কবি লেখক ও ব্লগার ইসফাক কুরেশী সুন্দরবনের জাহাজে
শ্রীহট্ট বিজয়ের পর শাহজালাল(রঃ) এখানে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করে ধর্মপ্রচার এবং উপাসনাতে আত্মনিয়োগ করেন। পবিত্র ইসলাম ধর্ম প্রচার ও প্রসারে সঙ্গী আউলিয়াগনকে চতুর্র্দিকে প্রেরণ করেন। তাহারা শুধু শ্রীহট্টে নয় ঢাকা, চট্টগ্রাম, ত্রিপুরা, কুমিল্লা, ময়মনসিংহ, রংপুর, নোয়াখালী, আসাম এমন কি পশ্চিমবঙ্গের সাতগাও ইত্যাদি অঞ্চলে ইসলাম প্রচারে গিয়াছিলেন বলিয়া জানা যায়। ঢাকার অদূরে সোনারগাঁয়ে শাহজালালের কান্দির অবস্থান দৃষ্টিগোচর হয়।
হজরত শাহ জালাল(রঃ) ছিলেন একজন বিখ্যাত সুফি। সুফিরা নির্জনবাস ও দারিদ্রতা পছন্দ করতেন। সবধরনের ব্যক্তিগত সম্পদ হতে নিজেকে সরিয়ে রাখতেন। তারা নিভৃত সাধনায় কোরানের মর্ম উদঘাটনের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য লাভের চেষ্টা করতেন। সুফিরা আত্মার পরিশুদ্ধি ও পরমাত্মার প্রেম সাগরে ডুবে থাকা পছন্দ করতেন। তাঁরা সমাজের সব ধরনের অনাচারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতেন। সুফিরা আধ্যাত্মিক সাধনার অংশ হিসাবে সুদীর্ঘ্য দেশ ভ্রমণ বা সফর করতেন। ইবনে বতুতার বিবরণে আমরা শাহজালালের মধ্যে উপরুল্লেখিত সবগুলো সুফি বৈশিষ্ট্যের উপস্থিতি লক্ষ্য করি। অত্যন্ত সাদাসিদা জীবনযাপন, সুদৃঢ় চরিত্রবল ও আন্তরিক দরদ দিয়ে তিনি মানুষের হৃদয় মন জয় করেছিলেন। ফলে দলে দলে সিলেটের মানুষ তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে।
বাংলাদেশে পাল রাজারা নবম শতাব্দী পর্যন্ত রাজত্ব করেন। তারা ছিলেন বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। পালবংশের রাজত্বকালে সিলেটের মানুষ ছিলো বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী প্রজা, দ্রাবিড় ও মঙ্গোলয়েড প্রকৃতি পূজারী উপজাতি। পরবর্তীকালে মুসলমানদের আগমনের পূর্ব পর্যন্ত সনাতন হিন্দু ধর্মানুসারী সেনরা বাংলাদেশে রাজত্ব করেন। বাংলায় বৌদ্ধ যুগের পরিবর্তনে সিলেটেও হিন্দু রাজত্ব কায়েম হয়। হিন্দু রাজত্বকালে হিন্দুধর্মের জাতিবেদ প্রথায় তখন অহিংস বৌদ্ধরা নিম্নবর্ণের অস্পর্ষ্য জনগোষ্টিতে পরিণত হয়। তারা অধীর আগ্রহে মুক্তির সুযোগ খোঁজছিল। হজরত শাহজালালের আগমন তাদের সেই সুযোগ তৈরী করে দেয়। হজরত শাহজালালের অক্লান্ত প্রচেষ্টায় ইসলাম ধর্মের একত্ববাদ ও মানুষে মানুষে সমমর্যাদা তথা সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের নীতি সিলেট অঞ্চলের তৎকালীন উৎপীড়িত ও অবহেলিত জনগোষ্টিকে দ্রুত ইসলামের ছায়াতলে চলে আসতে অনুপ্রাণিত করে।
হজরত মোহাম্মদ (দঃ) বলেছেন- আমার উম্মতের আলেমগন বনী ইসরাঈলের নবীদের সমতুল্য। জ্ঞান ও সাধনায় যারা উচ্চমার্গে পৌছে গেছেন, তারাই নবীদের সত্যিকারের উত্তরাধিকারী ও সত্য ধর্মের প্রতিনিধি। হজরত শাহজালাল (রঃ) ছিলেন তাঁদের একজন। তিনি জ্ঞান ও সাধনায় তাসাউফের উচ্চমার্গে পৌছে ছিলেন। হজরত শাহজালাল আগমনের সময় সিলেটের অবস্থা ছিল প্রচলিত লোকগীতির ভাষায় এরকম-
“হিন্দু ছিল লাখে লাখে, নাইরে মছলমান,
সিলেট মোকামে আসি কে দিবে আজান।”
শাহজালাল আসার পূর্বে এদেশে মুসলমানদের সংখ্যা ছিল অতি অল্প। কিন্তু শাহজালাল কতৃক মুসলিম বিজয়ের পর শ্রেণিবিভক্ত হিন্দু সমাজ ব্যবস্থায় নির্যাতিত অনেক লোক হিন্দু ধর্মের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে দলে দলে ইসলাম ধর্ম গ্রহন করে। বিশেষত হজরতের উত্তম চরিত্র ও আচার আচরণের অধিকারী সঙ্গী আউলিয়াগনের যত্ন ও কঠোর পরিশ্রমে ইসলাম ধর্মের মাহত্ন্যে আকৃষ্ট হয়ে অনেক মানুষ ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করে। এভাবে শ্রীহট্ট অল্প দিনের মধ্যে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ট অঞ্চলে পরিণত হয়।
কথিত আছে শাহজালাল জিয়াউদ্দিন নামক তাঁর এক সঙ্গী আউলিয়াকে গৌড়রাজ্যের পূর্বপ্রান্তবর্তী করিমগঞ্জের বুন্দাশীল নামক স্থানে ইসলাম প্রচারে পাঠিয়েছিলেন। তিনি সেখানে গিয়ে দেখলেন দেওরাই নামক এক প্রবল পরাক্রান্ত নিশাচরের ভয়ে মানুষ অতীষ্ট। জিয়াউদ্দিন হজরতকে এর প্রতিবিধানের অনুরোধ জানালে হজরত বুন্দাশীলে গিয়ে নিজ আধ্যাত্মিক শক্তির সাহায্যে দেওরাইকে বধ করে সেখানে শান্তি স্থাপন করেন। এই দেওরাইয়ের অধিকৃত এলাকা পরে দেওরালী পরগনা নামে অভিহিত হয়।
এখানে বরাক নদী সুরমা ও কুশিয়ারা এই দুই শাখায় বিভক্ত হয়েছে। তখন সুরমার জল সুপেয় ছিল না। কথিত আছে দেওরালী অবস্থানকালে হজরতের দোয়ায় সুরমার জল স্বচ্ছ ও সুপেয় হয়ে উঠে।
শাহজালাল ও তাঁর সঙ্গীয় আউলিয়াগন সম্পর্কে তৎকালীন জনসমাজে এমন ধারণা সৃষ্টি হয়েছিল যে তাঁরা আল্লাহর দরবারে সুপারিশ করে পাপীদেরকে নাজাত করে দিতে পারেন, নির্ধণকে ধনী করতে পারেন, শারীরিক ও মানসিক রোগীকে আরোগ্য করতে পারেন এবং একই সময়ে বিভিন্ন স্থানে আত্মিকভাবে উপস্থিত থেকে ভুত বর্তমান ও ভবিষ্যতের সংবাদ বলে দিতে পারেন। তাঁদের আস্থানা ছোট বড় হিন্দু মুসলিম সর্ব শ্রেনির মানুষের নিরাপদ আশ্রয় স্থলে পরিণত হয়। মোঠ কথা হজরত শাহজালাল ও তাঁর সঙ্গী আউলিয়াগনের ইসলাম প্রচারের ফলে সিলেটের এই সময়টি ছিল মুসলিম সম্প্রদায়ের দ্রুত সম্প্রসারণের যুগ। সে ধর্ম প্রচারের যুগে কঠোর পরিশ্রম ও সাধনায় এই অঞ্চলে ইসলাম ধর্মকে স্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠিত করে হজরত শাহজালাল(রঃ) অবিস্মরণীয় হন।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন