভব করলাম।

প্রায় ছয়সাত শত লোকের তিনদিন হোটেলে থাকা খাওয়া ঘুম এবং প্রায় হাজার লোকের দুইদিনব্যাপি অনুষ্ঠানিক সভা পরিচালনা করা বেশ চ্যালেঞ্জিং ব্যাপার। ঢাকা চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার ছাড়া বাংলাদেশের অন্য কোন শহরে এই ধরনের একটি বড় কর্পোরেট অনুষ্ঠান করার মত অবকাঠামো নেই। সিলেটেও কোন জাতীয় পাবলিক লিমিটেড কোম্পেনি এই  ধরনের বড় অনুষ্ঠান আগে করে নি। আমার মনে হল এই অনুষ্টান সফল ভাবে সিলেটে অনুষ্ঠিত হলে সিলেটের লাভই হবে, দেশের আর বড় বড় কোম্পানিগুলো নতুনত্বের স্বাধে সিলেটে ছুটে আসবে, ফলে এই শহর অনেক ব্যবসা পাবে।   

তৎকালীন প্রধান কার্যালয়ের জিএসডিডি প্রধান আইনুল হক ভুইয়া এবং সিলেট-সুনামগঞ্জের অঞ্চল প্রধান মোসাদ্দিক চৌধুরী সিলেটে এই বড় অনুষ্টান করার চ্যালেঞ্জ সাহসের সাথে গ্রহন করলেন। কিন্তু সম্মেলন হল খুঁজতে গিয়ে মোসাদ্দিক স্যার প্রথমেই একটা হোঁচট খান। দুপুর ও রাতের আলাদা খাবার স্থানসহ সংলগ্ন হাজারখানেক লোকের অডিটরিয়াম গ্যালারীতে বসে অনুষ্ঠান করার মত কোন উপযুক্ত স্থান সিলেটে নেই। অনেকগুলো বিয়ে সেন্টার, হোটেলের সম্মেলন কক্ষ পরিদর্শন করে মোসাদ্দিক স্যার শাহজালাল উপশহরের হোটেল রোজভিউ কতৃপক্ষের স্মরনাপন্ন হন। তারা রোজভিউ হোটেলের শীর্ষতলায় অসংখ্য খুটিপূর্ণ একটি অডিটোরিয়াম দ্রুত হাজার লোকের অনুষ্ঠানের জন্য প্রস্তুত করে দিল। ঝাড়বাতি সজ্জিত এই হলটি সেজে গুজে বিয়ের কনের মত সুন্দরি হয়ে গেল। ঢাকার কতৃপক্ষ এসে দেখে এই অডিটোরিয়াম অনুমোদন করলেন।

সারাটা দেশ হতে আগত অতিথিদেরকে শহরের বিভিন্ন নামীদামী হোটেল ও রিসোর্টে থাকার ব্যবস্থা করা হল। সিলেট শহরের এই বার্ষিক সম্মেলনকে স্বাগত জানিয়ে অনেকগুলো তোরণ নির্মান করা হল। আমরা এই সম্মেলন উপলক্ষে সিলেট হতে একটি ছোট্ট ম্যাগাজিন প্রকাশ করলাম। সিলেট শহরে সীমিত আকারের একটি আনন্দঘন পরিবেশ তৈরী হল।

আমার স্পষ্ট মনে আছে সেই সম্মেলনের প্রথম দিনটি ছিল ৪ ফেব্রুয়ারি ২০১১ সাল। আমাদের মহামান্য ব্যবস্থাপনা পরিচালক হেলাল আহমদ চৌধুরী ছিলেন সভাপতি, আমন্ত্রিত অতিথি ছিলেন ব্যাংকের চেয়ারম্যান হাফিজ আহমদ মজুমদার এবং ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ। সম্মেলনের দ্বিতীয় দিবসও ছিল বসন্তের এক উজ্জল রোদেলা দিন। সারাদিন বেশ সুন্দর অনুষ্ঠান হয়। বিকেলে মাননীয় এমডি মহোদয় ব্যবস্থাপক, অঞ্চল প্রধান ও বিভাগ প্রধানদের প্রশ্নত্তোর পর্ব পরিচালনা করছিলেন। এমন সময় ভবন হঠাৎ কেঁপে ওঠে। সবাই ভয় পেলেও নিজ নিজ আসনে বসে থাকেন। কিন্তু পাঁচসাত মিনিট পর আবার প্রচন্ড ভুমিকম্প আঘাত হানলো। বেশ কয়েক মিনিট ধরে ভবনের ঝাড়বাতি, পর্দা, চেয়ার টেবিল দোলতে লাগল। ভবনটি কিছুক্ষণের জন্য একটি দোলনায় পরিনত হল। ভয়ে সবাই সৃষ্টিকর্তাকে ডাকাডাকি করে দিকবিদিক ছুটাছুটি আরম্ভ করেন। স্টেজে বসা এমডি হেলাল এ চৌধুরী, এ এম ডি আব্দুল হালিম চৌধুরী, চীফ টেকনিক্যাল অফিসার মোহাম্মদ আলী স্যাররাও প্যান্ডেল হতে নিচে নেমে আসেন।

আমি একজন সামান্য সিবিল ইঞ্জিনিয়ার হিসাবে জানতাম ভুমিকম্প হলে বহুতল ভবনের নিচের চেয়ে উপরের অংশটা খুব বেশি দোলে ওঠে। চিফ টেকনিক্যাল অফিসার মোহাম্মদ আলী স্যার আমার পাশে বসলে বললাম, এই ভবনটি খুব শক্ত করে নির্মিত, অন্ততঃ ৪৫ ডিগ্রি কাত না হলে এই ভবনের কিছুই হবে না। তাই ভয়ের কোন কারণ নেই। মনে পড়ে সেদিন মোহাম্মদ আলী স্যারকে আমি কানে কানে একটি সমস্যার কথাও বলে ছিলাম, তাহল আমাদের কাস্টমাররা বারবার ফোন করে তাদের হিসাবের ব্যালেন্স ও কিছু লেনদেনের খবর আমাদের কাছে জানতে চায়। কাস্টমারদেরে তাদের মোবাইলে অটো জানানোর ব্যবস্থা করা যায় কিনা? মোহাম্মদ আলী স্যার তখন পজেটিভ জবাব দেন, হ্যাঁ, এব্যাপারে কাজ চলছে। একসময় হয়ে যাবে।     

সভায় এক ভীতিকর অবস্থা তৈরী হলে ব্যবস্থাপনা পরিচালক হেলাল এ চৌধুরী এখানেই সভার সমাপ্তি ঘোষনা করেন। এই ভূমিকম্পের ভীতি রাতের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানেও অনুভূত হয়। অনেকে চলে যান, তেমন অংশগ্রহণকারী ছিল না, অনুষ্ঠানটি কেমন যেন ফাকা ফাঁকা মনে হল। বিকেলবেলার  আতঙ্কময় ভূমিকম্প খুব যতনে সাজানো পুবালী সাংস্কৃতিক সন্ধ্যাটির সব আনন্দ যেন ফিকে করে দেয়।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন