বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কার এবং দিনবদলের রাজনীতি
চৌধুরী
ইসফাকুর রহমান কুরেশী
আজ আমাদের প্রয়োজন মাহাথির মোহাম্মদ কিংবা নেলসন মেন্ডেলার মত
বলিষ্ট ও দূরদর্শী নেতার,
যিনি এই হতাভাগা দেশটাকে নিমজ্জমান
অবস্থা থেকে উদ্দার করে নিয়ে যেতে পারবেন সোনালী ভবিষ্যতের স্বপ্নরাজ্যে।
আমরা পরিবর্তন চাই। বাংলাদেশকে বাঁচাতে হলে অবশ্যই
সর্বক্ষেত্রে পরিবর্তন আনতে হবে। সবার আগে প্রয়োজন রাজনৈতিক সংস্কার ও পরিবর্তন।
অতীত রাজনৈতিক দুষ্টচক্র হতে আমাদেরকে বেরিয়ে আসা ছাড়া আর কোন পথ নেই। সুবিধাবাদী
লুটেরাচক্র কখনও চাইবেনা রাজনীতিতে কোন গুণগত পরিবর্তন হোক। গণতন্ত্রের নামে
লুটপাটতন্ত্র চালু থাকলে তারা আগের মত ব্যবসা ও দুর্নীতি চালিয়ে যেতে সক্ষম হবে।
১/১১ এর আগমনে জনগণ আশা করেছিলো দেশে বড় ধরনের একটা পরিবর্তন আসবে, স্বজনপ্রীতি দুর্নীতি গডফাদারদের দৌরাত্মের অবসান হবে। এই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও কোন
বড়ধরনের পরিবর্তন আনতে সক্ষম হয়নি। বরং যারা মনে পরিবর্তন ও সংস্কারের বিরোধী
তাদের ইচ্ছের কাছে তারা শেষ পর্যন্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও আত্মসমর্পন করতে বাধ্য
হয়েছেন। জিরো টু ফরমুলা শেষ পর্যন্ত অনলি টু তে পরিণত হয়েছে ও রাজনীতে বিকল তৃতীয়
শক্তির উত্থানও সম্ভব হয়নি। আমাদের রাজনীতির পরিমন্ডলে যারা বিচরণ করেন যুগের
পরিবর্তনের সহিত নিজেদের স্বভাবের পরিবর্তন না করার কারণেই ১/১১ এর জন্ম হয়।
পরিনামে এইসব রাজনীতিবিদগণ বিগত দুই বৎসরের জন্য রাজনীতির অঙ্গন থেকে বহিস্কৃত হন, রাষ্ট্রের ক্ষমতা চলে যেতে বাধ্য হয় এক অনির্বাচিত পরিষদের
হাতে।
রাষ্ট্রের মালিক জনগণ,
আর জনগণের পক্ষে জনপ্রতিনিধিরা চালাবেন
দেশ। এটাই গণতন্ত্র। জনগণের সম্মতি নিয়ে না আসা পরিষদ বেশিদিন ক্ষমতায় থাকা
কোনক্রমেই সমীচিন নয়। অথচ আমাদের রাজনীতিবিদরা ১৯৯০ সনের পট পরিবর্তনের পর দেশে
গণতন্ত্র ও আইনের শাসন প্রাতিষ্ঠানিকভাবে
প্রতিষ্ঠার সুন্দর সুযোগ কাজে না লাগিয়ে এক সঙ্কীর্ণ মনমানসিকতা ও অসুস্থ রাজনীতি
চর্চায় নিমগ্ন হন-যার পরিনাম ভুগতে হয় তাদের নিজেদেরকে সেই সাথে সমগ্র দেশবাসীকেও।
১৯৯০ এর সাফল্যে বাংলাদেশের জনগণ স্বপ্ন দেখছিল বাংলাদেশের গণতন্ত্র আসবে, পরিবর্তন আসবে,
দিনবদলের হাওয়ায় দ্রুত উন্নয়নের পথে
এগিয়ে যাবে দেশ। কিন্তু ১৯৯০ থেকে ২০০৬ এই দীর্ঘ ১৬টি বৎসর মানুষ গণতন্ত্রের
প্রকৃত রূপ নয়, দেখেছে এক বিকৃত ভয়ঙ্কর রূপ। এই সময়ে
আমরা তিনটি নির্বাচিত সরকার পেয়েছি সত্য কিন্তু প্রকৃত গণতন্ত্র পাইনি। আসলে এই
তিনটি নির্বাচিত সরকারের আমলকে আমরা গণতান্ত্রিক শাসনামল বলে আত্মতৃপ্তি অনুভব
করলেও প্রকৃতপক্ষে তা ছিল অসামরিক শাসন ব্যবস্থার একটি রূপ, কোন ক্রমেই গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা নয়। যে তিনটি নির্বাচিত
সরকার এসেছে প্রতিটি সরকার নির্বাচনে জয়ী হয়ে তারা যেন জলমহালের মত পাঁচ বছরের
জন্য দেশটাকে ইজারা গ্রহণ করেছে। ইজারা গ্রহণের পর রুই, বাউশ থেকে চুনোপুটি যা সম্ভব জাল ফেলে কিংবা সেঁচে উঠানোর
কার্যকলাপে লিপ্ত হয়েছে। রিলিফ-এর টিন,
বিস্কুট, শাড়ি
চুরি থেকে শুরু করে এমন কোন জায়গা নেই যেখানে নির্বাচিত সরকারের প্রভাবশালীরা জড়িত
হয়নি। জনগণ হতাশ হয়েছে যখন গণতন্ত্রের নাম ব্যবহার করে রাষ্ট্রের এলিটগাষ্ঠি
রাষ্ট্রশক্তিকে নিজেদের ব্যক্তিস্বার্থে বার বার ব্যবহার করেছে। তথাকথিত
গণতন্ত্রের বিগত দেড় দশক আমাদের স্বনামধন্য রাজনীতিবিদগণ আমাদের জাতীয় সংসদেকে এক
অকার্যকর প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেন। বিরোধী দলের সংসদে অনুপস্থিতি, পবিত্র সংসদে সরকার ও বিরোধীদলের সদস্যদের মধ্যকার মারামারি
ঝগড়াঝাটি, কোরাম সংকট ইত্যাদি জাতীয় সংসদকে এক
পুতুল সংসদে পরিণত করে। সাংসদগণ নিজেদের ব্যক্তিগত স্বার্থে যেভাবে একতাবদ্ধ হয়ে
সংসদকে ব্যবহার করেছেন জাতীয় স্বার্থে তেমনটি করেননি। জনস্বার্থে কিংবা
জাতীয়স্বার্থে জড়িত নয় এমন সব তুচ্ছাতিতুচ্ছ বিষয় নিয়ে সরকার ও বিরোধী দল সংঘাতে
লিপ্ত হয়ে দেশকে চরম অস্থিরতা ও নৈরাজ্যের মধ্যে নিক্ষেপ করতে আমাদের জাতীয় নেতারা
কখনও পিছপা হননি। ঢাকা বিমনবন্দরে পা রেখেই এক নেত্রী ঘোষণা করলেন অন্যকোন দল
অংশগ্রহণ না করলেও তিনি নির্বাচনে যাবেন। একজন জাতীয় নেত্রীর কি জানা নেই সকল দলের
অংশগ্রহণ ছাড়া নির্বাচন গ্রহণ যোগ্য হবে না। আরেক নেত্রী চট্টগ্রামে তার আমলের সব
দুর্নীতিবাজ লুটেরাদের মুক্তির দাবী উত্থাপন করেন। বর্তমানে জেলে আটক বিলখেলাপী, ঋণখেলাপী তোষামোদকারী সুবিধা বাদিদের মুক্ত করে রাজনীতিতে
পুনর্বাসনের দাবী ও ইচ্ছে প্রকাশ করেন তিনি। এই যদি হয় আমাদের প্রধান প্রধান
নেতা-নেত্রীদের মনমানসিকতা তাহলে ধরে নিতে হবে এই জাতির কপালে আরও অনেক দুঃখ আছে।
বিগত ষোল বছর উপজেলা নির্বাচন না করে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাকে অচল ও জবাবদিহি হীন
করে রাখা হয়, কেবলমাত্র আমাদের সংসদগণের খবরদারী ও
দাপট বজায় রাখার জন্য। উপজেলার প্রতিটি কাজে এমপিদের অযাচিত হস্তক্ষেপ দুর্নীতির
বিস্তারে সহায়ক ভূমিকা রাখে। পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোতে এমপিদের কাজ হচ্ছে আইন
প্রণয়ন করা। আর আমাদের দেশে তারা লকেল গভর্ণমেন্ট থেকে শুরু করে গম-আটার ঠিকাদারি
সব দায়দায়িত্ব নিজেদের কাঁধে তুলে নেন। যার ফলে বিগত সরকারগুলো প্রতিশ্র“তি দিয়েও
উপজেলা নির্বাচন করেনি। পুতুল পার্লামেন্ট-এর সদস্য পদ লাভ নিজেদের পকেট ভারী
করণের ও সব অসৎ ইচ্ছে পূরণের হাতিয়ারে পরিণত হয়। সুবিধাবাদী ব্যবসায়ীরা অধিক
মুনাফার আশায় দুই দলের মনোনয়ন ক্রয়ে করে হঠাৎ করে রাজনীতির মাঠে এসে রাজনীতিকে
লাভজনক ব্যবসায় রূপান্তরিত করে। পেশী শক্তিবহুল রাজনীতিতে সন্ত্রাসীরা ছলেবলে কৌশলে
সহজেই ঢুকে পড়ে গডফাদারে পরিণত হয়। এভাবে আমাদের অযোগ্য ও অদক্ষ দলীয় নেতা
নেত্রীগণ দুষ্ট লোভী সন্ত্রাসী লোকদের হাতের ক্রীড়ানকে পরণত হন।
১৫ কোটি মানুষের অস্বস্তিপূর্ণ ঘন বসতির এক ক্ষুদ্র দরিদ্র দেশ, আমাদের জন্মভূমি এই বাংলাদেশ। যেখানে প্রায় ১০ কোটি মানুষ চরম
দারিদ্র্যসীমার নীচে বাস করে,
লক্ষ লক্ষ মানুষ গাছতলায় ঘুমায়, পুষ্টিহীন শিশুরা অভুক্ত দিন কাটায়, হাজার হাজার বেকার তরুণ বিভ্রান্তের মত কাজের খুঁজে রাস্তায়
রাস্তায় ঘুরে বেড়ায়, এমন একটি দেশের নেতা-নেত্রীদের রাজনীতি
যদি নিছক ক্ষমতার জন্য পরিচালিত হয়,
দেশ ও জনগণের আসল সমস্যাকে পাশ কাটিয়ে
যেনতেনভাবে ক্ষমতা লাভের হানাহানিতে পর্যবসিত হয়, তাহলে
এই দুর্ভাগা দেশ কিভাবে মাথা তুলে দাঁড়াবে। আজ আমাদের প্রয়োজন সৎ, দেশ প্রেমিক,
দূরদৃষ্টিসম্পন্ন রাজনৈতিক নেতৃত্ব, যার মধ্যে জেনারেল ওসমানী কিংবা মাওলানা ভাসানীর মত থাকবে দেশপ্রেম
ও দেশের মানুষের প্রতি অকৃত্রিম ভালবাসা। আজ আমাদের প্রয়োজন মাহাথির মোহাম্মদ
কিংবা নেলসন মেন্ডেলার মত বলিষ্ট ও দূরদর্শী নেতার, যিনি
এই হতভাগা দেশটাতে নিমজ্জমান অবস্থা থেকে উদ্ধার করে নিয়ে যেতে পারবেন সোনালী
ভবিষ্যতের স্বপ্নরাজ্যে। আমরা চাই ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচন হোক সব দলের অংশ গ্রহণে।
সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচিন না হলে দেশ ও গণতন্ত্রের জন্য উক্ত নির্বাচন এক
শুভঙ্গরের ফাঁকিতে পর্যবসিত হবে। দেশে স্থিতিশীলতা আসবে না। অর্থনীতি ও ব্যবসা
বাণিজ্য বিপর্যস্ত হবে। আমরা যে অবস্থায় ছিলাম, সেই
অবস্থায়ই থেকে যাবো। জাতি হিসাবে সর্বক্ষেত্রে আমাদের যে অধঃপতন চলছে তা রোধ করা
কোনক্রমেই সম্ভব হবেনা। “অতীতের চেয়ে নিশ্চয় ভাল হবে ভবিষ্যৎ” এই আশা রেখে আমাদের
রাজনৈতিক নেতৃত্বের বিবেক ও শুভবুদ্ধির উদয় কামনা করছি।
[প্রকাশ কাল: দৈনিক সিলেটের ডাক, ১৩ ডিসেম্বর,
২০০৮ইং]
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন