আজ রবিবার। সপ্তাহের অবসর দিন। আড্ডা বসেছে জয়নুলের বাসায়। একসঙ্গে প্রবেশিকা পাশ করে আমরা বাপের টাকার শ্রাদ্ধ করতে এসেছি শহরে, কলেজে পড়তে আর জয়নুল পোস্ট অফিসে চাকুরি পেয়ে এই মেসে ঠাঁই নিয়েছে। চাকুরেদের মেস। জয়নুল ছাড়া সবাই বিবাহিত এবং নিয়মিত শনিবারের গৃহযাত্রী।
ভিতরে আসতে পারি কি? জবাবের অপেক্ষা না করেই একজন ভদ্রলোক ঘরে ঢুকলেন। ছিপছিপে ধরণের চেহারা, বুদ্ধিদীপ্ত চোখ। দেখতে আহামরি না হলেও স্বাভাবিক আকর্ষণী শক্তি রয়েছে। সামনের চেয়ারে বসে ভদ্রলোক বলতে লাগলেন- আপনাদের মত আমাদেরও এমন একদিন ছিল, কেবল হৈ হল্লা করেই কাটিয়েছি। দুঃখ বলতে আমাদের কিছুই স্পর্শ করতে পারে নি।
যাক আজ একটা ঘটনার কথা আপনাদের বলব- যা বোধ হয় কারও জীবনে ঘটেনি এবং যার অবসান ঘটলো আজই।
আমি তখন এস.এস.সি পাস করে কলেজে পড়তে আসি। হোস্টেলে থাকার মত অবস্থা ছিল না। অনেক খোঁজাখুঁজি করে একটি বাসা পাওয়া গেল। অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারী। তিনটে ছেলেমেয়েকে পড়াতে হবে। অট্টালিকার মত বাড়িটা বেশ বড়। গেটে খোদাই করে লিখা আছে- ‘মায়ামহল’। এই মায়ামহলের ছোট্ট একটি কামরা আমার জন্য বরাদ্ধ হল।
একদিন লক্ষ্য করলাম আমার বিছানার নিকটস্থ দেওয়ালে একটু শেওলা পড়ার দাগ। অনেকটা মুখচ্ছবির মত। কলেজে তখনও পড়া আরম্ভ হয়নি। বসে বসে কিংবা শুয়ে শুয়ে কাটত দিনের অধিকাংশ সময়। তখন প্রায়ই চোখে পড়ত ঐ শেওলা আঁকা মুখচ্ছবিটি ও যতসব আজগুবি কল্পনা ভিড় করত আমার মাথায় ওটাকে নিয়ে। ছবিটা যেন দিন দিন পরিস্কার হতে লাগল।
মুখটা আমাকে রীতিমত পেয়ে বসল।
জানিয়ে দেওয়া হল পরের দিন থেকে ক্লাস আরম্ভ হবে। নির্দিষ্ট দিনে কলেজে গেলাম। ঘন্টার্ধ্বনীর সংগে সবাই ক্লাসে ঢুকলাম, একটু পরেই আসলেন প্রফেসর। সংগে সংগে লেডি স্টুডেন্টস, গ্যালারির সামনে ওদের স্থান নির্দিষ্ট। ওরা সংখ্যায় মাত্র কয়েকজন। ওদের দেখছি, হঠাৎ আৎকে উঠলাম। পাশের চশমাওয়ালা মুখটা যেন কোথায় দেখেছি। গোল মাংসল মুখ, বড় বড় চোখ, নাক চ্যাপ্টা না হলেও ধারাল নয়। হুঁ, সেই দেওয়ালের ছবির সঙ্গে মিলে যাচ্ছে। হঠাৎ সে আমার দিকে তাকাতেই ব্লাকবোর্ডের দিকে চোখ ফিরিয়ে নিলাম।
প্রতিদিনই এইরূপ চোখাচোখি হয়। আর লক্ষ্য করি মেয়েটা আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। আমারও ওর প্রতি একটা টান জন্মে গিয়েছিল।
আসলে ওই মেয়েটা আমার বাসার সামনের রাস্তা দিয়ে কলেজে যাওয়া আসা করে।
আমরা উদগ্রীব হয়ে শুনছি, ভদ্রলোক বলে যাচ্ছেন-
দিন যায় ......... ..........।
নিন, আপনার চিঠি- বলে বৃদ্ধ চাকর গনশা আমার নাম ঠিকানাযুক্ত খাম এগিয়ে দিল, ডাক পিয়ন দিয়ে গেছে।
মেয়েলী হাতের লেখা, নীচে ছোট্ট করে নাম লিখা- মায়া, রোল-৫৬। পত্রের বিষয় মামুলী ধরণের প্রেম নিবেদন। আমিও উত্তর দিলাম, যতদুর সম্ভব কবিত্ব করে গদগদ ভাষায়। পত্র লেনদেন চললো পুরোদস্তুর। শুনেছি খোট্টা দারওয়ালদের খতমারফৎ সব হয়। দেশে বউয়ের বাচ্চা-কাচ্চা হয়। যদিও সে এখানে পড়ে থাকে বছরের পর বছর।
আমি প্রেমের জলে পড়ে হাবুডুবু খাচ্ছি আর পত্রগুলো রাজদূরের কাজ করছে। হালত তবদুল।
সেদিন কলেজে এসে শুনি উৎপল, ফরিদ, অজিত সবাই বলাবলি করছে, আজ কলেজ হবে না।
আজতো কোন গেজেটেড হলিডে নেই। ছুটি হবে কেন?
জিজ্ঞেস করলাম।
আরে তুই কিছুরই খবর রাখিস না।
অজিত বললো-
আমাদের ক্লাসের সেই মোটা মেয়েটি---
‘মায়া, রোল-৫৬’ মরেছে। মানে আত্মহত্যা করেছে। বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠল আমার। যতদুর সম্ভব নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম- কেন রে! কি হয়েছিল? হবে আবার কী। সেই পুরনো গল্প, প্রেমে পড়া, প্রণয় প্রার্থীকে না পেয়ে আত্মহত্যা। মেয়েটা নাকি কার প্রেমে পড়েছিল। ওর বাপ মা চেয়েছিলেন বিয়ে দিতে, ওকে ওদের মত এক ধনী মদ্যপায়ী ছেলের সাথে। ওর প্রতিবাদে কোন কাজ হয়নি, তাই জের টেনেছে বিজলী তারে হাত দিয়ে। আমার কি হল, কিছু বুঝতে পারছি না। যেন সমস্ত জগতটা কার বিরহে গুমরে মরছে।
কলেজ ছুটি হয়ে গেল। ধীর পদক্ষেপে বাসায় এলাম। হাঁটতে শক্তি পাচ্ছি না। বাসায় এসে দেখি রীতিমত চুনকাম চলছে। বুকটা আবার ছ্যাঁৎ করে উঠল। মনে পড়ল সেই মুখটার কথা, তাড়াতাড়ি ঘরে ঢুকলাম। চেয়ে দেখি দেওয়ালের সেই মুখচ্ছবিটি জন্মের মত মুছে দেয়া হয়েছে চুন দিয়ে।
দেখুন বাড়িটার নাম ‘মায়ামহল’। মেয়েটির নাম ‘মায়া’। মেয়েটির হুবহু মুখচ্ছবি জেগেছিল দেওয়ালে। মেয়েটির মৃত্যুর সংগে সংগে ছবিটাও মুছে গেল।
আমার চমক ভাঙ্গল যেন হিপনোটাইজড অবস্থায় ছিলাম।
তাড়াতাড়ি
উঠলাম লোকটাকে ডাকতে। ততক্ষণে সে রাস্তার লোকের ভীড়ে মিশে গেছে।
[প্রকাশ: স্মরণিকা ২০০৯, অর্থনীতি বিভাগ, এম.সি. কলেজ, সিলেট।]
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন