শনিবার, ১৬ জানুয়ারী, ২০১৬

ইতিহাসের আলোকে শাহদাউদ কুরায়শী (রহঃ)



   দরগাহে হজরত শাহদাউদ কুরায়শি(রঃ), দাউদপুর, দক্ষিণ সুরমা, সিলেট।
শাহদাউদ কুরায়শি  ভারতবর্ষে ইসলাম প্রচারকারী সিলেটের সুপ্রসিদ্ধ দরবেশ শাহজালালের ৩৬০ আউলিয়ার অন্যতম। শাহজালালের  ইতিহাস বলে এক ধরনের উপাখ্যান বা লোককাহিনি সিলেটের জনসমাজে বহুদিন ধরে প্রচলিত ছিল। পরবর্তীকালে সেইগুলোর সমন্নয়ে ১৭১৫ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট ফররুখ শিয়ারের রাজত্বকালে শাহজালালের অন্যতম সাথী হামিদউদ্দিন নার্নুলির জনৈক বংশধর “রওজাতুস সালেহিন” নামক একটি পুস্তক প্রনয়ণ করেন। ১৭২১ খ্রিস্টাব্দে মুর্শিদাবাদের নবাব মুর্শিদ কুলি খানের সুবাদারিকালে তাঁর উদ্যোগে  শাহজালালের জনৈক খাদিম মঈন উদ্দিনরিসালা” নামে আর একটি গ্রন্থ সামান্য পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করে লিপিবদ্ধ করেন। এই আদি গ্রন্থগুলো এখন আর নাই। 
ত্রিপুরার অধিবাসী নাছির উদ্দিন নামক জৈনিক ভদ্রলোক ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে সিলেটের মুনসেফ ছিলেন ও তিনি দরগামহল্লায় অবস্থান করে ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দে ফারসি ভাষায় শাহজালালের ইতিহাস বিষয়ক গ্রন্থ “সুহলে ইয়ামেন” রচনা করেন। পূর্ববর্তী দুই গ্রন্থের সার সংগ্রহ করে আরও অনেক তথ্য প্রমাণ যুক্ত করে তিনি পুস্তকটি প্রনয়ণ করেন। “সুহলে ইয়ামন” এখনও সযতনে দরগায় রক্ষিত রয়েছে। “সুহলে ইয়ামেন”  গ্রন্থে ৩৬০ আউলিয়ার মধ্যে ২৪০ জন আউলিয়ার নাম লিপিবদ্ধ হয়েছে। এই তালিকায় শাহদাউদ কুরায়শি অন্যতম। সিলেটের ইতিহাস ও বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন পুস্তকে শাহদাউদ কুরায়শি সম্পর্কে যথেষ্ট আলোকপাত করা হয়েছে। 
সুপ্রাচীন “রওজাতুস সালেহিন” থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত লিখিত সমুদয় ঐতিহাসিক মৌলিক গ্রন্থসমুহে শাহদাউদ কুরায়শির উল্লেখ রয়েছে।
নিম্নে কতিপয় গ্রন্থে শাহদাউদ কুরায়শি সম্পর্কে বর্ণিত তথ্যের আলোকপাত করা হলঃ

“শেখ দাউদ কুরায়শি(রঃ) ঃ
তাঁর মাজার রেঙ্গা পরগনার দাউদপুর মৌজায় অবস্থিত। দাউদপুরের চৌধুরীগন তাঁরই বংশধর। মরহুম খান বাহাদুর  গৌছ উদ্দিন আহমদ চৌধুরী এম.এল.সি এই বংশের লোক ছিলেন।”
সূত্র ঃ সৈয়দ মুর্তজা আলীর “হজরত শাহজালাল ও সিলেটের ইতিহাস” প্রকাশকাল ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দ, পৃষ্টা-২৭

শাহ দাউদ কুরায়শি(র) :
রেঙ্গা পরগনার দাউদপুরে তাঁর সমাধি অবস্থিত। দাউদপুরের বিখ্যাত   চৌধুরী   পরিবার  তাঁর  বংশধর বলে দাবি করেন। খান বাহাদুর গৌছ উদ্দিন আহমদ চৌধুরী এই  পরিবারের  লোক ছিলেন।”
সূত্রঃ মুফতি আজহার উদ্দিন সিদ্দিকীর “শ্রীহট্টে ইসলাম জ্যোতি” প্রথম প্রকাশকাল-১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দ, পৃষ্টা-৫৬ 

“দাউদপুরের চৌধুরী পরিবার 
হজরত শাহদাউদ কুরায়শি(র:) হজরত শাহজালালের(রঃ) সঙ্গী ৩৬০ আউলিয়ার অন্যতম। সিলেট বিজয়ের পর হজরত শাহজালালের(রঃ) নির্দেশে ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে তিনি সিলেট সদর থানার দাউদপুর গ্রামে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। দাউদপুরের বর্তমান চৌধুরী পরিবার  হজরত শাহ দাউদের বংশধর।”
সূত্রঃ সিলেট গাইড প্রকাশকাল-১৯৯৫, পৃষ্টা-১৮৫

“শায়খ দাউদ কুরায়শি(রঃ) ঃ
তাঁর নামানুসারে দাউদপুরের নামকরণ করা হয়েছে। দাউদপুরে তদীয় মাজার বিদ্যমান আছে। রেঙ্গার চৌধুরী সাহেবান তাঁর  বংশধর। এই বংশীয় খানবাহাদুর  গৌছ উদ্দিন চৌধুরী  ছিলেন।”
সূত্রঃ দেওয়ান নূরুল আনোয়ার হোসেন চৌধুরীর “জালালাবাদের কথা” প্রকাশকাল-১৯৯৭ খ্রিস্টাব্দ, পৃষ্টা-৬৮

“শাহ দাউদ কুরায়শি ঃ
দাউদ কুরায়শি শাহজালালের একই বংশে (কুরায়েশ) জন্মগ্রহণ করেন। তিনি রেঙ্গা পরগনায় গমন করেন। তদীয় বসতি স্থান দাউদপুর নামে খ্যাত। এখানকার চৌধুরীগন তদ্বংশীয় বলে প্রকাশ।"
অচ্যুত চরণ চৌধুরীর মতে সিলেটে ৩৭৫ জন কুরায়শ বংশীয় লোক ছিলেন। স্পষ্টতঃ শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত প্রনয়ণের কথা এটি। লেখক ৩৬০ আউলিয়ার যে তালিকা দিয়েছেন তাতেও শাহদাউদ কুরায়শি(রঃ) এর নাম আছে।
সূত্র ঃ অচ্যুত চরন চৌধুরীর “শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত” ২য় ভাগ ২য় খন্ড  প্রকাশকাল-১৯১০ খ্রিস্টাব্দ

“হজরত শাহজালাল(রঃ) ও দাউদ কুরায়শি(রঃ) ঃ
হজরত শাহজালাল(রঃ) ছিলেন কুরাইশ বংশদ্ভুত। তাঁর জনক ছিলেন মোহাম্মদ বিন ইব্রাহিম কুরায়শি। শাহজালাল(রঃ) যখন মক্কা ত্যাগ করে প্রাচ্য দেশের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন তখন তাঁর সঙ্গে ছিলেন কিছুসংখ্যক কুরাইশ বংশীয় সহচর। হজরত শাহদাউদ কুরায়শি ছিলেন হজরতের সঙ্গীদের অন্যতম। সিলেটের অদূরবর্তী রেঙ্গা অঞ্চলে তিনি ইসলাম প্রচার করেন ও বসতি স্থাপন করেন। তাঁর নামেই তাঁর আবাস স্থানের নাম হয় দাউদপুর। হজরত শাহদাউদ কুরায়শির মাজার এই দাউদপুর গ্রামে অবস্থিত।”
সূত্রঃ ফজলুর রহমানের “সিলেটের একশত একজন” প্রকাশকাল- ১৯৯৪ খ্রিস্টাব্দ, পৃষ্টা- ২১৭ 

“দাউদ কুরায়শি ঃ
তিনি হজরত শাহজালালের নিজ বংশের লোক। তিনি বিখ্যাত দরবেশ ছিলেন। রেঙ্গা পরগনার অন্তর্গত দাউদপুরে তাঁর মাজার অবস্থিত।”
সূত্রঃ খন্দকার মোঃ বশির উদ্দিনের “হজরত শাহজালাল(রঃ)” প্রকাশকাল- ১৩৮৮ বঙ্গাব্দ পৃষ্টা- ২১৭।

“শাহ দাউদ কুরায়শি ঃ
রেঙ্গা পরগনার দাউদপুরে তাঁহার সমাধি অবস্থিত। দাউদপুরের বিখ্যাত চৌধুরী পরিবার তাঁহার বংশধর বলিয়া দাবি করেন।”
সূত্রঃ মোঃ নুরুল হক সম্পাদিত “আল ইসলাহ” প্রকাশকাল- ১৩৬৪ বঙ্গাব্দ, শাহজালাল সংখ্যা- ১ম খন্ড, পৃষ্টা- ১৫৩।

দেওয়ান নুরুল আনোয়ার হোসেন চৌধুরীর রচিত এবং ২০০০ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত “হজরত শাহ দাউদ কুরায়শি ও তাঁর বংশধরগণ” গ্রন্থের ভুমিকায় জাতীয় অধ্যাপক দেওয়ান মোহম্মদ আজরফ লিখেছেন- “প্রাচ্যসূর্য্য হজরত শাহজালাল(রঃ) ১৩০৩ খ্রিস্টাব্দে সিলেটের তৎকালীন অত্যাচারী রাজা গৌড়গোবিন্দকে পরাজিত করে এঅঞ্চলে ইসলামি সমাজ ও শাসন প্রতিষ্ঠা করার পর তাঁর সঙ্গে আগত দরবেশগণকে এঅঞ্চলের বিভিন্ন স্থানে প্রেরণ করেন। এই ওলি আল্লাহদের মধ্যে হজরত শাহ দাউদ কুরায়শি(র:) তাঁর আদেশে বর্তমান দাউদপুর অঞ্চলে ইসলাম প্রচার করার জন্য গমন করেন। তখন সে অঞ্চলে হিন্দু সমাজের লোকদের আধিপত্য ছিল। তথাপি এলাকার লোকজন ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হতে থাকেন এবং শাহদাউদ কুরায়শির(র:) বংশধরগণ জমিদার শ্রেণিতে পরিনত হন। খুব সম্ভব দাউদপুরের জমিদারগণের কর্তৃত্বের মধ্যে তুর্কি আমলে যে সব ভুম্যাদি ছিল মোগল আমলে তা বহাল থাকে। এজন্য ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কর্তৃক ১৭৯৩ সালে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত দেওয়ায় দেখা যায় রেঙ্গা পরগনা ও দাউদপুর মৌজায় শাহদাউদ কুরায়শির বংশধরদের বরাবরে বিরাট তালুকাদি বন্দোবস্ত দেওয়া হয় এবং তদবধি তারা জমিনদাররূপে সমাজে উচ্চস্থান লাভ করেন।”
বিগত তিন শত বৎসর অর্থাৎ ১৭০০ খ্রিস্টাব্দ হতে আজ ২০১২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত হজরত শাহজালাল ও ৩৬০ আউলিয়া সম্পর্কিত প্রায় সকল মৌলিক রচনাতেই ৩৬০ আউলিয়ার অন্যতম হজরত শাহদাউদ কুরায়শির উল্লেখ লক্ষণীয়। হজরতের বংশধরগণ সুলতানি ও মোঘল আমলে ফারসি ভাষায় নছবনামা সংরক্ষণ ও সময়ের সহিত নতুন বংশধরগণকে সংযোজন করে আসছিলেন। এই যুগে এসে শাহদাউদ কুরায়শির  ফারসি ভাষায় লিখিত অধস্থন পারিবারিক বংশ তালিকা তাঁর ত্রয়োদশ বংশধর হাফিজ আব্দুর রহিমের বাড়ি হতে ঢাকায় নিয়ে রাযী উদ দীন কুরায়শি বাংলায় অনুবাদ করে ট্রেসিং পেপারে অনেকগুলো কপি করে তাঁর বংশধর সবাইকে বিতরণ করেন। দাউদপুর চৌধুরীগোষ্টির পারিবারিক ইতিহাসে প্রাচীনকাল হতে বংশপরম্পরায় নসবনামা সূত্রে হজরত শাহদাউদ কুরায়শির ইতিহাস সংরক্ষিত হয়ে আসছে।

চিত্রঃ কবি, লেখক ব্লগার ও ব্যাংকার ইসফাক কুরেশী (ডানে) ও পুত্র জেফার কুরেশী (বামে) সারালাগো রিসোর্ট, ডিজনিওয়াল্ড, অরল্যান্ডো, ফ্লোরিডা, যুক্তরাষ্ট্র।            

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন