আমেরিকার স্বপ্নভঙ্গঃ
২০২০ খ্রিস্টাব্দে করোনা
মহামারীর কারণে টার্কি এয়ারের টিকেট কেটেও আমেরিকা গমন সম্ভব হয়নি। টার্কি এয়ার
জানিয়ে দেয় তাঁদের ফ্লাইট বন্ধ হয়ে গেছে। টিকেটের মূল্য সাথে সাথে ফেরত আসে।
গ্রিনকার্ডের শর্তানুসারে আমেরিকা ছাড়ার এক বছরের মধ্যে সেখানে ঢুকার বাধ্যবাধকতা
রয়েছে। আমার চিকিৎসক পত্নীর যুক্তরাষ্ট্রে যাবার কোন আগ্রহ নেই। তিনি জন্মভূমি
বাংলাদেশ ছেড়ে চিরতরে আমেরিকায় পাড়ি দেওয়াকে মনে মনে মেনে নিতে পারেননি।
গ্রিনকার্ডধারী আমরা বছরে একবার করে পাঁচ, পাঁচবার আমেরিকা গিয়ে কিছুদিনের মধ্যে
ফিরে আসি বাংলাদেশে।
বাংলাদেশে কাজ হারানো, চেম্বার
নষ্ট, আমার চাকুরী নষ্ট, একমাত্র পুত্রের ভবিষ্যৎ চিন্তা, পুত্রকে আমেরিকায় একাকী
ছেড়ে দেওয়া ইত্যাদি ইত্যাদি মানসিক দুশ্চিন্তা ডাঃ নুরজাহান বেগমকে কালো করে দিতো।
বাংলাদেশে সাজানো গুছানো সংসার ফেলে দিয়ে নতুন দেশে নতুন সংসার সাজানোকে আমার
কাছেও বেশ অস্বস্তিকর মনে হয়।
অর্থনীতিতে অপরচ্যুনিটি কস্ট বা সুযোগমূল্য বলে একটা কথা প্রচলিত রয়েছে। জীবনে যদি একসাথে একাধিক সুযোগ আসে যার মধ্যে একটিকে বেছে নিতে হবে। তাহলে ভেবে চিনতে যেটি লাভজনক সেটিই বুদ্ধিমান লোকেরা বেছে নেয়। কিন্তু আমেরিকা নাকি বাংলাদেশ, কোনটি আমাদের জন্য লাভজনক আমি সিন্ধান্ত নিতে পারিনি। আমি দুটোকেই আমার জন্য সমান জরুরী ধরে নেই। ভাবলাম চাকুরীতে অবসর না নেওয়া পর্যন্ত আমেরিকায় যাওয়া আসা করি। চাকুরী শেষে সার্ভিস বেনিফিট নিয়ে আমেরিকা গিয়ে স্থায়ী হব। মনে মনে ভাবি বাকি জীবন গ্লোভাল মানুষ হয়ে আমেরিকায় গ্রীষ্মকাল এবং বাংলাদেশে শীতকাল কাটাবো।
তবে ২০২৫ সাল পর্যন্ত আমাদের গ্রিনকার্ডের মেয়াদ রয়েছে।
আমার বিদেশ ভ্রমণের সহযোগী আহমদ
এভিয়েশনের ফুজায়েল ভাইকে দিয়ে অনলাইনে আমাদের গ্রিণকার্ডের মাধ্যমে আমেরিকা
প্রবেশের অনুমতি চেয়ে আবেদন করি। ঢাকার আমেরিকা দুতাবাসে ৫ এপ্রিল ২০২৩ বুধবার
স্বাক্ষাৎকারের জন্য হাজির হতে বলে দেয়।
বহুদিন পর ট্রেনে চড়ে ঢাকা যাই।
ছোট সম্মন্দি আজিজ ভাই গাড়ি নিয়ে কমলাপুর আসেন। রাস্থায় তেমন জ্যাম নেই, কলাবাগান
প্রান্তপথ হয়ে আমাদেরকে ধানমন্ডি বাসায় নিয়ে যান। আজিজ আহমদ চৌধুরী কিছুদিন হয়
নিউইয়র্ক হতে ঢাকায় এসেছেন। তাঁর চালক খোকন আমাদেরকে নিয়ে পরদিন সকাল ১১ টায়
বনানীতে আমেরিকান দুতাবাসের গেটে নামিয়ে দেয়।
প্রাচিন দুর্গের মত সুরক্ষিত
দুতাবাসের ভিতর সুনসান নীরবতা, এ যেন এক টুকরো আমেরিকা। যথাস্থানে গিয়ে দেখি কেবল
দুইজন মা-শিশু এবং আমরা তিনজন ইন্টারভিউ দিতে এসেছি। মা ও শিশু ভিসা পেয়ে মহানন্দে
বেরিয়ে যান। আমাকে ইন্টারভিউ ফি দিতে ডাকা হয়। ষাট হাজার টাকার নতুন একটি বান্ডিল
বাঙ্গালী ক্যাশিয়ারের হাতে তুলে দেই।
এবার আমাদের ডাক পড়ে। একজন
শ্বেতাঙ্গ অফিসার এলেন। তাঁর সাহায্যের জন্য সাথে আসেন একজন বাঙ্গালী দুভাষী মেয়ে।
আমেরিকায় আমরা কতদিন থেকেছি জানতে চাওয়া হল। আমেরিকায় আমাদের বাসাবাড়ি, ব্যাংক
হিসাব, ইনকামটেক্স ফাইল আছে কিনা ইত্যাদি বিষয় জানতে চান। প্রায়ক্ষেত্রেই আমাকে
নাবাচক জবাব দিতে হল। দূতাবাস কর্মকর্তা এবার বললেন, আপনাদের গ্রিনকার্ড একবছরের
ভিতর আমেরিকায় না ঢুকার কারণে বাতিল হয়ে গেছে। আপনারা ভিজিট ভিসার মাধ্যমে আমেরিকা
যেতে পারেন। আসুন আমরা ভিজিট ভিসা দেবো।
আমি প্রায় সাত কোটি টাকার শেয়ার
এবং ব্যাংক ডিপোজিট দাখিল করি। আমার চাকুরী প্রায় শেষ, পূত্র চিকিৎসক হয়ে গেছে।
এখন আমি স্থায়ীভাবেই আমেরিকা পাড়ি দেবো। সেখানে গাড়ি বাড়ি করবো। কিন্ত কে শুনে কার
কথা। লোকটা আমার আর কোন কথাই শুনলো না।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন