শ্রীমঙ্গল লাউয়াছড়া ভ্রমণ ও সীতেশ বাবুর চিড়িয়াখানা পরিদর্শন
২০১১ সালের হাড়কাঁপানো শীতে এক
ছুটির দিনে নুরজাহান বেগম ও বালক পুত্র জেফারকে নিয়ে আমি লালকার ড্রাইভ করে
ফেন্সুগঞ্জ পথে শ্রীমঙ্গল ছুটলাম। জুৎস্না খানম চৌধুরী আমার চাচাতো শালিকা, ব্যবসায়ী স্বামী ও জনাকয়েক ভাগ্না ভাগ্নি নিয়ে শ্রীমঙ্গল শহরে
তাদের স্থায়ী বসবাস। জুৎস্না বেগমের শ্বশুর এক সময় এই ছোট্ট পর্যটন শহরের পৌরসভার
চেয়ারম্যান ছিলেন। জ্যুৎস্না বেগম ও দোলাভাই আমাদেরকে প্রায়ই তাদের বাসায় আমন্ত্রন
জানাতেন। এবার আমাদেরকে বাসায় হাজির পেয়ে আহলাদে আটকানা। দিনে ভাগ্নাকে নিয়ে আমরা
কারে আশপাশের লাউয়াছড়া উদ্যান, চা বাগান, চা গবেষনা ইন্সটিটিউট ঘুরলাম। এসব জায়গা
আমরা বারবার ঘুরেছি, প্রতিবারই আনন্দ পেয়েছি নতুন আসার মতন।
ভাগ্না আমাকে নিয়ে গেল
শ্রীমঙ্গলের সুপ্রসিদ্ধ পশুপাখি প্রেমিক সীতেশ বাবুর বাসায়। প্রৌড় বয়সী শ্যামলাবরণ
সীতেশ বাবুর একটি চোখ নেই। এই ভদ্রলোক সারা জীবন সিলেটের পাহাড়ি অঞ্চলের বিরল
প্রজাতির পশুপাখি সংরক্ষনে কাজ করে যান। তিনি তার এই মূল্যবান জীবনটাকে বন্য
পশুপাখিদের জন্য বিনামূল্যে উৎসর্গ করে দেন। একটি বুনো ভালুকের বাচ্ছা উদ্ধার করতে
গিয়ে এই বন্ধুটির থাবায় তার বাম চোখটি হারান। সীতেশ বাবুর সাথে সংক্ষিপ্ত আলাপ
সমাপন করে কাছে তার প্রাণী সংরক্ষনাগারে গিয়ে লাফালাফি করা এই দুষ্ট ভালুকের সাথেও
মোলাকাত করি। নয়ন হারালেও তিনি এই অবুঝ প্রানীটাকে আদর করে দুধকলা দিয়ে পুষলেন। বিরল
প্রজাতির সাপ এবং পাখির বাচ্ছা ফুটাতেও তার জুড়ি নেই। অসুস্থ বিষাক্ত সাপ এবং
প্রানী উদ্ধারে তিনি জীবনের ঝুকি নিতেও কখনও পিছপা হন না। তার এই ক্ষুদে
চিড়িয়াখানায় নামমাত্র মূল্যের টিকেট কেটে ঢুকলাম। বিগত আমলে সিলেটের বনাঞ্চলের সব
ধরনের পশু পাখি সাপ শিয়াল বেজী তক্ষক বনবিড়াল কলিম পাখি সবার সাথে এখানে দেখা হয়ে
গেল। সৃষ্টিকর্তা তার সৃষ্ট প্রানী জগতকে রক্ষার জন্য এমনই কিছু মানুষ তৈরী করে
দেন যারা এসব প্রজাতি সংরক্ষণে অক্লান্ত পরিশ্রম করে যান। সীতেশ বাবুর সাথে আলাপ
করে মনে হল তিনি আল্লাহ কতৃক প্রেরিত এমনই একজন সোনার মানুষ, যিনি শ্রীমঙ্গলের
অতীত দিনের সেই নানা প্রজাতির জীবনের চিহ্ন যা আজ হারিয়ে যাচ্ছে তা ধরে রাখতে
পাগলপরা।
রাতে খুব পরিপাঠি করে সাজানো কক্ষে
আমরা তিন ভিআইপি মেহমান ঘুমিয়ে পড়লাম। তবে খুবভোরে লাউয়াছড়া যাবার একটা লোভ আমার
বহুদিনের। আমি সিরাজনগর চা বাগানে খুব ভোরে হাঁটতাম নানা বন্যপ্রাণীর দেখা পেতে এবং
ভোরের আলো এসব বিরল প্রাণীকে আমার চোখের সামনে নিয়ে আসত। ভোরের আজানের আগেই উঠে
আমরা কার স্টার্ট করলাম। ঘন কুয়াশা ঝরছে, হেডলাইটের আলো কুয়াশায় ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে।
সামনের দশহাত দূরের কিছুই দৃষ্টিগোচর হচ্ছেনা। এমনই করে লাউয়াছড়া উদ্যানের ভিতর
গাড়ি ঢুকল। এবার গাড়ির গতি মাত্র ৫ কিলোমিটার/পার আওয়ারে নিয়ে আসলাম। গাড়ির আলো
নিভিয়ে দিলাম। সামনের রাস্থায় একটি বনমোরগ পড়ল। গাড়িতে মানুষ আছে টেরপেয়ে লাফানো
উড়াল দিয়ে পাশের ঝোপে হারিয়ে গেল। পাশের বৃক্ষডালে একটি মা বানর বাচ্ছাকে বুকে
জড়িয়ে বসে আছে। তখন বনের সুউচ্চ বৃক্ষমালার উপর দিয়ে উচ্চসুরে কোরাস গেয়ে গেয়ে সবুজ
তুতার পাল উড়ে যাচ্ছিল। শেয়ালের হুক্কাহুয়া শব্দে বন বারবার কেপে উঠল। পাশের ঘাসের
আড়ালে খরগোসের আনাগুনা চোখে পড়ল। কিছু বনবিড়ালের চোখ হতে বেরিয়ে আসছিল উজ্জ্বল
আলোকচ্ছটা। গুচ্ছলেজের বর্নালি কাটবিড়ালীর কটার কট, কটার কট শব্দের বাজনা তো
অবিরাম বাজছেই। এবার কানে আজানের ধ্বনি ভেসে এল। তাপ ও আলো পেয়ে লাউয়াছড়া অরন্য যেন
নানান প্রজাতির পাখির গানে রাতের ঘুম ভেঙ্গে জেগে উঠল। ক্লোরফরম মানুষকে অঞ্জান
করে ঘুম পাড়িয়ে দেয়। দেখলাম এখানে পাশেই একটি ক্লোরফরম বৃক্ষ দাঁড়িয়ে আছে। কমলগঞ্জের
সবুজ শ্যামল পথে অনেকক্ষন ঘুরেফিরে বাসায় ফিরে হল এক গর্জিয়াস চানাস্তা ও
ব্রেকফাস্ট। দিনে ঘুরলাম কমলগঞ্জের পাহাড়ঘেরা মাধবপুর লেকে। প্রকৃতির কাছে আমি
বারবার যাই। এই প্রকৃতি রাজ্যেকেই মনে হয় আমার জীবনের সব সুখ ও শান্তির এক সীমাহীন
খনি। এই প্রকৃতির মাঝে আমি আমার প্রভুর অপার মহিমাও খুজে পাই। তাইতো এই প্রকৃতির
হাতছানি আমাকে নিয়ে গেছে এই বিচিত্র পৃথিবীর নানা দেশের বিচিত্র সব প্রান্তরে প্রান্তরে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন